ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে শিল্পী
দেখি নাই ফিরে
পার্বতীর স্মৃতি: একটা কথা বলি। ‘দেশ’ পত্রিকায় সমরেশ বসুর উপন্যাস যখন আঁকা হচ্ছে, তখনও লেখক এবং শিল্পী পরস্পরকে চিনতেন না। আনন্দবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষই অনুরোধ করেছিলেন, ‘সমরেশ বসু রামকিঙ্করের উপর জীবনী-উপন্যাস লিখছেন, আপনাকে ছবি আঁকতে হবে।’ সমরেশবাবু যা লিখতেন, প্রতি মাসে সেগুলো আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। উনি তা পড়ে ওঁর মতো ভেবে ইলাস্ট্রেশন করে দেশ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। পরে ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক পার্টিতে দু’ জনের প্রথম পরিচয়।
বলাকা: ওই সিরিজটা আমি বাবার পাশে বসে পুরো দেখেছি। এক ধরনের রং-পেন্সিল বা কন্টি আর জল-রং ব্যবহার করতেন। আর মাঝে মাঝে বোঝাতেন, এটা চাইনিজ ওয়াটার কালার, এটা গুয়াশ, ওটা ব্রিটিশ ওয়াটার কালারের স্টাইল। দেশ-এ সমরেশ বসু বা রামকিঙ্কর ছাড়াও বাবার কাছে ওই জলরঙের এ-দিক সে-দিক বোঝাটা খুব আনন্দের। বাবা কোনও দিন আমাকে বা আমার ভাইকে ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে দেননি, উনি ও সবের ঘোরতর বিরোধী। বলতেন, এই যে আঁকার শিক্ষকেরা এ ভাবে গাছ, পাখি, গ্রামের দৃশ্য এঁকে দেন, এতে বাচ্চার ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট হয়। সেই বাবার কাছে বসে ছবি দেখা। আর ওই ‘দেখি নাই ফিরে’ আঁকতে আঁকতেই তো তিনি কলেজ লাইফের পর ফিরে এলেন জলরঙে। তার আগে তো অয়েল পেন্টিং। বাবা বলছিলেন, ফের জলরঙে ফিরতে ভাল লাগছে।
কয়েক ঘণ্টায় ইন্দিরা
পার্বতীর কথা: ওই ফোনটাও বিকেলে ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে এসেছিল। সে দিন দুপুরেই ইন্দিরা গাঁধী দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন, দ্রুত কিছু এঁকে দিতে হবে।
সারা শহরে প্রায় অঘোষিত কারফিউ, তার মধ্যেই বিকেলে উনি বেরোলেন। রাস্তাঘাট শুনশান, দোকানপাট বন্ধ। শুধু একটা ফুলের দোকান খোলা। সেখান থেকে জবার মালা কিনে বাড়ি ফিরলেন, তার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ইন্দিরার দৃষ্টিহীন শূন্যতা, জবার মালায় বুলেটের ছিদ্র, শুকিয়ে আছে চাপ চাপ রক্ত।
ছবিটা এঁকেছিলেন খুব দ্রুত। সারা রাত আদৌ লাগেনি। এমনিতে ওঁর অভ্যেস ছিল, রাত জেগে স্টুডিয়োয় কাজ করা। কিচ্ছু খেতেন না, মাঝে মাঝে শুধু কফি দিতে হত। সঙ্গে বিস্কিট-ফিস্কিট কিছু না। মাঝে মাঝেই দেখতাম, বুঁদ হয়ে আঁকতে আঁকতে তুলিটা কফির কাপেই ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই ভাবেই ভোর ছ’টা-সাতটা নাগাদ কাজ শেষ হত। কিন্তু তার পরও প্যালেট, ব্রাশ সব নিজে পরিষ্কার করে টেবিলে যেখানে রং লেগেছে তা মুছে স্নানে যেতেন। ওই যে টিপটপ থাকার অভ্যেস!
স্নান সেরে, এক কাপ চা খেয়ে বিছানায়। একটা অভ্যেস ছিল, ঘুম ভেঙেও পায়ের আঙুল নাচানো। অনেক দিন বেলাবেলি তুলে দিয়েছি, ‘কী গো, সাড়ে দশটা বাজে। উঠবে না?’ উনি পায়ের আঙুল নাড়াতে নাড়াতে জবাব দিয়েছেন, ‘আমি কি আর ঘুমোচ্ছি? ছবি তৈরি করছি।’ সকালবেলার বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতেই ওঁর মনে তৈরি হত অনেক ছবি।
আমার বাবা
বলাকা: এই রুট বা শিকড় জিনিসটায় বাবা খুব বিশ্বাস করতেন। উনি বলতেন, আমার শিকড় এখানে। দক্ষিণ কলকাতায় আমি কোনও দিন যাব না। বাড়িতে জিন্স পরার অনুমতি ছিল না, হয় শাড়ি নয় সালওয়ার কামিজ। স্কুল থেকে হয় মা বা ঠাকুমা কেউ একজন নিয়ে আসবেন। স্কুল থেকে বেরোনোর পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পড়ার ইচ্ছে ছিল, বাবা বললেন, ‘না, লেডি ব্রেবোর্ন’। আমাকে অত দূরে পাঠানোর ইচ্ছে ওঁর নেই। কলেজ বা বন্ধুদের বাড়ি যেখানেই যাই না কেন, ড্রাইভার গিয়ে নিয়ে আসবে। বাবা কি একটু রক্ষণশীল ছিলেন? হয়তো। আসলে সব সময় আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পেতেন। কিন্তু মানুষটাকে আবার অন্য ভাবেও তো দেখেছি। কলকাতায় কেবল টিভি, ভিসিআর আসার পর পরই আমাদের বাড়িতে। বাবা তখন বিবিসিতে ‘ইয়েস মিনিস্টার’, ‘অ্যালো অ্যালো’ এ সব সিরিয়াল দেখতেন, আর ফি রবিবার আমাদের সঙ্গে নিয়ে ‘স্টার ট্রেক’ দেখতেই হবে। ভিসিআর কিনেই বাড়িতে আনা হল ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ আর সব বিদেশি ছবি। এখনও মনে পড়ে, ৯/১০ বছর বয়সে বাবার পাশে বসে তারকভস্কি দেখছি, বিশেষ বুঝতে পারছি না। কিন্তু বাবা ধৈর্যের সঙ্গে আমাদের দুই ভাই বোনকে গল্পটা বলে চলেছেন।
আর ছিল অভিমান। কলেজ-জীবন অবধি বাবাই আমাকে নিউ মার্কেট, পার্ক স্ট্রিটে নিয়ে গিয়ে শাড়ি, সালওয়ার কামিজ কিনে দেবেন। মায়ের শাড়িও কিনবেন তিনি নিজে। এর অন্যথা হলে মুখ ভার। আমরাও সাহস করতাম না। আসলে সব মিলিয়েই বিকাশ ভট্টাচার্য একজন পারিবারিক মানুষ। শিল্পী মানেই বোহেমিয়ান, এই সমীকরণ অন্তত ওঁর জীবনে নেই।