ছাপচিত্র: দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীতে সনৎ করের শিল্পকর্ম। —ফাইল চিত্র।
দেবভাষা গ্যালারিতে সদ্যপ্রয়াত শিল্পী সনৎ করের একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল সম্প্রতি। এ যেন শিল্পীর উদ্দেশে এক স্মৃতিতর্পণ। এই প্রদর্শনীতে মোট বারোটি প্লেট এবং ওই প্লেট থেকে নেওয়া বারোটি প্রিন্টও দেখতে পাওয়া গেল। ছাপাই ছবির প্রিন্ট দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু ‘প্লেটস অ্যান্ড প্রিন্টস’ নামের এই প্রদর্শনীটি যেন শিল্পীর রন্ধনশালায় প্রবেশাধিকার! সনৎ কর ষাটের দশকের প্রথম থেকে জ়িঙ্ক প্লেটের উপরে এন্টালিয়ো কাজ শুরু করেছিলেন এবং বেশ কিছু দিন জ়িঙ্কের উপরে কাজ করেছিলেন। পরবর্তী কালে প্রায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ধাতুর প্লেট খরচসাপেক্ষ মনে হওয়ায়, কাঠের উপর এন্টালিয়ো করা শুরু করেন শিল্পী। এরও কিছু দিন পর সেগুন কাঠও ব্যয়বহুল মনে হওয়ায় মাথায় আসে অন্য রকম চিন্তা। খুব অল্প দিনেই কার্ডবোর্ড এবং তারপর সানমাইকার উপরে খোদাই করা রপ্ত করে ফেলেন তিনি। এ দেশে সনৎ করের আগে কার্ডবোর্ড বা সানমাইকার উপরে এচিং বা এনগ্রেভিং সম্ভবত কেউ করেননি। এই ধরনের কাজে তাঁকেই পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়।
অন্য দিকে, চিনে খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিল্কের উপরে ছাপাই করা হত। সমগ্র ইউরোপেই, বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ড এবং আরও অন্যান্য জায়গায় জ়িঙ্ক (দস্তা) বা কপারের (তামা) উপরে ছাপাই ছবি পনেরোশো শতাব্দী থেকেই শুরু করেছিলেন নামীদামি শিল্পীদের প্রায় অনেকেই। কিন্তু কার্ডবোর্ড বা সানমাইকার উপরে এচিং বা এনগ্ৰেভিং সম্ভবত সনৎ করই প্রথম উদ্ভাবন করেছেন। যদিও অনেক ইউরোপীয় শিল্পীই কিন্তু কার্ডবোর্ডের উপরে ছবি এঁকেছেন।
এন্টালিয়ো বলতে আমরা এচিং, এনগ্ৰেভিং, ড্রাইপয়েন্ট এবং অ্যাকোয়া টিন্ট— এই সমস্তটাই বুঝি। তার মধ্যে যখন সারফেস বা উপরের স্তরটি কোনও যন্ত্রের সাহায্যে কেটে বা খুঁড়ে ছবিটা বের করা হয়, তাকে এনগ্রেভিং বলে। আর এচিং হচ্ছে একটি রাসায়নিক পদ্ধতি। অ্যাসিড এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পুড়িয়ে ছবিটাকে বার করা হয়। খুব শ্রমসাধ্য এই পদ্ধতি।
দেবভাষার এই প্রদর্শনীতে, ষাটের দশকের প্রথম থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত সনৎ করের হাতে তৈরি জ়িঙ্ক, কাঠ, সানমাইকা এবং কার্ডবোর্ডের নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর কাজ বদলে গিয়েছে প্রত্যেক দশকে। এক সময়ে যখন তাঁর মনে হয়েছে সংস্কৃত না জেনে ছবি আঁকা সম্ভব নয়, তখন তিনি প্রথমে সংস্কৃত শিক্ষা গ্ৰহণ করেন এবং পরে বৈষ্ণব পদাবলি নিয়ে প্রভূত পড়াশোনা করেন। তার নমুনাও আমরা এই প্রদর্শনীর কাজে দেখতে পাই।
১৯৭৩ সালে করা জ়িঙ্ক প্লেটের উপরে রাধার ছবি আমরা দেখতে পাই। বিমূর্ত পরিকল্পনা এবং ছক কাটা, কিন্তু তার মধ্যেও রাধা ভাবটি স্পষ্টই ধরা পড়ে। ‘‘হরি হরি আর কবে এমন দশা হব। ছাড়িয়া পুরুষ-দেহ কবে বা প্রকৃতি হব...’’ এই কথাগুলি তিনি কাঠের গায়ে লিখেছেন খোদাই করে। ছবিটি কাঠের উপরে এন্টালিয়ো করা। সম্পূর্ণ ভক্তিরসের ছবি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সালে আর একটি ছবিও কাঠের উপরে এন্টালিয়ো। সেটিও বৈষ্ণব পদাবলির রসে সিক্ত। দু’টি ভক্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের হাত, একটি চোখ এবং একটি যেন রাখালের লাঠি অথবা বাঁশি। ছবির পটভূমিতে বিমূর্ত কারুকার্য। অনবদ্য কাজ।
ভারতীয় ছাপাই চিত্রের ইতিহাসে সনৎ কর এক উদ্ভাবক। যত দিন চিত্রকলার এই বিভাগটি রয়ে যাবে, তত দিন তাঁকে স্মরণ করতে হবে আমাদের। কারণ, এ ক্ষেত্রে তিনি পারাপার করেননি, পথ গড়ে তুলেছেন।
সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকে আবার তাঁর ছাপাই ছবিতে আমরা ফিরে পাই সরলীকরণ এবং চরম আধুনিকতা। সেই সঙ্গে ফিরে আসে চোখ, কখনও একাধিক চোখ। এই প্রদর্শনীতে কার্ডবোর্ডের উপরে অপূর্ব একটি এনগ্ৰেভিং চোখে পড়ে। সবচেয়ে কম লাইনে করা একটি মেয়ের অবয়ব, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ১৯৮৬ সালের কাজ। আরও একটি ওই রকম মিনিমাল কাজ ছিল সানমাইকার উপরে এনগ্রেভিং। একটি মেয়ে, উপরের দিকে তার চাউনি, লম্বা তার গ্ৰীবা। আর কিছুই নেই। এই কাজটিও যথেষ্ট আকর্ষক।
শিল্পী সনৎ করের সাম্প্রতিক রচনায় উজ্জ্বল রং অনুপস্থিত। খুব চাপা ভাবে সিপিয়া, নীল এবং ধূসর ইত্যাদি মৃদু রং লক্ষ করা যায়, কিন্তু তার রেখা প্রবহমান।
এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে আকর্ষক ব্যাপারটি ছিল এই যে, শিল্পীর রন্ধনশালায় ঢুকে দেখতে পাওয়া গিয়েছে বারোটি প্লেট, যেখানে শিল্পী কাজ করেছেন। একই সঙ্গে রয়েছে রঙের ব্যবহারে, রেখার উৎকর্ষে পরবর্তী কালে শিল্পী ওই সব কাজের যতগুলি প্রিন্ট বার করেছেন, সেগুলিও। সবটাই পাশাপাশি রাখা ছিল প্রদর্শনীতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy