Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হুমকি চোখরাঙানি নজরদারি

তার মধ্যেই শুরু কৌশিক সেনের নতুন নাটক ‘আন্তিগোনে’। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়প্রেক্ষাগৃহে পা রাখতেই অতর্কিতে ছুটে এল নিরাপত্তা-রক্ষী। ছোপ ছোপ জলপাই উর্দি। বুকের কাছে শক্ত হাতে ধরা কালাশনিকভ রাইফেল। প্রায়ান্ধকারেও দপ দপ করছে তার চোখের তারা। হিসহিসানি শাসানির গলা শোনা যায়, ‘‘টিকিট কোথায়? দেখান।’’ তাকে পেরিয়ে খানিক এগোতেই আরও একজন। রাইফেলের নল তাক করে ধরে এ বার কড়া হুমকি, ‘‘নাটক দেখতে এসেছেন, না! আমরা সব নজর রাখছি।’’ মাথার ওপর থেকে চক্কর মারছে সার্চ লাইট। সামনের মঞ্চে ঝুলছে অসংখ্য লাশ। মেঝেতেও সার সার মৃতদেহ। শুকনো রক্তের দাগ।

সে দিনের মহলায়। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

সে দিনের মহলায়। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

প্রেক্ষাগৃহে পা রাখতেই অতর্কিতে ছুটে এল নিরাপত্তা-রক্ষী। ছোপ ছোপ জলপাই উর্দি। বুকের কাছে শক্ত হাতে ধরা কালাশনিকভ রাইফেল।

প্রায়ান্ধকারেও দপ দপ করছে তার চোখের তারা। হিসহিসানি শাসানির গলা শোনা যায়, ‘‘টিকিট কোথায়? দেখান।’’

তাকে পেরিয়ে খানিক এগোতেই আরও একজন। রাইফেলের নল তাক করে ধরে এ বার কড়া হুমকি, ‘‘নাটক দেখতে এসেছেন, না! আমরা সব নজর রাখছি।’’

মাথার ওপর থেকে চক্কর মারছে সার্চ লাইট। সামনের মঞ্চে ঝুলছে অসংখ্য লাশ। মেঝেতেও সার সার মৃতদেহ। শুকনো রক্তের দাগ।

প্ল্যাকার্ড হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক দল মুখোশধারী। তাতে লেপটে আছে মাসখানেক আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আলোড়ন ফেলা ভয়ার্ত শিশুর ছবি। গুলি, বোমা, হত্যা, রক্ত দেখতে দেখতে বড় হওয়া যে শিশুটি আলোকচিত্রীর বড় লেন্সের ক্যামেরা দেখে বন্দুক ভেবে কান্নায় ডুকরে উঠেছিল। ঢিমে আলোর গোটা চত্বরে নাগাড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের খবর। গৃহযুদ্ধ। খুন, পাল্টা খুন। বিধ্বস্ত, সন্ত্রস্ত, বিপন্ন জনজীবনের কুৎসিত সব মুহূর্ত। সোমালিয়া, সিরিয়া, বাংলাদেশ...।

এমনই এক সন্ত্রাস-মাখা, থম মারা আবহতেই শুরু হয় স্বপ্নসন্ধানী-র নতুন নাটক ‘আন্তিগোনে’। পরিচালনা কৌশিক সেন। প্রথম শো ২৯ মে, জ্ঞানমঞ্চ, সন্ধে সাড়ে ছ’টা। এ বছরে স্বপ্নসন্ধানী-র জন্মোৎসবের ওটিই শেষ দিন।

মহাভারত প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, এ কোনও সুদূরবর্তী ধূসর স্থবির উপাখ্যান নয়, আবহমান মানবজীবনের মধ্যে প্রবহমান।

গ্রিক ট্র্যাজেডি নাটকের মহানায়ক সোফোক্লেসের ‘আন্তিগোনে’ও কি তেমনই? নইলে আড়াই হাজার বছরের পুরনো এই নাটক, তার প্রতিটি বাক্য, প্রত্যেকটি সংলাপ এতটা সমকালকে ধরে কী করে?

সারা পৃথিবীতে ঠিক কতগুলো ভাষায়, কত বার অভিনীত হয়েছে ‘আন্তিগোনে’?

স্বয়ং ঈশ্বরও এ প্রশ্নে ডাহা ফেল করবেন। কিন্তু যত বারই হয়েছে, যে দেশেই হয়েছে, তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে রাষ্ট্রের আস্ফালন, ক্ষমতাবাজের দপদপানি, প্রতিবাদীর জেহাদ— অনিবার্য সংঘর্ষের রক্তাক্ত অধ্যায়।

বাংলায় যখন প্রথম বার এ নাটক মঞ্চে আনছে ‘নান্দীকার’, তারিখটা খেয়াল করুন।— ২৫ মার্চ, ১৯৭৫। ইন্দিরা গাঁধীর জমানা। জরুরি অবস্থা।

নাটকের জন্য নান্দীকারের একটি বিজ্ঞাপনী স্লোগান ছিল ‘থেবাইয়ের আকাশে শকুন, কলকাতার রাজপথে মৃতদেহ’। নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এই বাক্যবন্ধে।

শোনা যায়, নাটকের প্রচার ঠিক কী ভাবে হবে, তার জন্য কড়া নজরদারি চলত সরকারি মহলের উচ্চ পদ থেকেই। এমনকী আন্তিগোনে নিয়ে কলম ধরায় মিশায় আটক করা হয় এক প্রখ্যাত সাংবাদিককে।

আগের কয়েকটি প্রযোজনাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ছবিটা একই। ফরাসি নাট্যকার জ্যঁ আনুই যখন সোফোক্লেসের নাটকটিকে নতুন করে সাজাচ্ছেন, তখন হিটলারের আজ্ঞাবহরা মুক্তমনা ফ্রান্সকে শাসন করছে। ব্রেখটের রূপান্তরে সঙ্গী হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি। বাংলাদেশে মুজিব-হত্যার পর্যায়। আরব বা আফ্রিকাতেও ওই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

আন্তিগোনে। রাজা অয়দিপাউস ও রানি ইয়োকাস্তার মেয়ে। রাজার দুই ছেলে এতোয়েক্লেস ও পলুনেইকেস। রাজার মৃত্যুর পর যত দিন তাঁর দুই ছেলে সাবালক হয়নি, থিবেস রাজ্যের দেখভাল করছিল অয়দিপাউসের শ্যালক, আন্তিগোনের মামা ক্রেয়ন। দুই ভাই যখন বড় হল, রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বাধল লড়াই। এতোয়ক্লেসের তরবারি বিদ্ধ করে পলুনেইকেসকে। পলুনেইকেসের অস্ত্রে মারা যায় এতোয়ক্লেস। ক্রেয়ন আবার ক্ষমতায় বসেন। তার পরেই তাঁর ঘোষণা, এতোয়ক্লেস নগরের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে, তাই তাকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু পলুনেইকেস ধ্বংস করতে চেয়েছিল পিতৃপুরুষের পবিত্র নগরী, তাই তার জন্য কোনও শোক নয়। সে পড়ে থাকবে নগ্ন। সে হবে শকুন-কুকুরের খাদ্য। ‘এ বড় সামান্য পরোয়ানা নয়/ যে এ আদেশ অমান্য করবে/ সে মরবে,/ তার মৃত্যু হবে প্রস্তারাঘাতে’।

আন্তিগোনে রাজাজ্ঞার তোয়াক্কা করে না। সে তার ভাইয়ের মৃতদেহর সৎকার করবেই। কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষায় যোগ্য নাগরিক তাকেই বলে, যে যুদ্ধের ঝোড়ো দিনেও আনুগত্যে অবিচল, বিপদের দিনে বিশ্বস্ত সহযোগী। ফলে ক্ষমতার চোখে আন্তিগোনে রাষ্ট্রদ্রোহী। তাকে নিকেশ করবে রাষ্ট্র।

রাষ্ট চায় আনুগত্য। তার বিরুদ্ধাচরণের ন্যূনতম সম্ভাবনাতেও সে থাবা উঁচিয়ে ধরে। ক্ষমতা কাউকে রেয়াত করে না, বিরুদ্ধাচারী তার কাছে যেমন দোষী, তেমনই দণ্ডযোগ্য সেই দোষীর পরিধিতে থাকা মানুষজনও। এমনকী যে ‘অপরাধী’, ধরা পড়ার পরও নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত নয়, তাকে রাষ্ট্র আরওই ঘৃণা করে।

রাষ্ট্র নিয়ত ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। তার চোখে কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট জনগণের মধ্যে বিভেদ চায়। তার কাছে কেউই বিশ্বাসী নয়। শত্রু তো নয়ই, মিত্রও নয়। নাটকের এই বুননেই, এই ভাষ্যেই লেখা হয়ে যায় আন্তিগোনেদের পরিণতি-নামা! যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে-দেশান্তরে।

রাষ্ট্রের আগ্রাসন, তার অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষণ, তাকে ঘিরে সনাতন ব্যাখ্যা যদি এ নাটকের আশি শতাংশ জুড়ে থাকে, তো বাকি অংশে অবশ্যই আছে পুরুষতন্ত্রকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ভাইয়ের সৎকার করতে উদ্যোগী আন্তিগোনেকে যখন তার বোন ইসমেনে বলে, ‘‘আমরা তো নারী/পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের কাজ নয়’’— এ তো সেই পৌরুষকে মেনে নেওয়া, মানাতে চাওয়ারই উচ্চারণ। যাকে অস্বীকার করেই তো বেড়ে ওঠে আন্তিগোনেরা। বিলি জোয়েলের একটি গান— ‘শি ইজ অলওয়েজ আ উমেন টু মি’, সুচারু ভাবে ব্যবহার করে নাটকের এই সুরটাকে আরও সূক্ষ্ম ভাবে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক।

কৌশিকের নাটকে কাব্যময়তা নতুন কিছু নয়। ‘প্রথম পার্থ’, ‘মুখোমুখি বসিবার’, ‘অনাম্নী অঙ্গনা’, ‘ডাকঘর’, ‘মাল্যবান’, ‘সমুদ্রের মৌন’, ‘দর্জিপাড়ার মর্জিনারা’, ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’...। সেই অর্থে, নাট্যকাব্যও বলতে গেলে স্বপ্নসন্ধানীর সিগনেচার। তার সঙ্গে সমকালকে ধরতে গিয়ে কৌশিক তাঁর সংলাপে প্রায়ই সমকালীন দেশীয় রাজনীতিকে হুবহু ‘কোট’ করেন। তাঁর সমালোচকরা বলেন, এতে নাটকের শিল্পগুণ কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়।

এ নাটকে কিন্তু সেই স্পষ্টোচ্চারণ থেকে কৌশিক শত হস্ত দূরে। সংলাপের গড়নটাই এমন যে, সমকালকে ধরতে মুহূর্তকালও লাগে না। একটি বারের জন্যও ভারত ভূখণ্ডের কোনও অংশের উল্লেখ নেই। কিন্তু তার মধ্যেও প্রাসঙ্গিক হয়ে জেগে ওঠে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা।

শিশিরকুমার দাসের ‘আন্তিগোনে’ অনুবাদটি নিয়ে নাটকের দুটি পর্বে অসম্ভব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ জুড়েছেন তিনি। যেখানে ওঁর সম্পাদনা লক্ষ করার মতো।

ওই দুটি অংশের একটি রয়েছে একেবারে শুরুতে। সেখানে থিবেসের অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তা তেইরেসিয়াস এসে নাটকের চলন, মেজাজ নির্ধারণ করে দেন। এটিও অনুবাদকের অন্য একটি লেখা থেকে নেওয়া। অপর সংযোজিত অংশটি ‘নান্দীকার’-এর মূল স্ক্রিপ্ট থেকে জুড়ে দেওয়া। —ক্রেয়ন-আন্তিগোনের দীর্ঘ সংলাপ।

ক্রেয়নের চরিত্রে কৌশিক স্বয়ং। অঙ্গ সঞ্চালনে, চোখের চাউনিতে কখনও ঔদ্ধত্য, কখনও ক্রূঢ়তা, হিংস্রতা এনে কৌশিক একটি জোরালো চরিত্র নির্মাণের মুখে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে পর্যুদস্ত, ভঙ্গুর ক্রেয়নকে যেভাবে তিনি তুলে ধরতে চাইছেন, তা যেমন পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রতি আরও আশা বাড়ায়, তেমনই অভিনেতা হিসেবেও।

কিন্তু এ নাটকে তোলপাড় করার মুখে দাঁড়িয়ে রেশমি সেনের আন্তিগোনে।

সরলতার সঙ্গে জেদ, প্রেমের সঙ্গে শ্রদ্ধা, বিতৃষ্ণা-ঘৃণার সঙ্গে সঙ্কল্প জুড়ে যে আন্তিগোনে ফুটে উঠছে ওঁর মধ্যে, তাকে দেখাটা নিঃসন্দেহে এক অভিজ্ঞতা। মঞ্চ জুড়ে তাঁর অভিনয় এক-এক সময় রীতিমতো চ্যালেঞ্জে ফেলে দিচ্ছে কৌশিকের ক্রেয়নকেও। নিঃসন্দেহে এ অবধি রেশমির সেরা চরিত্রায়ণ এই আন্তিগোনে।

ছোট্ট, কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে ঋদ্ধি সেন। যাঁর ভূমিকা অনেকটা মহাভারতের সঞ্জয়ের মতো। অন্ধ তেইরেসিয়াসকে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, নৃশংসতা, রক্তক্ষয়ের বর্ণনা করে যাওয়া যার কাজ। ঋদ্ধির গলায় দুটি গানও এ নাটকের অন্যতম অলঙ্কার হতে চলেছে।

শেষমেশ যে দুটি প্রসঙ্গ না তুললেই নয়, তার একটি মঞ্চ (সৌমিক)। যার আভাস গোড়াতেই আছে। দ্বিতীয়টি আবহসঙ্গীত (গৌতম ঘোষ)। যাকে ঠিক মিউজিক না বলে ‘এফেক্টস্’ বলা ভাল। যে ধরনের ব্যবহার স্বপ্নসন্ধানীর আরেকটি সিগনেচার। হাওয়া, বৃষ্টি, পাখির ডাক...। আর যুদ্ধের আওয়াজ...।— দূরের কোনও আধুনিক সমরাস্ত্র ক্ষেপণের শব্দ এসে মিলছে একেবারে কাছে, প্রাচীন মারণাস্ত্রের ঝনঝনানিতে।

এ ভাবেই ইতিহাস থেকে সমকাল, আর সমকাল থেকে ইতিহাসের দিকে যাতায়াত করতে করতে এগিয়েছে আদি-অনন্তের উপাখ্যান ‘আন্তিগোনে’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE