উৎপলা সেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের পাশে বাবা
ময়দানেও খেলা দেখতে যেত বাবা। সেখানেও আবার এক কীর্তি! শচীন দেববর্মন প্রায়ই আসতেন দেখতে। বাবাদের ধারণা হয়েছিল, এসডি অপয়া। গ্যালারিতে বসলেই লাল-হলুদ হারে। শচীনর্কতাকে নাকি তাই ওরা পিছন দিকে গ্যালারির নীচে দাঁড় করিয়ে রাখত। ভাবুন একবার! কর্তা নাকি হাসিমুখে তা মেনেও নিতেন। দল জিতলেই হল। শুধু গ্যালারিতে তেমন চিৎকার শুনলে জোর গলায় জানতে চাইতেন, ‘‘আরে কাগো চিৎকার ক’! আমাগো?’’
খেলা শুরুর আগে সবুজ লজেন্স খাওয়ার খুব চল ছিল। মোহনবাগান জার্সির রং যে সবুজ-মেরুন, তাই। বাবারা এক-এক জন একটা একটা করে লজেন্স খেত, আর বলত, ‘‘এই মোহনবাগানরে খাইলাম!’’
বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার খেলার প্রতি একটা ন্যাক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাবা নিজে ক্রিকেটটা ভালই খেলত। ফুটবল-ক্রিকেট দুটো খেলা নিয়েই বাপ-মেয়েতে বেশ আড্ডা হত।
তার একটা গল্প না বললে নয়। তখন বয়ঃসন্ধি পেরোচ্ছি। সুন্দর পুরুষ দেখলে চোখ চলে যায়। খুব পছন্দ ছিল কার্সন ঘাউড়িকে। বাবাকে বলতাম, ‘‘বিয়ে যদি করতেই হয়, কার্সনকে করব। আর ফুটবলার হলে ভাস্কর গাঙ্গুলি।’’ বাবা শুনে মিটিমিটি হাসত আর বলত, ‘‘তাই? আচ্ছা!’’
ও মা! একবার কী হল, দমদমে ভাস্করদাদেরই পাড়ার কাছে একটা অনুষ্ঠান। ভাস্করদাও দেখলাম গিয়েছে। বাবা সটান ওকে ডেকে বসল, তার পর বলল, ‘‘এই শোন, আমার মেয়ে বলেছে, তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না!’’ আমার তো তখন ‘ধরিত্রী দ্বিধা হও’ দশা!
আর সত্যিকারের যখন প্রেমে পড়লাম, রাহুলের কথা বাবাকে বললাম। বাবার তো কোনও কিছুতে ‘না’ নেই। খুশিই হল। হঠাৎ একদিন দেখি, ডাকছে। বলল, ‘‘তোর জন্য একটা গান বেঁধেছি। শোন।’’ বলে শোনাল, ‘‘ক্ষমা চাইছি বলতে কোনও দ্বিধা নেই/হেন কথা দিয়েছি কিনা জানা নেই/যে চিরদিন মোরা থাকব বসন্তে/বরষার জলে কভু ভাসব না যে!’’
আমি জানি না, পৃথিবীর আর কোনও বাবা, তার মেয়ে প্রেমে পড়েছে বলে গান বেঁধেছেন! মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তা-ই করেছিলেন!
অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করত বাবা! হঠাৎ একবার ঠিক করল, হোমিওপ্যাথি শিখবে। ব্যস, মেটেরিয়া মেডিকা কিনে চলল দিনের পর দিন পড়াশোনা।
বাবার যে কী জনপ্রিয়তা, সেটা ছোটবেলায় তেমন টের পাইনি। পরে গল্প শুনে, নয় নিজের চোখে দেখে বুঝেছি।
দুটো গল্প বলি।
মেহেদি হাসান। রবীন্দ্রসদনে গাইতে এলেন। মেহেদির পাগল-ভক্ত বাবা। শুনতে গেল। এ দিকে মঞ্চে গাইতে বসে মেহেদি বলে উঠলেন, ‘‘মানবেন্দ্রজি, আপনি একটু উঠে দাঁড়াবেন? একবার অন্তত আপনাকে দেখতে চাই।’’
লতা মঙ্গেশকর। হোপ এইট্টি সিক্স-এর সময় কলকাতায়। বাবা দেখা করতে গেলেন গ্রিনরুমে। লতাজি বললেন, ‘‘আপ উও গানা গায়ে থে! হাম তো কুছ ভি নেহি গা পায়ে!’’ কী ব্যাপার? তার ঠিক আগেই সলিল চৌধুরীর সুরে অসম্ভব শক্ত তাল-লয়ের একটি গান ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’ রেকর্ড করেছে বাবা। এর যখন হিন্দি ভার্সান হবে, সুর শুনে লতাজি বলেছিলেন, ‘‘সলিলদা, এ অসম্ভব। কেউ গাইতে পারবে না।’’ সলিল চৌধুরী তখন শুধু বলেছিলেন, ‘‘এ গান অলরেডি বাংলায় রেকর্ডেড।’’
আমাদের বাড়িটা যে কী ছিল! কখনও হারমোনিয়াম বন্ধ হত না। রাতদিন খোলা। বাবা গাইত। আমিও গাইতাম। আর যখন-তখন এসে পড়ত আমার কাকারা, পিসিরা। তাদের এক-এক জনের নাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়— কে নয়! পণ্ডিত রবিশঙ্করও এসেছেন, বাবাকে ওঁর নিজস্ব মিউজিক্যাল অপেরা ‘ঘনশ্যাম’-এর জন্য নেমন্তন্ন করতে।
আমার প্রথম গানের রেকর্ডিং বাবা দেখে যেতে পারেনি। কিন্তু সেখানেও কী কাকতালীয় ভাবে জুড়ে আছে বাবা!
পুরনো কলকাতার গান নিয়ে একটা সংকলন বেরোবে। বাবাই গাইবে। ট্র্যাক রেকর্ডিং যে দিন, বাবার শরীরটা ভাল না। দমদমে যাচ্ছি বাবার সঙ্গে। স্টুডিয়োয়। গাড়িতে যেতে-যেতে বলল, ‘‘আজ তো ট্র্যাক রেকর্ড, শরীরটা তেমন জুতের নেই। দরকার হলে তুই গেয়ে দিতে পারবি? ডাবিং-এর সময় না হয় গেয়ে দেব আমি,’’ বলে খাতা খুলে দশটা গানের মধ্য থেকে দুটো গানের পরীক্ষা নিল গাড়িতে যেতে যেতে। তার পর বলল, ‘‘একদম ঠিক আছে।’’
ডাবিং আর করা হল না। হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে বাবা চলে গেল আমাদের ছেড়ে। কাউকে এতটুকু সময় না দিয়ে।
তার পরের ঘটনা। স্টুডিয়ো থেকে আমায় ডেকে পাঠানো হল। ওঁরা ঠিক করেছেন, সে দিনের ওই ট্র্যাক-রেকর্ড থেকেই কাজটা শেষ করবেন। কিন্তু আমাকে একটু দেখে দিতে হবে। আমি মন দিয়ে শুনতে বসলাম। দেখলাম, সব ক’টাই ঠিক আছে। দুটো গান ছাড়া। ওঁরা বললেন, ‘‘তা হলে ও দুটো তুমিই গেয়ে দাও। আর তো উপায় নেই।’’
গাইলাম আমি। সংকলনও বেরোল। আর শিহরিত হয়ে আবিষ্কার করলাম, যে দুটো গান সে দিন গাড়িতে বাবা আমায় গাইতে বলেছিল, এ দুটিই সেই গান!
অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
ছবি: সমর দাস