বর্ণিল: প্রতীতির প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
আধুনিকতাকে আশ্রয় করে কাজ করেছেন পাঁচ শিল্পীর তিনজন। সকলেই স্বশিক্ষিত। রূপ সম্পর্কে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি বড্ড ধোঁয়াশা ও জটিলতায় আচ্ছন্ন। বিবিধ ফর্মের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যাকে নিজের মতো কিছু শব্দ-অক্ষরে বিশ্লেষণ করেছেন, যা রচনার সামগ্রিকতার সঙ্গে মেলে না। মেলেওনি। আসলে ওই আধুনিকতাকেই তাঁরা বুঝতে পারেননি সঠিক ভাবে। বিষয়টি সহজও নয়। নিজের বোধে তৈরি করা ফর্ম অন্যান্য রূপবন্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অথবা কাঠামোগত বিবর্তনের মধ্যে পড়ে একটা সংঘাতও তৈরি করছে। কোথাও সেই অভিঘাত থেকে তৈরি হচ্ছে একরকম বিমূর্ত সংলাপ অথবা চরম নৈঃশব্দ্য। এই ফর্ম ও কালার দর্শককে হয়তো ভাবাচ্ছে তাঁদের রচনার কিছু বৈশিষ্ট্যে, কিন্তু তার গভীর কোনও অর্থ আদৌ আছে কি?
স্পেসের ব্যাপ্তি এবং জ্যামিতিক বিভাজনের স্টাইলকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে নিজের অজান্তেই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন। সেখানেই কখনও অরিগ্যামির ফর্মেশনের বিভ্রম থেকে ডিজ়াইনও এসে গিয়েছে ছবিতে। এই জায়গাগুলিকেই ধরতে পারেননি কম্পোজ়িশনের সামগ্রিকতায়। রূপ যখন রূপক অর্থে ধরা দেয়, তার প্রকৃত সত্তার বৈশিষ্ট্যে বেজে ওঠে রং-রেখা-ড্রয়িংয়ের এক রকম সিম্ফনি, যা অনুভব করতে অসুবিধে হয় না। ফর্ম একটা তৈরি করে ফেলে, তার অন্তর্গত গভীরতাকে না বুঝে অন্যান্য লাইন, রূপবন্ধ, বর্ণের সমাহারে মিলিয়েমিশিয়ে দিলেই যে ছবি হয়ে উঠবে, তা তো নয় একেবারেই। এরও নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকরণ আছে, থাকতেই হয়।
অবচেতনের রূপকে হয়তো সৃজন করতে চেয়েছেন, কিন্তু দ্বিমাত্রিক সারফেসে অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়েও তো ভাবতে হবে। সমতল বর্ণের বাহুল্যে অন্যান্য দিকের পরিধিতে ভারসাম্যের অভাব ঘটছে, সে দিকটা সকলে বুঝতে পারেননি। রূপ সেখানে কী এবং কী ভাবে অবস্থান করলে তাকে সংগঠিত করা যায় অন্যান্য কিছুর সহযোগিতায়— এই ‘অন্যান্য কিছু’র সন্ধান সম্পর্কে কেউ কেউ খুবই অসচেতন।
পরাবাস্তববাদীদের ধারণায় চিত্রকল্পনার মূল ও প্রথম উৎসই ছিল অবচেতন। সেখান থেকে জন্ম নেয় আশ্চর্য অদ্ভুত সব অবাস্তব বিচ্ছিন্নতা। সেখানে যুক্তি, মন, বাস্তবজগৎ চুরমার হয়ে যায়। বস্তু কিছু নয়, স্বপ্নই সব।
যদিও এরা কেউ সুররিয়ালিজ়মকে আশ্রয় করেননি। আবার মডার্নিজ়মকে গুরুত্বও দেননি, এমন নয়। বরং তাঁদের এক ধরনের আশ্চর্য আধুনিকতা ও জ্যামিতিক বিন্যাস, এক ধরনের স্টাইল ও রূপবন্ধকে অন্য ভাবে দেখতে চাওয়ার চেষ্টা ও তাকে নানা ভাবে ভেঙে বিন্যস্ত করা, লাইন ও টোনের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য তৈরি করে একটি মাত্র রূপকে নানা ভাবে দিকনির্দেশ করার প্রবণতা ও পরিকল্পনার মধ্যে নিশ্চিত ভাবে একটি ছাপ থাকে। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে ‘প্রতীতি’র সদ্যসমাপ্ত প্রদর্শনীটি শিল্পকল্পনার এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। আধুনিক শিল্পকলা তাঁরা বুঝুন, বা না-ই বুঝুন।
প্রিয়ঙ্কা দাসের অন্বেষণ তাঁর নিজের বিশ্লেষণে দেখা ও অনুভূতির সমন্বয়। সব ক্ষেত্রেই তাঁর ছবিতে একটি নিরীক্ষা আছে। যা জ্যামিতি-আশ্রিত ও বস্তুকেন্দ্রিক, সে রেখাই হোক বা ফর্ম। নিজের মতো এই রচনার বিন্যাসে বেশ কিছু রেখা ও ফর্মের গভীরতা ও স্টাইল-টেকনিকের সমন্বয়টি যথেষ্ট অর্থবহ। কৌতূহল তৈরি করে, যা দর্শককে ভাবনার খোরাক জোগায়। সবই কাগজে অ্যাক্রিলিক।
সৃজনী দাসমুন্সী রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে তাঁর কাজে ছোটগল্প, নাট্য, কাব্যকে ‘তৃষ্ণার ফসল’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘মেঘলা দিনে’ কাজটি বেশ।
দীপাঞ্জন দত্ত ভৌমিক বড্ড বেশি বর্ণিল। সব কাজ অয়েল, ক্যানভাসে। একঘেয়েমি-আচ্ছন্ন। বারবার বর্তুল রূপটি প্রায় একই ভাবে গ্রহের মতো এ-দিকও-দিক বিন্যস্ত। কী বলতে বা করতে চেয়েছেন স্পষ্ট নয়। এখানেও জ্যামিতিকে কিছুটা এনেছেন। হয়তো না বুঝেই। সেখানেই সঙ্কট। আধ্যাত্মিকতা? অসীম সাধনা? কীসের?
রিয়্যালিজ়মকে অবয়বপ্রধান ছবিতে আত্রেয়ী রায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছেন। বিশেষ করে নারীজাতির কিছু বিশেষত্বকে ছবির প্রকাশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকেই খুঁজেছেন। ভাল কাজ। ‘নারীশক্তি’, ‘উদাসীন’-এর মুখে চমৎকার আলো। দু’টিই চারকোলের কাজ, রঙিন বোর্ডে। অন্যান্য জল-রংও ব্যবহার করেছেন।
নিজের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অমন বিমূর্ত ফর্ম ও জ্যামিতিক রূপারোপে কী করে তাঁর ছবিতে তিনি বুঝতে পারলেন, তা টুম্পা হাজরাই জানেন। কোন অবস্থানকে তিনি খুঁজতে চেষ্টা করেছেন? বিশ্লেষণের সঙ্গে ছবি মেলেনি। চেষ্টা সাধুবাদ পাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy