Advertisement
০২ মে ২০২৪

ফাগুনের রঙে

দোলপূর্ণিমায় শুধু শান্তিনিকেতনই কেন? কোথাও ঝুমুরের ছন্দে, পলাশের আগুনে, কোথাও বা পুরনো মন্দিরের চাতালে মিশিয়ে দিন ফাগের রং দোলপূর্ণিমায় শুধু শান্তিনিকেতনই কেন? কোথাও ঝুমুরের ছন্দে, পলাশের আগুনে, কোথাও বা পুরনো মন্দিরের চাতালে মিশিয়ে দিন ফাগের রং

পুরুলিয়ার দোলে ছৌ নাচ

পুরুলিয়ার দোলে ছৌ নাচ

ঊর্মি নাথ
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০১:১৭
Share: Save:

নিজের শহরের বাইরে, দোল মানেই শান্তিনিকেতন— বলতে বাধা নেই, অধিকাংশ বাঙালির মনের কথাই এটা। কিন্তু জানেন কি, আমাদের রাজ্যের অনেক জায়গাতেই দোল দেখা একটা অভিজ্ঞতা? কোথাও সুপ্রাচীন মন্দিরে, কোথাও বা পলাশের রঙে, ঝুমুরের তালে, রঙিন আবির মিলেমিশে দোলপূর্ণিমায় তৈরি হয় বসন্ত উৎসব।

পুরুলিয়া

শান্তিনিকেতনের পরেই দোল খেলার জন্য বাঙালির কাছে এখন জনপ্রিয় পুরুলিয়া। এই সময়ে পুরুলিয়ার প্রকৃতিই বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠে। পলাশের রঙের সঙ্গে মিশে যায় গুলালের রং। পুরুলিয়ার দোল জনপ্রিয় করেছে কলকাতার মানুষই। শহরের মানুষজনের উৎসাহে এই জেলার বাঘমুণ্ডি, চড়িদা, মুরগুমা, চিলিওয়ামা, খয়রাবেড়া জলাধারের কাছে, অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা। দোলের আগের দিন ও পরের দিন মিলে সাধারণত আড়াই-তিন দিনের প্যাকেজে শুধু রং খেলা নয়, আয়োজন করা হয় ছৌ, ঝুমুর, ঘোড়া নাচের। রাতে পূর্ণিমার আলোয় বনফায়ার, স্থানীয় শিল্পীদের নাচেগানে জমজমাট হয়ে ওঠে পরিবেশ। ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি হয় চড়িদা গ্রামে। এ বছর সেখানে স্থানীয় মানুষদের হস্তশিল্প নিয়ে মেলার আয়োজন করা হবে।

ঝাড়গ্রাম

এক সময়ে জঙ্গলমহল শব্দটাই ছিল ত্রাস। আর আজ ঝাড়গ্রামের দোল এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, আগে থেকে হোটেল, লজ বুক না করলে থাকার জায়গা পাওয়া মুশকিল। জঙ্গলমহল সম্পর্কে ভীতি কাটিয়ে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ২০১৪ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে বসন্ত উৎসবের শুরু। সরকারি সহায়তায় এক বেসরকারি টুরিজ়ম সংস্থার উদ্যোগে রবীন্দ্র পার্কে আয়োজন হয় দোলের, প্রধানত পর্যটকদের জন্য। ঝুমুর গান, রায়বেশে নাচের সঙ্গে আবির খেলা ও মিষ্টিমুখ এখানে দোলের অন্য মাত্রা তৈরি করে। তিন বছর হল ঘোড়াধরা পার্কেও ঝাড়গ্রামবাসীদের উদ্যোগে হয় আরও একটি অনুষ্ঠান। আবির খেলায় আর মিষ্টিমুখে তাঁরা আপন করে নেন অতিথিদের।

কোচবিহার

কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির

দোলপূর্ণিমা মানে রাধাকৃষ্ণের আরাধনা। শ্রীকৃষ্ণ কোথাও মদনমোহন, কোথাও বা শ্যামচাঁদ। ভক্তরা সে দিন সকলেই শ্যাম ও রাইয়ের রূপে মেতে ওঠেন ফাগ খেলায়। এই ছবি পাওয়া যায় কোচবিহারে। সেখানে দোল মানে মদনমোহনকে ঘিরে আনন্দোৎসব। উনিশ শতকের শেষের দিকে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মদনমোহন মন্দির। দোলের আগের দিন মন্দিরের কাছে রাসমেলার মাঠে খড় দিয়ে তৈরি হয় বুড়িঘর। ভেড়ার লোম দিয়ে পুজোর পরে সেই ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মদনমোহনের মন্দির ও চারপাশের অন্যান্য মন্দির থেকে পালকি করে বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় মাঠে। বুড়িঘর পোড়ানোর পরে আবার মন্দিরে ফিরে যান মদনমোহন। দোলপূর্ণিমায় মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। হয় স্পেশ্যাল ভোগ রান্না। মন্দিরে ভিড়ও হয় বেশ। ভক্তদের কথা ভেবেই আসন থেকে নামিয়ে মন্দিরের সামনে বিগ্রহ রাখা হয়। মদনমোহনকে আবির দিয়ে পরস্পর রং খেলায় মাতেন এখানকার মানুষ। দোলের পরের দিন মদনমোহনকে আবার পালকি করে রাসের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। এই প্রথাকে বলে দোলসওয়ারি।

বিষ্ণুপুর

বিষ্ণুপুর ছিল মল্ল রাজাদের রাজধানী। তাঁদের উপাস্য দেবতাও মদনমোহন। ধুমধাম করে দোল খেলতেন রাজারা। মল্ল রাজাদের তৈরি বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা মন্দিরগুলো আজও পর্যটককে মুগ্ধ করে। এখনও দোল পূর্ণিমায় মদনমোহনের মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। অন্নভোগের পাশাপাশি থাকে চিঁড়ের ভোগ। মদনমোহনের পায়ে আবির দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণেই রং খেলায় মাতেন ছেলে-বুড়ো সকলে। গোটা বিষ্ণুপুর জুড়ে একাধিক ছোট- বড় রাধাকৃষ্ণের মন্দির। দোলের দিন অনেকেই ছোট ছোট দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন মন্দিরের সামনে দোলের গান করেন। কোন দলের গান সবচেয়ে ভাল হল, এই নিয়ে প্রতিযোগিতাও হত এক সময়ে। গানের সঙ্গে চলে আবির খেলা। বিষ্ণুপুরের প্রতিটা মানুষ জুড়ে যান এই খেলায়। অতিথিদের আপন করে নিয়ে, মিষ্টিমুখ করানোয় কার্পণ্য করেন না তাঁরা। আগে প্রথা ছিল দোলের পরের দিন পালকি করে বিগ্রহ রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। এখন মদনমোহন বার হন নগর পরিক্রমায়।

নবদ্বীপ মায়াপুর

নবদ্বীপে মহামণ্ডল পরিক্রমা

দোলপূর্ণিমায় আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের। তাই নবদ্বীপের দোল যতটা শ্রীকৃষ্ণের, তার চেয়ে অনেক বেশি চৈতন্যদেবের জন্মতিথি পালনে। নবদ্বীপে দোলপূর্ণিমাকে বলা হয় গৌরপূর্ণিমা। এখানে দোলের প্রধান আকর্ষণ নবদ্বীপ মহামণ্ডল পরিক্রমা। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি নরহরি চক্রবর্তী এই পরিক্রমা শুরু করেন। এখন নবদ্বীপ ও মায়াপুরে প্রায় শতাধিক মঠ-মন্দির নামসংকীর্তন-সহ আবির ছড়াতে ছড়াতে পরিক্রমায় যোগ দেয়। রঙে আর গানে গমগম করে নবদ্বীপের বাতাস। মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে কয়েক হাজার বিদেশি ভক্ত আসেন। প্রচুর ফুল ও আলো দিয়ে সাজানো হয় মন্দির।

শান্তিপুর

নদিয়া জেলার শান্তিপুরের দোল

এক দিনের উৎসব নয়। পূর্ণিমার পাঁচ দিন পরে পঞ্চম দোল, সাত দিন পরে সপ্তম দোল এবং রামনবমীতেও এখানে দোল খেলা হয়। শান্তিপুরে বিখ্যাত শ্যামচাঁদ ও গোকুলচাঁদের মন্দিরের দোল। গোকুলচাঁদের মন্দিরে দোলের দিন দেবতাকে আবির দেওয়ার সুযোগ পান ভক্তরা। শ্যামচাঁদের দোল হয় পূর্ণিমার পরের দিন প্রতিপদে। সে দিন বিশেষ পুজো, ভোগ, নামসংকীর্তন হয়। সন্ধ্যায় শ্যামচাঁদ আলোকসজ্জা-সহ শোভাযাত্রায় নগর পরিক্রমা করেন। এই দৃশ্য দেখতে রাস্তার দু’ধারে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। শোভাযাত্রা যায় ওড়িয়া গোস্বামীবাড়িতে, সেখানে হয় ডালিধরা উৎসব। সমস্ত বারোয়ারি পুজোও এখানে গিয়ে ডালি নিবেদন করে। বারোয়ারি দোলের মধ্যে চৌগাচা পাড়ায় বড় গোপাল দেখার মতো। দোলের পরের দিন গোপালের বিরাট মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা দেখার মতো। বিগ্রহবাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম বড় গোস্বামীবাড়ির দোল।

শান্তিপুরের কিছু দূরে অম্বিকা কালনাতেও আছে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির। সেখানেও সাড়ম্বর পালিত হয় দোলযাত্রা।

মনে রাখবেন, এই জায়গাগুলোয় দোলে উপচে পড়ে পর্যটকের ভিড়। তাই যেতে হলে আগে থেকে হোটেল বুক করতে ভুলবেন না।

ছবি: সুদীপ সিংহ (পুরুলিয়া)

হিমাংশুরঞ্জন দেব (কোচবিহার)

সুদীপ ভট্টাচার্য (নবদ্বীপ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Holi Spring Purulia Jhargram Shantiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE