ছোটবেলার কথা মনে আছে? শীত পড়তে না পড়তেই লেপ কম্বলের সঙ্গেই বেরোত তেলের বাটি আর ছাদে রোদ পোহানোর দিনগুলোও। আজকের রোজকার ব্যস্ততায় না আছে রোদ, না আছে সময়। সকাল থেকে স্কুল-কলেজ, টিউশন, নয়তো অফিসে ঢুকে এসির শীতল বাতাস। আসতে-যেতে যেটুকু বা রোদ গায়ে লাগে, তাও দামি সানস্ক্রিনে ঢাকা। ফলে ত্বক কিছু বাঁচল বটে, কিন্তু আরও বড় কিছু হারাচ্ছি না তো!
সকালে উঠেই গা ম্যাজম্যাজ, ক্লান্তি থেকে শুরু করে হাতে পায়ের পেশিতে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা, হঠাৎ হঠাৎ মুড পরিবর্তন। কৈশোরের কোঠা পেরোতে না পেরোতেই ভিড় করে আসছে এমন রকমারি সমস্যা। সমাধান কিন্তু সেই সূর্যের আলো অর্থাৎ কিনা ভিটামিন ডি। আসলে এই ভিটামিনটি শরীরে নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে এটির অভাব হলে কেবল মাত্র হাড় ক্ষয়ে যাওয়া বা ব্যথা-বেদনা নয়, তৈরি হতে পারে আরও বড় সমস্যা। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পেশি নাড়াচাড়া করতেও প্রয়োজন হয় এটির। এমনকী এর সাহায্য ছাড়া মস্তিষ্ক থেকে সারা শরীরে বার্তা পর্যন্ত পাঠাতে পারে না স্নায়ু। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এই ভিটামিনটি ছাড়া ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসদের প্রতিহত করা দুঃসাধ্য।
জানেন কি, একমাত্র এই ভিটামিনটিই মানুষের শরীরে নিজে নিজে তৈরি হতে সক্ষম! ছোট থেকে জেনেছি, ক্যালসিয়ামের গুণেই মজবুত হয় দাঁত ও হাড়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিটামিন ‘ডি’ ঠিক মতো তৈরি না হলে ক্যালসিয়াম কাজ করতে পারে না। ফলে থাবা বসায় ছোটদের রিকেট থেকে শুরু করে বড়দের অস্টিওম্যালশিয়া, অস্টিওপোরেসিস প্রভৃতি নানাবিধ রোগ। অনেক সময় কোলন ক্যানসার, স্তন বা প্রস্টেট ক্যানসারের মতো মারণ রোগ প্রতিরোধেও কাজ করে এই প্রয়োজনীয় ভিটামিনটি।
কী করে বুঝবেন শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-র ঘাটতি হচ্ছে?
ক্লান্তি, যথেষ্ট ঘুমের পরেও ঘুমঘুম ভাব, হাড় বা পেশিতে ব্যথা। টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ, দাঁতের ক্ষয় ও নানা সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত বা ইনসমনিয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ডিপ্রেশন— এ সবই কিন্তু হতে পারে ভিটামিন ‘ডি’-র অভাবজনিত লক্ষণ।
আসুন জেনে নিই, কোন বয়সে শরীরে কতখানি ভিটামিন ‘ডি’ প্রয়োজন। ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বোর্ড (জাতীয় বিশেষজ্ঞদের একটি দল) আন্তর্জাতিক এককে (IU) মেপে দিয়েছে সেই সীমা।
• জন্ম থেকে ১২ মাস : ৪০০ IU
• ১ থেকে ১৩ বছর : ৬০০ IU
• ১৪ থেকে ১৮ বছর : ৬০০ IU
• ১৯ থেকে ৭০ : ৬০০ IU
• তার ঊর্ধ্বে: ৮০০ IU
• গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী তরুণী ও মহিলারা : ৬০০ IU
বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ মানুষকেই পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, কোনও না কোনও উপাদানের ঘাটতিতে তিনি ভুগছেন। তার অন্যতম কারণ ভেজালের যুগ। তবু সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ‘ডি’-র অভাবে ভোগে শিশুরা। অনেক সময় বাড়ন্ত বাচ্চারাও এই ঘাটতির শিকার হয়। এর পরেই রয়েছে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলারা। ষাট বছর বয়সের পরে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে শরীরে এ সময় ভিটামিন ‘ডি’-র ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়। আর যাঁরা বেশি ত্বকের যত্নের ঠেলায় শরীরে রোদ লাগান না, ঘাটতির শিকার হচ্ছেন তাঁরাও।
মোদ্দা কথা হল, রোদ থেকে পাওয়া ভিটামিন ‘ডি’-র কোনও বিকল্প নেই। তবে এমন বেশ কিছু খাবারদাবার রয়েছে, যা খেলে শরীরে কিছুটা হলেও ভিটামিন ‘ডি’-র অভাব পূরণ হয়।
কী কী খাব
তৈলাক্ত মাছ যেমন স্যামন, টুনা, ম্যাকারেল জাতীয় সামুদ্রিক মাছ। কড লিভার অয়েল, এই ধরনের প্রাণিজ খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে। মাটন, ডিমের সাদা অংশ, মাশরুম, দুধ, ছানা, মাখন থেকে শুরু করে দুগ্ধজাত খাবারেও কিছু ভিটামিন ‘ডি’ থাকে।
কিছু বেবি ফুডেও বাইরে থেকে আলাদা করে ভিটামিন ‘ডি’ যোগ করা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি পূরণে সক্ষম সেগুলিও।
তা ছাড়া বাজারে কিছু ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্টও পাওয়া যায়। তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ না করে সেগুলি নৈব নৈব চ।
তার চেয়ে বরং আসুন, সূর্যের আলোর কাছে যাই। রোজকার যাপনে আসুন না, কিছুটা সময় রোদ্দুর মাখি। গবেষণা বলছে, এসপিএফ ১৫ বা তার বেশি এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ত্বকে ভিটামিন ডি৩ উত্পাদন ৯৯% কমিয়ে দিতে পারে। সানবেদিং-এর প্রয়োজন নেই। তবে কিছু সময় হাত-পা না ঢাকা অবস্থায় রোদে থাকা ভাল। তার মানে এই নয়, জৈষ্ঠ্যের ঠা ঠা রোদ্দুরে ঠায় দাঁড়িয়ে সানস্ট্রোক বাধাবেন! বরং মেকআপ-সানস্ক্রিনের পর্দা সরিয়ে রোদ মাখুন না গায়ে। অতিরিক্ত তাপের হাত থেকে বাঁচবেন ঠিক কথা, কিন্তু শুধু ট্যান পড়ার ভয়ে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে থাকবেন না। তাই চন্দ্রবিন্দু যতই বলুক, মাঝেমধ্যে সূর্যের দিকে চাইলে শরীর-মন দুইয়েই কিন্তু ঝিলমিল লাগতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy