Advertisement
০৭ অক্টোবর ২০২৪
Art Exhibition

কালি ও তুলির ঐকতান

সৈকত মণ্ডল অতি আধুনিক এক শিল্পশৈলীর নজির রেখেছেন। রঙের প্রকাশ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এই সিরিজ়ে কালি দিয়ে জলরঙের মতো ফিনিশ আনতে কিছুটা সক্ষম হয়েছেন।

An image of the art

কালি ও কলা: শিল্পী সৈকত মণ্ডলের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।

শমিতা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৩ ০৮:০৫
Share: Save:

ছবি ও ঘর গ্যালারিতে বেশ অভিনব একটি প্রদর্শনী দেখা গেল। নাম ‘ইঙ্ক অ্যান্ড ইউ’— কালি এবং তুমি। শিল্পী সৈকত মণ্ডল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় শিল্পী। সারা জীবন লেখালিখিতে ঝরনা কলম ব্যবহার করেছেন। কাজেই সুলেখা কালি তাঁর বাল্যসঙ্গী। ওই কালি সোজাসুজি কাগজের উপরে তুলি দিয়ে, জল দিয়ে অন্য রকম ভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন তিনি। যেমন আগে জলরং ব্যবহার করতেন, খানিকটা সেই পদ্ধতিতে। অতিমারির সময়ে কালির ব্যবহারে ধীরে ধীরে দক্ষতা লাভ হল শিল্পীর এবং তাঁর অন্যতম প্রধান অঙ্কন মাধ্যম হিসেবে নির্বাচিত হল সেই কালি। কালো, নীল এবং লাল। একটু সীমিত প্যালেটে কাজ। বেশ একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলল কিছু কাল, কারণ ওই কালিকে বাগে আনতে গিয়ে শিল্পীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কালিটার যেন নিজস্ব একটা বিচারবুদ্ধি আছে। তুলির এবং শিল্পীর হাতের শাসন সে কোনও মতেই মানবে না। কিন্তু শেষে যেন কিছুটা বশীভূত করা গেল সেই ছোটবেলার সঙ্গী সুলেখা কালিকে। তাই সৈকত এই প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন, ‘ইঙ্ক আ্যন্ড ইউ’।

এখানে সৈকত মণ্ডল অতি আধুনিক এক শিল্পশৈলীর নজির রেখেছেন। রঙের প্রকাশ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এই সিরিজ়ে কালি দিয়ে জলরঙের মতো ফিনিশ আনতে কিছুটা সক্ষম হয়েছেন। শিল্পীর বক্তব্য যে, আমাদের ভবিষ্যতের যে রকম কোনও স্থিরতা নেই, তেমনই এই কালির খেলারও কোনও নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ নেই।

‘ইঙ্ক অ্যান্ড ইউ’ যেন এক যাত্রাপথ। গ্রামের পটভূমি দেখিয়েছেন শুধুমাত্র কালো কালি বিভিন্ন ঘনত্বে ব্যবহারের মাধ্যমে। কালো কালি সামান্য জলে গুলে ব্যবহার করতে করতে পেয়ে গিয়েছেন এক নতুন সেপিয়া রং। কিছু পরে শহরতলিতে এসে পড়ায় দেখতে পাওয়া যায় লাল কালির ব্যবহার। প্রথম ছবিটি বেশ বড় নেপালি হ্যান্ডমেড কাগজে করেছেন। এটি একটি কোলাজ। নাম রেখেছেন ‘আদিম ধারা’। অরণ্য বিন্যাস দেখাচ্ছেন সেখানে শিল্পী। বন কেটে সাফ করার সময়ে যে কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে, যে কোদাল দিয়ে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে, সেই কুড়ুলের এবং কোদালের রক্তে রাঙানো ছবি এটি।

এর পর তিনটি ছবির একটি সিরিজ় নজরে আসে। এই ছবিগুলোর নাম ‘সৃষ্টি’, ‘স্থিতি’ এবং ‘প্রলয়’। প্রধানত কালো এবং লাল কালির কাজ, কাগজের উপরে। একটিতে অ্যাক্রিলিকের‌ও ব্যবহার আছে। ‘সৃষ্টি’ ছবিটিতে যেন হারিয়ে যাওয়া এক উপত্যকায় লাল নদীর বহতা ধারা নতুন আরম্ভের সূচনা ঘোষণা করছে। দ্বিতীয় ছবি ‘স্থিতি’তে আমরা দেখি ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে এবং সুজলা-সুফলা হয়েছে পৃথিবী। এ বার তৃতীয় ছবিটি, যার নাম ‘প্রলয়’, সেখানে সৈকত দেখাচ্ছেন লাল নদী এবং প্রলয় নাচন।

দু’টি ছবির সিরিজ়, নাম ‘দিবারাত্রির কাব্য’। এই দু’টি ছবিতে বিভিন্ন ঘনত্বে ব্যবহার করেছেন, লাল ও কালো কালি এবং কাগজের এক যুগলবন্দি। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ নামকরণ, কারণ জীবনের এক পূর্ণতা, বহমানতা হৃদয়ে অনুভব করাতে চাইছেন শিল্পী। এই অবস্থায় মানুষ যেন কবিতার জন্ম দেয়। গাছ, নদী, মানুষ সকলেই সুন্দর এক সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থানে বিচরণ করছে এই ছবি দু’টিতে। এখানে শিল্পী জীবনের প্রতি আস্থাশীল।

একটি ছবির নাম ‘নিদ্রিতা’। টুকটুকে লাল রঙের আকাশ এবং ওই একই রঙের লাল নদী। দূরে কালো পাহাড় এবং সামনে কাগজ-ছেড়ে কালো কালো লাইনে হয়তো গাছপালা বা মানুষের বসতি দেখাচ্ছেন শিল্পী। এই ছবিটিতে একটা যেন শান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। যদিও চারদিকে গাঢ় লাল রং কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশমিশে কালো রঙের ব্যবহারে একটা সাররিয়াল ব্যাপার ঘটিয়েছেন সৈকত মণ্ডল। ক্যাপশনে লিখছেন, ‘ঘুমের নদী বহে যায়, স্বপ্নের কথা গল্পে মিশায়’। সত্যিই এই ছোট্ট ছবিটিতে এক স্বপ্নময়তা এসেছে।

সৈকত মণ্ডলের ছোট ফরম্যাট বা বিন্যাসে এত রঙিন, তীব্র প্রখর লাল এবং কালো রঙের ব্যবহার এবং সীমিত রঙে অনুভূতি জাগানোর প্রচেষ্টা ইউরোপীয় শিল্পী হেনরি মাতিসের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মাতিস বিশ্বাস করতেন যে, রঙের শুধু অনুভব জাগানোর ক্ষমতা আছে, তা নয়, আমাদের অন্তরের ভাবকে বেশ কিছুটা পরিচালনা এবং পরিশীলিত করাতেও রঙের ভূমিকা রয়েছে।

সৈকত তাঁর কাজে গাঢ় লাল এবং কালো রঙের ব্যবহার নানা ভাবে করতে চেয়েছেন বিশেষ ভাবে। কিছু কিছু ভূদৃশ্যে বেশ একটা অনুভূতিও জাগাতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পী। সেখানেই তাঁর কালিতুলির সার্থকতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

artist Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE