Advertisement
১১ মে ২০২৪

কারেন্ট কারেন্ট

তবে নুন-এ। বছর বছর ধরে যার আহ্লাদ ফুরোবার নয়। লিখছেন বুবুন চট্টোপাধ্যায়।ক্যান্ডি-বার্গারের ঠ্যালায় বাউন্ডারির বাইরে ঠেলাগাড়ির লাল-নীল শরবত, টিনের বাক্সোর চাপ-চাপ ঘুঘনি-আলুর দম। কিন্তু ‘কারেন্ট নুন’ যুগ যুগ জিও! জিভে দিলেই ওই যে চিড়িক চিড়িক, চিন চিন, চিট পিট— বছর বছর ধরে চলছে। কিন্তু চলবে কি? সে তো পরের কথা। আপাতত হাইটেক-কাসুন্দি ঘাঁটা ছেলেপুলেরাও যে কতটা ‘ক্রেজি’ এই কারেন্টে, নমুনা পাওয়া গেল দক্ষিণ কলকাতার নামী স্কুলের এক ছাত্রীর কাছে।

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০১:৩০
Share: Save:

ক্যান্ডি-বার্গারের ঠ্যালায় বাউন্ডারির বাইরে ঠেলাগাড়ির লাল-নীল শরবত, টিনের বাক্সোর চাপ-চাপ ঘুঘনি-আলুর দম।

কিন্তু ‘কারেন্ট নুন’ যুগ যুগ জিও!

জিভে দিলেই ওই যে চিড়িক চিড়িক, চিন চিন, চিট পিট— বছর বছর ধরে চলছে। কিন্তু চলবে কি?

সে তো পরের কথা।

আপাতত হাইটেক-কাসুন্দি ঘাঁটা ছেলেপুলেরাও যে কতটা ‘ক্রেজি’ এই কারেন্টে, নমুনা পাওয়া গেল দক্ষিণ কলকাতার নামী স্কুলের এক ছাত্রীর কাছে।

মৌলী বিশ্বাস। ক্লাস সেভেন। বাবার চাকরির সুবাদে সামনের মাসেই পাড়ি দিচ্ছে মার্কিন মুলুক। যাওয়ার আগে তার ঝুলোঝুলি শুরু হয়েছে বাবা-মায়ের কাছে— স্কুলের সামনে হজমিওয়ালার থেকে অন্তত কিলোখানেক ‘কারেন্ট’ সে নিয়ে যাবেই!

কথাটা শুনে ফোনেই হেসে ফেললেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সেই কোন কালে ছেড়েছেন বরানগরের ভিক্টোরিয়া মর্নিং স্কুল।

এখনও তাঁর চোখে ভাসে খেটো ধুতি, ফতুয়া, কাঁচা-পাকা চুলের হজমি-কাকুকে। বাঁশের দুটো চোঙার সরু মুখটা পেটের কাছে জোড়া। খোলা মুখের এক দিকটা মাটিতে। অন্যটা ওপরে। ওটাই স্যান্ড। তার ওপরে বসানো কাঠের খোলা ট্রে। যেখানে পাশাপাশি সাজানো যাবতীয় মণিমুক্তো— কাচের বয়ামে— বুনো কুল, আমসি, ফালি আমড়া। আর একটুকুনি প্যাকেটে মোড়া গাঢ় খয়েরি হজমি! পালে পালে পড়ুয়া তাকে ঘিরে। এক হাতে নিচ্ছে কোনও এক মহার্ঘ মণি, তো অন্য হাতে ‘ফাউ’— কারেন্ট! কালচে গুঁড়ো নুন— কোনও বাজারে মিলবে না, পাওয়ার ঠিকানা ওই একটাই।— স্কুল-গেট। সে পাড়ার কমলাসুন্দরী গার্লসই হোক, কি অমুক বয়েজ, তমুক মিশনারি।

‘‘তবে স্বাদ বোধ হয় একটু বদলেছে। আর, আমাদের সময় এক রকমের গুলি হজমি পাওয়া যেত, সেটা আর দেখি না। এক টাকায় দশটা! মুখে দিলেই পুরো আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড হয়ে যেতাম’’, বলছিলেন নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়।

স্বাদ বদলেছে? তার মানে, এখনও তিনি এ রসে বঞ্চিত নন! জানতে চাইলে কর্তা সৌরভের মতো স্ট্রেট ড্রাইভ, ‘‘ইয়েসস, অফকোর্স!’’ মেয়েকে স্কুলে আনতে গেলে আজও মাঝেমধ্যেই বিটনুন আর কারেন্ট দেওয়া কুল কিনে দিব্যি স্বাদ নেন ডোনা।

আর কর্তা? উত্তর এল, ‘‘হ্যাঁ-এ-এ। আর এখনও যখন খায়, সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ার সময়ও নিশ্চয়ই খেত।’’

ঋদ্ধি সেনকে ফোনে ধরা গেল। ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’-এর ফোয়ারা। ওর জবাব অনেকটা এক নামী বিস্কুটের বি়জ্ঞাপনের মতো—‘‘আমি তো এমনি এমনিই খাই।’’ তবে ঋদ্ধির সবচেয়ে পছন্দ ওর পেয়ারের হজমি দাদুর ‘টক-টক-ঝাল-ঝাল-মিষ্টি-মিষ্টি’ রোদে পোড়া আমলকী।

‘‘বাবা-মা কত ভয় দেখাত, ও সব কাঠের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি, কে শোনে কার কথা, প্রথম-প্রথম ভয় পেয়ে বাড়িতে তৈরির চেষ্টা করতাম, তেঁতুল শুকিয়ে, বিটনুন দিয়ে বেটে। কোথায় কী! তারপর ভাবলাম, ধুস,’’ বললেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই শৈবাল নাগ।

শৈবাল স্কুলবেলায় প়ড়তেন উত্তর কলকাতায়, ‘‘আরে আমার তো প্রথম প্রেম ওই কারেন্ট খেতে খেতেই। স্কুল যাতায়াতের পথে বিডন স্ট্রিটে সৌমী যে স্কুলে পড়ত, সেখানেই খাওয়ার নেশাটা বেশি ছিল। তখনই আলাপ। অনেক দিন চলেও ছিল সে-প্রেম। পরে অবশ্য...,’’ বলছিলেন শৈবাল। সৌমী এখন কানাডায়। কিন্তু ফেসবুকে প্রায়ই ‘চ্যাট’ হয় আগডুম-বাগডুম। তার প্রথম দিনে ওই কারেন্ট-এর কথা উঠেছিল।

ষাটের দশকের শেষাশেষি ছেড়ে এসেছেন ইউনাইটেড মিশনারি স্কুল। কিন্তু বন্ধুরা মিলে বছরখানেক আগে ঠিক করেছিলেন কিশোরী বেলায় ফিরে যাবেন। সেই মতো সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য এক পুজোয় প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ঘুরতে ঘুরতে আইসক্রিম খেয়েছেন। বেলুন, ভেঁপু কিনেছেন।

শেষে হজমিওয়ালার কাছে দাঁড়িয়ে সেই কবেকার ‘কারেন্ট’-এর স্বাদ নিতে যাবেন, হঠাৎ যা-তা! মানে? বললেন, ‘‘আরে কী কাণ্ড, কোত্থেকে এক মহিলা কাছে এসে বললেন, ‘আপনি সুচিত্রা ভট্টাচার্য, না?’ ব্যস, টকাস করে শব্দটাও গিলে ফেলতে হল।’’

মধ্য কলকাতায় লরেটো স্কুলের সামনে বছর কুড়ি ধরে হজমি ফিরি করে চলেছেন মহসিন। ছুটির সময় উনি আজও যে ভাবে ‘মবড’ হন, তা যে কোনও টলিউডি স্টারকে পাল্লা দেবে। মহসিনের বাঁধা কাস্টমার যেমন স্কুলের ছাত্রীরা, তেমন তাঁদের মায়েরাও। দিন গেলে মহসিনের রোজগার শুনলেও ‘কারেন্ট’ খেতে হয়— ন’শো থেকে এক হাজার টাকা! কিন্তু হাজার জিজ্ঞেস করলেও তিনি রেসিপি বলতে নারাজ। সে অবশ্য মহসিন কেন, সব হজমিকাকু-দাদুদের কাছেই ‘টপ সিক্রেট’!

‘‘তবে একটা জিনিস দেখবেন, মেয়েদের স্কুলের সামনে হজমিওয়ালারা বোধ হয় তুলনায় বেশি রোজগেরে,’’ মেয়েকে মধ্য কলকাতার এক ইংরেজি মিডিয়াম থেকে আনতে এসে বলছিলেন পরমা সেন।

কথাটা মেনে নিলেন রানি বিড়লা কলেজের অধ্যক্ষা সুনেতা সিংহ, ‘‘ছেলেরা চিরকালই ততটা ফ্যান্সি খাবারের ভক্ত নয়। ওরা একটু পেটভরা খেতে পছন্দ করে,’’ এ ব্যাপারে স়়ঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আরেকটু মেয়েদের দিকে হেলে, ‘‘আরে ছেলেদের আবার রুচি আছে নাকি, হজমির স্বাদ ওরা বুঝবে কী!’’

এ শহরে বেশ কয়েকটা কলেজের সামনে ঘুরে কিন্তু কোনও হজমিওয়ালার দেখা পাওয়া গেল না। প্রশ্ন করায় জি ডি বিড়লা কলেজের অধ্যাপিকা কেয়া ঘোষ বললেন, ‘‘হজমি-টজমির মধ্যে একটু ছেলেমানুষি ব্যাপার আছে। তাই বোধ হয়...।’’ ইগো? হতে পারে!

শৈবালবাবুর কাছে ব্যাপারটা পাড়তে আকাশ থেকে পড়লেন। ওঁর পড়াশোনার শেষ ‘ল্যাপ’টা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিক্স বিভাগে। অর্থাৎ, বিটি রোডের ধারে। কাটাকলে।

তখন শৈবাল থাকতেন নাগের বাজার, ‘‘কাটাকল থেকে বাড়িতে ফেরার একটাই বাস ছিল। এস টয়েন্টি ওয়ান। একটা মিস করলে অন্যটা পেতে কম করে চল্লিশ মিনিট। ততক্ষণ ওই কারেন্ট খাওয়া চলতই। কলেজের গলিটার মুখে বাস স্ট্যান্ডে যে হজমিওয়ালা দাঁড়াতেন, তার তো বাম্পার সেল ছিল।’’

কিছু দিন আগে বিটি রোড ধরে যেতে যেতে কাটাকল বাস স্টপে তাকিয়ে দেখলাম, নাহ্ কোনও ‘কারেন্ট’ নেই তো!

মনে মনে ভাবলাম, হয়তো সাময়িক লোডশেডিং চলছে, একটু বাদেই...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE