Advertisement
০৩ মে ২০২৪

‘গিলি গিলি গে’র মানে জানেন?

এই আশ্চর্য ‘মন্ত্র’ আউড়ে কেউ দাঁতে করে ধরে ফেলেন ছুটে আসা বুলেট। কেউ চোখের দৃষ্টি ফেলে বাঁকিয়ে দেন ধাতব ছুরি। পৃথিবীবিখ্যাত জাদুকরদের বিচিত্র সব খেলার কাহিনি শোনাচ্ছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যবিবিসি টেলিভিশনের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী রিপোর্টার নেমেছেন বার্সিলোনার রাস্তায়! ম্যাজিশিয়ান তাঁকে নিয়ে ঘুরবেন শহরের পাড়ায় পাড়ায়। টিভি-র দর্শক দেখছে লাইভ।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বিবিসি টেলিভিশনের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী রিপোর্টার নেমেছেন বার্সিলোনার রাস্তায়!

ম্যাজিশিয়ান তাঁকে নিয়ে ঘুরবেন শহরের পাড়ায় পাড়ায়।

টিভি-র দর্শক দেখছে লাইভ।

মহিলা যেমন যেমন মনে হল ঘুরে বেড়ালেন। পাশে পাশে চলেছেন ম্যাজিশিয়ান।

শেষে পছন্দ করে এক দামি কাফেতে বসে দু’জনের জন্য দুটো নরম পানীয় অর্ডার করলেন। বিল মেটানোর পর জাদুকর পকেট থেকে বার করলেন একটা কাগজ, যাতে পরিষ্কার লেখা আছে রিপোর্টার শহরের কোথায় কোথায়, কী কী দেখে বেড়াবেন, কী বই কিনবেন বুক স্টোরে এবং কোন কাফেতে বসে কী ড্রিংক অর্ডার করবেন!

স্তম্ভিত রিপোর্টারের সঙ্গে দর্শকও শুনছে সুদর্শন, মধ্যবয়েসি জাদুকরের যুক্তি— আমার কাজটা হল আপনার মনটা পড়ে ফেলা। মাইন্ড রিডিং। তার পর আপনাকে দিয়ে আমার মনমতন কাজটা করিয়ে নেওয়া।

আসুন আরেকটি খেলায়...

মরুভূমির মতো খোলা প্রান্তর। সেখানে দশ ফুট উঁচু, দশ ফুট চওড়া দু’দুটো কাঠের ফ্রেম রাখা হল পাশাপাশি। মোটা ক্যানভাসে ঢাকা।

এক ব্রিটিশ মহিলা রেসিং-কার ড্রাইভারকে গাড়ির চাবি দিয়ে বলা হল দুটো ফ্রেমের যে-কোনওটার একটা দিয়ে দেড়শ’ মাইল স্পিডে ড্রাইভ করে যেতে। মহিলা স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসতে ম্যাজিশিয়ান দূর থেকে এসে দাঁড়ালেন একটি ফ্রেমের পিছনে। এবং মহিলা ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে চলে গেলেন একটা ফ্রেম তছনছ করে।

পাশের ফ্রেমের পিছনে দেখা গেল দিব্যি অক্ষত দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাজিশিয়ান। এও এক ভয়ঙ্কর মাইন্ড রিডিং। মনের ম্যাজিক।

এ হেন জীবন-মৃত্যু খেলা কলকাতায় বসেও দেখেছি আমরা। জাদুকরের নাম প্রিন্স শীল।

দর্শকদের থেকে ডেকে নেওয়া হল একজনকে, রিভলভারের ট্রিগার দাগার জন্য। কলকাতার এক নামী পুলিশ কর্তা এক বার উঠে গিয়েছিলেন ওই ডাকে। একটা বড় বাটিতে এক গুচ্ছের টোটা রেখে অতিথিকে বলা হল গোটা কয়েক টোটা রিভলভারে ভরে নিতে। কোনও হদিশ নেই প্রিন্স শীলের ছ’ঘোড়ার যন্ত্রে ক’টা গুলি এবং কোথায়।

এ বার শুরু হল অতিথির মাইন্ড রিডিং। শীল দাঁড়িয়ে একটা কাচের ঢালের অদূরে। যদি ওঁর মনে হয়, ট্রিগার টিপলে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার হবে, তবে তিনি আঙুল দেখাবেন নিজের কপালের দিকে। আর গুলি আছে বুঝলে কাচের শিল্ডের দিকে।

দর্শক তাজ্জব হয়ে দেখল, কাচের ঢালে তাক করলে গুলিতে ফেটে চুরমার হচ্ছে সেটা। আর জাদুকর নিজের কপাল দেখালে ফাঁকা আওয়াজ!

প্রিন্স শীল এ খেলাকে মাইন্ড রিডিং-এর নজির বলেন। ম্যাজিকের শাস্ত্রকাররা অবশ্য এ হেন মনপড়াকে হিপনোটিজম বা সম্মোহনের অন্তর্গত মনে করেন।

হিপনোটিজম-এর আরও একটি গল্প না শুনিয়ে পারছি না।

১৯৭৯। হেমন্ত কাল। ব্রাসেলস-এ বসে টিভিতে লাইভ দেখছি শহরের সেরা প্রেক্ষাগৃহে দুনিয়ার সেরা জাদুকরের সেরা খেলা। যাঁদের মধ্যে আছেন সে-সময়কার ক্রমশ দুনিয়া কাঁপিয়ে তোলা ম্যাজিশিয়ান ডেভিড কপারফিল্ড।

আসরের শেষ খেলা।

স্লেট অব হ্যান্ড বা হাত সাফাইয়ের হুডিনি বলা হত যাঁকে, সেই শুভ্রকেশ বৃদ্ধ স্লাইডিনি এলেন স্টেজে। এক হাতে একটা বেতের ঝুড়ি, অন্য হাতে এক রাশ কাগজ।

মঞ্চে এসে দর্শকদের থেকে একজনকে উঠে আসতে বললেন। এক চালাক চতুর তরুণ উঠে গেলেন। তাঁকে সামনে একটা স্টুলে বসিয়ে অন্য একটা স্টুলে বসলেন স্লাইডিনি।

পাশে ঝুড়িতে রাখা কাগজ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ছোট্ট একটা গোলা পাকিয়ে যুবককে বললেন, ‘‘কাগজটা আমার কোন মুঠিতে আছে বলে মনে হয়?’’

যুবক দেখালেন ডান হাত। স্লাইডিনি মুঠি খুলে দেখালেন— নেই!

তা’হলে বাঁ হাত?

সে মুঠিও খুলে দেখালেন— নেই!

তা হলে কোথায় গেল কাগজের ছোট্ট গোলা? হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে যুবক বোঝালেন: বুঝতে পারছি না। অথচ হলের দর্শক এবং টিভির সামনে যারা, স্পষ্ট দেখলাম, গোলা পাকাতে পাকাতে স্লাইডিনি কাগজটা যুবকের মাথার পিছনে ছুড়ে দিলেন।

এর পর স্লাইডিনি একটার পর একটা গোলা পাকাতে শুরু করলেন। আর গোলাগুলো ক্রমশ বড় থেকে আরও বড় হতে লাগল।

হলের ও টিভির দর্শক হাসতে হাসতে সেই কাণ্ড দেখছি। কিন্তু যুবকের গোচরেই আসছে না গোলাগুলো যাচ্ছে কোথায়!

শেষে স্লাইডিনি ওঁকে দাঁড় করিয়ে পিছন মুড়িয়ে দেখালেন ওঁর পিছনে স্টেজের অংশটা সাদা কাগজের গোলায় প্রায় আলাস্কা হয়ে গেছে!

এ খেলার পুরোটাই কিন্তু হাতের বাজি নয়। সঙ্গে স্লাইডিনি ওঁর জাদুকরি চাহনি দিয়ে একটা সম্মোহন জুড়তেন।

ইতিহাস বলছে যে, মাত্র দু’শ বছর আগেও হিপনোটিজম বা সম্মোহনকে মনে করা হত মিস্টিসিজম বা ভাবানুভূতির অন্তর্গত। কালে কালে এরও কিছু কিছু যুক্তি বা বিজ্ঞান ঠাহর করা গেছে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এর মান্যতা তৈরি হয়েছে।

এই সম্মোহনকেই বেশ নাটকীয় করে দেখানো হয় মানুষকে হাওয়ায় ভাসানো বা করাতে কাটার খেলায়। তবে ভাসানোর খেলাকে ইল্যুশন বা মায়ার ভেল্কি বলে ধরা হয় ম্যাজিকে। আর মন পড়া বা মাইন্ড রিডিং-কে এখনও জাদুবিশ্বের বড় অংশে ভেল্কি কী ভোজবাজির থেকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা প্রবল। বলা বাহুল্য, মাইন্ড রিডিং নিয়ে জগৎ জুড়ে তাই গল্পের কোনও সীমাসংখ্যা নেই। আর তেমন একটা অতুলনীয় গল্প আমাদের দেশের সেরা জাদুকর পিসি সরকারকে নিয়ে।

হ্যাঁ, সরকার সিনিয়র।

বিদেশের এক ভরাট হলে বিশ্বজোড়া খ্যাতির পিসি সরকার শো করতে এলেন পাক্কা এক ঘণ্টা দেরিতে। কিন্তু জাদুসম্রাট এমন ভাবে ঢুকলেন যেন সময় নষ্টের কোনও ব্যাপারই ঘটেনি। কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে প্রতুলচন্দ্র আকাশ থেকে পড়লেন।—‘‘সে কী! খেলা তো ছ’টায় শুরু, আর আমি তো ছ’টাতেই ঢুকলাম!’’

গোটা হল তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে, তাই তো! কোথায় সাত, বাজে তো ছ’টাই!

এর কতটা কী সত্যি বলা মুশকিল। কিন্তু কাহিনি হিসেবে এর জবাব নেই।

মাইন্ড রিডিংকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সাধারণ মানুষের পক্ষে সমস্যা বইকী!

আপাত দৃষ্টিতে একে কিছুটা অতিপ্রাকৃত ভেবে নেওয়া যায়। যদি মাইন্ড রিডিংও অতি তুঙ্গ পর্যায়ের কৌশল, দক্ষতা ও মনঃশক্তির উপর নির্ভর করে। ইজরায়েলি psychic (এ ভাবেই ওঁর বর্ণনা হয়) ইউরি গেলার তো দাবি করতেন যে, তিনি চোখের দৃষ্টি ও মনের শক্তিতে চামচ, ছুরি বাঁকাতে বা সিল করা খামের ভেতরকার কাগজ পাল্টে দিতে পারেন।

সত্তর দশকে এই নিয়ে জগৎ জুড়ে বহুত হইহুল্লোড় হয়েছিল। কিন্তু কারও এ দাবি টেকেনি। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই পশ্চিমী দেশের থিয়েটার হলে কী ভোদভিলে মাইন্ড রিডিং-এর আসর জমতে শুরু করে।

এর কিছু পরে ১৯০৫-এর লন্ডনের আলহামব্রা প্রেক্ষাগৃহে ডেনমার্কের এক দম্পতি তুলকালাম বাঁধিয়ে দেন তাঁদের মনবদল বা থট ট্রান্সফারেন্স খেলা দেখিয়ে। তাঁদের শো-এর বিজ্ঞাপনে লেখা হত ‘দ্য জ্যানসিগজ: টু সাইডস উইথ আ সিঙ্গল থট’। অর্থাৎ, জ্যানসিগজ যুগল: দুটি মনে একই চিন্তা।

এতকাল বাদে সে-বৃত্তান্ত প়ড়লেও চমকে যেতে হয়।

কী রকম?

চোখবাঁধা অবস্থায় মহিলা স্টেজে বসে। তাঁর কর্তা প্রেক্ষাগৃহে ঘুরে ঘুরে দর্শকদের থেকে ঘড়ি, কলম, টাইপিন, কয়েন, লিপস্টিক, চশমা, কোমরের বেল্ট হেনাতেনা জোগাড় করে বেড়ালেন। তার পর ওই জিনিসগুলোর নিখুঁত বর্ণনা দিতে শুরু করলেন মহিলা। ঘড়ি হলে ধাতু, ব্র্যান্ড, কোন দিকে ঘড়ির দুটি কাঁটা মুখ ঘুরিয়ে, তার পিছনে কী কী লেখা আছে, এবং আশ্চর্যের আশ্চর্য, সেই ঘড়ি ক’বার বন্ধক দিয়ে টাকা ধার দে‌ওয়া হয়েছে!

শার্লক হোমস কাহিনিমালার রচয়িতা স্বয়ং আর্থার কোনান ডয়েল ওঁদের কাণ্ডকারখানার মানে-মাথা না পেয়ে দম্পতিকে বর্ণনা করেছিলেন ‘সাইকিক’ বলে!

এই স্মরণ ও মননের রহস্য হল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘কোড’-এ কথা বলার অনুশীলন। মুহূর্তের মধ্যে কত অসংখ্য সূত্র ও কোড যে মাথায় ঘোরাতে হয় তা খেয়াল করলেই ভিরমি খেতে হয়।

১৯০৬-এ এঁদের এই কাজ দেখে ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ও রানি আলেক্সান্দ্রা তাঁদের নিজেদের প্রাসাদে না ডেকে পারেননি।

এই ধারার সেরা কাজ অবশ্য দেখিয়ে গেছেন এক ইংরেজই— মরিস ফোগেল। স্টেজের খেলা ছাড়াও তিরিশ বছর ধরে তিনি পাবলিসিটি স্টান্ট হিসেবে একের পর এক আজব খেলা দেখিয়ে গেছেন। যার মধ্যে একটা ছিল, মহাকাশ যাত্রার রকেট থেকে উধাও হয়ে যাওয়া। সেই পলায়নের সাক্ষী থাকতে ফোগেল আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের জোড্রেল ব্যাঙ্ক-এ বসানো জায়ান্ট রেডিয়ো টেলিস্কোপের ডিরেক্টর স্যার বার্নার্ড লাভেলকে।

এই সুযোগে জানিয়ে দিই, আমাদের দেশে পিসি সরকার সিনিয়র ও পিসি সরকার জুনিয়রও অসাধারণ মজার সব খেলা দেখিয়েছেন, যা অবলীলায় পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। প্রতুলচন্দ্র ইউরোপের জনবহুল রাস্তায় চোখে মোটা কালো ফেট্টি জড়িয়ে দিব্যি সাইকেল চালিয়ে বেড়িয়েছেন। তার পর হাতপায়ে শিকল বেঁধে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে রেললাইনে। অথচ তুমুল বেগে ট্রেন এসে পড়ার আগেই তিনি শিকল খুলে প্ল্যাটফর্মের ওপর!

আর প্রদীপ সরকার মানে জুনিয়র সরকারকে তো বেঁধেছেদে ক্যাপসুলে ভ’রে নামানো হয়েছে সমুদ্রের জলে। তার পর তো দশ গোনার আগেই তিনি শিকলমুক্ত ও ভাসমান।

আবার ফোগেল-এ ফিরে যাচ্ছি।

বিবিসি রেডিয়োয় ‘স্টারলাইট আওয়ার’ নামে মাইন্ড রিডিং শো করে তিনি গোটা দেশকে পাগল করে দিয়েছিলেন। স্টুডিয়োতে থিক থিক করছে দর্শক, আর খেলা যা চলছে তা রেডিয়োর প্রেজেন্টার নিখুঁত ডিটেলে বর্ণনা করে শোনাচ্ছেন বিবিসি রেডিয়োর বিস্তীর্ণ শ্রোতৃমণ্ডলীকে।

প্রশ্ন উঠবে, শুনে শুনে কি ম্যাজিক উপভোগ করা যায়?

যায় বই কী, যদি খেলাগুলো সম্পূর্ণ কথানির্ভর হয়। এই খেলায় যেমন দর্শকদের থেকে কেউ স্টেজে উঠে এলেই ফোগেল তার মন পড়ে বলে দিচ্ছিলেন তার নাম, বাড়ির ঠিকানা এবং পেশা! এ ভাবে কত জনেরই যে ঠিকুজি-কুষ্টি উগরে বলে দিলেন ক্রমাগত, যে উপস্থিত দর্শক এবং অদৃশ্য শ্রোতা তো বিস্ময়ে বিগলিত।

শেষ খেলায় একটা খাম খোলা হল, যেটি পনেরো দিন আগে তিনি রেডিয়ো কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছিলেন। খাম খুলে দেখা গেল তাতে একটি কাগজে লেখা, অনুষ্ঠানের দিনের খবরের কাগজের হেডলাইন!

তবে মরিস (দ্য আমেজিং) ফোগেল অমর হয়ে আছেন তাঁর সব চেয়ে বিপজ্জনক এবং সব চেয়ে বিখ্যাত খেলা ‘রাশিয়ান রুলেত’-এর জন্য। যে-খেলায় টেবিলের ওপর পাঁচখানা টোটাভরা এবং একটা খালি রাইফেল রেখে টেবিলের মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।

তার পর ছ’জন রাইফেল শ্যুটারকে বলা হয় একটা-একটা বন্দুক তুলে নিতে। সেই ছ’জনের মধ্যে যার রাইফেলে গুলি নেই বলে মনে করলেন, ফোগেল তাঁকে বললেন, ওঁর কপালে তাক করে ফায়ার করতে। আর বাকিদের দেখালেন নিজের মাথার পিছনে ও উপরে রাখা পাঁচটা ডিনার প্লেট।

রাইফেল দাগা হতে পাঁচটা প্লেটই চুরমার হল, ফোগেল রইলেন যে–কে-সেই। এই খেলাকে বর্ণনা করা হয়েছে মন-পড়ার এক চরম বাজি বলে।

রচনার প্রথম দিকে আমাদের শহরের প্রিন্স শীলের যে রিভলভারের খেলার কথা বলেছি তা ফোগেলের এই খেলার দ্বারা অনুপ্রাণিত।

জীবন বাজি রেখে আরও একটা গুলি ও বন্দুকের খেলা তিনি দেখান যা তাঁকে এ দেশের সেরাদের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। তা হল রাইফেল থেকে ছো়ড়া বুলেট দা়ঁত দিয়ে ধরা! এতে মন পড়াপড়ির ব্যাপার নেই, কিন্তু চোখ-মন-শরীর ও অনুশীলনের যে আশ্চর্য সূচ্যগ্র মিলন এতে যে বার-বার দেখেও ঘোর কাটে না।

আমি একটি বারের ঘটনা বলছি।

তিরুঅনন্তপুরমে গাঁধী পার্কে খেলা। যেহেতু বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন মহাত্মা, তাই শান্তির বার্তা দিতে এই বুলেটের খেলা। তা দেখতে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের ভিড়।

একটি রাইফেলে কার্তুজ ভরা হল, তাতে বিশেষ একটা দাগ চিহ্ন হিসেবে কেটে বসানো হল। বন্দুকধারী এবং জাদুকরের মাঝখানের একটা কাচের পাত বসিয়ে দেওয়া হল। তারপর এক, দুই, তিন...গুড়ুম।

কাচের পাত ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন জাদুকর। সব দর্শক উৎকণ্ঠায় লাফিয়ে উঠল — জাদুকর তা হলে কি মারাই পড়লেন? মহিলারা, দুর্বলচিত্তেরা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কিন্তু দাঁতে সেই দাগানো কার্তুজ চেপে ধরে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন ম্যাজিকের রাজকুমার প্রিন্স শীল। টিপিক্যাল মধ্যকলকেতে শিক্ষিত বাঙালি।

কিন্তু বাঙালি ও শিক্ষার কথা উঠলে উঠে আসবেই প্রদীপচন্দ্র সরকার, থুড়ি, পিসি সরকার জুনিয়রের কথা। বিশেষ করে মনন শক্তির প্রসঙ্গ যদি ওঠে।

১৯৭২-য়ে কলামন্দিরে চোখবাঁধা অবস্থায় ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে যা ভেলকি তিনি দেখিয়েছিলেন তা জন্মেও ভোলার না। হল থেকে উঠে আসা নারীপুরুষ বোর্ডে কোনও ইংরেজি শব্দ লেখা শুরু করতে না করতেই বোর্ডের আরেক জায়গায় সোঁ সোঁ করে শব্দটা লিখে শেষ করে দিচ্ছেন প্রদীপ।

কেউ হয়তো অনেকগুলো সংখ্যা পর পর লিখলেন। লেখা শেষ হতে না হতেই তাদের যোগফল, বিয়োগফল, গুণফল, ভাগফল দিয়ে দিচ্ছেন প্রদীপ। এবং যে গতিতে তা ভারতবর্ষে অদৃষ্টপূর্ব।

সংখ্যা ও মাইন্ড রিডিংয়ের যুগলমিলনে কী ঘটতে পারে তার এক অপরূপ কীর্তির কথা শুনিয়ে শেষ করব।

নাটের গুরু মার্কিন মেন্টালিস্ট গ্লেন ফলকেনস্টাইন। মোটা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে যা-সব সংখ্যা ও মনের ম্যাজিক দেখিয়ে গেছেন তাতে ওঁকে ম্যাজিকের আইনস্টাইন বলে ভাবলেও দোষ নেই।

ওঁর খেলায় অডিয়েন্স থেকে চার জনকে ডেকে নেওয়া হল। প্রত্যেককে বলা হল ১০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে একটা সংখ্যা ভেবে নিতে। তারা যখন তাদের মনোমত সংখ্যা বোর্ডে লিখছে, গান্ধারীর মতো চোখ বাঁধা ফলকেনস্টাইন তাদের সেই সব ভাবিত এবং লিখতে থাকা সংখ্যার যোগফল কী দাঁড়াবে তা এক অন্য ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে ফেললেন।

যোগফল তিনি তো আগেই লিখে ফেলেছেন। অন্য সংখ্যা লেখা হলে যোগ করে দেখা গেল ফল অবিকল এক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Magics Magicians
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE