Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রাজমহল

‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর...’

কবিভাষ্যে সেই গঙ্গার তীরে বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাহেবগঞ্জ জেলায় পাহাড়পর্বত, বনজঙ্গল, ঝরনা আর গঙ্গা নদী বেষ্টিত রাজমহল—যেখানে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত পলায়নরত বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লা ব্রিটিশের গুপ্তচরের হাতে বন্দি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই দেশের দীপ্ত স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হওয়ার সূত্রপাত হয়েছিল।

মোহনকুমার দাস
অরঙ্গাবাদ শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৩৮
Share: Save:

কবিভাষ্যে সেই গঙ্গার তীরে বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাহেবগঞ্জ জেলায় পাহাড়পর্বত, বনজঙ্গল, ঝরনা আর গঙ্গা নদী বেষ্টিত রাজমহল—যেখানে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত পলায়নরত বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লা ব্রিটিশের গুপ্তচরের হাতে বন্দি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই দেশের দীপ্ত স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হওয়ার সূত্রপাত হয়েছিল। এর পর যে ইতিহাস, তা তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু তারও আগে—ঐতিহাসিক মতে গঙ্গার পথ পরিবর্তনের ফলে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে এই রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সেই থেকে সম্রাট আকবরের গভর্নর তথা শাসক রাজা মান সিংহের রাজত্ব চলেছিল ষোড়শ শতকে এই রাজমহলকে কেন্দ্র করে। আর তখন থেকেই রাজার মহাল—রাজমহল!

কিন্তু ইতিপূর্বে জানা ছিল না, আমার বাড়ির কাছেই মুর্শিদাবাদের অরঙ্গাবাদ থেকে মাত্র ৮৫ কিমি দূরে এমন ঐতিহাসিক এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও মনোময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক ভ্রমণোপযোগী জায়গা রয়েছে! অবশেষে কোনও নিকটাত্মীয়ের পরামর্শেই রাজমহলের উদ্দেশে রওনা হলাম এক দিন সপরিবার একটি গাড়িতে সওয়ার হয়ে। এখানে জানিয়ে রাখি, গাড়িতে সারা দিন ঘুরলে এক দিনেই সম্পন্ন হতে পারে রাজমহল ভ্রমণ।

নির্দিষ্ট দিনটিতে সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লাম—প্রথম গন্তব্য শাল সেগুন মেহগিনি মহুয়া জারুলের ভিড়ে ঠাসা জঙ্গলের চড়াই-উতরাই পথ বেয়ে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপর পাথর খাদানে। কয়েকটি খাদানের কর্মকাণ্ড দেখলাম আমরা। বড় বড় পাহাড়কে ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে, সেখানে সমানে চলেছে বোল্ডার সংগ্রহের কাজ। ফাটানোর পরপরই দেখলাম পাহাড়ের ভেতরের পাথরের অদ্ভুত বাদামি রং! সেই সঙ্গেই দেখলাম উপর থেকে নেমে আসছে জলের ধারা আর তার পর ক্রাশার মেশিনে ফেলে বোল্ডার থেকে জন্ম নিচ্ছে নানা ধরনের উপযোগী আকারের লক্ষ লক্ষ অংশ।

কখন যাবেন

অগস্ট-সেপ্টেম্বরই উপযুক্ত সময়।

কী ভাবে যাবেন

পূর্ব রেলের বর্ধমান-সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে তিনপাহাড়, তালঝাড়ি স্টেশন থেকে রাজমহল ১২-১৪ কিমি।

কোথায় থাকবেন

রাজমহলে থাকার জন্য ভাল মানের হোটেলের অভাব আছে। তবে বনবাংলো অথবা বেসরকারি গেস্ট হাউস পাওয়া যেতে পারে।

অত উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপরেও দেখা গেল আদিবাসীদের। সেই মূল বাসিন্দাদের ২০-২৫টি পরিবারের একেকটি জনপদ। বেঁচে থাকার জন্য কত ভাবে যে মানুষকে জীবনযাপন করতে হয়! প্রকৃতির দান, প্রকৃতির সৃষ্টি ও পাহাড়পর্বতের ধ্বংসলীলা দেখে কিছুটা ক্ষুণ্ণ মনেই ঘন জঙ্গলে ভরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে এলাম সমতলে। রাজমহলের আরও এক বিখ্যাত খনিজ সম্পদ হল ‘চায়না ক্লে’ বা চিনামাটি। এই সব খনি মূলত গঙ্গার ধার ঘেঁষেই। সে-সবের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে শুনলাম, গোটা ভারতের মধ্যে এই রাজমহলের চিনামাটিই নাকি গুণ ও মানের বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ! এখানকার বেশির ভাগ খনিই আবার প্রখ্যাত একটি সর্বভারতীয় সংস্থার দখলে। ফলে তারাই এই পরিশোধিত চায়না ক্লে পাঠিয়ে দেয় নানা শিল্পে, রেল দফতরে এবং অবশ্যই চিনামাটির সামগ্রী নির্মাতাদের কাছে। এ ক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে, কী বিপুল এই খনিজ শিল্পের আর্থিক লেনদেন!

এখান থেকে আমাদের গন্তব্য গঙ্গাতীরের এক বিশাল ও সুদৃশ্য মন্দিরে—নাম ‘কামাইয়াস্থান’। এই বিশাল মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্যদেবের মূর্তি ও তাঁদের পদচিহ্ন। জনশ্রুতি, এই স্থানে শ্রীচৈতন্যদেব নাকি এক সময় পদার্পণ করেছিলেন। সে যাই হোক, গঙ্গাতীরের সুন্দর নিরালা পরিবেশে এই মন্দির স্থানীয় মানুষদের কাছে অবশ্যই একটি পবিত্র তীর্থস্থান!

সেখান থেকে আমরা যাই মুঘল সাম্রাজ্যে। মুঘল সম্রাট আকবরের গভর্নর বা এই অঞ্চলের প্রশাসক রাজা মানসিংহের আমলে। বলা বাহুল্য, তাঁর হাতেই ছিল এই বিস্তীর্ণ এলাকার শাসনভার ও যত কিছু উন্নয়নের দায়িত্ব। তাঁরই তত্ত্বাবধানে গঙ্গার তীরে নির্মিত হয়েছিল ‘সিংহি দালান’ নামে রাজা মহারাজাদের একটি প্রমোদস্থল যার অর্ধেকেরও বেশি বর্তমানে গঙ্গাগর্ভে বিলীন। তবু যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও চমৎকার!

ছুটি এক্সপ্রেস

বেড়ানোর গল্প লিখুন অনধিক ৫০০ শব্দে আর পাঠিয়ে দিন। জানান যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার হালহকিকত। ছবি (নিজের ছাড়া) দিন। পাঠান এই ঠিকানায়:

সম্পাদক (‌সেন্ট্রাল বেঙ্গল)

আনন্দবাজার পত্রিকা

৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলিকাতা — ৭০০০০০১

অথবা, করুন ই-মেল:

edit.centralbengal@abp.in

(সম্পাদকের নির্বাচনই চূড়ান্ত।)

রাজমহল শহর থেকে ১০-১২ কিমি দূরে রয়েছে রাজা মানসিংহের জোড়া স্থাপত্যকীর্তি, যা একেবারেই মুঘল স্থাপত্য-রীতিতে নির্মিত। তার মধ্যে একটি ‘বারোদুয়ারি’। অর্থাৎ শত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করার সময় এখান থেকে ১২টি সুড়ঙ্গপথ ধরে বারো দিক থেকেই বেরিয়ে পড়া যায় শত্রুপক্ষকে চমকে দিতে! বিরাট এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই বারোদুয়ারি সৌধ। এর অর্ধেকই এখন ভগ্নদশায়। তবে আশার কথা হল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি ফলক আছে এখানে যা থেকে জানা যায়, এই সৌধটিকে সাজিয়েগুছিয়ে তার আগের অবস্থায় ফেরানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ঠিক একই অবস্থা উল্টো দিকে অবস্থিত জামে মসজিদেরও। ৫৭৬ বর্গমিটার জায়গার মুঘল স্থাপত্য অনুকরণে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল দোতলা মসজিদটি। যদিও ‘দোতলা’ নির্মাণ মনে হলেও আসলে এটি মোটেই দোতলা নয়। বাইরে থেকে দেখতে দোতলার মতো। মসজিদের ভিতরের দেওয়াল ও সিলিং মুঘল স্থাপত্যরীতিতেই দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত। বিপুল প্রবেশতোরণের পর এক বিশাল উঠোন—যেখানে ৫-৬ হাজার মানুষের একত্র বসে প্রার্থনা করার জায়গা! চারিদিকের সুদৃশ্য বাগান এখনও বর্তমান।

অতঃপর আমাদের শেষ গন্তব্য শহর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে রাজমহল! সাহেবগঞ্জ সড়কের ধারে কমবেশি ২ কিমি ভিতরে। বিশাল উঁচু ও খাড়া (প্রায় ৩০০-৩৫০ ফুট) পাহাড়ের উপর থেকে সরাসরি প্রবল বেগে নেমে আসছে অন্তত ৩-৪ ফুট চওড়া দুটি জলধারা, যার নাম ‘মোতি ঝরনা’। তবে ‘ঝরনা’র বদলে এটিকে ‘জলপ্রপাত’ বলাটাই বোধহয় ঠিক হতো। অদ্ভুত সুন্দর এই দৃশ্য। দূর থেকে দেখে মনে হয়, যেন রুপোর দুটি চওড়া পাত উপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে! সেই জলধারা পড়ছে পাহাড়ের নীচে একটি ছোট শিবমন্দিরের মাথায়— যেন শিবের মাথাতেই জল ঢালা হচ্ছে। চমৎকার এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে মন আনন্দে ভরে গেল। সঙ্গী এক প্রবীণ আত্মীয় আবেগবিহ্বল হয়ে সাহিত্যসম্রাটকেই স্মরণ করলেন— ‘আহা, কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Travel and Tourism Rajmahal রাজমহল
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE