Advertisement
০৯ অক্টোবর ২০২৪
Art exhibition

পরম্পরা ও আধুনিকতার যুগলবন্দি

গোলাকৃতি আকারের মধ্যে সদা ঘূর্ণীয়মান জাগতিক লীলার যে সমাবেশ, সৌরভ ও তৃণার কাজগুলির মধ্যে সেই আস্বাদ পাওয়া যায়।

সুদৃশ্য: চারুবাসনা গ্যালারিতে আয়োজিত ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্ট্যালজিয়া’ প্রদর্শনীর কাজ

সুদৃশ্য: চারুবাসনা গ্যালারিতে আয়োজিত ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্ট্যালজিয়া’ প্রদর্শনীর কাজ

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ ০৮:৩৫
Share: Save:

পরম্পরা এক জৈব ধারা— কাল ও সময়ের নিরিখে, আদান-প্রদান এবং সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে যা সদা প্রবহমান। চারুবাসনা গ্যালারিতে সম্প্রতি সেই পরম্পরা ও আধুনিকতার সমন্বয়ে প্রদর্শিত হল দুই শিল্পী তৃণা চট্টোপাধ্যায় ও সৌরভ ঘোষের বেশ কিছু কাজ। প্রদর্শনীর নাম ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্ট্যালজিয়া’। এঁরা দু’জনে কলাভবনের প্রাক্তনী ও সহপাঠী। নব্বইয়ের দশকে শান্তিনিকেতন থেকে শিখে যে যাঁর পরিবার ও কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সৃষ্টি এবং সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে যুক্ত থেকেছেন। অবশেষে বহু অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত হয়ে, এই দুই শিল্পী তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজন করেছিলেন সুদৃশ্য এক প্রদর্শনীর।

প্রদর্শনীটির প্রাথমিক চমক— শিল্পীদ্বয়ের প্রায় সব কাজই গোলাকৃতি। ভাবনার ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটলেও, ছবির চিত্রপটগুলি নিখাদ বৃত্তাকার। প্রচলিত আয়তাকার চিত্রপট থেকে তাই কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী। ‘বৃত্ত’ একটি বিশ্বজনীন আকার। আদিকাল থেকে এই বৃত্তকে কেন্দ্র করে তাই গড়ে উঠেছে স্থান, মন, বুদ্ধিমত্তা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিদগ্ধ সব অন্বেষা। ভারতীয় দর্শন ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বৃত্তের তাৎপর্য ও সার্বিকতা বিষয়ে বহুবিধ আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ মেডালিয়ন থেকে জৈনমণ্ডলা— সর্বত্রই এই বৃত্তাকার রূপের ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যান পাওয়া যায়।

সেই রকম গোলাকৃতি আকারের মধ্যে সদা ঘূর্ণীয়মান জাগতিক লীলার যে সমাবেশ, সৌরভ ও তৃণার কাজগুলির মধ্যে সেই আস্বাদ পাওয়া যায়। তৃণা তাঁর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন মূলত পেপার ম্যাশ বা কাগজের মণ্ড শিল্প। অর্থাৎ কাগজ জলে ভিজিয়ে, তার মণ্ড দিয়ে শিল্পী নিজে নির্মাণ করেছেন তাঁর প্রতিটি চিত্রপট। অন্য দিকে, সৌরভ মূলত নির্মিত পোড়ামাটির সরার উপরে শান্তিনিকেতনের পরম্পরাগত আলপনার আকার ও আকৃতি নিয়ে, নিজের রচনে তা পরিবেশন করেছেন। সৌরভ আশৈশব রাবীন্দ্রিক পরিবেশে প্রতিপালিত হওয়ার ফলে তাঁর আলপনার মধ্যে সেই ছন্দোময় সামঞ্জস্যপূর্ণ রৈখিক গতির বিন্যাস দেখা যায়, যা দর্শককে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। ফুল, ফল, পাতার মধ্যে যে এক আত্মিক আলাপচারিতা থেকে থাকে, সেই বিশেষ প্রাকৃতিক আবেদনটি সৌরভ তাঁর নিপুণ তুলির টানের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। সঙ্গে সুষম রঙের বিন্যাসে ও রেখার পেলবতায় সেই পারস্পরিক সহমর্মিতা এক নান্দনিক পর্যায় প্রাপ্ত হয়েছে। প্রকৃতির এই সব বাহ্যিক রূপ থেকে শুধুমাত্র তার আত্মিক নির্যাসকে গ্রহণ করে, তাকে আলঙ্কারিক রূপ প্রদান করা এক উল্লেখনীয় বৈশিষ্ট্য। রাবীন্দ্রিক শিক্ষাদর্শে ও নন্দলালের নেতৃত্বে, বিংশ শতকে এক বিশিষ্ট শৈলীতে উপনীত হয় তা। সৌরভ সেই ধারার এক সুযোগ্য উত্তরসূরি। পরম্পরাকে প্রবহমান রাখার এক উল্লেখযোগ্য কান্ডারিস্বরূপ।

অন্য দিকে, শিল্পী তৃণা চট্টোপাধ্যায় তাঁর আধুনিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কাগজের ম্যাশের উপরে সৃষ্ট কাজগুলি দ্বারা দর্শককে অন্য এক শিল্পভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটান। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে তৃণা তাঁর কাজগুলি নির্মাণ করেছেন। বিষয় কখনও ‘বাগান’, ‘পরিবার’, ‘প্রিয় পোষ্য’ অথবা ‘ঘরের অভ্যন্তরীণ বিস্তার’। কিন্তু মাধ্যম ও উপস্থাপনার গুণে কাজগুলিতে এক দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভাব প্রকাশের সংশ্লেষ লক্ষণীয়। এই মাধ্যমজনিত কারণেই গঠনবিন্যাসের এক স্পৃশ্যতাও বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়। গোলাকৃতি চিত্রপট হেতু, তথাকথিত পরিপ্রেক্ষিত ও আলোছায়ার খেলা যেমন অনুপস্থিত, তেমনই শিল্পী এক নিজস্ব কাল্পনিক প্রেক্ষিত তৈরি করে কাজগুলির মধ্যে এক সার্বিকতা সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় প্রাচীন ভাস্কর্যে সাঁচী ও ভারহুতের মেডালিয়নসমূহের এ যেন আধুনিক এক প্রতিফলন। কখনও একই রঙের প্রাধান্যে, আবার কখনও একের অধিক রঙের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমীকরণের মধ্য দিয়ে তৃণা এক বিরল সৃষ্টিসুখের আস্বাদ প্রকাশ করেছেন। নৈনিতালের মতো মনোরম পাহাড়ি দেশে দীর্ঘ কাল শিক্ষকতা ও জীবনযাপনের ফলেই হয়তো অসমতল চিত্রপটের প্রতি শিল্পীর এই বিশেষ আকর্ষণ। সর্বোপরি, কাজগুলির মধ্যে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক আত্মদর্শন, দর্শককে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করে।

তৃণা ও সৌরভের আকর্ষক শিল্পকর্মগুলির মধ্য দিয়ে পরম্পরা ও আধুনিকতার এক অভিনব যোগাযোগ ও সেচন আমরা দেখতে পাই। এই প্রদর্শনীটি তাই দর্শককে এক নতুন ভাষা ও ভাবনার সূচক প্রদান করেছে।

সোহিনী ধর

অন্য বিষয়গুলি:

Art exhibition Art Gallery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE