স্মরণীয়: ললিতমোহন সেনের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
শিল্পচর্চা এক নিরন্তর গতির সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু সেই বিস্মৃতির অতল থেকে তাদের আবিষ্কার করার উদ্যোগ একমাত্র শিল্প সমালোচক ও গবেষকরাই করে থাকেন। কেসিসি গ্যালারিতে ঠিক তেমনই এক সুপরিকল্পিত প্রদর্শনী সম্প্রতি আয়োজিত হল বিগত শতকের শিল্পী ললিতমোহন সেনের বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম দিয়ে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন শিল্প সমালোচক ও গবেষকদ্বয়— দেবদত্ত গুপ্ত ও ঊষ্মিতা সাহু।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে শিল্পধারার যে সকল পরম্পরাগত মাধ্যম, সেই রকম বহু মাধ্যম দিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনীটি দর্শকের কাছে এক চমৎকার দলিল যেন পরিবেশন করেছে।
ললিতমোহন সেনের (১৮৯৮-১৯৫৪) জন্ম শান্তিপুরে। লখনউ আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে লন্ডন রয়্যাল একাডেমি অব আর্টে যাওয়ার সুযোগ পান এবং অসিত হালদারের পরে লখনউ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ পদেও আসীন হন। এই বরেণ্য শিল্পী একাধারে চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, বিজ্ঞাপন, আলোকচিত্র, বয়নশিল্পের ডিজ়াইনার, ছাপাই ছবি ইত্যাদি বহুবিধ মাধ্যমে নিজের সৃষ্টির সম্ভার রেখে গিয়েছেন। যা কিনা জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তৃত। সে যুগে অর্থাৎ প্রাক্ স্বাধীনতা পর্বে ইংরেজ অনুশীলনে শিক্ষাপ্রাপ্ত ললিতমোহন সেন অ্যাকাডেমিক রিয়্যালিজ়মের কাজে ছিলেন বিশেষ ভাবে পারদর্শী। তবে পাশ্চাত্যের রিয়্যালিজ়মের সঙ্গে ভারতীয় আদর্শের মেলবন্ধনে তাঁর কাজে খুঁজে পাওয়া যায় এক অনন্য মাত্রা। যেমন এই প্রদর্শনীতে পরিবেশিত তাঁর বাস্তবানুগ বহু নুড স্টাডি। মূলত কালো সাদা রং ব্যবহার করা কাজগুলিতে রূপ ও রেখার যে ছন্দ ও লয়, সেটি বিশেষ ভাবে আকর্ষক। নারী ও পুরুষ দেহের মধ্যে যে কমনীয়তা ও দৃঢ়তার তারতম্য, তা খুবই সুস্পষ্ট। এ ছাড়াও তাঁর প্রতিকৃতি অঙ্কনের অসামান্য দক্ষতা দেখা যায় যেমন গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি রচনা থেকে। তিনি নিজে যেহেতু একজন সুদক্ষ আলোকচিত্রী ছিলেন, তাই ছবি নির্মাণের প্রয়োজনে আলোকচিত্রের ব্যবহার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়, যা নাকি সমকালীন শিল্পচর্চার এক বিশেষ আঙ্গিক।
বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী ছিলেন ললিতমোহন সেন। তাঁর সৃষ্ট ভিত্তিচিত্র, ছাপাই ছবি, আলোকচিত্র, বিজ্ঞাপন, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, বয়নশিল্পের অলঙ্করণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সেই যুগের শিল্পভাবনা ও মাধ্যমগত উৎকর্ষের এক বিরল ও উৎকৃষ্ট নজির পাই। ১৯২৯ সালে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে যে সব ভারতীয় শিল্পী ভিত্তিচিত্র নির্মাণের কাজে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ললিতমোহন সেন বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয়। এক সময় বাগ গুহার প্রতিলিপি তৈরির কাজেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর অনবদ্য আলোকচিত্র তাঁকে পরবর্তী কালে রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেনের সদস্য পদেও নিযুক্ত করে।
মাধ্যম ও প্রকরণগত বৈশিষ্ট্য তাঁর শিল্পচর্চার এক বিশিষ্টতা। তাই তাঁর বহুবিধ কাজের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি খুব সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে পেশাগত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার দিকটিও হয় প্রতিষ্ঠিত। পারিবারিক সংগ্রহ থেকে সুবিন্যস্ত ভাবে আয়োজিত এ রকম প্রদর্শনী বর্তমানকে শেখায় অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার প্রেরণা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy