এন্ট্রি ৫
আমরা তখন থাকতাম লেক গার্ডেন্সে। ফোন ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ সন্ধেবেলায় গিয়ে দাঁড়াতাম সুভাষদার কাছে। সুভাষদা তখন একটা ছোট টাইপরাইটারে একটা করে লাইন লিখতেন, তার পর সেটাকে টাইপরাইটার থেকে খুলে গোল্লা করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলতেন। সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকত, উড়ে বেড়াত গোলা পাকানো লাইন। বিড়াল গোলাগুলো নিয়ে খেলে বেড়াত। সে কথাও তাঁর কবিতায় আছে। গীতাদি (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মজা করে হাসতে হাসতে বলতেন— ‘‘এই দ্যাখো, তোমাদের সুভাষদা গড়াগড়ি খাচ্ছেন।’’ বহু দিন কোনও কথা না বলে বসে থেকেছি। কথা প্রায় বলতেনই না। তাঁর উপর নেমে আসা খড়্গ আমি দেখতে পেতাম। তিনি নিজের মুখে কোনও দিন বলেননি।
এন্ট্রি ৬
নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে সে বার গিয়েছি। ওঁরা বললেন, ভারতবিখ্যাত এক জন বাঙালি কবিকে আমরা ডেকেছি, সঙ্গে এক জন নবীন কবি। সুভাষদার সঙ্গে আমাকে ডাকার কোনও কারণ ছিল না। কিংবা একটা কারণ ছিল বটে। সে সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ‘রূপম’। কবিতাটি ফোটোকপি করে হস্টেলের দরজায় দরজায় টাঙানো হয়েছিল। সেই গল্প ছাত্র আর মাস্টারমশাইদের মুখে শুনে মনে হল, এ জন্যই আমায় ডেকেছে।
দুপুরবেলা সুভাষদা কবিতা পড়তে শুরু করলেন। কী সব কবিতা! পাগল বাবর আলির চোখের মতো আকাশ (সালেমানের মা), মিছিলের মুখ, কুকুরের মাংস কুকুর খায় না, ভেঙো নাকো শুধু ভাঙা নয়, ফুল ফুটুক না ফুটুক, ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমি যত দূরেই যাই, ঘোড়ার চাল (ঘোড়াগুলো বাঘের মতো খেলছে), ছেলে গেছে বনে, কাল মধুমাস (ওঁর দীর্ঘতম কবিতা)। প্রতিটা কবিতাই ইতিহাস! সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। জানালার শিক ধরে ছেলেমেয়েরা কবিতা শুনছিল। এক-একটা লাইন বলছিলেন আর চাপা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল হলঘর। আর আমি ভাবছিলাম, এর পরে আমাকে কবিতা পড়তে হবে, ধরণী দ্বিধা হও! কিন্তু বাংলা কবিতার অভিভাবক অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার, সে দিনের সভাপতি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন সাহস দিয়ে, স্নেহ দিয়ে। রাতের বেলায় গেস্ট হাউসে সুভাষদার সঙ্গে কত গল্প! আমি প্রথমেই বললাম, আপনি বাসে চড়ে ৩৭ নম্বরে মস্কো যেতেন? একটু হাসলেন। ‘‘হ্যাঁ, আমি একটু বেশি বেশি মস্কো গিয়েছি। তবে শোনো— তোমরা নতুন এসেছ, তোমাদের বলি। রাশিয়াতে চুরি হত, ডাকাতি হত, ধর্ষণ হত। আমি সেগুলো লিখতে পারিনি, আমাকে লিখতে দেয়নি ওরা।’’ আমি বললাম, কারা দেয়নি? ‘‘এই আমাদের পাড়ার স্তালিনগুলো। তবে শোনো, রাশিয়ার একটা জিনিস খুব ভাল। তার নাম ভদকা। লেক মার্কেট থেকে আমি ছোট ছোট আলু কিনি। কম দাম। মার্বেলের মতো ছোট। ওগুলো সেদ্ধ করে নুন-মরিচ দিয়ে খেতে খুব ভাল লাগে। সঙ্গে একটু ভদকা। তোমাকে ফিরে গিয়ে বলব।’’ আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম— পরেন একটা ফতুয়া, প্রিয় খাবার আলুসেদ্ধ, পায়ে একটা চপ্পল, লেখেন দুটো কবিতা, ঘুমোন একটা চৌকিতে। অথচ এত আয়োজনহীন একটা মানুষ— তাঁকেও কিনা শুনতে হচ্ছে মদ-মেয়েমানুষের বদনাম!
উত্তরবঙ্গের ওই অসাধারণ আড্ডায় এক বারও কারও নামে নিন্দে করেননি। ‘পাড়ার স্তালিন’রা তাঁকে ছিঁড়ে খাচ্ছে তখন। তবুও মুখ খোলেননি। দুটো ছোট আক্ষেপ তিনি করেছিলেন অবশ্য, ‘‘শক্তিকে (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) বলেছিলাম, ‘শক্তি, অনেক দিন বাঁচতে হবে, না হলে জ্ঞানপীঠ পাবে না।’ শক্তি আমার কথা শোনেনি।’’ ওঁর দ্বিতীয় আক্ষেপটি বড় তিক্তমধুর, ‘‘নীরেনের (কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) কবিতা আমার খুব ভাল লাগে, সেটা আমি কাউকে বলতে পারিনি। বললে ওরা আমার দিকে খারাপ চোখে তাকাত।’’