Advertisement
E-Paper

বিস্মৃত নায়ক দুর্গাদাস

গত শতকের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে বাংলার মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই নায়ক। উত্তমকুমারের আগে তিনিই বাংলা সিনেমার যথার্থ ‘স্টার’, বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’। কেউ কেউ বলতেন তিনি ‘ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস অব দ্য ইস্ট।’ লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায়গত শতকের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে বাংলার মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই নায়ক। উত্তমকুমারের আগে তিনিই বাংলা সিনেমার যথার্থ ‘স্টার’, বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’। কেউ কেউ বলতেন তিনি ‘ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস অব দ্য ইস্ট।’ লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:৩০
বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিকেল ফুরিয়ে আসছে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে লাল আকাশের দিকে চেয়ে আছে ছেলেটি। সে অপেক্ষা করছে সন্ধে নামার।

ও দিকে তার অপেক্ষায় থেকে থেকে দিশেহারা উদ্যোক্তারা। সে না গেলে যে পালাগান শুরু করতে পারছেন না তাঁরা। জমিদার বাড়ির ছেলেটাই যে তাঁদের ‘পাণ্ডবগৌরব’ নাটকের নির্দেশক-অভিনেতা। এ দিকে সে নাটক করছে জানতে পেরে, তাকে বন্দি করে রেখেছে রক্ষণশীল বাবা-কাকারা। তাঁদের বিশ্বাস, অভিনয়ে নামলে মেয়েমানুষের সংস্পর্শে ছেলেটা বখে যাবে!

বাড়ির লোক যা-ই ভাবুক, ছেলেটা সংকল্প করেই নিয়েছে। সন্ধে নামতেই সে জানালার শিক বেঁকিয়ে, কাপড় ঝুলিয়ে একতলার কার্নিশে নেমে পড়ল। তার পর বাগান পেরিয়ে অন্ধকারে দৌড়। একেবারে গ্রিনরুম। দ্বিতীয় পাণ্ডবের মেকআপ নিয়ে সোজা মঞ্চে!

অভিনয়ের জন্য ঘর-পালানো সে দিনের এই ডাকাবুকো ছেলেটিই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৮৯৩-এর ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ গড়িয়ার এক বর্ধিষ্ণু জমিদার বংশে জন্ম দুর্গাদাসের। বাবা তারকনাথ ছিলেন রাশভারী জমিদার। বেশির ভাগ সময় তিনি বাইরে থাকতেন। বাড়িতে কাকা যদুনাথের নজর এড়িয়ে মা অন্নপূর্ণার কাছেই চলত আদর-আবদার। সুন্দরবন অঞ্চলের চোরাই মালের ক্রেতা ছিলেন দুর্গাদাসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রপিতামহ। চার নাতনির পর দুর্গাদাসের যখন জন্ম হল, ঠাকুরদা বললেন, স্বর্গে ঘণ্টাধ্বনি হয়েছে। আদর করে বংশের বড় নাতির নামও দেন ‘ঘণ্টা।’

তার তখন কত আদর!

সেরেস্তা ছেড়ে সরকারমশাই ছুটছেন। সঙ্গে দু’দশটা চাকরবাকর। ‘‘ঘণ্টাবাবু... ও ঘণ্টাবাবু।’’

ঘণ্টাবাবুর কি অত সময় আছে নাওয়া-খাওয়ার! তার কত কাজ। গ্রামে যে যাত্রার দল তাঁবু ফেলেছে। খুব ছোটবেলায় গ্রামের যাত্রা-থিয়েটার দেখেই দুর্গাদাসের শখ হয় সে দলে নাম লেখানোর। কিন্তু বাবা-কাকার ভয়ে তার সব ইচ্ছেই বাড়তে থাকে মনের গহনে। একদিন সে মরিয়া হয়ে ওঠে। দোল-দুর্গোৎসবে অপেরা দলের যাত্রা দেখে দলও খুলে ফেলে গোপনে।

কিছু দিন পর সে আরও একটা দল খুলল। ডায়মন্ড। অভিনয়, অভিনয় আর অভিনয়। সাউথ গড়িয়ার স্কুলে পড়ার পাঠ প্রায় চুকিয়েই দিল দুর্গাদাস। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে মতি হল ছবি আঁকায়। বাড়ির অমতেই হাজির হল কলকাতায়। প্রথমে বউবাজার আর্ট স্কুলে শিখল কিছু দিন। তার পর গেল সরকারি আর্ট কলেজে। সে সব দিনের গল্প নিজেই শুনিয়েছেন দুর্গাদাস। ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় লিখেছেন, কেমন করে আর্ট কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড় করেছিলেন।

আসলে সে সময় তার হাতে কোনও পয়সাই দিতেন না বাড়ির বড়রা। অগত্যা, দুপুরবেলা চুপি চুপি মায়ের আঁচল থেকে চাবির গোছা নিয়ে ঘর খুলে একদিন ৮ টাকা চুরি করল। পিসিমার কাছে আবদার করে চাইল আরও ছ’টাকা। সেই চোদ্দো টাকা দিয়ে ভর্তি হল আর্ট কলেজে। মাসিক মাইনে কী ভাবে দেবে, তখনও তার অজানা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সে খবর গিয়ে পৌঁছল বাড়ির সর্বময় কর্তা সেজোকাকার কানে। তিনিই শেষ পর্যন্ত মাসিক মাইনে দিতে রাজি হলেন। তবে ঠিক হল, সেরেস্তার সরকারমশাই গিয়ে সে টাকা কলেজে দিয়ে আসবেন।

কলকাতায় আর্ট কলেজে ক্লাস করতে গিয়ে যেন নেশা ভর করেছিল দুর্গাদাসের দু’চোখে। অবনঠাকুর-নন্দলালের ছবি দেখতে দেখতে, গিরিশ-শিশিরকুমারের মতো অভিনয় করার স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে একদিন থিয়েটার পাড়ায় যাওয়ার কথা ভাবলেন তিনি। কিন্তু অভিনয় করবেন কী, চোখে-চেহারায় যে অভাবের লেশমাত্র নেই। থিয়েটার পাড়ায় এমন চিকন চেহারা দেখলে কাজ দেবে কে! ক’দিন না খেয়ে, চোখের কোণে কালি ফেলে, হতদরিদ্রের চেহারা বানিয়ে ফেললেন নিজের। গেলেন নটশ্রেষ্ঠ গিরিশ ঘোষের কাছে, যদি কোনও কাজ জোটে। কিন্তু তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, জুটল অপমান! চিৎকার করে উঠলেন গিরিশ, ‘‘ডেঁপো ছোকরা! এয়ারকি করতে এসেছ? ভাঁড়ামি করবার আর জায়গা পাওনি? থিয়েটার করবে এই বয়সে— ঢের হয়েছে, যাও, যাও, ইসকুলে যাও!’’ দুর্গাদাসকে তেতো কথাগুলো বলে গাড়িতে চেপে চলে গেলেন নটশ্রেষ্ঠ। আর রঙ্গমঞ্চের সদরে দাঁড়িয়ে অপমানিত হয়ে দুর্গাদাস ভেবে পাচ্ছিলেন না, কী করবেন! তা হলে কি মঞ্চে অভিনয় করা হবে না এ জীবনে! ফিরে যেতে হবে! ভিজে চোখে পথের দিকে চেয়ে রইলেন। দেখলেন, দূরের হাওয়ায় পাক খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নটশ্রেষ্ঠের সাদা গাড়ির ধুলো। খুব রাগ হল তাঁর। শিল্পী লিখছেন সে দিনের কথা, ‘‘তাঁর প্রতি ছিল সীমাহীন, অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভক্তি। মুহূর্তে তা মিলিয়ে গেল। এই রূঢ় আঘাত তরুণ মনকে যেন বেঁকিয়ে ধনুকের মতো করে দিয়ে গিয়েছিল— তাতে উঠেছিল একটি কঠিন সংকল্পের টঙ্কারধ্বনি। এ যেন প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা!’’ সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল দুর্গাদাসের!

ঠিক করলেন, নতুন করে অভিনয় নিয়ে মেতে উঠবেন। দু’চোখে শুধু অভিনয়ের স্বপ্ন। ঘরে ফিরে সংসারে মন নেই তাঁর। বিপদ বুঝে দুর্গাদাসের বিয়ে দিলেন অভিভাবকরা। কিন্তু তবুও সংসার তাঁকে জড়াতে পারল না!

স্ত্রী বীণাপাণিকে অনুনয় করে, গভীর রাতে জানালা গলে চুপি চুপি পালিয়ে যেতেন রিহার্সালে। ফিরতেন নিশি ভোরে। মদ ধরেছেন, নেশায় দু’চোখ টকটকে লাল। বীণাপাণি বুঝতেন দুর্গাদাসের কষ্ট, কিছু ব‌লতেন না। এ ভাবেই কাটল তিন বছর। দুর্গাদাস নিজের সে সময়ের কথা লিখেওছেন, ‘‘সে আমাকে টেনে রাখতে পারেনি। বিবাহিত জীবনের স্বপ্ন আমার চোখে রঙিন ঘোর এনে দেয়নি। মন আমার গিয়ে পড়েছে তখন মঞ্চে, তারই নেশায় সে রঙিন।’’

শেষে ঠিক করলেন, ক‌লকাতায় ফিরে থিয়েটারের সিন আঁকার কাজ করবেন। তবু তো মঞ্চ ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা-জীবন!

সে কাজের জন্য এক রঙ্গমঞ্চ থেকে আর এক রঙ্গমঞ্চ আর্ট কলেজের ডিগ্রি নিয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরতে শুরু করলেন। কাজও জুটল। ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানির নির্বাক ছায়াচিত্রের বর্ণলিপিকার। পরের বছর শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নরেশচন্দ্র মিত্র এবং আরও ক’জন শিল্পী মিলে গড়ে তুললেন তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি। দুর্গাদাস সেখানেও কাজে যোগ দিলেন ‘টাইটেল রাইটার’ হিসেবে। মনের কোণে তাঁর আশা রইল, যদি কখনও ছবি আঁকতে আঁকতে অভিনয়ের সুযোগ মিলে যায়!

মিলল। এক্সট্রার চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই তাঁর একটা উপায় হল। নির্বাক ছবি ‘আঁধারে আলো’, ‘মানভঞ্জন’ পেরিয়ে সেলুলয়েডে ক্রমে দুর্গাচরণ হলেন দুর্গাদাস! সে দিনের কথা। রাজপথে অন্যমনস্ক হাঁটছিলেন দুর্গাদাস। পিছন থেকে কেউ যেন তাঁকে ডাকলেন।

‘শুনছেন?’

দুর্গাদাস দেখলেন ছিপছিপে এক ভদ্রলোক। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? কোথায়? আপনি কি কোনও থিয়েটারে কাজ করেন?’

‘না।’

‘তবে!’

দুর্গাদাস আর গোপন করলেন না। জানালেন তিনিও ম্যাডান থিয়েটারেই কাজ করেন। টাইটেল রাইটারের। ভদ্রলোক সব শুনে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘অভিনয় করবেন? আমি একটি নতুন মুখ খুঁজছি।’

‘অভিনয়!’ দুর্গাদাস যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উল্টো দিকের ভদ্রলোক ততক্ষণে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যাচ্ছেন, ‘আমি নরেশচন্দ্র মিত্র। শরৎবাবু... শরৎবাবুকে চিনলেন না? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘চন্দ্রনাথ’ নামাচ্ছি। কিন্তু চন্দ্রনাথকে পাচ্ছি না। আপনাকে আমার পছন্দ। করবেন অভিনয়?’

নাট্যমঞ্চে দুর্গাদাস

রাজি হয়ে গেলেন দুর্গাদাস। নরেশ মিত্তিরের হাত ধরে চলে গেলেন দমদমে কাক্কু ঘোষের বাগানবাড়িতে শ্যুটিংয়ে। শিল্পীর উত্তরণের এ গল্প দীর্ঘ। তাজমহল ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে শিশিরকুমার চলে গেলে নরেশচন্দ্র মিত্র ‘চন্দ্রনাথ’ করলেন। নায়ক চরিত্রে অভিনয় করলেন সুদর্শন দুর্গাচরণ। ১০ রিলের এই ছবি থেকেই দুর্গাচরণ নাম বদলে নিলেন শিল্পী। ক্রমে দর্শকের কাছে দুর্গাদাস হলেন শ্রদ্ধার ‘দুগ্গাবাবু।’

তাঁর অভিনয়ে পরিচালক নরেশ মিত্র এতই মুগ্ধ হলেন যে, পরের ছবিতেও নিলেন।

একে একে দুর্গাদাস প্রায় ১৯টি নির্বাক ছবিতে অভি‌নয় করলেন— ‘জেলের মেয়ে’, ‘মিশর রানি, ‘ধর্মপত্নী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘সরলা’, ‘রজনী’, ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারানী’ প্রভৃতি। তাঁর শেষ নির্বাক ছবি ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ মুক্তি পেল চিত্রা হলে, ১৯৩২-এর এপ্রিল মাসে। সহশিল্পী প্রমথেশ বড়ুয়া, সবিতা দেবী। সব ছবির মতো সে ছবিতেও দুর্গাদাস সাফল্য পেলেন!

ছায়াছবিতে কাজ মিললেও নাটকে রোল পাওয়া সহজ ছিল না দুর্গাদাসের। কিন্তু নাছোড় তিনি। আসলে মঞ্চকে তিনি ভালবাসতেন। সিনেমায় অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। বন্ধু-স্বজনরা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘এত অর্থ সিনেমায়। তা হলে কেন নাটকের মঞ্চে আপনি?’

উত্তরে দুর্গাদাস বলতেন, ‘মঞ্চকে আমি ভালবাসি। মঞ্চের বৈদ্যুতিক আলোর সামনে দাঁড়িয়ে যখন আমার চোখের সামনে অসংখ্য কালো কালো মাথা দেখতে পাই, তখন আমার দেহের শিরা-উপশিরাগুলি আনন্দে তাথৈ তাথৈ করে নেচে ওঠে। কিন্তু এ আনন্দ পর্দায় অভিনয় করে
আমি কোনদিন পাইনি বা পেতে পারি না।’

‘চন্দ্রনাথ’-এ কাজের সূত্রেই একদিন নরেশ মিত্রকে ধরলেন। বললেন, ‘যে ভাবেই হোক মঞ্চে অভিনয়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

হতবাক নরেশচন্দ্র! ‘তোমাকে সুযোগ করে দিতে হবে!’

তত দিনে শিশিরকুমার মেতেছেন নাট্যমন্দির নিয়ে। শুরু হয়েছে আর্ট থিয়েটার্সেরও কাজ। এক সন্ধেবেলা নরেশচন্দ্র অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে দুর্গাদাসকে নিয়ে গেলেন। অপরেশচন্দ্র তখন ‘কর্ণার্জুন’-এর মহলা করাচ্ছেন। নাটকের সব পার্ট বিলি হয়ে গিয়েছে। পড়ে আছে কেবল বিকর্ণ। দুর্গাদাস তাতেই রাজি হলেন! বললেন, ‘যে পার্টই করি না কেন, নাটকে আমি সাপ খেলিয়ে দেব!’

‘সাপ খেলিয়ে দেবে!’

তাঁর কথায় মহলা থামিয়ে সকলে চেয়ে রইলেন। স্তম্ভিত অপরেশচন্দ্র!

নিছক কথার কথা নয়, অভিনয়ের প্রথম রাতে সত্যি সত্যি সাপই খেলালেন দুর্গাদাস!

৩০ জুন বিকর্ণ চরিত্রেই সেই প্রথম পেশাদার অভিনয় তাঁর। বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ হল আর এক ‘স্টার’ নায়কের। দর্শক আপ্লুত। অভীক চট্টোপাধ্যায় ‘চিরনবীন নায়ক’-কে নিয়ে গ্রন্থ সম্পাদনা করতে গিয়ে ভূমিকায় লিখছেন, ‘‘তাঁর হাঁটাচলা, চুলের ধরন, কথা বলার ঢং, পোশাক-আশাক ইত্যাদির প্রভাব পড়েছিল মূলত যুবসমাজের উপর এবং নারী দুনিয়াকে তো আলোড়িত করেইছিলেন তিনি। ... তখনকার নামকরা অভিনেত্রী নীহারবালা বলেছিলেন যে, হাততালি

অনেকেই পায়, কিন্তু চুড়ি পরা হাতের হাততালি একজনই পান—

তিনি দুর্গাদাস।’’

‘কর্ণার্জুন’-এ কর্ণের ভূমিকায় ছিলেন তিনকড়ি চক্রবর্তী, অর্জুনের ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী স্বয়ং। অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে দুর্গাদাসের আলাপ এই আর্ট থিয়েটারেই। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করে অহীন্দ্র লিখছেন, ‘‘দুর্গাদাসের সাধনা দুর্গাদাসকে বড়ো করেছিল, বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে নীরবে সে এগিয়ে চলছিল— তার আকাঙ্খা ছিল যে, ‘আমি অভিনয় জগতে নিজেকে রীতিমতো প্রতিষ্ঠা করবো’ এবং তা সে করেছিলও।’’

১৯২৩-এর অক্টোবরে মঞ্চস্থ হল ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক। তাতে চন্দ্রগুপ্তের ভূমিকায় অভিনয় করলেন দুর্গাদাস।

এবং এই নাটক থেকেই সুখ্যাতি ছড়াল তাঁর। পরের বছর ‘ইরানের রানি’-তেও সেই খ্যাতির ধারা বহমান রইল। একে একে অভিনয় করলেন, ‘প্রফুল্ল’, ‘সাজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘আলমগীর’ ‘চিরকুমার সভা’, ‘মহুয়া’ প্রভৃতি নাটকে। সব চরিত্রেই তিনি ছিলেন নিপুণ অভিনেতা। ‘আলমগীর’ নাটকে ভীমসিংহ চরিত্র করলেও মাঝে মাঝে অওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করতেন।

তাঁর অভিনয় দেখে ‘বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস’ প্রণেতা অজিতকুমার ঘোষ লিখছেন, ‘‘ঔরংজীবের ভূমিকায় তাঁর অনবদ্য অভিনয় দেখেছি, এবং সেই দেখার স্মৃতি কোনো দিন ম্লান হবে না। তাঁর সেই অনিন্দ্য চেহারা নিয়ে ভাবনামগ্ন চিত্তে মঞ্চে চলাফেরা, তাঁর সেই বিমোহন স্থির দৃষ্টি, কাটা কাটা সুস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত কথাগুলি, ‘আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ঝড় উঠবে। একটা নদী পার হয়েছি, এ আর এক নদী— ভীষণ কল্লোলিত তরঙ্গসঙ্কুল।’ যিনি এ অভিনয় দেখেছেন, তিনি কোনো দিন তা ভুলতে পারবেন না।’’

শিশিরকুমার ভাদুড়ী একবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘দুর্গার গলার আওয়াজ ছিল ভারী ভাল। চেহারা ছিল অতি সুন্দর। অভিনয় যে খুব logical, চরিত্র অনুযায়ী হত তা নয়, কিন্তু একটা গুণ ছিল, he had a way of his own— পার্টটা নিজের করে নিতে পারত। সেটাও অনেক সময় ভালই লাগত।’’ সৌমিত্র লিখছেন, এর পরেই শিশির ভাদুড়ী ‘একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘আর, ওর অভিনয় সবথেকে কারা বেশি পছন্দ করত জানো তো? মেয়েরা।’’

শিল্পীকে ঘিরে থিয়েটার পাড়ায় উড়ত কত ঝিলমিল গল্প। কখনও তাঁর মহিলাসঙ্গের কথা। কখনও নেশার গল্প। শোনা যেত জমিদারি রক্তের জেদের গল্প। রংমহলের মালিক তখন গদাধর মল্লিক।

মল্লিকমশাই কিছুতেই আর ছোট শিল্পীদের মাইনে বাড়াতেন না। একদিন সে কথা কানে যেতেই হাঁক ছাড়লেন দুর্গাদাস, ‘মল্লিক!’

তৎক্ষণাৎ সামনে হাজির মল্লিক। ‘বলুন দুগ্গাবাবু!’

দুর্গাদাস সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘এঁদের মাইনে বাড়ান না কেন? দিন দিন, আপনি এক্ষুনি বাড়িয়ে দিন।’ মল্লিক বিপদে পড়ে বললেন, ‘আজ্ঞে, নিশ্চয়ই দেব।’

‘দেব মানে! এক্ষুনি দিন। ভাউচার এনে সবার বেতন মিটিয়ে দিন আমার সামনে!’ এ গল্প অপর্ণা দেবী লিখেছিলেন দুর্গাদাসের মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিতে। তাঁর সঙ্গে দুর্গাদাস এক রাত অভিনয় করেছিলেন। কেবল এক রাতই! কেন— সে কাহিনিও শুনিয়েছেন ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘বিজয়িনী’ ছবির অভিনেত্রী স্বয়ং!

মঞ্চে দুর্গাদাস।

নাট্যনিকেতনে ‘মন্ত্রশক্তি’ নাটক চলছে। অপর্ণা দেবী অব্জা আর দুর্গাদাস অব্জার স্বামী মৃগাঙ্কের চরিত্রে মঞ্চে।

একটি মধু-রাতের দৃশ্যে অব্জা শুয়ে আছে। তার মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মৃগাঙ্ক ঘরে এসে চুম্বন করে অব্জাকে। অপর্ণা দেবী লিখছেন, ‘‘দুর্গাদাস মদ্যপান করেই মঞ্চে আসতেন। অনেকদিন নেশার ঘোরে আজেবাজে কথাও বলতেন। সুতরাং আমি রীতিমতো কাঠ হয়ে শুয়ে আছি। ঘেমেও যাচ্ছি। কারণ সেদিন দুর্গাদাস একটু বেশিমাত্রায় মদ্যপান করেছিলেন। ... মৃগাঙ্ক কাছে এল, আমাকে বন্ধু বলেই সম্বোধন করল, হঠাৎ আমার কপালে একটা চুম্বন করল। আমার সমস্ত দেহটা তখন ঘেমে যাচ্ছে। আমি অভিনয় করব কি, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললাম। উত্তেজিত হলাম দুর্গাদাসের ওপর।’’

নাটক শেষ। দুর্গাদাস গুম হয়ে গ্রিনরুমে বসে রয়েছেন। নেশার ঘোরে জেদ করে বারবার বলছেন, ‘অপর্ণাকে ডেকে দাও। নইলে বাড়ি যাব না।’ বিপদ বুঝে কেউ সে কাজ করেনি। সে দিন দুর্গাবাবুকে ঘিরে রেখেছিল সবাই। পিছনের দরজা দিয়ে নাকি অপর্ণা দেবীকে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল!

এ সবের সঙ্গেই এক দিকে রঙ্গমঞ্চে নতুন নতুন নাটক, অন্য দিকে সেলুলয়েডে নতুন ছবির কাজ।

১৯৩১-এ নিউ থিয়েটার্স লিমিটেডে তাঁর প্রথম সবাক ছবি ‘দেনাপাওনা’য় অভিনয়ের পরে শ্যুটিংয়ের ডেট দিতে দিতে ক্লান্ত নায়ক! কত ছবি, কত চরিত্র। অভিনয় করলেন ‘চিরকুমার সভা’র পূর্ণ চরিত্রে। ‘চণ্ডীদাস’-এ চণ্ডীদাস তিনিই। হাতে এল ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মীরাবাঈ’, ‘মহুয়া’, ‘ভাগ্যচক্র’, ‘বিদ্যাপতি’-র কাজ। এর পরই অভিনয় করবেন ‘পরশমণি’, ‘অবতার’ ছবিতে।

দু’দিক সামলাতে সামলাতেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মদ্যপান।

তবু অভিনয়ে জন্য পরিশ্রমে খামতি নেই দুর্গাদাসের। পরনে শান্তিপুরী ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে শৌখিন নাগরা। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের কাছে ‘মহৎ আশ্রম’ হোটেলের আয়নামোড়া ঘর। একা একা বিভিন্ন কৌণিক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছেন তিনি। বলতে বলতেই টেবিল থেকে ঢেলে নিচ্ছেন তরল সুধা। কত যে হল, কে রাখে তার হিসেব!

একই সংলাপ বলছেন, একবার, দু’বার... বারবার। বয়স যত বাড়ছে, চিরচেনা নিজেকে ভেঙে-গড়ে নিচ্ছেন বুঝি। চোখের চাহনি বদলে যাচ্ছে। মহলা করতে করতেই পকেটে রুপোর সিগারেট কেসটার খোঁজ করছেন। না পেয়ে, গুরুগম্ভীর আওয়াজে দরজায় মুখ বাড়িয়ে ডাকছেন, ‘ওরে কে আছিস, আমার সিগারেট-কেসটা দিয়ে যা।’ কখনও আবার অভিনয়ের ফাঁকে স্মিত হেসে নিজস্ব স্টাইলে সিগারেট ধরাচ্ছেন। নতুনদের অভিনয় দেখে বক্স অফিস থেকে চিৎকার করে উঠছেন, ‘‘হচ্ছে না, হচ্ছে না। কিচ্ছু হচ্ছে না। সব রস নষ্ট হয়ে গেল!’’ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের হোটেলের এই ঘরেই মাঝে মাঝে দুপুরবেলা আসতেন নায়কের এক অনুরাগিণী। কী যেন নাম...

‘স্বয়ং কন্দর্প দুর্গাদাস’ বইতে শচীন দাশ লিখছেন, ‘‘প্রায় অপরাহ্ণেই তাঁর পদধ্বনি শোনা যেত। বরং বলা যায়, দুর্গাদাস যেন অপেক্ষা করতেন তাঁর জন্য।’’ সব জেনেছিলেন বীণাপাণিদেবী। ওঁকে বলেছিলেন দুর্গাদাস স্বয়ং! তবে মদের নেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। কখনও বাধা দিলে আর ঘরেই ফিরতেন না।

শেষের দিকে আরও যেন একরোখা হয়ে উঠেছিলেন। কখনও কি কারও কথা শুনেছেন!

‘পরশমণি’ ছবির সাফল্যে জোর করেই তো পুরনো বন্ধু প্রভাত সিংহের আহ্বানে পটনায় ‘দেশের মাটি’-র কল শোয়ে গেলেন। প্রবল অসুস্থ হয়ে টেলিগ্রাম করলেন সেই বীণা-কেই। কিন্তু কলকাতা

ফেরার আগের দিনই জোর করে তাঁকে স্টেজে তুলে দিয়েছিলেন প্রভাত সিংহ।

অসুস্থ শিল্পী মঞ্চে উঠে বলেন, ‘আমি খুবই অসুস্থ।’

খেপে গিয়ে দর্শক বলে, ‘অসুস্থ তো স্টেজে নেমেছেন কেন!’

অপমানে মাথা নত করে নায়ক ফিরলেন কলকাতায়।

অসুস্থতা আরও বাড়ল ’৪১-এর অগস্ট থেকে।

শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী।’ সেখানে তাঁর চরিত্র জহর। একদিন মেকআপ নিয়ে অপেক্ষা করছেন নায়িকা চন্দ্রাবতী দেবী। দুর্গাদাস আর আসেন না। এমন প্রায়ই হতো শেষের দিকে। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে তখন ভিতরে মদ

খাওয়া নিষেধ।

দুর্গাদাস খেতেন। ডাবের ভিতর লুকিয়ে। একদিন ধরে নিয়ে আসা হল তাঁকে। টালমাটাল পায়েই ‘জহর’ চরিত্রে অভিনয় করলেন।

শুরু করেছিলেন আত্মজীবনী লেখাও। শেষ হল না! তার আগেই হঠাৎ চলে গেলেন!

থিয়েটারে শেষ অভিনয় মিনার্ভা থিয়েটারে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নাটক ‘কাঁটা ও কমল’-এ। তখন খুবই অসুস্থ। বাড়িতেই থাকেন। চাইলেও উঠতে পারেন না। দৃষ্টি ঝাপসা। নানা চরিত্র আর সংলাপ এসে অহরহ ঘুমের মধ্যে খেলা করে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মুক্তি পেল ‘প্রিয় বান্ধবী।’

বিছানায় শুয়ে শুয়েই প্রথম শো-এর খবর জানতে অশক্ত শরীরে আঁকড়ে ধরলেন টেলিফোন! চোখের পাতা ভিজে এল তাঁর। ‘সত্যি বলছ, ভিড় হয়েছে! লোকে এসেছে দুর্গাদাসের ছবি দেখতে!’

ঋণ

স্বয়ং কন্দর্প দুর্গাদাস, শচীন দাশ। প্রতিভাস

চিরনবীন নায়ক দুর্গাদাস, সম্পাদনা অভীক চট্টোপাধ্যায়। প্রতিভাস

অগ্রপথিকেরা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আজকাল

Durgadas Bannerjee Matinee Idol দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় Films Actor Theatre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy