Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
‘পঞ্চতপা’র মতো ছবি করেও চলচ্চিত্র-বাণিজ্য সাগরে ভেসে কূল হারানো অসিত সেন কে নিয়ে লিখেছেন সুদেষ্ণা বসু।
Tollywood

Asit Sen: স্বর্ণযুগের আর এক মানিক অসিত সেন

তাঁর ছবি বাংলা ও হিন্দি দু’ভাষাতেই সফল। সিনেমাকে তিনি দিয়েছেন অবিস্মরণীয় কিছু গান।

সুদেষ্ণা বসু
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:৫৬
Share: Save:

ঞ্চাশের দশকে যখন বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের সূচনা হচ্ছে, উত্তম-সুচিত্রা জুটির আবির্ভাব প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠছে, কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফিহাউসের দু’টি কক্ষের একটিতে আড্ডা মারতেন কয়েক জন ভাগ্যান্বেষী তরুণ। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন অবশ্যই সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক। বাকিরাও স্বনামধন্য। সেই বাকিদের একজন হলেন অসিত সেন।

অসিত সেনের ডাকনাম ছিল মানিক। সত্যজিৎও মানিক। দুই মানিকের আলাপ হয়েছিল ডি জে কিমারের অফিসে। অসিত ছিলেন ওই অফিসের চুক্তিভিত্তিক স্থির চিত্রগ্রাহক। একসময় টি বোর্ডের একটি বিজ্ঞাপনের ছবির জন্য যৌথভাবে চিত্রনাট্য লিখে জমা দিয়েছিলেন তাঁরা। দু’জনের প্রেমপর্বও চলেছে একই সময়ে। আবার দু’জনেই তাঁদের প্রথম ছবি বানিয়েছিলেন কমবেশি একই সময়ে। সত্যজিৎ যখন ‘পথের পাঁচালী’ বানিয়েছেন, অসিত তখন তাঁর দ্বিতীয় ছবি তৈরি করেছেন, ‘চলাচল’। একই সময় পরিবেশকের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন দু’জনেই। জীবন সায়াহ্নে বন্ধু সত্যজিৎকে ঘিরে অসিত সেনের আত্মসমীক্ষাটিও চমৎকার, “সত্যজিৎ রায় জন্মায়। আর চেষ্টা করলে, লেগে থাকলে অসিত সেন হওয়া যায়।”

অসিত সেনের জন্ম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯২২, অবিভক্ত বাংলার বিক্রমপুরের আটিসাহী গ্রামের মামার বাড়িতে। পৈতৃক ভিটে খামার খাড়া গ্রামে। দাদামশায় ছিলেন জমিদার। মামারা স্বাধীনতা সংগ্রামী তবে বাবা-কাকারা গরিব ছিলেন। বাবা রবীন্দ্রনাথ সেন, মা ঊর্মিলাদেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ইংরেজ আমলের ভারতীয় রেল কোম্পানিতে চাকুরিরত আইনজ্ঞ। অসিতরা দু’ভাই। অসিত (মানিক) আর অশোক (মণ্টু)। চার বোন কমলা, অঞ্জলি, শিউলি ও গোপা। তাঁর শৈশব কেটেছে ঢাকা বিক্রমপুরের আটিসাহী গ্রামে। বিক্রমপুরের রাধানাথ হাই স্কুলে তাঁর লেখাপড়া শুরু। ঢাকার ‘মুকুল থিয়েটার’-এ জীবনের প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবে সে সিনেমা ছিল নির্বাক। তাঁর দেখা প্রথম সবাক ছবি নীতিন বসুর ‘ভাগ্যচক্র’।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত রাধানাথ হাই স্কুলে কাটিয়ে তার পরে নওগাঁয় চলে যান বাবার কাছে। সেখানে বেঙ্গলি হাই স্কুল থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় আসেন আই এসসি পড়তে। বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। অসিত খুব ভাল গান গাইতেন, ক্রিকেট খেলতেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সলিল চৌধুরী ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছাত্রজীবনে তিন বন্ধুর ইচ্ছে ছিল, গৌরীপ্রসন্ন গান লিখবেন, সলিল তাতে সুর বসাবেন আর অসিত গাইবেন। বি এসসি পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তথ্যচিত্র নির্মাতা, পরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্তর। এই হরিসাধনকে সিনেমার নেশা ধরিয়ে ছিলেন অসিত সেনই।

বি এসসি-র প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থায় অসিত এমনই প্রেমে পড়েন যে, গ্র্যাজুয়েট হওয়া তাঁর আর হয়নি। পুত্র পার্থ সেনের কথায়, “গড়পারে বোনেদের স্কুল ‘ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়’-এর এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বাবা। সেখানে তাঁর চোখে পড়ে ‘প্যান্ডেলের মধ্যে খুঁটি ধরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। ভীষণ ফর্সা, নীল চোখ’। সেই প্রথম দেখা মায়ের সঙ্গে। যাকে বলে বোধহয় লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।” অসাধারণ সুন্দরী এই রেখাই (তখন দাশগুপ্ত) ছ’বছরের প্রেমপর্ব পার করে অসিত সেনের ঘরনি হন ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে।

তবে সেই প্রেমপর্ব শান্তিতে পার হননি অসিত। রেখা ছিলেন অভিজাত পরিবারের মেয়ে। বিলেত ফেরত এক ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন বাড়ির লোক। অবস্থা সামলাতে অসিত সেনকে মরিয়া হয়ে রোজগারের খোঁজে বেরোতে হয়। এমনই এক সময়ে সম্পর্কে মামা চিত্রগ্রাহক রামানন্দ সেনগুপ্ত তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন নিজের ‘রলিকট’ ক্যামেরাটি। সেই ক্যামেরা হাতে ক্রমশ অসিত ফোটোগ্রাফিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এক বন্ধুর দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ির একতলার একটি ঘরে ফোটো তোলার স্টুডিয়ো ‘শিল্পমন্দির’ গড়ে তোলেন। এর কিছু দিনের মধ্যেই রামানন্দবাবু তাঁর চতুর্থ সহকারী হিসেবে অসিতকে ঢুকিয়ে নেন ‘ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়ো’তে। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পূর্বরাগ’ (১৯৪৭) ছবিতে তিনি সহকারী হিসেবে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান ১৭ টাকা মাইনেতে। ছবি তৈরির অন্যান্য বিভাগের কাজও তিনি শিখে নিতে শুরু করেন এই সুযোগে। রেখা এই ঘটনাক্রমে খুশি হলেও অসিত সেনের বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার তখনও সিনেমা তৈরিকে নিকৃষ্ট কাজ বলেই মনে করত। রেখা এই সব সমস্যা সামাল দিয়েছিলেন শক্ত হাতে।

এরই মধ্যে ১৯৪৬-’৪৭ সালে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালি ও পটনায় মহাত্মা গান্ধীর শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগযাত্রার উপরে একটি তথ্যচিত্র তৈরির বরাত পেয়েছিলেন রামানন্দবাবু। কিন্তু শারীরিক কারণে তিনি যেতে না পারায় পাঠিয়ে দেন অসিতকে। ১৬ মিমি ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েন অসিত। টানা ২৫-২৬ দিন শুটিং করেছিলেন। যদিও কোনও তথ্যচিত্র তৈরি হয়নি শেষ পর্যন্ত, সব ফুটেজ ভারত সরকারের কাছে জমা পড়ে যায় স্বাধীনতার পরে। কিন্তু তাঁর তোলা গান্ধীজির সেই সব শট আজও বিভিন্ন নিউজ় রিল বা টিভির পর্দায় দেখা যায়।

ইতিমধ্যে অসিত সেন ‘লাইটহাউস’ সিনেমার উল্টো দিকে ‘এভারেস্ট স্টুডিয়ো’তে ফোটোগ্রাফার হিসেবে যুক্ত হন। এখানে নিয়মিত আসতেন সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত। আড্ডা হত। আড্ডার মূল বিষয় অবশ্যই ছিল সিনেমা। এই স্টুডিয়ো থেকে একটি কাগজও বার করা হত। নাম ছিল ‘সোসাইটি ক্লোজ আপ’। সত্যজিৎ সিনেমার স্টারদের কার্টুন আঁকতেন। চিদানন্দ ফিল্মের অংশটা দেখতেন। অসিত দেখতেন ফোটোগ্রাফির পাতাটি। লাইটহাউসের পাশেই দোকানটি ছিল বলে, হলের ম্যানেজার তাঁদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে হলিউডের ছবি এলেই তাঁরা বিনা টিকিটে দেখতে পেতেন। কখনও প্রোজেকশন রুমে গিয়ে রিল থেকে ‘শট বাই শট’ পরীক্ষা করতেন। কখনও মিনিয়েচার রুমে বসে ছবি চালিয়ে সাউন্ড ট্র্যাক দিয়ে, কখনও তা বন্ধ করে ছবিগুলি দেখতেন তাঁরা।

কিন্তু ছবি তৈরি করার স্বপ্ন তখনও বাস্তব রূপ নেয়নি। হঠাৎই নওগাঁয় বাবার এক মক্কেলের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে সেই সুযোগ এসে যায়। রেখা ও অসিত দু’জনেই ঝাঁপিয়ে পড়েন ছবি তৈরির কাজে। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় বসে অসিত সেন তাঁর জীবনের প্রথম কাহিনিচিত্রটি তৈরি করেন অহমিয়া ভাষায়। ছবির নাম ‘বিপ্লবী’। একজন সন্ত্রাসবাদী যুবকের ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গের কাহিনি। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অনুপমা ভট্টাচার্য, চন্দ্র ফুকন, রানি নাথ, জগৎ বেজবড়ুয়া। শোনা যায়, তৈরি হওয়ার পরে প্রযোজনা সংস্থা নিজের মতো করে ছবিতে কিছু অদলবদল ঘটান। তাতে অসিত অসন্তুষ্ট হয়ে ছবিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন।

অসিত সেন যে একদিন ভারতবিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন রেখা। বিয়ের পরের বছরই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর, ৬ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে। দিনটি পুত্র পার্থর জন্মদিন। দুর্ভাগ্য অসিতের, সাফল্যের দিনগুলিতে রেখা তাঁর পাশে থাকতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথায় পাই, “খুব অল্প সময় স্ত্রী আমার সংসারে ছিলেন। কিন্তু যতটুকু সময় ছিলেন, ভালবাসায়, মমতায়, স্নেহে ও সাহচর্যে ভরিয়ে রেখেছিলেন আমাদের সংসার। তাঁর চলে যাওয়াটা আকস্মিক বলেই বোধহয় স্মৃতি থেকে মুছতে পারিনি কখনও।” স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। জীবনের চরম সাফল্যের দিনে বারবার ফিরে এসেছে রেখার স্মৃতি। আর তাই হয়তো তাঁর সব ছবিতেই বিরহব্যথার আবহ এত স্পষ্ট।

নিজের জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলতে একাই চেষ্টা করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর ‘শিল্প মন্দির’ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাজের সন্ধানে ঘুরতেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের অফিসে। সেই সূত্রেই ডি জে কিমারের অফিসে আলাপ হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। শিক্ষানবিশিও চলত একই সঙ্গে। এভারেস্ট স্টুডিয়োয় বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অসিত ‘চলাচল’-এর চিত্রনাট্য লিখতেন। সেই চিত্রনাট্য প্রথমে শুনিয়েছিলেন সুচিত্রা সেনকে। তিনি রাজি হলেও যে পারিশ্রমিক চান, তা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। বন্ধু নির্মলকুমার সেই স্টুডিয়োর আড্ডায় এলে তাঁকেও শোনাতেন সেই চিত্রনাট্য। নির্মলকুমারই এই চিত্রনাট্যের খবর দেন অরুন্ধতীদেবীকে। চিত্রনাট্য শুনে অরুন্ধতীদেবী ছবিতে অভিনয় করতে আগ্রহী হন। অরুন্ধতী ও অসিতের যৌথ চেষ্টায় তৈরি হয় ‘চলাচল’। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেয়ে ‘চলাচল’ বক্স অফিসে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। তার পর অসিত-অরুন্ধতী জুটি ১৯৫৭ সালে তৈরি করেন তাঁদের কালজয়ী দ্বিতীয় ছবি ‘পঞ্চতপা’।

এমনই এক সময়ে অসিত সেনের সঙ্গে দেখা হয় বিমল রায়ের। তিনি তখন মুম্বইতে ছবি করছেন। রাজ কপূরকে ডেকে ‘পঞ্চতপা’ দেখিয়েছিলেন বিমল রায়। অসিত সেনের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল মুম্বই চলচ্চিত্র মহলে। প্রযোজক এল ভি লক্ষ্মণ (এল ভি ফিল্মস) মুম্বইয়ে এসে ছবি করার প্রস্তাব দেন অসিত সেনকে। যদিও অসিত বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। তখন তিনি তাঁর তৃতীয় ছবি ‘জীবনতৃষ্ণা’র জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই ছবিরও নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল অরুন্ধতীদেবীর। ছবির গান রেকর্ড করার জন্য সুরকার ভূপেন হাজারিকাকে নিয়ে অসিত মুম্বই যান। সেই প্রথম তাঁর মুম্বই যাওয়া। অজানা এক শহরে অনেক ছোটাছুটি ও বিড়ম্বনার পরে যখন গান রেকর্ডিং শেষ হল, কলকাতা থেকে প্রযোজক খবর দিলেন কাউকে কিছু না জানিয়ে অরুন্ধতীদেবী বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে পাড়ি দিয়েছেন তপন সিংহর সঙ্গে। সে বছর (১৯৫৭) সপ্তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার পায়।

অসিত সেনের মাথায় বাজ পড়ে। অরুন্ধতীর এহেন আচরণ তাঁকে দুঃখ দিয়েছিল। শুটিংয়ের সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থায় দরকার হল একজন বিকল্প নায়িকার। তিনি সোজা পৌঁছে গেলেন সুচিত্রা সেনের বাড়ি। অনেক কথাবার্তার পরে সুচিত্রা ও উত্তমকুমারকে নিয়ে শুরু হল ‘জীবনতৃষ্ণা’র কাজ। আর অসিত পেয়ে গেলেন সারা জীবনের জন্য এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। অসিত জানিয়েছেন, এই ছবির কাজ করতে করতেই ‘দীপ জ্বেলে যাই’ এর ভাবনা তাঁর মাথায় আসে।

১৯৫৭ সালে ‘জোনাকির আলো’ নামে আরও একটি ছবি করেছিলেন অসিত সেন। অভিনয় করেছিলেন পাহাড়ী সান্যাল, অনুভা গুপ্ত, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনেতা। ছবির কাহিনি লিখেছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। অসিত সেনের কথায়, “জেনেশুনে সেই প্রথম আমার আর্ট ফিল্ম করা।” এই ছবির উদ্যোগকর্তা ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তখন বামপন্থী গণনাট্য সংঘের কর্মী। সন্ধে হলে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় যাঁরা গ্যাসের আলো জ্বালাতেন, তাঁদেরই একজনকে নিয়ে গল্প। বাণিজ্যিক ছবির জগতের সফল পরিচালক অসিত বলেছিলেন সত্যবাবুকে, “একটা ভাল ছবি করে দেব ঠিকই, কিন্তু ছবিটা কতটা পপুলার হবে বা সাকসেসফুল হবে, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।” তবে তাঁর এ-ও মনে হয়েছিল, “অন্তত একশো বছর এগিয়ে ছবি বানাচ্ছি।’’ সমালোচকরা প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু দর্শক নেননি।

এর পর ‘দীপ জ্বেলে যাই’। এ ছবিতে পরিচালকের মুনশিয়ানার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। অসিত সেন দাবি করেছেন, “আমি বলছি না যে আমি খুব বড় ডিরেক্টর। কিন্তু এ কথা বলব যে, সুচিত্রা সেনকে যথেষ্ট এক্সপ্লয়েট করেননি অন্য নির্দেশকরা। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ আজ ইতিহাস। সুচিত্রা সেনের কেরিয়ারের মোড়-ঘোরানো ছবি।” চেন্নাই শহরে শিবাজী গণেশনের ডাকে দেখা করতে গিয়ে অসিত সেন আবিষ্কার করেছিলেন শিবাজী তাঁর বাড়ির নিজস্ব প্রোজেকশন রুমে ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর একটি প্রিন্ট রেখে দিয়েছেন। রোজ ছবিটি তিনি দেখতেন। এটা ছিল তাঁর কাছে প্রত্যেক দিন গীতা পাঠের সমান।

‘দীপ জ্বেলে যাই’ এর পরে ‘স্বরলিপি’ ছবিতে হাত দেন অসিত সেন। এই ছবির একটি দৃশ্যের শুটিং করতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল মুম্বই। কলকাতা থেকে আসা পরিচালকের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিমল রায়। তিনি তাঁর নিজের ইউনিটের সদস্যদের এই ছবির জন্য কাজ করতে বলেছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। আর তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই অসিত খুঁজে পান তাঁর ভবিষ্যতের হিন্দি ছবির চিত্রগ্রাহক কমল বসুকে।

১৯৬১ ও ’৬২ এই দু’বছরে ‘স্বরলিপি’ (সৌমিত্র-সুপ্রিয়া), ‘স্বয়ম্বরা’ (সৌমিত্র-সুপ্রিয়া), ‘আগুন’ (সৌমিত্র-কণিকা), ‘তৃষ্ণা’ (বিশ্বজিৎ-জ্যোৎস্না) চারটি ছবি তৈরি করেন অসিত সেন। কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষ করার তা হল, উত্তমকুমারের অনুপস্থিতি। ‘জীবনতৃষ্ণা’র পরে আর কোনও ছবিতে স্টার উত্তমকে নিয়ে তিনি কেন ছবি করেননি, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বরং এই পর্বে পরপর তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজ করছেন। সে-ও কি দুই মানিকের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের কার্যকারণে ঘটেছিল?

অসিত সেনের সবচেয়ে সফল ছবি ‘উত্তর ফাল্গুনী’। আজও বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ছবিটি। নায়িকাপ্রধান এই ছবি সম্পর্কে অসিত সেনের উক্তি, “আমার প্রিয় সৃষ্টি ‘উত্তর ফাল্গুনী’ও এক অর্থে উত্তম-সুচিত্রা জুটিরই ছবি। সেখানে প্রযোজক উত্তমকুমার। উত্তম কোনও দিন ছবির নির্মাণে নাক গলাত না, ও কেবল চাইত সুচিত্রা যাতে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা পায় এই ছবিতে।” কিন্তু এমন সাফল্যের পর পরের ছবির জন্য তাঁর দরজায় কোনও প্রযোজক এসে দাঁড়াননি। কিছু দিন তিনি বারুইপুরে চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থেকেছেন।

বন্ধু সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অসিত সেন।

বন্ধু সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অসিত সেন।

১৯৬৫-’৬৬ সালে অনেক চেষ্টার পরে শুরু হয়েছিল ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র হিন্দি রূপান্তর ‘মমতা’ তৈরির প্রস্তুতি। প্রসঙ্গত, পরবর্তী কালে হিন্দি ছবির দুনিয়ায় কাজ করতে গিয়ে অসিত সেনকে বারবার তাঁর বাংলা ছবিরই হিন্দি সংস্করণ বানাতে হয়েছে। ‘মমতা’, ‘খামোশি’, ‘সফর’। ছবিগুলো দু’ভাষাতেই সফল হয়েছিল আর অসিত সেনকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছিল। তবে ‘মমতা’ তৈরি হয়েছিল কলকাতায়। সর্বভারতীয় স্তরে মুক্তি পাওয়া ও কলকাতায় তৈরি শেষ হিন্দি ছবি সম্ভবত এটিই। কলকাতার ইন্ডোর স্টুডিয়োতে বানানো প্রথম রঙিন ছবিও বটে। এর আগে ১৯৬২ সালে আউটডোরে বানানো প্রথম রঙিন বাংলা ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’।

অসিত সেনের প্রথম হিন্দি ছবি ‘মমতা’। এই ছবি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায়। এর পরে তাঁর মুম্বই যাত্রা অবশ্যম্ভাবী ছিল। সেখানে তিনি শুরু করেন আরও একটি অনবদ্য কাজ, ‘আনোখি রাত’। একটি প্রাসাদোপম বাড়ির হলঘরে সতেরোটি চরিত্র নিয়ে এক দুর্যোগের রাতের ঘটনা, যেখানে প্রেম, ভালবাসা, ডাকাতি, লোভ-লালসা, আত্মদান, ষড়যন্ত্র, মহানুভবতার সংঘাত জড়িয়ে আছে কাহিনির নানা স্তরে। অসিত ভেবেছিলেন, এই গল্প নিয়ে তিনি একটি ‘ডিরেক্টর’স ফিল্ম’ বানাবেন। বানিয়েছিলেনও তাই। একটি বড় ঘরের মধ্যে আবদ্ধ ক্যামেরাকে এমন মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন, যার জুড়ি ভারতীয় সিনেমায় নেই বললেই চলে। ছবি দেখতে দেখতে দর্শকের হলিউডে ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিডনি লুমেটের ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’ ছবির কথা মনে পড়তে পারে।

কথা ছিল এই ছবি শেষ করে তিনি ফিরে আসবেন কলকাতায়। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। প্রথম দিকে মুম্বইয়ে তাঁর আবাস বলতে ছিল প্রযোজকদের দেওয়া বিভিন্ন হোটেলের ঘর, যে ঘর ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত। প্রযোজক থেকে অভিনেতা, কলাকুশলী, গায়ক, সুরকার এমনকি অসিতের অপরিচিত হাজি মস্তানও এসে চুপ করে বসে থাকতেন সেই ঘরে। ছবির পর ছবি তৈরি করেছেন আর বদলে গিয়েছে হোটেল ও তার ঘর। অসিত যাকে বলতেন ‘সং-সার’। পরিবারহীন একজন সফল চলচ্চিত্রকারের একাকী জীবন।

ওই রকম এলোমেলো জীবনযাত্রার মধ্যেও ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৫ অবধি অসিত সেনকে পাওয়া যায় সৃষ্টির সবচেয়ে ঊর্বর মুহূর্তে। এই পর্বেই ‘সফর’ ছবির জন্য তিনি ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার পান। পুরস্কার হাতে বাড়ি ফিরে সংসারের একমাত্র সদস্য ‘কাজের লোক’-এর হাতে সেটা তুলে দেওয়ার পরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে তিনি সেটা সন্তর্পণে আলমারির নীচের তাকে রেখে দেন। ভেবেছিলেন, মহার্ঘ্য কোনও পানীয়ের বোতল। অসিত জানিয়েছেন, “সে দিন প্রথম রেখার জন্য কেঁদেছিলাম। ওই একবারই আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।”

ভারতীয় সিনেমাকে অসিত দিয়েছেন অবিস্মরণীয় কিছু গান। কী ভাবে তিনি সেই সব গান তৈরি করিয়ে নিতেন সুরকারদের দিয়ে তা শুনলে অবাক হতে হয়। ১৯৬৮ সালের ‘আনোখি রাত’ থেকে ১৯৮৩ সালের ‘মেহেন্দি’। মোট ১১টি ছবির (অসমাপ্ত ছবি ‘তেরি আরজু’ বাদে) মধ্যে ‘আনাড়ি’ অবধি যে অসিত সেন, তার থেকে ‘বৈরাগ’ পরবর্তী অসিত সেন একদমই অন্য এক মানুষ। ‘বৈরাগ’ ছবিটি যেন তাঁর নেমেসিস। বাণিজ্যিক সিনেমার অন্দরমহলের নানা জটিলতা, সংঘাত তাঁকে সামলাতে হয়েছিল আজীবন। তবু তিনি সফল হয়েছেন। কিন্তু ‘বৈরাগ’ ছবিতে এসে তিনি যেন ক্লান্ত, অবসন্ন। দিলীপকুমারের অতি উৎসাহ তাঁকে রিক্ত করে দিয়েছিল। ‘উকিলবাবু’ ছবির মধ্য দিয়েই বোধহয় শেষ একবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অবস্থা বদলায়নি।

আশির দশকে পৌঁছে মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগৎ থেকে তাঁর চেনা প্রযোজকদের আর খুঁজে পাচ্ছিলেন না অসিত। পুত্র পার্থ জানিয়েছেন, “বাবার হতাশা ক্রমশ বাড়ছিল। মদ্যপান করতেন খুব। আমি অনেকবার সামলেছি। বলতেন, ‘জানিস এরা আমাকে একজন ‘বেশ্যা’র মতো ব্যবহার করতে চায় এখন। সামান্য টাকা নিয়ে প্রযোজক হয়ে এরা পরিবেশকদের দোরে দোরে ঘুরে টাকা জোগাড় করে ছবি করতে আসে। সেই লগ্নিকারীদের মর্জি মতো ছবি আমাকে তৈরি করে দিতে বলে। আমি এই বেশ্যাবৃত্তি করতে পারব না।’”

মা ঊর্মিলার (বাঁ-দিকে) সঙ্গে স্ত্রী রেখা।

মা ঊর্মিলার (বাঁ-দিকে) সঙ্গে স্ত্রী রেখা।

কলকাতায় ফিরে অসিত সেন ‘প্রার্থনা’ (১৯৮৪) ও ‘প্রতিজ্ঞা’ (১৯৮৫) এই দুটো ছবি করেছিলেন। এর পর কলকাতা টেলিভিশনের জন্য টেলিফিল্ম ‘সওগাত’, ধারাবাহিকও তৈরি করেন। কিন্তু সে সবে পরিচিত অসিত সেনকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাঁর ছেড়ে যাওয়া সেই ষাটের দশকের স্বর্ণযুগের বাংলা টালিগঞ্জ পাড়ার আবহাওয়া আর ফিরে পাননি তিনি। জীবনের শেষ বছরগুলি তাঁর কেটেছিল একাকিত্বে আর হতাশায়।

জীবনে সায়াহ্নে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, “আজকের প্রজন্ম আমায় ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘চলাচল’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর অসিত সেন বলে চেনে। অথচ আমার সত্যিকারের ভাল ছবি হল ‘জোনাকির আলো’, ‘স্বয়ম্বরা’, ‘স্বরলিপি’, ‘পঞ্চতপা’। আজ প্রিন্ট নেই একটারও।” এক চলচ্চিত্রকারের হতাশাকে বুঝতে অসুবিধে হয় না।

২০০১-এর ২৫ অগস্ট লিভার ক্যানসারে বাংলা চলচ্চিত্রের আর এক মানিক অসিত সেন চলে যান।

কৃতজ্ঞতা : পার্থ সেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE