Advertisement
২৮ মার্চ ২০২৩

মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা

তাই শিল্পে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে দায়বদ্ধ ‘ক্যালকাটা ব্রডওয়ে’ তার মূলগত তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত সম্ভাবনাময় শিল্পীদের চিহ্নিত করে প্রচারের আলোয় আনা।

নৃত্যবিন্যাস: অনুষ্ঠানের মঞ্চে তনুশ্রীশঙ্কর

নৃত্যবিন্যাস: অনুষ্ঠানের মঞ্চে তনুশ্রীশঙ্কর

শতাব্দী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

সম্প্রতি বিক্রম দাশগুপ্ত ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘ক্যালকাটা ব্রডওয়ে’ শীর্ষক এক অভিনব প্রয়াসের শুভ উদ্বোধন ঘটল কলকাতার ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলে। অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় সাগ্নিক সেনের গলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কিছু জনপ্রিয় গান দিয়ে। তার পরে গ্লোবসিন গ্রুপের কর্ণধার বিক্রম দাশগুপ্ত ‘ক্যালকাটা ব্রডওয়ে’ গঠনের উদ্দেশ্যের কথা বলেন। এর পরে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় অভিকরণ শিল্পী (পারফর্মিং আর্টিস্ট), কলাকুশলী (টেকনিশিয়ান) ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সমন্বিত একটি স্বাস্থ্যবিমার।

Advertisement

এই পরিকল্পনার জন্ম প্রথমত ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গুরু-শিষ্য পরম্পরা ধারার বহমানতাকে সংরক্ষণের দায়িত্ববোধ থেকে এবং দ্বিতীয়ত ভারতের অত্যন্ত প্রতিভাধর অথচ অভাবগ্রস্ত শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর আন্তরিক তাগিদ থেকে। শিল্প চিরকালই রাজা ও বণিক সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষণায় চর্চিত হয়ে এসেছে। প্রাচীন ভারতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পচর্চা সরকারি অনুদান নির্ভর হয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি চলচ্চিত্রে বিপুল লগ্নি করলেও সঙ্গীত, মঞ্চাভিনয় ও নৃত্যচর্চার প্রতি উদাসীন। কারণ এগুলিতে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক নয়। তাই দু’চোখে শিল্পচর্চা এবং কেবলই শিল্পচর্চার স্বপ্ন দেখা নবীন প্রজন্মের অনেকেরই স্বপ্ন জীবিকা অর্জনের বাস্তবতার নীচে চাপা পড়ে যায়। অথবা দিনান্তে কোনও ক্রমে শখটুকু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় রূপান্তরিত হয়। এমনিতেই আমরা কেন যেন অন্যায় ভাবে মনে করি যে, মঞ্চশিল্পীদের উপার্জন না করলেও চলে। তার উপরে আবার ইদানীং যুক্ত হয়েছে এক ভয়াবহ ‘পে অ্যান্ড পারর্ফম’ সংস্কৃতি, যা শিল্পচর্চাকে অভিজাত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিলাসিতায় পর্যবসিত করছে। কারণ এ ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে কেনা যাচ্ছে মঞ্চ পরিবেশন, তদুপরি পুরস্কৃত হওয়ার সুযোগ। আর এ সবের মাঝে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বহু আশ্চর্য সম্ভবনাময় প্রতিভা।

তাই শিল্পে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে দায়বদ্ধ ‘ক্যালকাটা ব্রডওয়ে’ তার মূলগত তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত সম্ভাবনাময় শিল্পীদের চিহ্নিত করে প্রচারের আলোয় আনা। দ্বিতীয়ত অভিকরণ শিল্প যথা সঙ্গীত, নৃত্য ও মঞ্চাভিনয়কে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিহার (প্রিমিয়াম) মূল্যের আওতায় আনা এবং তার মাধ্যমে নাট্যকুশলতায় ও নাট্য অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রার সংযোজন। তৃতীয়ত শিল্পী, কলাকুশলী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সমন্বিত একটি স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করা। বিস্তারিত জানতে দেখতে পারেন ‘ক্যালকাটা ব্রডওয়ে’র ওয়েবসাইট।

এই উদ্যোগে বিক্রম দাশগুপ্ত ফাউন্ডেশনের পাশে রয়েছেন বহু কৃতী ব্যক্তি, যথা প্রসার ভারতীর প্রাক্তন অধিকর্তা জহর সরকার, নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সোহাগ সেন ও কৌশিক সেন, সুরসাধক পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র, নৃত্যশিল্পী তনুশ্রীশঙ্কর প্রমুখ। আশা রাখব, এই অভূতপূর্ব সামাজিক উদ্যোগ নতুন নজির গড়বে এবং উদ্যোগপতিদের অনুপ্রাণিত করবে সমাজ হিতৈষণার মনোভাব নিয়ে গুণী শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে। এতে তাঁরা সসম্মান ও নিশ্চিন্তে শিল্পচর্চায় ব্যাপৃত থাকতে পারেন ও সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।

Advertisement

সবশেষে সেই সন্ধের বিশেষ আকর্ষণ ছিল তনুশ্রীশঙ্কর ব্যালে ট্রুপের নিবেদন ‘আকাশ’। বিশ্বায়ন বিগত মাত্র তিন দশকের এক ভাবনা। অথচ বহু যুগ আগেই প্রাচীন ভারতীয় মনীষীরা বলেছিলেন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। আমরা এই পৃথিবীতে ক্ষণিকের অতিথি। মহা যাত্রাপথের মাঝের বিরতিতে পৃথিবী আমাদের পরমাশ্রয়। অতএব বসুধার সকলেই পরস্পর পরমাত্মীয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভাজনের অনেক উর্ধ্বে, যুগ-যুগান্তর ধরে আমাদের পৃথিবীকে পরিবেষ্টিত করে রাখা আকাশ সীমাহীন এবং অনন্ত। ক্ষুদ্রতা আর বিভেদের উর্ধ্বে গিয়ে আমরা ধ্যানে, মননে যেন সেই আকাশের মতোই অসীম ও প্রসারিত হতে পারি— এই ছিল উপস্থাপনার উপজীব্য।

আনন্দশঙ্করের জীবনের অন্তিম পর্বের সঙ্গীতায়োজনে এবং তনুশ্রীশঙ্করের অনুপম নৃত্যবিন্যাস ও পরিকল্পনায় মনোময় উপস্থাপনা এই আকাশ। নৃত্যশিল্পীদের মধ্যকার সহযোজনাও যথার্থই প্রশংসনীয়। সর্বোপরি তনুশ্রীশঙ্করের উপস্থিতি পরিবেশনায় নতুন মাত্রা সংযোজিত করে। মঞ্চের পটভূমির কারণে আলো-আঁধারির কারচুপি ও পোশাকের বর্ণময়তা কিছুটা চাপা পড়ে গেলেও সামগ্রিক ভাবে এই উপস্থাপনা দর্শকের মনোরঞ্জন করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.