Advertisement
১১ নভেম্বর ২০২৪

সুবর্ণজয়ন্তীতে সোনালি রেখা দেখা গেল না

ন’জনই বর্ষীয়ান শিল্পী, দু’জন প্রয়াত। পুস্তিকায় বিপুলকান্তি সাহার জন্মসাল উল্লিখিত হলেও প্রয়াণের সাল-তারিখ নেই কোথাও। বিপুলের ড্রয়িংগুলিও ভাস্কর্যের খসড়া।

কল্পনাময়: পেন্টার্স অর্কেস্ট্রার আয়োজিত প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজ

কল্পনাময়: পেন্টার্স অর্কেস্ট্রার আয়োজিত প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজ

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:২৪
Share: Save:

পঞ্চাশ বছর ধরে পথ চলা কম কথা নয়। প্রথম প্রদর্শনী ’৬৮-তে। তখন নাম ছিল গ্রুপ অফ আর্টিস্ট। ’৭৫ সালে পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা নাম দেন প্রয়াত ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত। দলের পঞ্চাশ বছরের প্রদর্শনীটি সম্প্রতি শেষ হল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। অর্কেস্ট্রা যতটুকু বেজেছে, সবটাই পেন্টার্সরা বাজাননি। দু’এক জন স্কাল্পটরের ছেনি-বাটালির অনুরণনও শোনা গিয়েছে। এত চিত্র-ভাস্কর্যের বাছবিচার শিল্পীরা সে ভাবে করেননি। মান যাচাই করার চেষ্টা অবশ্যই থাকা উচিত ছিল।

ন’জনই বর্ষীয়ান শিল্পী, দু’জন প্রয়াত। পুস্তিকায় বিপুলকান্তি সাহার জন্মসাল উল্লিখিত হলেও প্রয়াণের সাল-তারিখ নেই কোথাও। বিপুলের ড্রয়িংগুলিও ভাস্কর্যের খসড়া। একটি মাত্র ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে ছিল, অদ্ভুত মুখ। হুবহু বিন্দুবাদীদের মতো না হলেও, অনেকটা ওই স্টাইলে এবং অনন্য জ্যামিতিতে ’৮৯ সালে অমিত রায় সুন্দর কাজ করেছেন। ২০১৮-য় উল্লম্ব, আনুভূমিক ও সমান্তরাল ফর্মে এবং সমতল উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে ‘নিয়োপ্ল্যাস্টোনিজ়ম’ নামে যে ক’টি কম্পিউটার গ্রাফিক্স করেছেন, তা যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। রচনা এবং রঙের আকারগত ভারসাম্য যেন ক্রমাগত গভীরে নিয়ে যায়।

জে রাজ দাসানির কাজ চিন ও জাপানের ব্রাশিংয়ের ধরন মনে পড়িয়ে দেয়। অসামান্য ক্ষিপ্রতায় এবং সাদাকালো জলরঙের বলিষ্ঠ কমনীয় টানে নরনারীর শরীরী বিভঙ্গকে ছায়াতপ ও গাঢ়ত্বে ফেলে যে ভাবে তিনি দেখিয়েছেন, তার কথা বহু কাল মনে থাকবে।

জহর দাশগুপ্ত যথেষ্ট খেটেছেন নারীকেন্দ্রিক পেন্টিংয়ে। তবে কাব্যিক সুষমা মার খেয়েছে অতি আলঙ্কারিক ও বিস্তৃত রচনায়। ভঙ্গি ও বৈচিত্রের ঐক্য শিল্পগুণকে প্রতিফলিত করে। শিল্পী ডিজ়াইনকে কোথাও কোথাও প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রিকতার সেই গুণকে একটু হলেও ভেঙেছেন। গাছপালার অনুষঙ্গ সুন্দর।

শুচিব্রত দেবের রঙিন পটের কুশীলবরা বেশ নাটকীয় ও কৌতূহল জাগানো। কিন্তু একটু সচিত্রকরণধর্মী। শান্তনু ভট্টাচার্য কাগজ ছিঁড়ে, কেটে, পাকিয়ে যে কাজ করেছেন, তাতে মজা থাকলেও অস্বস্তি হয় এই ভেবে যে, তাঁর অসাধারণ পেন্টিংগুলি এখানে নেই। বিশেষত তাঁর ছোট কিছু কাজ এই প্রদর্শনীতে বেশ মানানসই হত, সন্দেহ নেই।

প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ পার্থপ্রতিম দেবের ‘অ্যাজ় ইউ লাইক ইট’। ওয়াশ মাধ্যমে করা ছোট ছোট ১২টি কাগজে এবং তিনটি লাইনে চারটি করে কাজ। জানালা, দরজা, গ্রিল, পর্দা, খড়খড়ি— ভিতর-বাইরের এই আশ্চর্য সমীকরণকে ডিজ়াইনের মতো স্টাইলাইজ়েশনে ও উল্লম্ব-সমান্তরাল ড্রয়িংয়ে অসাধারণ রূপ দিয়েছেন।

রূপবন্ধের এই সন্নিবেশ তাঁর উত্তর-আধুনিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা এক পরিশীলিত ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ায়। পপ আর্ট থেকে নিঃসৃত ভাবনা ক্যানভাসগুলিতে প্রতিফলিত হচ্ছে ফ্যান্টাসিতে।

মানসী মিত্র নৌকা নিয়ে অনেক দিন কাজ করছেন। কিন্তু ছবিতে সুতো-ফিতে আটকেও কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেননি। ‘জার্নি টুওয়ার্ডস ইনফিনিটি’ বরং অনেক আধুনিক। অরুণ মজুমদারের ছবিতে প্রচুর জিনিসের সংমিশ্রণ। গুচ্ছের ঘরবাড়ি, ঘাড়ের উপরে ওঠা স্থাপত্য... যেন বিরতি নেই কোথাও! যেন দ্রব্যগুণ ও রচনায় মিলেমিশে জটিল এক কাঠিন্য এনে ফেলেছেন। অরুণকে ঠিক এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে হবে। শিশির টিকাদার চমৎকার ভাস্কর্য গড়েছেন ব্রোঞ্জ এবং ফাইবারে। লাবণ্যময় রূপে ছন্দকে প্রতীকায়িত করেছেন। ওঁর গণেশের করতলের ক্ষুদ্রতা চোখে লাগলেও বলতেই হবে যে— অনবদ্য একটি কাজ‍!

শ্যামল মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্য বেশ অন্য রকম। অকালপ্রয়াত শিল্পী সুব্রত বিশ্বাসের দু’টি প্রাণবন্ত প্রকৃতি এই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ। ক্যানভাস বোর্ডে অসামান্য পেন্টিং!

দিব্যেন্দু বসুর অ্যাক্রিলিকে করা সিংহাসনের সামনে দাঁড়ানো এক রাজাসদৃশ জান্তব মানব বেশ নাটকীয়। এক দিকে লাল উল্লম্ব থামের দীর্ঘায়ত ফর্ম যেন আশ্চর্য ভাবে সমগ্র রচনাটির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাঁর টেকনিকও বেশ অন্য রকম। পটভূমিতে নীলাভ স্তিমিত যেন ‘আলোহীন’ এক আলোর উপস্থিতি অসাধারণ। টেম্পারায় করা ‘স্লিপিং ড্রিম’ এক মায়াময় আচ্ছন্নতার নীরব সাঙ্গীতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করায়। আকাশি শাড়ির এক রহস্যময়ী নারী ও বাদ্যযন্ত্রের সুর একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে যেন এক তরল আলোর গভীরে! বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পপকর্নের কাজটিও অসামান্য!

এ ছাড়াও ছিলেন তাপসশঙ্কর বসু, চিন্ময় রায় এবং অন্যান্য শিল্পীরা। প্রদর্শনী হয়েছিল অ্যাকাডেমির তিনটি কক্ষ নিয়ে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE