ছবি: তপন দাস
সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে’র অনুষ্ঠান।
কলকাতা তো ফেটে পড়েছেই, ফ্লাইট ধরে-টরে শ্রোতা এসেছেন আমেদাবাদ, সুরাট, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, কোথা থেকে নয়!
বাংলাদেশ থেকেও ফোন আসছে উদ্যোক্তাদের কাছে। ওঁরা নাকি ভিসা, প্লেনে যাতায়াতের টিকিট সব করে ফেলেছেন। দরকারে দাঁড়িয়ে, এমনকী মাটিতে বসেও গান শুনতে চান। এত ক্রেজ সেবার! আমরা জনা চারেক গান-বন্ধু সব কাজ ফেলে গেছি শুনতে। ভিআইপি গ্রিনরুমের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।
একটু বাদেই সন্ধ্যাদি এলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। আমাদের দেখামাত্র ওঁর মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। কোনও কথা না বলে হনহন করে চলে গেলেন গ্রিনরুমের দিকে। আমরা তো হাঁ! কী হল রে বাবা! ইতস্তত করেও পিছু নিলাম। ঘরে ঢুকতেই প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বললেন, ‘‘কী করছ তোমরা, অ্যাঁ?’’
আমরা তো হাঁ! কী করছি, মানেটা কী! দিদি বলে চললেন, ‘‘এক্ষুনি একটা লোক-হাসানো ব্যাপার হবে, আর তোমরা দেখতে এসেছ?’’
এবারে হেসে ফেললাম। ততক্ষণে যে বুঝে গিয়েছি, কেন অমন করছেন! অনুষ্ঠানের আগে মারাত্মক টেনশনে ভোগা ওঁর স্বভাব। তাই বেশি না ঘাঁটিয়ে চুপচাপ সরে পড়লাম।
ফার্স্ট হাফে গাইতে বসলেন দিদি। দুর্ধর্ষ গাইলেন। দেখা করতে গেলাম, তখন দেখি রিল্যাক্সড। টিফিন কৌটো থেকে চিঁড়ের পোলাও খাচ্ছেন। হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘‘কী মনে হল, ভালই হয়েছে, না?’’ শিশুর সারল্যমাখা মুখের দিকে তখন তাকিয়ে থাকা দায়! বললাম, ‘‘নইলে কি আর খাবারটা মুখে তুলতে পারতেন!’’
শুনে আবার সেই হাসিটা!
আরও পড়ুন: জীর্ণশীর্ণ ভাবে ধরা দিতে ঘুম নেই গৌতম ঘোষের
গানজগতে তো মানুষ কম দেখিনি, কিন্তু এত আপনজন আর কে আছেন! ওই মাপের একজন মানুষ, অথচ যেচে আলাপ করেছিলেন নিজের থেকে।
সালটা ১৯৯৯ কি ২০০০। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের একটা অনুষ্ঠানে গাইলাম। দূরদর্শন অনুষ্ঠানটা রেকর্ড করেছিল। মাঝে মাঝেই সেটা সম্প্রচারও করত। এখনও করে।
আমি তখন সেলিমপুরে থাকি। সময়টা মোবাইল-যুগ শুরুর আগে। বাড়িতে ল্যান্ডলাইন সম্বল। সাতসকালে ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। তুলতেই ওপারে একটা শান্ত সুরেলা গলা।
‘‘হ্যালো, শ্রীকান্ত বলছ?’’
‘‘বলছি। আপনি?’’
‘‘আমি লেক গার্ডেন্স থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলছি।’’
‘লেক গার্ডেন্স’ শব্দটায় জোর দিয়ে বললেন। যেন ওটা না বললে ওঁকে চেনা যাবে না! আমার জন্ম, বড় হওয়া অনেকটাই লেক গার্ডেন্সে। বাঙ্গুর পার্কে খেলতাম। পোস্ট অফিসের পাশে দিদিদের বাড়ি। কিন্তু ফোন পেয়ে সব বুঝেও যেন বুঝছি না। দু’তিন সেকেন্ড পুরো ধাঁ মেরে গেলাম। ঠিক শুনছি তো! ওদিক থেকে এবার ভেসে এল, ‘‘ব্যস্ত নাকি? বিরক্ত করলাম?’’
আর ব্যস্ত! ভয়ে সিঁটিয়ে গেছি। শুধু বুঝলাম, দূরদর্শনে আমার গোলপার্কের অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংটা দেখে ফোন করছেন। মিনিট কয়েক হুঁ-হাঁ করে উল্টোপাল্টা কী যে বলেছিলাম, মনে নেই।
সেই আমার প্রথম কথা বলা দিদির সঙ্গে। পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করেছি, তার এক-দু’মাস পর। গায়ক-শিল্পীদের সংস্থা ‘অ্যাপস্’-এর একটা অনুষ্ঠানে অ্যাম্বুলেন্স বার করা হল। তখন দিদি এসেছিলেন। প্রণাম করলাম। উনি গাল টিপে আদর করলেন আমায়। কেউ একজন তার ছবিও তুলেছিল! বাড়ি বদলের সময় কোথায় যে গেল ছবিটা!
ওঁর বাড়িতে প্রথম যাই তারও পরে। এক দাদাস্থানীয় পরিচিত মানুষ স্বপনদার সঙ্গে। সঙ্গে গৌতমদাও ছিলেন, যিনি কিশোরকুমারের গান করে বিখ্যাত। গিয়ে দেখি, দিদি স্পন্ডেলাইসিসের ব্যথায় কাবু।
আমরা তো গিয়েই উঠব-উঠব করছি। সে হবে না। নিজে হাতে চা এনে দিলেন। প্রচুর স্ন্যাক্স। সবটা খেতেই হল। ওঁর এই আতিথেয়তার কথা কম শুনিনি! তাই অবাক হলাম না তেমন। তার মাঝেই গৌতমদাকে বললেন, ‘‘তুমি কী করো?’’ গৌতমদা দু’হাতে নিজের কান ধরে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘‘মানে, ইয়ে কিশোরকুমারের গান করি।’’
তাতে এক ধমক, ‘‘অমন করে বলছ কেন? ওটা কি খারাপ কাজ?’’
গৌতমদা এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে, বসে বসেই জ্বর এসে গেল ওর। দিদি একটু বাইরে যেতে আমায় বলল, ‘‘দ্যাখ তো, কপালে হাত দিয়ে!’’ ঠিক তখনই দিদি ফিরছেন ঘরে। দেখেই বললেন, ‘‘এ কী, তোমার জ্বর এল নাকি।’’
সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পরিচারিকাকে ডেকে পাঠালেন। গরম জল বসাতে বললেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা আনালেন। তার থেকে ওষুধ বার করে গরম জলে গুলে কাপটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘একটু একটু করে খাও। বাড়ি গিয়ে শুয়ে প’ড়ো।’’
এই হল দিদি। বলছিলাম না, মায়ের মতো লাগে মাঝে মাঝে। এত কেয়ারিং! তা’ও আবার এক-আধজনের জন্য নয়, সবার জন্য। ফোনেই যে কতবার কত কিছু বলেছেন।— ‘‘অ্যাই শোনো, একদম চোখে বুজে গান করবে না তো। চোখ খুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গান প্র্যাকটিস করবে। আর বেশি কথা বলবে না। জোরে তো নয়ই। চিৎকার-চেঁচামেচি কখনওই না। বুঝলে? ফোনেও বেশি কথা নয়। রেকর্ডিং-এর দিন ফোন? রাখো এক্ষুনি! আচ্ছা, তুমি ইংরিজি গান শোনো?’’ বলে দু’কলি হয়তো গান শুনিয়েও দিলেন। একদম পশ্চিমি গায়কিতে! যদ্দুর মনে পড়ে, একবার ফ্র্যাঙ্কি লেন-এর বিখ্যাত একটা গান শুনিয়েছিলেন, ‘রোজ্ রোজ্ আই লভ ইউ...’। খুব বলেন, ‘‘শোনো, পারতপক্ষে অন্যের গানের বিচারক হয়ো না।’’ আমি প্রায় অন্ধের মতো ওঁকে মেনে চলি।
আর ওঁর সিনসিয়ারিটি! ভাবা যায় না। কল্যাণদার (সেনবরাট) কাছে গল্প শুনেছি। কল্যাণদা একটা গান শিখিয়েছেন ওঁকে। রেকর্ডিং হবে। হঠাৎ তারই মাঝে দিদির তলব ফোনে।— ‘‘একবার আসবে? আমি না, ঠিক তোমার মতো পারছি না।’’
কল্যাণদা গেলেন, দিদিকে নিয়ে আবার গাইতে বসলেন, দিদি শুধু ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুনে গেলেন। গানের কাঠামোয় যেন মাটি লেপে লেপে মূর্তি গড়লেন কল্যাণদার ওই ভাবটুকু দেখে!
যে দিন প্রথম একা গিয়েছিলাম, সে এক অভিজ্ঞতা। এমনিতে দিদির বাড়ি ঢুকলেই একটা অদ্ভুত ফিলিং হয়। কেমন যেন আরাম বোধ হয় ভেতরে-ভেতরে। এমনিতে এত পরিপাটি বাড়িও আমি খুব কম দেখেছি। সব জায়গা তকতক করছে। অথচ বাহুল্য নেই কোনওখানে!
সে দিন গিয়ে দেখি, শ্যামলদা (গুপ্ত) টিভি দেখছেন। দিদি হঠাৎ বললেন, ‘‘ফুল ভালবাসো?’’ শ্যামলদা বললেন, ‘‘ওকে ছাদে নিয়ে যাও না!’’ গেলাম ছাদে। রেলিং বরাবর ফুলের টব। নিখুঁত যত্নে রাখা। একটা জুঁই ফুল হাতে নিয়ে কলাবতীর পাতায় মুড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘মুঠোয় রাখো এটা, ভাল্লাগবে।’’
সন্ধে নামছে। আকাশে হালকা মেঘ। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। একটু বাদে শুনি দিদি গুনগুন করছেন—‘‘জানি না ফুরাবে কবে, এই পথ চাওয়া...!’’ আমার গায়ে কাঁটা দিল। শিরশির করে উঠল সারা শরীর। গান থামল। বিড়বিড় করে বললাম, ‘‘গানে মোর ইন্দ্রধনু-টা যদি...!’’ ধরলেন। মনে হচ্ছিল, অবিশ্বাস্য স্বপ্নঘোরের মধ্য দিয়ে হাঁটছি! ভুপালিতে একটা তারানা করলেন। তান সরগম-ও। বললেন, ‘‘গলা দাও না।’’ আমি তো ক্লাসিকাল জানি না! সেটা বলতেই বললেন, ‘‘তবুও গাও।’’ এক সময় দেখি, পাশের বাড়িটায় পট পট করে জানালা খুলছে। কালো কালো ছায়া নড়ছে। থেমে গেলেন দিদি।
‘‘ক’টা বাজে বলো তো?’’
‘‘পৌনে ন’টা।’’
‘‘চলো, নীচে যাই, তোমার দাদার খাওয়ার সময় হয়েছে, লোকজনও কী ভাবছে, ছাদে গান করছি, এবার পাগল ঠাওরাবে।’’
সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়।
দিদির সঙ্গে ‘ডুয়েট’ গাওয়া, সে’ও কি কম! হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। ২০০৪ সাল। কী যে ঝামেলায় পড়েছিলাম প্রতীকের (চৌধুরী) জোরাজুরিতে! মহালয়ার আগের দিন। সায়েন্স সিটি। দিদি নিজে ক’টা গানের পর স্টেজে ডেকে নিলেন।
হাঁটু খুলে যাওয়ার জোগাড়। আঙুল স্টিফ হয়ে যাচ্ছিল। হারমোনিয়ামই বাজাতে পারব না, তো গান! দিদির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইলাম। উনি এমন একটা হাসি দিলেন, সেটাই যেন মহৌষধির কাজ করল! নিমেষে ভয়ডর সব হাওয়া, মনের খুশিতে গাইতে বসলাম।
ওই জ্বলজ্বলে হাসিখুশি মানুষটাকে একদিন খুব কাঁদতেও দেখেছি। অঝোরে। টানা। পিন্টুদার (ভট্টাচার্য) শ্রাদ্ধবাসর। দিদি এলেন সাদা একটা শাড়ি পরে। শনের মতো চুল ঈষৎ এলোমেলো। চোখমুখে শোকের চাপ চাপ দাগ। পিন্টুদার ছবির সামনে গিয়ে বসলেন। মিনিট কুড়ি ছিলেন। যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ ওঁর চোখ উপচে গেল শুধু জলে। কেঁদেই গেলেন সারাক্ষণ।
ওঁকে দেখে আমরাও নিজেদের সামলাতে পারিনি সেদিন।
অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy