ধরুন, সকালে উঠে পশমের ওম জড়িয়ে, এককাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে রিসর্টের সামনে বারান্দাটায় বসলেন। তার গা ঘেঁষে নেমে গিয়েছে খাদ। সেই অতলস্পর্শী খাদে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা পাইনের সারি। সবুজের আধিপত্য। খাদের ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘা, রাজসিক শোভা নিয়ে পলকহীন চোখে আপনার দিকে তাকিয়ে। মাঝেমধ্যে একটু পাখির ডাক... পাশে এসে বসল আপনার খুব কাছের কেউ...
দিনের শুরুটা কী শান্তির! ভাবলেই মন পলকে তাজা হয়ে যায়। কিন্তু এমনটা হতেই পারে জানেন! হিমালয়ের কোলে মেঘে ঢাকা একটা ছোট্ট গ্রাম। চিবো। যদি হাতে মাত্র চার দিনও সময় থাকে, ঘুরে আসতে পারেন। কালিম্পং থেকে চার কিলোমিটারের কিছুটা বেশি দূরত্বে, ৪১০০ ফুট উচ্চতায় এই গ্রামটির সঙ্গে এখনও টুরিস্টদের বেশি জানাশোনা হয়নি। সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি এগিয়ে চলে, সামনে পাহাড়ের বিশালত্বকে উপভোগ করব না কি নীচে খাদের দিকে তাকাব... মনে সংশয় জাগে।
রিসর্টের বারান্দা থেকে
এখনও তেমন জমজমাট নয় বলে, চিবোতে থাকার জায়গা একটিই রিসর্ট, ‘চিবো ইন’। পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো ছোট-ছোট কাঠের কটেজ। তাতে বহু বিদেশি সমাগমের কারণে আধুনিক অনেক সুবিধেই পাবেন। আর খাওয়াদাওয়া? ইউরোপীয়, চিনা না কি পুরোপুরি বাঙালি, কোন ধরনের খাবারে আপনার ছুটির আমেজ পরিপূর্ণ হবে? সেটাই হাজির হবে আপনার সামনে। খাবারের যেমন স্বাদ, তেমনই তাঁদের আতিথেয়তা। দামও কিন্তু খুবই কম।
চিবো সম্পর্কে গোড়াতেই একটা কথা বলে রাখি, পাহাড়ি জায়গা হলেও, এখান থেকে কিন্তু সানরাইজ দেখা যায় না। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে প্রাণ ভরে উপভোগ করা যায়। শীতের রাতে বনফায়ারের জন্য একটা অসাধারণ খোলা জায়গা রয়েছে, যার ঠিক উলটোদিকেই বিশালবপু কাঞ্চনজঙ্ঘা দাঁড়িয়ে। শুকনো ডালের ইন্ধনে আগুনের সশব্দ জ্বলে ওঠা... কনকনে ঠান্ডায় উষ্ণ পরশ, সামনে হাজির অর্ডারমাফিক গরম-গরম নানা স্বাদের পকোড়া... দুর্দান্ত আড্ডাস্পট! এখানে আরও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, রিসর্টের মধ্যে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি রয়েছে। কালিম্পং ও সিকিমের উপর ইংরেজিতে লেখা নানা বই এখানে পাবেন। ফিলটা বেশ নতুন রকম।
এবার রিসর্ট ছেড়ে আশপাশে কী আছে, ঘুরে দেখা যাক।
সিলেরি গাঁও ভিউ পয়েন্ট
প্রথম দিন চলে যান কালিম্পং। দুরপিন দারা অবজারভেটরি পয়েন্ট সহ আরও কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট থেকে হিমালয়ের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। খরস্রোতা তিস্তার বয়ে যাওয়া, অনেক নীচে প্লেন ল্যান্ড। পাহাড়-নদীর এ হেন দৃশ্য আপনি অন্য হিল স্টেশনেও পাবেন, কিন্তু কালিম্পংয়ের বিশেষত্ব হল, এখানকার নার্সারি, যা মনোমুগ্ধকর। কাছাকাছি কয়েকটি মনাস্ট্রিও আছে। আপনি সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। ইতিহাস যাঁদের প্রিয় বিষয়, তাঁরা পারলে একবার পেডং মনাস্ট্রির কাছে ভগ্নপ্রায় ভুটানি ফোর্ট দেখে আসুন।
কাছাকাছি জায়গাগুলো যাঁরা ঘুরে দেখতে চান, তাঁরা একদিন লাভা লোলেগাঁও চলে যেতে পারেন। তবে আমাদের যেটা সবচেয়ে ভাল লেগেছিল, সেটা হল ডেলো পাহাড়ে প্যারাগ্লাইডিং। চিবো থেকে খুবই কাছে জায়গাটি, মিনিট দশ-পনেরো মতো সময় লাগে পৌঁছতে। এই অ্যাডভেঞ্চারাস স্পোর্টসের সুযোগ কিন্তু ভুলেও মিস করবেন না। এ ধরনের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ জীবনে বারবার আসে না। কালিম্পংয়ের উপর দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে অঞ্চলটি প্যারাসুটে করে ঘুরে দেখাটা, যতটা ভীতিপ্রদ, ততটাই ফুলফিলিং। অভিজ্ঞ পাইলট মেঘের মধ্য দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে।
চরম উত্তেজনা আর প্রবল ভয়ে মিলেমিশে ওই ১৫ মিনিট সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত যেন আরও বেশি করে বাঁচা। তাই এ সুযোগ ছাড়বেন না। এখানে প্যারাগ্লাইডিংয়ের সার্ভিস প্রোভাইডার অনেকই আছে, যে কোনওটা বেছে নিতে পারেন।
প্যারাগ্লাইডিংয়ের মজা নিতে ভুলবেন না
এর পর আমরা গিয়েছিলাম সিলেরি গাঁও। নামটা হয়তো অনেকেরই শোনা, কিন্তু ট্রেক করে পৌঁছেছিলাম সিলেরি গাঁও ভিউ পয়েন্টে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট হেঁটে পৌঁছে যাবেন একটা খাড়াই বাঁধানো পথে। সে পথ ধরে আর একটু উঠে গেলেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা আপনাকে গ্রাস করবে।
এ যেন মহাদেবের গলায় নাগপাশ! হিমালয়কে চার দিক থেকে পেঁচিয়ে রেখেছে তিস্তা। পরিবেশকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে ঘণ্টিপোকার আওয়াজ, যা শুনলে মনে হয়, দেবাদিদেবের আরাধনায় চতুর্দিকে যেন ঘণ্টা বেজে চলেছে। বড় সুন্দর স্বর্গীয় এক পরিবেশ, যেখানে চাইলেও আপনার মন কলুষিত হতে পারবে না। ভিউ পয়েন্ট থেকে চার দিকের উন্মুক্ত যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তাকে বন্দি করার সাধ্য ক্যামেরার নেই। তা থাকবে আপনার উপলব্ধিতে।
কীভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে রাতে ট্রেনে চেপে বসুন। পরদিন সকালে পৌঁছে যান নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।
যাঁরা ফ্লাইটে যেতে চান, তাঁরা বিমানে পৌঁছে যান বাগডোগরা বিমানবন্দর। সেখান থেকে ভাড়া গাড়িতে শিলিগুড়ি বা এনজেপি।
নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিন কিংবা শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান কালিম্পং। সেখান থেকে আট মাইল দূরত্বের পেট্রল পাম্পটি পেরিয়ে, পাহাড়ি পথ ধরে এগোতে থাকবুন। প্রায় চার কিলোমিটার এগিয়ে গেলে পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্য, চিবোতে।
লেখা: পারমিতা সাহা
তথ্য ও ছবি: রত্নাবলী দত্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy