পার্কসার্কাসে প্রায়ই যেত আরেক দিদির বাড়ি। সেখানে অফিস ক্লাবের থিয়েটারের মহড়া চলত। একদিন বাবাকে ফের ওই অবস্থায় দেখে ‘ধুত্তেরি’ বলে ট্রামে চেপে সোজা পার্কসার্কাসে দিদির বাড়ি। সাহেবের মতো ফর্সা, লম্বা অতি সুদর্শন এক যুবাপুরুষ বাইরের ঘরে বসা। সে’ও একদৃষ্টিতে দেখছিল ছিপছিপে শ্যামাঙ্গী সুদর্শনাকে। বেণু শুনতে পেল দিদিকে জিজ্ঞেস করছে, “মেয়েটি কে?”
তার বোন শুনে ফের রসিকতা করে বলেছিল, “‘আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে?” নিছকই মজা। কিন্তু! দিদির কাছ থেকে ছেলেটির অফিস, কনট্যাক্ট নম্বর ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে চুপচাপ চলে এল বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির টাকার জন্য বিয়ে না-হওয়া ছোট মেয়ে।
কন্যাদায়গ্রস্ত অসহায় বাবার এগারো নম্বর কনিষ্ঠ কন্যাসন্তানটি আগুপিছু কিচ্ছু না ভেবে গড়িয়াহাটের ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের দোকান থেকে সোজা ফোন করল কনট্যাক্ট নম্বরে।
ও প্রান্তে ছেলেটির গলা পেতেই প্রথম বোমাটা ফাটাল, “আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?” ওদিক থেকে হতভম্ব প্রশ্ন, “কে? আপনি কে!”
এদিক থেকে স্থির স্বরে, “আমি দীপ্তিদির বোন। পার্কসার্কাসে যার বাড়িতে আপনি আমাকে দেখে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি। আপনি করবেন আমায় বিয়ে?”
ওদিক থেকে প্রচণ্ড থতমত গলায়, “আমি...আমি একটু ভেবে দেখি...তা ছাড়া আমার মা রয়েছেন। তাঁরও মত নিতে হবে।”
বেণু তথা সুপ্রিয়া বললেন, “ভাবুন। মায়ের মত নিন। আমি পরে আবার ফোন করব।”
ফোন রেখে বাড়ি। কাউকে একটি কথাও জানাল না। এই সুদর্শন ছেলেটিই বিশ্বনাথ চৌধুরী। বেণু বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুপ্রিয়ার প্রথম স্বামী। সে নয়, আঠারো বছরের মেয়েই বিয়ে করে ছাড়ল তাকে, বাবাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে। একেবারে রেজিস্ট্রি করেই বাড়ি এসে ঢুকল।
তখন রাস্তায় সন্ধের আলো জ্বলে গেছে। সময় পেরিয়ে গেছে বাড়ি ফেরার। রাশভারী বাবা রেগে টকটকে লাল হয়ে হাতের লাঠি উঁচিয়ে, “কোথায় ছিলে এত ক্ষণ?”
ছোট মেয়ে অকম্পিত গলায়, “লাঠি নামান। আপনি আমায় মারতে পারেন না। আমি বিবাহিত মেয়ে। রেজিস্ট্রি করে এসেছি।”
ঘটনার আকস্মিকতায়, ধাক্কায় সবাই প্রথমে বজ্রাহত। পরে মেনে নেওয়া, হিন্দুমতে বিয়ে, সবই করা হল।
বিয়ের পর থার্ডক্লাস ট্রেনে চেপে, তারপর রিকশা করে শ্বশুরবাড়ি বদ্যিবাটিতেও হাসিমুখেই গিয়েছিল বড় বাড়ির ছোট মেয়ে সুপ্রিয়া চৌধুরী। কিন্তু এই অদ্ভুত বিয়ের কাহিনি বলতে বলতে আমার বেণু আন্টি বারবারই বলেছে, “জানিস, যখনই রেজিস্ট্রি অফিসে বসে সই করলাম সুপ্রিয়া ‘চৌধুরী’, সেই মুহূর্তে মন ডেকে উঠেছিল,— ভুল, ভুল, বিরাট বড় ভুল করলাম। এর খেসারতও দিতে হবে আমাকেই।”
হয়েছিলও তাই। আমার বেণু আন্টি অর্থাৎ সুপ্রিয়া দেবীর বরাবরই সুন্দর পুরুষ-ভাগ্য। কী বাবা, কী প্রথম স্বামী, কী প্রেমিক বা দ্বিতীয় স্বামী। কিন্তু সেইসঙ্গে আজীবন যুদ্ধ করার খেসারত।
প্রথম বিয়েতে সুপ্রিয়া চৌধুরী তার স্বামীর কাছ থেকে একটিই ইতিবাচক জিনিস পেয়েছিল— সন্তান— ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে, সোমা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও টেকেনি এ বিয়ে।
অথচ অতি সাধারণ শ্বশুরবাড়ি, শাশুড়ি, দেওরের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়নি কোনও দিন। আজও বেণু আন্টি নির্দ্বিধায় প্রথম শাশুড়ি সম্পর্কে বলে, “মা।” বলে, “মা আমায় খুব ভালবাসত।”
দেওর সম্বন্ধেও একই সস্নেহ ভালবাসা মাখা কথা। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন নিয়ে মানসিক এবং দৈহিক নির্যাতনে জর্জরিত।
তখন যথেষ্ট নাম, যথেষ্ট রোজগার, একমাত্র মেয়েকে নামকরা বোর্ডিং স্কুলে রেখে পড়ানো। কিন্তু এতটুকু স্বস্তি নেই, শান্তি নেই নিজের ঘরে। যার ফলে মাঝেমাঝেই হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি থেকে ‘স্পেনসর্স’ হোটেলে পালিয়ে গিয়ে একা থাকা।
সেই দিনে সেই সময়ে এটা কম কথা নয়। কম সাহসের কাজ নয়। উত্তমকুমারের সঙ্গে তখন সম্পর্ক শুধুই সহকর্মীর, সহজ বন্ধুত্বের। যাক, প্রথম বিয়ে তো ভাঙল।
বিশ্বনাথ চৌধুরী চলে গেলেন দিল্লি। ফের বিয়েও করলেন ডিভোর্স না করেই এবং করলেনও প্রথম স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেই, “আমি কি বিয়ে করতে পারি?”
সুপ্রিয়া, তখনও চৌধুরী, সেই মুহূর্তে তার বুকের মধ্যে কিছু— কোনও কিছু হয়েছিল কি হয়নি, কেউ জানে না।
স্বামীকে এক কথায় ছাড় দিয়েছিল। বলেছিল “নিশ্চয়ই।” পরে ফর্মাল ডিভোর্স। ময়রা স্ট্রিট-এ বিশাল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে, সব দিক থেকে নিজের সামর্থ্যে নিজের সঙ্গে একা থাকা শুরু হল সুপ্রিয়া ‘দেবী’র।
আবারও বলছি, তখনকার সেই দিনে, ষাটের দশকের গোড়ায়, পূর্ণ যুবতী, দুরন্ত শরীরী আকর্ষণের কৃষ্ণাসুন্দরীর এইভাবে একা থাকা বিরাট সাহস আর প্রচণ্ড সংগ্রামী ক্ষমতা ছাড়া অসম্ভব।
এর পর জীবনের দ্বিতীয় ভাগ। যেখানে প্রবেশ উত্তমকুমারের।
আমার বাবা বারবারই বলত, “বেণু হচ্ছে সোফিয়া লোরেন অব দি ইস্ট। ও রকম ফিগার, হাইট, অ্যাপিল ইন্ডাস্ট্রিতে আর আছে? সেই সঙ্গে অভিনয়।”
এই অবধি বলে প্রায়ই চুপ করে যেত। কারণ, বাবা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, সুপ্রিয়াদেবীর অসামান্য অভিনয় প্রতিভা বা ক্ষমতার ষোলো কলা পূর্ণ হয়নি, হতে পারেনি। তাতে যে ‘গ্রহণ’ লেগেছে, ‘ছায়া’ পড়েছে, তার নাম ‘উত্তমকুমার’!
হ্যাঁ, আপামর উত্তম-ভক্ত পাঠক শক্ড হবেন জেনেও বলছি এই কথা। নিজে উত্তমকুমারের অসামান্য আকর্ষণ আর অভিনয়ে চরম মুগ্ধ মোহাবিষ্ট হয়েও বলছি একই কথা। বেণু আন্টি নয়, অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী এমনই বিলীন হয়ে কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন, নিজের পূর্ণ বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়টা ‘উত্তম-প্রেমে’, যে তার ‘আমি’ বলে আর কিছু রইল না। যে ‘আমি’র মধ্যে আরও অনেক অনেক সম্ভাবনা ছিল, বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল, দুর্দান্ত ন্যাচারাল অ্যাক্টিং-এর ক্ষমতা ছিল। ক্লাসিক্যাল নৃত্যকলা ছিল, মুম্বই থেকে তখনকার টপ হিরোদের সঙ্গে কাস্ট হওয়ার ডাক ছিল। কিন্তু হল না।
সব কিছু থাকা সত্ত্বেও উত্তমকুমারের প্রখর দীপ্তির ‘রিফ্লেক্টেড গ্লোরি’তে আচ্ছন্ন, ‘চাঁদের আলো’ হয়ে থাকাই বেছে নিল অসামান্য ক্ষমতার অভিনেত্রী সুপ্রিয়াদেবী। যার জ্বলজ্বলে প্রমাণ ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
বহু কাল আগে শক্তিপদ রাজগুরুর গল্প ‘চেনা মুখ’ পড়তে পড়তে পাশে ঘুমন্ত স্বামী বিশ্বনাথ চৌধুরীকে জাগিয়ে তুলে সুপ্রিয়া চৌধুরী অনুনয় করেছিলেন, “যদি কেউ কোনও দিন এই বইটা নিয়ে ছবি করে আর আমাকে ‘নীতা’ করতে দেয়, তাহলে তুমি টাকা-পয়সা নিয়ে একটা কথাও বোলো না”— অদ্ভুতভাবে পরদিনই বিকেলে তাদের হিন্দুস্তান রোডের বাড়ির সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
সুপ্রিয়া চৌধুরী তখনও শ্যুটিং থেকে বাড়ি ফেরেননি। তাঁকে দেখামাত্র বাঙাল ভাষায় বিচিত্র সম্বোধনে ঋত্বিক ঘটক বলে উঠেছিলেন, “অ্যাই ছেমড়ি, একটা ছবি করতাসি ‘চেনা মুখ’ গল্প নিয়া। তর লিগা একটা পার্ট আসে— ‘নীতা’। সব কাম প্যাক-আপ কইরা দশ দিনের লিগা শিলং চল...” নিজের চোখকানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সুপ্রিয়া। পরেরটা তো ইতিহাস। সবাই জানে। এখনও, এই আশি বছর পার করেও, সুপ্রিয়াদেবী মানেই ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
সুপ্রিয়াদেবীর অভিনয় মানেই “দাদা আমি বাঁচতে চাই...” সন্দেহ নেই, শ্রেষ্ঠ অভিনয়। সমস্ত সত্তা নিংড়ানো সেই হাহাকারে গায়ে কাঁটা দেয় আজও। কথা নয়, ডায়লগ নয়, ওই হাহাকারই সুপ্রিয়াদেবী।
মেকআপহীন ওই চেহারা, গোটা ছবি জুড়ে মারাত্মক সব টুকরো টুকরো শট, অদ্ভুত নীরব অথচ প্রচণ্ড বাঙ্ময় অসাধারণ অভিব্যক্তিগুলোই সুপ্রিয়াদেবী। কিন্তু তার পরেও নিজের জীবনে সত্যিই ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হয়েই কেন রয়ে গেল সে? কেন মেঘের ঘেরাটোপ ভেঙে নিজের প্রখর রৌদ্রতেজে দীপ্যমান হল না? কোথাও তো কোনও খামতি ছিল না।
মনে পড়ে ‘সন্ন্যাসী রাজা’-তে বৈধব্যবেশে তার অসামান্য দৃষ্টিপাত। সন্ন্যাসীর বেশে উত্তমকুমারকে অপরিসীম প্রেমে দেখতে দেখতে কী কোমল উষ্ণতায় বলে ওঠা, “এই সন্ন্যাসী আমার স্বামী।”
পরক্ষণেই অভিনয়ের একেবারে বিপরীত মেরুর তুঙ্গে ঝলসে উঠে ক্ষিপ্ত বাঘিনির গর্জন, “ওই ওই ডাক্তার! ও আমার স্বামীকে মেরেছে। আমাকে দিনের পর দিন...” কিংবা ‘লাল পাথর’-এ গাঁয়ের অশিক্ষিত বিধবা-বৌ থেকে রবিঠাকুরের ‘চোখের বালি’ পড়া রাজেন্দ্রাণীতে উত্তরণ!
জমিদারের রোলে উত্তমকুমারের সপাট চাবুক মুখে আছড়ে পড়ার পর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া সেই গনগনে ভীষণ, নিঃশব্দ অঙ্গার চাউনি! অথবা ‘কাল তুমি আলেয়া’-র সেই বিখ্যাত রেপ সিন।
যেখানে দৃশ্য জুড়ে উত্তমকুমারের ব্যাক আর তার শার্ট মুঠো করে ধরা সুপ্রিয়াদেবীর হাত। এক হাতের শটে প্রথমে প্রবল বাধা দেওয়া থেকে আস্তে আস্তে টোটাল সারেন্ডার। শুধুমাত্র হাতের মুঠির অব্যর্থ সঞ্চালনে। প্রথমে শুধু “না, না, না,” ক্রমশ সেটাই অদ্ভুত শীৎকার। ভাবা যায় অভিনয়ের এই রেঞ্জ?
এর পরেও, এত কিছু সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমার বেণু আন্টি তথা সুপ্রিয়া দেবী আক্ষরিক ভাবেই মেঘে ঢাকা তারা হয়ে থেকে গেল তার গোটা জীবনটায়। স্বেচ্ছায়, আত্মপীড়নে, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে, নিজের সঙ্গে নিজে যুঝতে যুঝতে।
মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার অবিরাম লড়াই। নিঃশর্ত সমর্পণের নিরন্তর সংগ্রাম। আইনি স্বীকৃতি না পেয়েও উত্তমকুমারের সামাজিক স্ত্রী হওয়ার প্রতিটি কর্তব্য নিখুঁতভাবে পালনের যুদ্ধ।
সব চেয়ে আশ্চর্যের যা, সেটা হল আঠেরো বছর ধরে সব চাহিদা পূরণ করে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে ঘর করার পর ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের মরদেহ নিয়ে খেয়োখেয়ি না করে নিঃশব্দে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার নিদারুণ যুদ্ধ।
ময়রা স্ট্রিট নয়, উত্তমকুমারের ভবানীপুরের বাড়ি নয়, স্টুডিয়োতে গিয়ে উত্তমকুমারকে শেষ দেখা দেখার অকল্পনীয় যুদ্ধ। ভাবা যায় কী করে এটা করতে পারল বেণু আন্টি!
সব শেষে বলি, জীবনের সঙ্গে লড়াই কিন্তু থামেনি আমার বেণু আন্টি বা সুপ্রিয়াদেবীর। কখনও বাড়িঘর, কখনও সাংসারিক ঝঞ্ঝাট, কখনও অশক্ত শরীর, কখনও মস্তিষ্কের ধোঁয়াশা। তবু চলছে দাঁতে দাঁত চিপে তার বাঁচার লড়াই। আমি বাঁচতে চাই। এ চাওয়া ‘নীতা’র চাওয়া নয়। এতে কোনও হাহাকার নেই। কোনও অসহায়তা নেই।
আছে শুধু জেদ। যোদ্ধার জেদ। তাই আশি বছর পার করা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আজ পুরোপুরি মুক্ত। স্বকীয় দীপ্তিতে জ্বলজ্বলে দ্যুতিময়।