Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ কোন ত্রৈলোক্যনাথ

দুর্ভিক্ষ রুখেছেন বুদ্ধি দিয়ে। খোঁজ দিয়েছেন স্বর্ণখনির। তিনিই আবার লুল্লু-ডমরুধরের জনক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়! লিখছেন বিনোদ ঘোষালহাতি ধরা দলের সঙ্গে মিশে চলে গিয়েছিলেন নাগপুরের বনে! খিদের জ্বালায় কখনও তেঁতুল পাতা চিবিয়ে দিন কাটিয়েছেন। কখনও সারাদিনে শুধু এক লোটা জল। কোনও দিন তাও জোটেনি। মাত্র ন’বছর বয়েসে নিজে এক লিপিমালা আবিষ্কার করে মাটির চাকতি আর কাঠের ফলকে লিখে রাখতেন। আশ্চর্যের কথা, তাঁর ছোটবেলার সৃষ্টি ওই বর্ণমালার সঙ্গে ‘শর্টহ্যান্ড রাইটিং’-এর জনক পিটম্যানের হরফের অদ্ভুত মিল!

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

হাতি ধরা দলের সঙ্গে মিশে চলে গিয়েছিলেন নাগপুরের বনে!

খিদের জ্বালায় কখনও তেঁতুল পাতা চিবিয়ে দিন কাটিয়েছেন। কখনও সারাদিনে শুধু এক লোটা জল। কোনও দিন তাও জোটেনি।

মাত্র ন’বছর বয়েসে নিজে এক লিপিমালা আবিষ্কার করে মাটির চাকতি আর কাঠের ফলকে লিখে রাখতেন।

আশ্চর্যের কথা, তাঁর ছোটবেলার সৃষ্টি ওই বর্ণমালার সঙ্গে ‘শর্টহ্যান্ড রাইটিং’-এর জনক পিটম্যানের হরফের অদ্ভুত মিল!

ভাবতে কোথায় বোধ হয় একটু হলেও অসুবিধে লাগে, ইনিই লুল্লু-ডমরুধর চরিতের স্রষ্টা, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়!

ছোট্ট থেকে কত যে বাঁকের মুখে পড়েছে তাঁর জীবন! এই সরু খাঁড়ি, তো পরক্ষণেই উত্তাল মোহনা। তার অল্প বাদেই ডোবা-পানা পুকুর!

বাবা ছিলেন গরিব ব্রাহ্মণ। মা নিছক ঘরনি। খুব অল্পবয়েসেই বাবা-মাকে হারিয়ে ক্লাস ফাইভেই শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথের।

দারিদ্র তখন হামলে পড়েছে। পেটের জ্বালায় একদিন বাড়ি থেকে পালালেন। তখন সবে আঠেরো।

যাবেন মানভূম। এক আত্মীয়ের বাড়ি। কিন্তু রানিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই পকেটের পয়সা শেষ।

এ বার কী হবে?

এ দিকে রানিগঞ্জ থেকে মানভূম আরও তিনদিনের পথ। তা’ও আবার বন পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়া।

পয়সা নেই, অতএব ঠিক করলেন হেঁটেই ওই রাস্তা পার করবেন!

সাঁতরে দামোদর নদ পেরোতেই পরিচয় হল এক বিহারি চাপরাশির সঙ্গে। চাপরাশি লোভ দেখাল, ‘‘অসমে গেলে তোমার ভাল চাকরি হবে। আমি তোমায় পাঠাতে পারি।’’

ত্রৈলোক্যনাথ রাজি। সেই লোকটির সঙ্গেই রানিগঞ্জ গেলেন। গিয়েই ভয়ঙ্কর বিপদ! চাপরাশিটির বাড়িতে পৌঁছানোমাত্র কুলিদের মস্ত একটা দল তাঁকে আটক করে ফেলল।

তরুণ ত্রৈলোক্য তখন বুঝতেই পারেননি ওই কুলিরা আসলে ফাঁদে ফেলে কুলি বানিয়ে তাঁকে ভিনদেশে পাচার করার তালে আছে।

কপাল ভাল। ওখানেই পরিচয় হয়ে গেল ওই বিহারি চাপরাশিরই এক বাঙালি রক্ষিতার সঙ্গে। ছেলেটির মায়ায় পড়ে গেলেন মহিলা।

একদিন পরে সেই রক্ষিতার সাহায্যেই ত্রৈলোক্যনাথ জঙ্গল দিয়ে পালালেন।

রাস্তার ধারে ধারে বুনো কুলের গাছ। খিদে পেলে সেই কুল খেয়েই কাটিয়ে দিলেন জঙ্গলের সারাটা পথ।

ইনিই সেই ত্রৈলোক্যনাথ!

ঘনাদা টেনিদার জন্মের বহু আগে এই মানুষটিই ডমরুধরের নামে হাসিমজা মেশানো গালগল্পে আসর জমিয়ে দিচ্ছেন বারবার! অবাক লাগে না ভাবতে!

জীবনে চূড়ান্ত কষ্ট, অনাহার, অভাব ছিল তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। চিঁড়ে নুন, একটু লঙ্কা— তাই খেয়েই কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। কখনও তাও জোটেনি। তা’বলে মাথা নোয়াননি কখনও। ভয়ঙ্কর অনটনেও এক পয়সা ধারও নেননি কারও কাছে।

আত্মজীবনীর এক জায়গায় ত্রৈলোক্যনাথ তাঁর এক যাত্রাপথের বর্ণনা দিচ্ছেন, “সন্ধ্যাবেলা আমি মেমারি আসিয়া পঁহুছিলাম। মেমারি স্টেশনের পুষ্করিণীর সান-বাঁধা ঘাটে পড়িয়া রহিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, দু’দিন আহার হয় নাই; অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি; যদি আজ রাত্রেও অনাহারে এখানে শুইয়া থাকি, তো কাল প্রাতে আরও দুর্বল হইয়া পড়িব। সুতরাং এখনি পথ চলা ভাল। রাত্রিতেই পথ চলিতে শুরু করিলাম। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পা আর উঠে না। একটা তেঁতুল গাছে চড়িয়া তেঁতুল পাতা পাড়িয়া লইলাম। তাহাই চিবাইতে চিবাইতে পরদিন বেলা বারোটায় মগরায় আসিলাম।’’

জীবনে বহুবার এমনটা ঘটেছে তার সঙ্গে। কখনও নিজের একমাত্র ছাতাটি বন্ধক দিয়ে একপয়সা ধার নিয়ে দুমুঠো খেতে পেয়েছেন, কখনও পরনের একমাত্র কাপড়টিও বেহাত হয়েছে। কখনও আবার খিদেয় কাতর হয়ে পথে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থেকেছেন। প্রাণ বাঁচিয়েছে মড়া পোড়ানোর ডোমেরা।

দেশে তখন বারবার এখানে ওখানে দুর্ভিক্ষ, মড়ক। ত্রৈলোক্যনাথকে চিন্তায় পেয়ে বসল। কী করে এই মড়ক রোখা যায়! অদ্ভুত এক উপায় বার করলেন তিনি! যাতে সত্যি করেই ভয়ঙ্কর এই বিপদ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেল অভাগা মানুষ!

আত্মজীবনীতে রয়েছে তার কথাও। নিজেই নিজেকে ত্রৈলোক্যনাথ সম্বোধন করে লিখছেন, ‘‘১৮৭৭-৭৮ সালে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হয়। ত্রৈলোক্যবাবু জানিতে পারিলেন গাজোরের চাষ করিয়া এবং গাজোর খাইয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারীগণ প্রাণে বাঁচিতে পারে।

প্রতি বিঘায় কত গাজোর চাষ হয়, চাষাদের ক্ষেত খুঁজিয়া তাহা স্থির করিলেন। রাত্রি দুই প্রহরের সময় উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কোন কোন গ্রাম ঘুরিয়া ফিরিয়া পূর্ব্বদিন কে কি খাইয়া দিনপাত করিয়াছিল ত্রৈলোক্যবাবু তাহার তত্ত্ব লইলেন; দুর্ভিক্ষ-সময়ে গাজোর যে অতি উপকারী সামগ্রী তাহা স্থির করিয়া ত্রৈলোক্যবাবু গবর্নমেন্টকে এ বিষয়ে জ্ঞাপন করিলেন।

শ্যামনগরের জন্মভিটে

গবর্নমেন্ট তাহা গেজেটে ছাপাইলেন। দুর্ভিক্ষ-সময়ে, যাহাতে তাড়াতাড়ি গাজোরের চাষ করিয়া লোকে প্রাণ বাঁচাইতে পারে এরূপ শিক্ষা দিবার জন্য গবর্নমেন্ট জেলায় জেলায় কর্মচারীদিগকে আদেশ করিলেন।

দুই বৎসরের পরে রায়বেরেলী, সুলতানপুর প্রভৃতি জেলায় দুর্ভিক্ষের সূচনা হইল সেই সময় সহস্র সহস্র লোক অনাহারে মরিয়া যাইত, কিন্তু মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের উদ্যোগে, এই গাজোরের জন্য সে-বার জনপ্রাণী মরে নাই।’’

দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা এখানেই শেষ নয়।

আরেক বারের ঘটনা।

ত্রৈলোক্যনাথ তখন আঠেরো টাকা বেতনে বীরভূমের দ্বারকা গ্রামে সেকেন্ড ইস্কুল-মাস্টার। সেই চাকরি আবার তাঁকে জুটিয়ে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সে বারও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। চার দিকে মৃত্যু আর মৃত্যু। মৃতদেহ দাহ করার পর্যন্ত লোক নেই। দুর্গন্ধে পথ চলা দায়।

সে সময় ত্রৈলোক্যনাথ প্রায় সন্ন্যাস নিলেন। তাতে যে খরচটাও বাঁচে! একবেলা হবিষ্যি খেতেন। গেরুয়া পোশাক পরতেন।

নিজেই লিখেছেন সেই দুর্দশার কথা—

“তখন যৌবনের প্রারম্ভ। অতিশয় ক্ষুধা। একেকদিন সন্ধ্যাবেলা এরূপ ক্ষধা পাইতো যে, ক্ষুধায় দাঁড়াইতে পারিতাম না। মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইত। তখন পেট ভরিয়া কেবল এক লোটা জল খাইতাম। তাহাতে শরীর কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইত। এরূপ করিয়া যাহা কিছু যৎসামান্য রাখিতে পারিতাম দুর্ভিক্ষ পীড়িত নরনারীদের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিতাম ও বাড়িতে পাঠাইতাম। সেই সময় হইতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম ভবিষ্যতে যাহাতে এই স্বর্ণভূমি ভারতভূমিতে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত না হইতে পারে এইরূপ কার্যে আমার মনকে নিয়োজিত করব”।

দারিদ্র দেখেছেন। হতচ্ছিন্ন জীবন কাকে বলে হাড়েমজ্জায় উপলব্ধি করেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে কত ভাবে যে ভাবিয়েছে!

মনে করতেন, এত ভাষাভাষীর এই দেশে একটি রাষ্ট্রভাষা খুব প্রয়োজন।

তখন তিনি ওড়িশায়। ওড়িয়া ভাষা শিখে ‘উৎকল শুভকরী’ নামের একটি ওড়িয়া পত্রিকার সম্পাদনা করছেন।

এ দিকে মাতৃভাষার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ভালবাসা। চেষ্টা শুরু করলেন বাংলাকে কী করে রাষ্ট্রভাষা করা যায়।

সে-চেষ্টা সফল তো হলই না, উল্টে বহু লোকের কোপে পড়লেন। তবে হাল ছাড়েননি।

আজ বাংলা ভাষায় ‘বিশ্বকোষ’ নামে যে বিশাল গ্রন্থটি দেখি, তার প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথ ও তাঁর দাদা রঙ্গলালের সম্পাদনায়।

এক বার একটি বই লিখে ফেললেন, তার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কতটুকু! বিষয়? ভারতের কোথায় কোথায় কোন কোন শিল্পদ্রব্য পাওয়া যায়। নাম দিলেন, ‘হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস (আর্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড র’মেটিরিয়ালস)।

উদ্দেশ্য একটাই, বিলিতি ক্রেতারা যাতে সেসব দ্রব্যের খোঁজ পেয়ে কিনতে পারেন আর সঠিক দাম পেয়ে ভারতীয় শিল্পীরাও অন্তত প্রাণে বাঁচেন!

কারুকাজ করা দেশীয় শিল্পদ্রব্য যাতে দেশিবিদেশি সকলের নজরে আসে, সে কারণে স্টেশনে-স্টেশনে ওই সব জিনিসের দোকান করার ব্যবস্থাও করেছিলেন।

কখনও হাতি ধরার দলে তো কখনও পুলিশের দারোগা। কখনও ইস্কুল মাস্টারের চাকরি, আবার কখনও ভারত সরকারের রাজস্ববিভাগের আধিকারিক। পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, আবার শেষ জীবনে কলকাতা মিউজিয়মের বিভাগীয় অধ্যক্ষ।

ইস্কুল-কলেজে শিক্ষার তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি তো বটেই, ওড়িয়া, হিন্দি, পারসি, উর্দু, সংস্কৃত ভাষাতেও ছিলেন সমান সাবলীল। ভূতত্ত্ব, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, নরতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, আরও নানা বিজ্ঞান শাস্ত্রে ছিল অগাধ জ্ঞান।

এমনই এক বহুদ্রষ্টার জীবন, কিন্তু তার মধ্যেও বৈপরীত্য কী ভাবে লুকিয়ে থাকে!— জাত যাওয়ার ভয়ে জীবনে প্রথমবার বিলেত যাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। পরে অবশ্য নিজের কুসংস্কার বুঝতে পারেন। তখন ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে গেলেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি সমেত আরও অনেক অনেক দেশ।

‘কুম্ভীর বিভ্রাট’ নামে একটি রচনা ছিল ওঁর। আর জীবনের কী পরিহাস! রচনার লেখক নিজেই এক বার নদীতে কুমীরের পেটে যাওয়ার থেকে বেঁচেছেন অল্পের জন্য। প্রবল ঝড়ে গাছের ডালে নিজেকে বেঁধে রেখে প্রাণ বাঁচিয়েছেন কোনও মতে।

শেষ জীবনে ত্রৈলোক্যনাথ কিন্তু অর্থে-সম্মানে দেশের অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি। তার প্রমাণ মেলে সেই সময়ের প্রথম সারির জনপ্রিয় পত্রিকা ‘জন্মভূমি’-র একটি লেখায়— ‘‘মুখোপাধ্যায় মহাশয় ভারতীয় শিল্প বিষয়ে একজন প্রগাঢ় চিন্তাশীল লেখক। ইংলন্ডে ইঁহার খুব নাম। ভারত গবর্নমেন্টের স্থাপিত কলিকাতা যাদুঘরস্থ কৃষিজাত-শিল্পজাত-বনজাত দ্রব্যসমূহের এবং মানবতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যক্ষ পদে ত্রৈলোক্যবাবু গবর্ণমেন্ট কতৃক উচ্চ বেতনে নিযুক্ত আছেন।


শিল্প ও মানবতত্ত্ব সম্বন্ধে ইঁহার অনেকগুলি গ্রন্থ আছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতমণ্ডলী কর্তৃক ইহা বিশেষরূপে প্রশংশিত।

ইনি ভারত গবর্ণমেন্ট কতৃক আদিষ্ট হইয়া যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস প্রতিষ্ঠিত মহামেলা পরিদর্শনার্থ ইংলন্ড গমন করেন। তথায় স্বয়ং ভারতেশ্বরী তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া পানভোজনে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন।’’

এত সম্মান, এত খ্যাতি, এত অর্থের অধিকারী হলেন। প্রথম জীবনের সেই দিনগুলো তখন তো অন্য মেরুতে। কিন্তু তার পরেও যেন সে-জীবনের ঘ্রাণ, তার ওলটপালট করে দেওয়া দাপট তাকে ছুঁয়ে যেত।

ত্রৈলোক্যনাথ বলছেন, ‘‘বিলাতে যাইলে মহারানি প্রভৃতি আমাকে যথোচিত সম্মান করিয়াছিলেন। যাঁহাদের কৃপাকটাক্ষে লোকে রাজা মহারাজা হইতে পারে, তাঁহারা সমকক্ষভাবে আমার সমাদর করিয়াছিলেন। কিন্তু বিলাত যাইয়া যাহাতে স্বার্থ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আমি কোনও বিষয়ে লাভবান না হই, যাহাতে স্বার্থ-চিন্তা আমার হৃদয়ে স্থান না পায়, এ বিষয়ে আমাকে বিশেষরূপে সতর্ক হইতে হইয়াছিল। যদি উচ্চপদ উচ্চ উপাধি লইয়া আসিতাম, তাহা হইলে, পাঠক! আজ তোমাদিগকে আমি শিক্ষা দিতে পারিতাম না। জনসাধারণকে লোকে যেভাবে বিচার করিয়া থাকেন, আমার প্রতি যিনি সেইভাব আরোপিত করিতে যাইবেন, তিনি ঘোরতর ভ্রমে পতিত হইবেন।’’

নিজেকে যত না সাহিত্যিক ভেবেছেন, তার চেয়েও বোধ হয় বেশি ভেবেছেন সমাজ সংস্কারক। বোধ হয় তাই, তাঁর জীবনের প্রথম সাহিত্য কীর্তি ছিল ভারতবর্ষে কোথায় কোথায় সোনা পাওয়া যায় আর তা কী ভাবে তুলে আনা যায়, তা নিয়ে একটি প্রবন্ধ।

কোনও দিন কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি বলে অনেক বন্ধু-আত্মীয়দের বিরাগভাজনও হয়েছেন বহুবার। দাম্ভিক বলেও ভুল ভেবেছেন অনেকে।

এই যেমন সে কালের এক খ্যাতনামা ব্যক্তি, অক্ষয়চরণ সরকারের বাবা গঙ্গাচরণ। ত্রৈলোক্যনাথকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু বারবার তিনি বলতেন, ‘‘যদ্যপি এই যুবক কিঞ্চিৎ দম্ভ পরিত্যাগ করিয়া বিনীত হয়, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতেছি, কালে এই যুবক ভারতবর্ষের শীর্ষস্থান অধিকার করিবে।’’

সেই দম্ভ কিন্তু কোনও দিনই ত্যাগ করেননি ত্রৈলোক্যনাথ।

আসলে বোধ হয় তা দম্ভ ছিল না, ছিল নিজের স়ঞ্চিত ভাঁড়ারকে আগলে চলার এক বর্ম। ওই ভাঁড়ারটুকুই তো তাকে বারবার মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে! জীবনকেও! তাই বর্মর খাঁচাটাকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতেন প্রাণপণে।

এখানেই তিনি ত্রৈলোক্যনাথ!

ডমরুধরের সেরা পাঁচ

১. এক ভণ্ড সন্ন্যাসীর পাল্লায় পড়ে ডমরুধরের স্থুল শরীর থেকে যেই সূক্ষ্ণ ডমরুধর বেরিয়ে এসেছে অমনিই সেই সন্ন্যাসী ফুড়ুৎ করে ঢুকে গিয়েছে ডমরুর স্থুল শরীরের ভেতর। কিছুতেই সে আর ডমরুর শরীর ছাড়বে না। ডমরুধর মন খারাপ করে চলে এলেন জঙ্গলে। সেখানে ছিল এক বাঘ। এক কাঠুরিয়ার সাহায্য নিয়ে পিছন থেকে বাঘের লেজ গাছের গুঁড়িতে এইসা পেঁচিয়ে ধরলেন যে বাঘ ভয়ের চোটে পালানোর জন্য বেজায় চেষ্টা করে শেষে পাকা আমকে পিছন থেকে চাপ দিলে যেমন আঁটি বেরিয়ে যায়, তেমনি বাঘের ছাল থেকে আসল বাঘটা বেরিয়ে গেল সড়াৎ করে। পড়ে রইল শুধু ছাল। সেই ছালের ভেতর ডমরুধর ঢুকে আবার ফিরলেন নিজের বাড়ি। এবার সন্ন্যাসী তো সেই বাঘ দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ডমরুর শরীর ছেড়ে আবার সূক্ষ্ণ শরীর ধারণ করল। আর অমনিই ডমরু বাঘের ছাল থেকে বেরিয়ে সুড়ুৎ করে আবার নিজের শরীরে। সন্ন্যাসী তখন পালিয়ে বাঁচে। ডমরুধরও সেইযাত্রা নিজের শরীর ফেরত পেয়ে বকি আয়ুটুকু কাটানোর সুযোগ পেলেন।

২. ডমরুধর একবার গেলেন মশা শিকার করতে। বাদুড়ের মতো পেল্লায় সাইজের সব মশা। মশারির বর্ম পরে সাঁওতালদের নিয়ে মশাদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলেন তিরধনুক হাতে। মানুষের গন্ধ পেয়ে যেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশারা আক্রমণ করল অমনই তির মেরে তাদের বধ করতে লাগলেন ডমরু। রাত্রে সেইসব মৃত মশার শুঁড় কেটে আগুনে পুড়িয়ে সাঁওতালরা নাকি মহানন্দে ভোজ দিল। পঁয়ত্রিশ দিনে কয়েক লক্ষ মশা মেরে ফিরে এসেছিলেন ডমরুধর। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি মশার শুঁড় নিয়ে এসে বাড়ির পাশের পুকুরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেগুলিই নাকি পরে জোঁক হয়ে গেছিল।

৩. কুমির শিকার করতে গেলেন ডমরুধর। সে কুমির নাকি তালগাছের মতো বড়। গ্রামে ঢুকে লোকের ঘরে দেওয়ালে সিঁদ দিয়ে মানুষ, গরু চুরি করে নিয়ে যায়। তো পাঁচশ লোকের সঙ্গে একলা লড়াই করল সেই কুমির। তারপরে হার মানল। মৃত কুমিরকে ডাঙায় তুলে তার পেট চিরতেই সকলের চোখ কপালে। কয়েক দিন আগে এক সাওঁতালি মহিলাকে তার বেগুনের ঝুড়ি সমেত এই কুমির আস্ত খেয়েছিল, সে সাঁওতালিনি নাকি তখন কুমিরের পেটের ভেতর বসে বেগুন বেচছে। কিন্তু বেচছে কাকে? ডমরুধরের সোজা উত্তর, তাড়াহুড়োয় বেগুনওয়ালিকে সেই প্রশ্ন আর করে ওঠা হয়নি।

৪. ডমরুধরের কথায়, তিনি যখন কলকাতায় চাকরি করতেন তখন তাঁর কাছে রোজ সন্ধের পর সাহেবি পোশাক পরে একজন আসতেন এবং টানা দু’ঘণ্টা ডমরুধর যা বলতেন, লিখে নিয়ে যেতেন। সেই লোকটি আর কেউ নয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলকে মেঘনাদবধ কাব্য আগাগোড়া ডমরুধরই বলে দিয়েছিলেন। তবে বিনিময়ে মাইকেল খুব বেশি টাকা দিতে পারতেন না ডমরুকে। টাকা দিতেন বঙ্কিম। কোনও দিন পাঁচ কোনওদিন দশ। যেদিন ডমরু দুর্গেশনন্দিনী শেষ করে বঙ্কিমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, বঙ্কিম তাঁকে একশ টাকা দিয়ে বলেছিলেন তিনি বেঁচে থাকতে যেন এই কথা প্রকাশ না পায়।

৫. শিবঠাকুরের চ্যালা নন্দীর গাট্টা খেয়ে ডমরুধরের শরীর থেকে বেশ কয়েকটা আলগা কোষ বেরিয়ে আরও কয়েকটা ডমরুধর তৈরি হয়ে গেছিল। তারা সারাদিন সকলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। আসল ডমরুধর তাদের জ্বালায় পাগল। কিছুতেই তাদের আর এক করতে পারেন না। অনেক ঠাকুর দেবতা, ভূতের কাছে সাহায্য চেয়েও সবাই ফেল। শেষে ডমরুধরের খাণ্ডারনি স্ত্রী এলোকেশীর ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে প্রত্যেকে আবার সুড় সুড় করে আসল ডমরুধরের ভেতর ঢুকে যায়।

ঋণ: ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসমগ্র, সাহিত্য সাধক চরিতমালা,
ত্রৈলোক্যনাথ- কথাসাহিত্য ভাবনা,
ত্রৈলোক্যনাথ- জীবন ও সাহিত্য,
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE