Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

পোষা কচ্ছপদের নাম রেখেছিলেন অমর আকবর অ্যান্টনি

গাছকে ভালবাসতেন সন্তানের মতো! ছিলেন দুর্ধর্ষ রাঁধুনি। তাঁর চলে যাওয়ার এক মাস পর বন্ধু ওম পুরী-র স্মৃতিচারণায় অঞ্জুম রাজাবলী। শুনলেন ভার্জিনিয়া ভাচা ভোর তখন কতই’ বা!বড়জোর পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা। ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠল। তুলতেই শুনি, ও পারে ওম!‘‘কী ব্যাপার, এত সকালে?’’ ‘‘এক্ষুনি আমার বাড়ি চলে এসো।’’‘‘সিরিয়াস কিছু?’’

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ভোর তখন কতই’ বা!

বড়জোর পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা। ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠল। তুলতেই শুনি, ও পারে ওম!

‘‘কী ব্যাপার, এত সকালে?’’

‘‘এক্ষুনি আমার বাড়ি চলে এসো।’’

‘‘সিরিয়াস কিছু?’’

‘‘এসোই না। এখন আর কথা বলতে পারছি না। রাখছি।’’

ওমের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে পাঁচ-ছ’টা বাড়ির পরে। সটান গিয়ে দেখি, ওম শিশুর মতো জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে বসে আছে। আর সদ্য কিনে আনা কচ্ছপের ডিম ফুটে তিনটে বাচ্চা বেরিয়েছে। তা নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা ওমের!

তখনও কচ্ছপ পোষা বেআইনি হয়নি। ফুটপাথের কোনও এক দোকান থেকে ও একজোড়া কচ্ছপ কিনে এনেছিল কয়েক দিন আগেই। তাদের জন্য ছোট্ট একটা বাগান বানিয়েছিল। একটা বড়সড় খাঁচাও। তার পরই ওই কাণ্ড! এর পর তিন বাচ্চা-কচ্ছপের নাম রেখেছিল— অমর আকবর অ্যান্টনি!

এই হল ওম পুরী!

ওর পশু-প্রীতি যে কী পর্যায়ের ছিল, চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।

ব্যাপারটা আমি খেয়াল করি আমাদের আলাপের একেবারে গোড়াতেই। সে ’৯৪ সালের কথা।

তার আগে ওমের ‘আক্রোশ’, ‘অর্ধসত্য’ দেখে আমি পুরো ফ্ল্যাট। এর পর যখন গোবিন্দ নিহালনী ‘দ্রোহকাল’ করবেন, স্ক্রিপ্ট লিখলাম আমি। ওম এল অভিনয়ে।

প্রায় প্রথম মুহূর্তে থেকেই বুঝে গেলাম, আমাদের বন্ধুত্বটা জমে যাবে। তার পর হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, আমরা দু’জনে পড়শি। এর পর তো বাড়িতেও যাতায়াত শুরু হল। আমার বাড়িতে তখন দুটো পোষা কুকুর। একটা বক্সার, অন্যটা রাস্তা থেকে আনা। ওম ওই দু’জনকেই প্রচণ্ড ভালবাসত।

এর পর ওম আর ওর বউ নন্দিতা দু’জনেই ঠিক করল, ওরাও রাস্তা থেকে একটা কুকুর বাড়িতে নিয়ে পালবে। সেই সময়ে একটা মেয়ে-কুকুরকে ওরা দেখল, যার সদ্য খানকতক বাচ্চা হয়েছে। কোনও এক বাচ্চাকে পছন্দও করল। কিন্তু সদ্যোজাত ছানাকে মায়ের কাছ থেকে না নিয়ে সাত-আট সপ্তাহ নজরে নজরে রাখল। এর পর যথা সময়ে নন্দিতা বাচ্চাটিকে নিতে গিয়ে একদিন দেখে, ওর চামড়ায় ঘা হয়েছে, শরীরটাও বেশ দুর্বল। তাই তাকে না নিয়ে, নিল অন্য একটিকে।

ওম বাড়ি ফিরে সব দেখেশুনে রেগে একশা।— ‘‘নো নেভার। এটা হতেই পারে না। ঘেয়ো হোক আর যাই-ই হোক, ও-ই ছিল আমাদের। এক্ষুনি যাও, ওকেই নিয়ে এসো। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না।’’

নন্দিতা বাধ্য হয়ে তা-ই করেছিল!

শুধু পশু নয়, গাছপালাকেও ও যে ভাবে ভালবাসত, দেখে তাজ্জব হয়ে যেতাম!

ওর একটা ওপেন-এয়ার টেরেস ছিল। সেখানে একটা রাবার-প্ল্যান্ট রেখেছিল। তাকে রোজ কী যে যত্ন করত! একটা পাতায়ও এক কণা ধুলো দেখিনি কোনও দিন। তো, একটু বড়সড় হয়ে যেতে ও ঠিক করল গাছটাকে বাগানে বসাবে। তাতে আমি বললাম, ‘‘আমায় দাও না। আমি ড্রইং রুমে রাখি।’’

দিল। নিয়েও এলাম। রাখলাম লিভিং-এ। তার ঠিক এক সপ্তাহ বাদে ওম এল আমাদের বাড়ি ডিনারে। বাড়িতে ঢুকেই কোনও কথাটথা নয়, সোজা চলে গেল ফ্রেঞ্চ উইনডোর ধারে রাখা সেই গাছের কাছে। তার পর দেখি সে কী আদর তাকে!— ‘‘আর্‌রে মেরে পেয়ারে, তু কিধার চালা গ্যয়া...।’’

ওমের আর একটা গুণ ছিল, অসম্ভব ভাল রান্না জানত। এমনও হয়েছে, ওম আমাদের বাড়ি এসেছে। সে দিনই আবার বাড়ির রান্নার মেয়েটি আসেনি। আমরা বললাম, চলো, আজ বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে নিই। সে হল না। ওর ঝোঁক চাপল, ও বাড়ির রান্নাই খাবে। এবং নিজে হাতে করবে। কারও কথাই শুনবে না।

এক রাতের গল্প শুনেছি নন্দিতার কাছে। রাত তখন প্রায় তিনটে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে নন্দিতা দেখে, ওম পাশে নেই। কোথায় গেল! বাথরুমে? না, তাও নয়। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। আর ওম কিচেন-প্ল্যাটফর্মটার ওপর বসে পা ঝুলিয়ে পরোটা খাচ্ছে। ধরা পড়ে শিশুর মতো বলল, ‘‘খিদে পেয়ে গিয়েছিল তো!’’

তো, রুটি মাখন ফল তো ছিলই, সে সব খেলেই তো হত। তা হবে না, চপচপে ঘি ছড়ানো ওই পরোটাই চাই। সে খেতেও নাকি দুর্ধর্ষ! নন্দিতাকে ‘টেস্ট’ করতে দিয়ে ওরও যখন ভাল লাগল, ওকেও দিল করে!

ওমের সঙ্গে সময় কাটানোর একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে।

‘অর্ধসত্য’-য় সদাশিব আম্রপুরকারের সঙ্গে ওম পুরী

জানুয়ারি, ২০১২। আমি তখন পুণেতে। এফটিআইআই-তে স্ক্রিন রাইটিং ডিপার্টমেন্টে পড়াই। ওম শ্যুটিং-এ গিয়েছিল।

শ্যুট শেষে হঠাৎ ফোন, ‘‘আর্‌রে গুরু, ক্যয়া কর্ রাহা হ্যায়?’’ ধাঁ করে চলে এল ইনস্টিটিউটে। আমরা দু’জনে মিলে ড্রাইভ করে গেলাম খান্ডালা। ওমের ওখানে একটা বাড়ি ছিল।

সে দিন কী ফুর্তি ওর! নিজে হাতেই বাড়ি গোছগাছ করল। আমার বিছানাটাও পেতে দিল। শক্ত বালিশ আমার পছন্দের, সেটাও দিল। তার পর কত আড্ডা! দু’জনে ডিনার করলাম বাইরে, একটা ‘থালি প্লেস’-এ। ও নিরামিষ খেতে ভালবাসত। খেয়েদেয়ে উঠে টাকা মেটাতে যাব, দেখি হোটেল-মালিক কিছুতেই ওমের কাছ থেকে টাকা নেবে না। শেষে ওম এমন একটা অ্যামাউন্ট টিপস দিল, যেটা ওই বিলের ঢের বেশি!

বাড়ি ফিরেও আড্ডা। অনেক রাত অবধি। সকালে উঠে দেখি, ওম ততক্ষণে উঠে পড়ে বাগানে চলে গেছে। আমায় দেখে নিজে হাতেই ব্রেকফাস্ট বানাল। তার পর আমরা ফিরে এলাম।

সে যে কী মিষ্টি স্মৃতি!

তবে ওর আমার মধ্যে সবটাই যে মিষ্টি-মিষ্টি, ভাল-ভাল এমনটাও নয়। তক্কও কম করিনি দু’জনে। দু’বারের কথা তো বলতেই পারি। এক বার ও যখন বিজেপি-র হয়ে প্রচারে নামল। দ্বিতীয় বার, ও যখন ভারতে ‘নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট’ নিয়ে বলে বসল, ‘‘চিনকে ঠেকাতে গেলে এটা দরকার।’’ দু’বারই প্রচণ্ড খেপে গিয়ে তক্ক করেছিলাম।

তা বলে বন্ধুত্বে যে কোনও দিন টাল খেয়েছে, তা নয়।

বছরে চারটে দিন। ১ মে ওর বিবাহবার্ষিকী, ২ জুলাই ছেলের জন্মদিন, অক্টোবরের ১৮ ওর নিজের জন্মদিন আর নভেম্বরের ১০ নন্দিতার। এই ক’টা দিন ওমের বাড়িতে পার্টি ছিল বাঁধা। এই সব মুহূর্তয় ওকে দেখে আরও মনে হত, ও ‘বন্ধু’ শব্দটাকে কী ভাবে নিজের মধ্যে আদর করে বাঁচিয়ে রাখত। এখানেই নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কেমিস্ট্রির কথাটা বলব। পাশাপাশি অমন মাপের দুই ব্যক্তিত্ব। যে কোনও সময় তো সংঘাত লেগে যেতে পারত। এক দিনের জন্যও তেমন কিছু দেখলাম না।

শেষে একদম ব্যক্তিগত একটা আফসোসের কথা বলব।

আমার ছেলের নামও ইশান। ওমেরও তাই। ওম আমার ছেলেকে ডাকত ‘ছোটে ইশান’। নিজের ছেলে ওর কাছে ‘বড়া ইশান’। আমার ছেলে এখন তেরো। ওম ওর কাছে ‘তায়াজি’, বাবার বড় ভাই।

দেওয়ালির আগে ওম এল আমাদের বাড়ি। ইশানের জন্য প্রচুর বাজি কিনে এনেছিল। আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না, দূষণ ইত্যাদি নানা কারণে আমারা বাজি পোড়াই না। তো, দিন কয়েক পরে ফোন করে বলল, ‘‘কী, ছোটে বাজি পোড়াল?’’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘‘না, আসলে ঠিক সময় পাইনি। নিউ ইয়ার্স-এ না হয়..।’’

ভেবেছিলাম, বাজিগুলো আমার স্ত্রী যে স্কুলে পড়ে, সেখানকার ছাত্রদের দিয়ে দেব। সেও আর হয়ে ওঠেনি।

জানুয়ারির ৪ তারিখ। হঠাৎ ওমের ফোন। —‘‘ছোটে বাজি পোড়াল?’’

আমি কেমন অস্বস্তির চোটে মিথ্যে কথা বলে দিলাম, ‘‘হ্যাঁ। ইশান এলে আমি তোমায় ফোনে ধরিয়ে দেব।’’

ইশান বাড়ি ফিরল। বললাম ওকে। ও সব শুনে আকাশ থেকে পড়ে বলল, ‘‘তায়াজিকে মিথ্যে বলব! অসম্ভব। আমি কিছুতেই ফোন করতে পারব না।’’ ও ফোন করলও না। কিন্তু সেই যে আমার অস্বস্তি শুরু হল, কিছুতেই আর যায় না!

ভেবেছিলাম, ওমের কাছে সত্যিটা বলে পাপস্খালন করব। তার মধ্যেই জানুয়ারির ৬ তারিখ খবরটা এল— ওম আর নেই!

এখন শুধু ভাবি, সময়ের কাঁটাটা যদি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া যেত! যদি একবার ওকে বলে গলার কাছে জমে থাকা ভারটা থেকে মুক্তি পেতে পারতাম!

সে আর কোনও দিনই হওয়ার নয়। আজীবন এই খেদটা আমায় বয়ে বেড়াতে হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Om Puri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE