Advertisement
E-Paper

বিজন ঘরে... আসবে যদি

বাংলা সাহিত্য ও নাটকের ইতিহাসে তাঁর পরিচয় শুধুই ‘নবান্ন’! একুশ শতকে পৌঁছেও বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যদর্শন এবং সমাজভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে ‘ভয়’ পায় বাংলা মঞ্চ। ছ্যাঁকা খাওয়ার ভয়। লিখছেন স্যমন্তক ঘোষ বাংলা নাটকের অন্যতম ‘চর্চিত অথচ বিস্মৃত’ চরিত্র। নাট্যকর্মীরা যাঁকে রোজই আবিষ্কার করছেন এবং তুলে রাখছেন আপাত গোছানো বইয়ের তাকে। ধুলো ঢাকা বিজন নস্টালজিয়ায় ভাল, বাস্তবে ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো। 

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০২
বাংলা নাটকের অন্যতম ‘চর্চিত অথচ বিস্মৃত’ চরিত্র বিজন ভট্টাচার্য।

বাংলা নাটকের অন্যতম ‘চর্চিত অথচ বিস্মৃত’ চরিত্র বিজন ভট্টাচার্য।

তত দিনে গণনাট্য ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। ছেড়ে চলে গিয়েছেন স্ত্রী মহাশ্বেতা। দক্ষিণ কলকাতার ভাড়া বাড়িতে নবারুণকে নিয়ে পাঁঠার মাংস আর ‘বাংলা’র সংসার। তাঁর নাটকের সংলাপের মতোই বাড়ির ইট-কাঠ-কংক্রিটের পাঁজর সময়ে সময়ে শুনছে, ‘বাঁচতি গেলি খাওয়া জোটে না, খেতি গেলি বাঁচা যায় না...’ কিন্তু তখনও তিনি বিশ্বাস করছেন, দিন বদলের স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে জীবন। বিশ্বাস করছেন, থিয়েটার একদিন জনগণের হয়ে উঠবে। সংলাপ আর কেবল সংলাপে আটকে থাকবে না। সাধারণ মানুষের বিপ্লবের ভাষা হয়ে উঠবে। বিজন ভট্টাচার্য।

বাংলা নাটকের অন্যতম ‘চর্চিত অথচ বিস্মৃত’ চরিত্র। নাট্যকর্মীরা যাঁকে রোজই আবিষ্কার করছেন এবং তুলে রাখছেন আপাত গোছানো বইয়ের তাকে। ধুলো ঢাকা বিজন নস্টালজিয়ায় ভাল, বাস্তবে ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো।

‘নবান্ন’র নাট্যকার এখনও ছ্যাঁকা দেন!

(১)

স্মৃতির কলমে সুবীর বসু লিখেছেন, ‘... একবার হয় রঙ্গনা নয়তো বিজন থিয়েটারে ‘চলো সাগরে’ নাটকের অভিনয় শেষ হয়ে গেছে। সকলে মেক আপ, জামা কাপড় পাল্টাচ্ছে। বিজনকাকা হঠাৎ হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর বলছেন— আমরা তো নাটকে ইন্টারন্যাশনাল গাইছি। কিন্তু কবে তা আমাদের দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গাইবে? আমরাই কি কেবল গেয়ে যাব?’

ইনিই বিজন ভট্টাচার্য। নাটককে যিনি কেবল একটা ‘পারফর্ম্যান্স’ হিসেবে দেখতেন না। শিল্প বলতে বুঝতেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। থিয়েটারকে বুঝতেন গণের নাটক। যা কেবল সাধারণ মানুষের ভাল-মন্দ-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলবে না। নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষও হয়ে উঠবেন সেই গল্পের এক-একজন কুশীলব। দর্শক এবং রঙ্গকর্মী সকলে একত্রে ঢুকে পড়বেন থিয়েটারের অঙ্গনে। তার পরে বিপ্লব ঘটে যাবে। জীবন, রাজনীতি এবং থিয়েটার নিয়ে এ ভাবেই মিলেমিশে ছিলেন বিজন। কোনও একটি সত্তাকে বাদ দিয়ে তাঁর অন্য সত্তাকে বোঝা মুশকিল। যাপন-অর্থনীতি-রাজনীতি-পরব— সব নিয়ে মাখামাখি যিনি, তিনি নিজেই আসলে একটা থিয়েটার! মোনোলগ।

১৯১৫ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের খানখানাপুরে ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে জন্ম বিজনের। বাবা ক্ষীরোদবিহারী। মা সুবর্ণপ্রভা আর ঠাকুরদা রাসবিহারী। রাসবিহারীর জমিজায়গা সে সময়ে গ্রাম্য সমাজে রীতিমতো আলোচনার বিষয় ছিল। আর চর্চিত ছিল তাঁর লেঠেলদের কাহিনি। তেমনই এক লেঠেল ছিলেন বাবর আলি। শোনা যায়, চল্লিশের দশকে চরের কিছু জমি নিয়ে কিরণশঙ্কর রায়ের নায়েবদের সঙ্গে বাবর আলির তীব্র সংঘর্ষ হয়েছিল। এবং শেষ পর্যন্ত চরের দখল রেখেছিল বাবর আলি। পরবর্তী কালে ঘনিষ্ঠ মহলে বিজন নাকি রসিকতা করে বলতেন, ’৪৬-এ বাংলায় মুসলিম লিগের সঙ্গে কিরণশঙ্করের জোট হয়েই যেত! কিন্তু নিজের জমি-জায়গা নিয়ে কিরণবাবু এতই উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং বাবর আলির কাছে পরাজিত হয়ে এতটাই মনোবল হারিয়েছিলেন যে, রাজনীতিতে বিশেষ মন দিতে পারেননি। জোটটাও তাই হয়নি।

জমিদারিতে অবশ্য খুব বেশি উৎসাহ ছিল না ক্ষীরোদবিহারীর। দেশ ভাগের অনেক আগেই বিজনকে নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন অধুনা উত্তর ২৪ পরগনার আড়বেলিয়ায়। শিক্ষক বাবার মতো বিজনও কোনও দিন জমিজায়গা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ বা উৎসাহ দেখাননি। তবে ষাটের দশকে একবারই কেবল জমি নিয়ে মামলা লড়েছিলেন। ঘটনাপ্রবাহে সে কাহিনিতে পৌঁছনো যাবে।

(২)

প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করে বিজন ভর্তি হয়েছিলেন প্রথমে আশুতোষ এবং পরে রিপন কলেজে। তবে সম্ভবত পড়াশোনা শেষ করেননি। বাম রাজনীতির জোয়ারে তত দিনে গা ভাসিয়েছেন। রুশ বিপ্লব তখন পৃথিবী জুড়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘প্রগতিশীল’ ছেলেমেয়েদের।

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে পৃথিবীময় তখন বাম ভাবাদর্শে ফুটছে অনেকেই। বিজনরা দেওয়াল লিখন পড়তে পেরেছিলেন। চলতি স্রোতে অবগাহন করতে সময় নেননি। আর তারই প্রেক্ষাপটে ঘটে যায় বঙ্গদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বিজনরা যে মন্বন্তরকে মনে করতেন ‘ম্যান মেড’। জোতদারদের গোলায় খাবার আছে। মহাজনেরা চড়া দামে তা বিক্রি করছে কালো বাজারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছচ্ছে না। রাস্তাঘাটে, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বুভুক্ষু লাশ। সেই প্রেক্ষাপটেই তৈরি হচ্ছে ‘নবান্ন’। কিছু দিনের মধ্যেই শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় যা মঞ্চস্থ হবে। দেশ জুড়ে সাড়া ফেলে দেবে। কয়েক বছরের মধ্যে ‘নবান্ন’ হয়ে উঠবে নতুন ধারার সাহিত্য রচনা এবং নাট্যশিল্পের দিকনির্দেশ। ‘নবান্ন’ অবলম্বনে ছবি তৈরি হবে হিন্দিতে। আর নাটকের অনুকরণে ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যে জোয়ার লাগবে। গণনাট্য সঙ্ঘের ভিত তৈরি হয়ে যাবে।

পটনায় গণনাট্যের ৭৫তম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে বারংবার উচ্চারিত হল প্রস্তুতি পর্বের সেই দিনগুলির কথা। প্রদর্শনীতে, আলোচনায় ফিরে এলেন বিজন। অনুষ্ঠানে এসে শাবানা অাজ়মি উল্লেখ করলেন ‘বিজনবাবু’র নাম। যদিও সরাসরি বিজনের সঙ্গে কখনও দেখা হয়েছে বলে মনে করতে পারলেন না। তবে বাবা কাইফি আজ়মির কাছে একাধিক বার শুনেছেন নাট্যকারের কথা। বিজন ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ উঠতেই শাবানা ফিরে গিয়েছিলেন ছোটবেলার স্মৃতিতে— ‘‘আসলে কোনও ব্যক্তি নন। কালেক্টিভ এফর্টে বিশ্বাস করতেন ওঁরা। আলাদা করে কারও কথা বলতেন না, বলতেন সময়ের কথা।’’ কালেক্টিভ তেমনই এক কমিউনে জন্ম শাবানার। এক দিকে রান্না-খাওয়া আর অন্য ঘরে লাল ঝান্ডায় শোভিত বসার ব্যবস্থা। সে ঘরেই নিয়মিত যাতায়াত ছিল গণনাট্যের কর্মীদের। দিনভর ওখানে বসেই তৈরি হয়েছে বহু সাহিত্য, নাটক, গান। ’৪৮-এ গণনাট্য

ছাড়ার পর বিজনও গিয়েছিলেন মুম্বইয়ে। চিত্রনাট্য লেখার কাজে। গণনাট্যের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও, কখনও কি কাইফি আজ়মির বাড়িতে যাননি বিজন? মলিন হয়ে গিয়েছে ইতিহাস।

তবে শাবানা যে সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন, তা তো মিলে যায় বিজন-মহাশ্বেতার যাপনের সঙ্গেও। সংসার নয়, তাঁরাও তো সে সময় বিশ্বাস করছেন কমিউন-জীবন! বিলাসবিমুখ উদ্‌যাপন!

গণনাট্যের পর্বেই বিজনের সঙ্গে আলাপ মহাশ্বেতার। শোনা যায়, বিজনের নাটক ‘জিয়ন কন্যা’য় অভিনয়ও করেছিলেন লেখিকা। তবে মহাশ্বেতার স্মৃতিতে প্রেমপর্বে বিজন যতটা না নাট্যকার, তার চেয়ে বেশি গল্পকার। পরবর্তী কালে যিনি গল্প লিখবেন ‘সহযাত্রী’ ছদ্মনামে। ’৩৬ সালে তৈরি হওয়া প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘেরও অংশ ছিলেন তাঁরা। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখছেন, ‘বিজন ভট্‌চায এসেছিলেন গল্পলেখক হিসেবে, পরে দল ভেঙে তিনি গান-নাটকের শিল্পীদের দলে ভিড়ে গেলেন।’ বস্তুত, তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় পরে বলেছেন, ‘বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম প্রকাশিত ও নির্দেশিত নাটক ‘আগুন’কে ছোট গল্পের রীতির মধ্যেই গণ্য করা যায়; ছোট গল্প নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা তখন বাংলা সাহিত্যে চলছে, তাতে এ ধরনের একটি গল্প, যাতে বিভিন্ন সাংসারিক পরিবেশ থেকে পারস্পরিক পরিচয়হীন কিছু মানুষ প্রাত্যহিক ক্ষুণ্ণিবৃত্তির অমোঘ টানে একটা জায়গায় এসে মিলিত হয়, আবার ছড়িয়ে যায়, কেউ লিখতেই পারতেন।’

‘নবান্ন’ নাটকের দৃশ্য

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ সেই মানুষগুলোই তখন হয়ে উঠছে সময়ের আখ্যান। ‘রিফিউজি’ গল্পে বিজন লিখছেন, ‘আগে ছিল বাগান বাড়ি, মাঝখানে হলো ভূতের বাড়ি, তারপর রিফিউজি কলোনি। দু’বছর পর এখন অবিশ্যি কলোনিও ঠিক বলা যায় না। তিরিশ-চল্লিশ ঘর উদ্বাস্তু পরিবার, কমে কমে এখন মাত্র দশ-বারো ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। জায়গাটা ঠিক বসবাসের উপযোগী নয়।’ তাঁর বিভিন্ন লেখায়, নাটকে

এ ভাবেই উঠে এসেছে খেটে খাওয়া, তাড়া খাওয়া মানুষের সমাজ। সমাজবীক্ষণ।

তথাকথিত বামপন্থী শিল্পীদের কলমে, পরিচালনায় তখন নাটক-সাহিত্যেই ধরা পড়ছে বাস্তব। মিলে যাচ্ছে অন্দর-বাহির। বিশ্ব আর অন্তর। সমাজ আর ব্যক্তিসত্তা। অনেকেই মনে করেন, বিজনের বিখ্যাত নাটক ‘মরাচাঁদ’-এ আসলে উঠে আসছে আত্মজৈবনিক কাহিনি। গরিব অন্ধ বাউলকে যেখানে ছেড়ে যাচ্ছেন স্ত্রী। চলে যাচ্ছেন তথাকথিত ‘চটুল’ গায়কের দিকে। আর অন্ধ বাউলকে পরবর্তী সময়ে গান গাইতে নিয়ে যাচ্ছে পার্টির ছেলেরা। তিনিও যাচ্ছেন। এ তো বিজন নিজেই! মহাশ্বেতার ছেড়ে যাওয়ার পর্ব! অথচ নাটক সেই ছাড়া-না ছাড়ার টানাপড়েনের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে আরও বড় এক সামাজিক দ্বন্দ্বে। যে নাটক দেখে তৃপ্তি মিত্র লিখছেন, ‘‘অন্ধ গায়ক পবন। দোতারা বাজিয়ে গান গায়। রাজনৈতিক সভায়ও গান গাইতে নিয়ে যায় বাবুরা কখনও-সখনও। তার সুন্দরী বউ প্রেমে পড়ল এক বৈষ্ণব ভেকধারী ভণ্ডের। তার পর এক দিন তার সঙ্গে চলে গেল। আমি যে অভিনয়টি দেখেছিলাম তাতে দু’টি চরিত্রই গোষ্ঠদা অভিনয় করেছিল। দু’টিই অসাধারণ অভিনয়। তার মধ্যে বিশেষ করে পবন।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৃপ্তি ছিলেন বিজনের আত্মীয়।

(৩)

মঞ্চে যখন এই অভিনয় চলছে, তখন বাড়িতেও ধুন্ধুমার অবস্থা। ’৪৮ সালে জন্ম হচ্ছে নবারুণ ভট্টাচার্যের। মতাদর্শের লড়াই করে বিজন ছাড়ছেন গণনাট্য। মহাশ্বেতা-বিজন তখন ভাড়াবাড়িতে। এক চিলতে ঘরে অভাব নিত্যদিন। বাড়িতে ভাত ফুটবে কি না, জানা নেই। অথচ বিজন বাড়িতে ধরে আনছেন কখনও সাপুড়ে, কখনও লোকগায়ক, আউল-বাউলদের। প্রবল অনটনেও শিল্পের খিদে, লোকসংস্কৃতির খিদে মরছে না। অন্য দিকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন মহাশ্বেতা। সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ৬-৭ বছরের নবারুণ বড় বয়সে বারবার রোমন্থন করেছেন সেই সব স্মৃতি— রোজ বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত। এবং এ ভাবে চলতে চলতে শেষ দিনের তাণ্ডবও মনে ছিল নবারুণের। ভালবেসে মহাশ্বেতাকে নাকি একটা বালা কিনে দিয়েছিলেন বিজন। পার্থিব ভালবাসা। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্বে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে সেই বালা বিজনের কপাল লক্ষ করে নাকি ছুড়ে মেরেছিলেন মহাশ্বেতা। নবারুণ দেখেছিলেন এক দিকে বাবার কপাল থেকে গলগল করে রক্ত বেয়ে নামছে, অন্য দিকে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ছেন মা।

বড় হওয়ার পরে নবারুণকে নাকি বিজন বারবার বলেছেন, মহাশ্বেতার অন্য সম্পর্ক ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। বস্তুত, মহাশ্বেতা চলে যাওয়ার পরে বিজন আর কখনও কোনও সম্পর্কেও জড়াননি। বাকি জীবন কেটেছে ছেলেকে নিয়ে।

অভাবের কারণ ছিল না। কারণ ছিল না এই অনিশ্চিত জীবনেরও। পারিবারিক সম্পত্তি কিছু কম ছিল না ভট্টাচার্যদের। শুধু তাই নয়, বছর কয়েক চাকরিও করেছেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে চাকরি করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাইনে নেহাত কম ছিল না। কিন্তু কোনওটাই পছন্দ হয়নি তাঁর। বছর কয়েকে বুঝে গিয়েছিলেন, ও কাজ তাঁর জন্য নয়।

আর জায়গাজমি? বিশেষ খবর রাখেননি কোনও কালেই। তবে ষাটের দশকে ও পার বাংলায় ফেলে আসা জবর দখল হয়ে যাওয়া জমি নিয়ে মামলা করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার তত দিনে সে জমি ‘খাস’ করে দিয়েছে। দীর্ঘ দিন লড়াই করে বিজন সেই মামলা জিতেও ছিলেন। কিন্তু পাক সরকার তখন সে সম্পত্তি ‘শত্রুর জমি’ বলে চিহ্নিত করে!

স্ত্রী মহাশ্বেতা এবং ছেলে নবারুণের সঙ্গে বিজন

দীর্ঘদিন ও পার বাংলার সেই বিশাল জমিদারিতে বসবাস করেছেন বিজনের আত্মীয়রা। নবারুণের স্মৃতিচারণায় ফিরে ফিরে আসত হাসিরানি আর গোবিন্দমোহনের কথা। ’৭১-এর যুদ্ধে খানসেনার হাতে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন।

(৪)

গণনাট্য ছাড়ার পর নিজের দল তৈরি করেছিলেন বিজন— ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। সেই গণনাট্যের আমল থেকেই তিনি বিশ্বাস করতেন নাটক আসলে ‘ইন্টার‌্যাকশন’। দর্শকও যার অংশ। সংলাপের মধ্য দিয়ে সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কথোপকথনের পরিমণ্ডল তৈরি করা।

শিক্ষক বাবার কাছে শেক্সপীয়র শুনেছিলেন বিজন। পড়েওছেন। কিন্তু ক্লাসিক্যাল থিয়েটার কখনওই টানেনি তাঁকে। আকর্ষণ করেনি পেশাদার ব্যবসায়িক থিয়েটার। মনে রাখা দরকার, যে সময়ে বিজন বড় হচ্ছেন, সেই সময়ে কলকাতায় পেশাদারি থিয়েটার যথেষ্টই জনপ্রিয়।

পরবর্তী কালে বিজন বারবার বলেছেন, ওই ধরনের থিয়েটারের রীতি, শৈলী কোনও কিছুই তাঁকে আকর্ষণ করেনি। নাটক রচনার ক্ষেত্রেও নয়, পরিচালনার ক্ষেত্রেও নয়। বরং তাঁকে নাটক লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে রেশনের লাইন। যেখানে তিনি দেখেছেন, ধর্ম-জাতি-সামাজিক স্তরের বেড়া ভেঙে সকলে একত্রে দাঁড়িয়েছেন। যোগাযোগ তৈরি হয়েছে একের সঙ্গে অপরের। কথোপকথন হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই লাইনেই তিনি দেখেছেন, সংকীর্ণ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে প্রশাসন, জোতদারের বিরুদ্ধে শ্রেণিস্বার্থ না ভেবে একত্রে প্রতিবাদ করছে জনসাধারণ। ওই জনসাধারণের মধ্যেই কমিউনিস্ট আস্ফালন দেখেছিলেন বিজন।

বাদল সরকারের কয়েক দশক আগেই বিজনরা বুঝে গিয়েছিলেন নাটক কেবল মঞ্চে নয়, রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে করার বিষয়। দর্শক আর অভিনেতার মধ্যে যেখানে মঞ্চের দূরত্ব তৈরি হবে না। আজীবন এ বিশ্বাস লালন করেছেন বিজন। পরবর্তী কালে বাদলরা যার নাম দেবেন ‘থার্ড থিয়েটার’।

মঞ্চের ভাষা আর কথ্য ভাষা নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন বিজন। কাজে লেগেছিল ’৪২-’৪৩ সাল জুড়ে সমগ্র বাংলা প্রদেশ পরিক্রমা। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘টুনে, মালো, বেদে শোলার কারিগর, প্রতিমাশিল্পী, সাপুড়ে, আউল-বাউল, জেলে, এমন নানা সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার মধ্য দিয়ে বিজনবাবু তাদের লোকাচার, জীবনদর্শন, লোকশ্রুতি, সংস্কার ও বিশ্বাস, ভাষা, কথার টান ও সুর আত্মস্থ করেছেন। ওই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাই তাঁর নাটকের ভাষা ও চাল নির্ধারণ করেছে।’

শমীককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিজন বলেছিলেন, ‘‘আই স হাউ ডায়লেক্ট চেঞ্জেস এভরি টু মাইলস। আমার যে এক্সপেরিয়েন্স, আমি হয়তো একসঙ্গে পঞ্চাশ মাইল হেঁটে গেছি কার্যকারণে, স্টপ করে করে। দেখেছি, অদ্ভুত, ল্যাঙ্গোয়েজ চেঞ্জেস এভরি টু মাইলস এবং ওই টুইস্ট আরম্ভ হল। একটা অঞ্চলে তুমি গেলে, তারপর ইউ ট্রেভার্স অ্যানাদার টু মাইলস অ্যান্ড সি, মূল একটা ভাষার ঐক্য আছে, কিন্তু টোন-টা আস্তে আস্তে চেঞ্জ করে এবং তার ইনটোনেশন, এমফ্যাসিস ও সিনট্যাক্সগুলো এসে পড়ে কিন্তু মূল ভাষা এক থাকে, তার ভিতরে আবার কী করে চেঞ্জ করতে করতে, এ দিক দিয়ে হাঁটলে পরে খুলনা দিয়ে মেদিনীপুর দিয়ে ওড়িশার বর্ডারে ঢুকে পরে কেমন করে ওড়িয়া হয়ে গেল, খুব ইমপারসেপটিবলি ওড়িয়া হয়ে গেল, বোঝা যায়।’

অঞ্চল ভেদে ডায়লেক্টের সেই তফাতকেই নাটকে বারবার ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন বিজন। আইপিটিএ ছাড়ার পরে নিজের দলেও সেই ডায়লেক্ট ভিত্তিক সংলাপের উপরেই জোর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর দলের অভিনেতারা অনেকেই পরে বলেছেন, উচ্চারণ নিয়ে কী ভয়ংকর খুঁতখুঁতে ছিলেন বিজন! ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠিক উচ্চারণের জন্য লড়াই করে যেতেন।

এক দিকে যখন মঞ্চ নিয়ে দিনের পর দিন এক্সপেরিমেন্ট করছেন নাট্যকার, একলা সংসারে তখন বড় হচ্ছেন নবারুণ। বন্ধু ঋত্বিক ঘটক নিয়মিত হাজির হচ্ছেন বাড়িতে। ‘বাংলা’র আসর বসছে। আর বিলাসিতা ছিল পাঁঠার মাংস। সুযোগ পেলেই মাংস রান্না হত বাড়িতে। আর কখনও পেটে ব্যথা হলে নবারুণকে হলুদ গোলা জল খাইয়ে দিতেন বিজন। টোটকা!

গণনাট্যের ৭৫ বছর পূর্তির লোগো

গণনাট্য ছেড়ে তত দিনে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন বাংলার শিল্পী সাহিত্যিকেরা। শম্ভু মিত্র থেকে উৎপল দত্ত সকলেই নিজের নিজের দল তৈরি করছেন। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিজনের দল আছে বটে। কিন্তু অন্যদের মতো তত নিয়মিত অভিনয় হচ্ছে না। ষাট-সত্তর দশকে গ্রুপ থিয়েটারে আসা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়েরা বলছেন, বিজন সব অর্থেই ছিলেন একজন শিল্পী। কিন্তু ‘অর্গানাইজ়ড’ ছিলেন না। যে কারণে আর সব গ্রুপ থিয়েটারের মতো নিয়ম করে অভিনয় চর্চাও চালাতে পারতেন না।

অশোকবাবু শুনেছেন, সেই সময়ে ক্যালকাটা থিয়েটারে নিয়ম ছিল, মহড়ায় কারও পৌঁছতে দেরি হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। শাস্তি। অধিকাংশ দিন দলের নেতাই নাকি দেরিতে পৌঁছে চুপচাপ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন! দলের নিয়ম ভাঙতেন না। কিন্তু যে দলে নেতাই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, সেই দল যে নিয়মিত অভিনয় গুছিয়ে উঠতে পারবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক!

অভিনয়কে, থিয়েটারকে বোধহয় খুব ‘অর্গানাইজ়ড’ ভাবে দেখতেও চাননি বিজন। দল গোছাতে চাননি। বরং সংগ্রামের পথটাই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। হয়তো সে জন্যই ’৭৮ সালে মুক্তমঞ্চে নাটক চলাকালীন যখন পায়ে পেরেক ফুটে গিয়েছিল, তিনি অভিনয় বন্ধ করেননি। দুই সিনের মাঝখানে পা থেকে বারও করতে পারেননি পেরেক। পেরেক বেঁধা রক্তাক্ত পায়ে শেষ হয় শেষ অভিনয়। রাতে বাড়ি ফিরে রক্ত বমি। দু’বার। পরদিন মৃত্যু।

কার মৃত্যু? ব্যক্তি বিজনের? নাকি একটা সংগ্রামের? বামপন্থী স্বপ্নের? ইন্টারন্যাশনালের? প্রশ্ন ঘুরতে থাকে হাওয়ায়। বাংলা থিয়েটার অগ্রসর হতে থাকে গ্রুপ থেকে গ্রুপে। মঞ্চ থেকে মঞ্চে। ক্রমশ বইয়ের তাকে জায়গা পেতে থাকেন বিজন। বাংলা ভাষার ডায়লেক্ট চর্চার মতোই। শহরমুখী বামপন্থা ক্রমশ বিজনচর্চা বেঁধে দেয় নবান্ন-পর্বে। নস্টালজিয়ায়।

ঋণ: নবারুণ ভট্টাচার্য ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিজন ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ’ অভি চক্রবর্তীর ‘বিজন ভট্টাচার্য— নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠক’ বহুরূপী পত্রিকা, ২০১৫ এক্ষণ পত্রিকা— বিজন ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা শামীম আহমেদ

Bijon Bhattacharya Theatre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy