Advertisement
E-Paper

উপেন্দ্রকিশোর

তাঁকে দত্তক নেন পালিত পিতা। তাঁর বেহালা শুনতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ২০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন। লিখছেন শুভাশিস চক্রবর্তীরীতিমতো যাগযজ্ঞ করে কামদারঞ্জনকে দত্তক নিলেন হরিকিশোর।নাম রাখলেন উপেন্দ্রকিশোর। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। ইতিপূর্বে হরিকিশোরের দুই স্ত্রী পরপর মারা গিয়েছেন। তাঁদের সন্তানাদি ছিল না। তৃতীয় বার বিয়ে করলেন। স্ত্রী রাজলক্ষ্মী। তাঁরও সন্তান হল না দেখে জ্ঞাতিভাই কালীনাথের মেজ ছেলেকে দত্তক নিলেন তিনি।

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:৩৫

রীতিমতো যাগযজ্ঞ করে কামদারঞ্জনকে দত্তক নিলেন হরিকিশোর।

নাম রাখলেন উপেন্দ্রকিশোর। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। ইতিপূর্বে হরিকিশোরের দুই স্ত্রী পরপর মারা গিয়েছেন। তাঁদের সন্তানাদি ছিল না।

তৃতীয় বার বিয়ে করলেন। স্ত্রী রাজলক্ষ্মী। তাঁরও সন্তান হল না দেখে জ্ঞাতিভাই কালীনাথের মেজ ছেলেকে দত্তক নিলেন তিনি।

সে ১৮৬৮ সালের কথা।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ছুঁয়ে মসুয়া গ্রাম। ময়মনসিংহ জেলায়। আগে এই গ্রামের নাম ছিল ‘খুকুরপাড়া’।

অঞ্চলের বাসিন্দা রামনারায়ণ রায় খ্যাতি–প্রতিপত্তিতে ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত।

রামানারায়ণেরই বংশধর কালীনাথ, হরিকিশোর ও শিবেন্দ্রকিশোর। তিন জ্ঞাতি ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে অবস্থাপন্ন হরিকিশোর। ওকালতি করে আর পৈতৃক আয় বাড়িয়ে বিশাল সম্পত্তি করেছিলেন তিনি।

উপেন্দ্রকিশোরকে দত্তক নেবার দুই বছর পর হরিকিশোরের তৃতীয় পত্নী এক পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম দিলেন।

ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের সব শিক্ষকই বালক উপেন্দ্রকিশোরকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। ভালবাসেন।

তবে তাঁদের অভিযোগ একটাই। ছেলেটি ক্লাসে প্রতিদিন পড়া পারে, পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় না, দুরন্ত মেধা আর প্রতিভা, কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে তার একদম আগ্রহ নেই। রাতে এক অক্ষরও পড়ে না সে।

এর কারণ কী?

বালকটি উত্তর দেয়, “শরৎকাকা আমার পাশের ঘরেই থাকে। রোজ সন্ধ্যায় সে চিৎকার করে করে পড়া মুখস্থ করে। ওতেই আমার পড়া হয়ে যায় যে!”

শিক্ষকেরা আর কোনও কথা খুঁজে পেলেন না।

প্রবেশিকা পরীক্ষা আসন্ন প্রায়।

এ দিকে কিশোর উপেন্দ্রকিশোর মজে আছেন বেহালা আর রংতুলিতে। স্কুলের প্রধানশিক্ষক রতনমণি গুপ্তের শরণাপন্ন হলেন শরৎচন্দ্র রায়। এত ভাল ছেলেটি, অথচ পড়ার বই নিয়ে বসেই না!

রতনবাবু ছাত্রকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “তোমার উপর আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের হতাশ কোরো না।”

শিক্ষকমশাইয়ের এ কথায় উপেন্দ্রকিশোর অত্যন্ত অনুতপ্ত। বাড়ি ফিরে এসে সাধের বেহালাটি দিলেন ভেঙে।

প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল পনেরো টাকা বৃত্তি পেয়েছেন উপেন্দ্র। পুরো টাকা দিয়েই বন্ধুদের নিয়ে এক ‘ব্রাহ্ম দোকান’-এ গিয়ে ভোজ দিলেন।

শুধু পড়াশুনো নয়, ছোট থেকে ভাল ছবিও আঁকতেন উপেন্দ্রকিশোর।

কারও কাছে যে শিখেছেন, তা নয়। সাহায্যও নেননি কোনও দিন।

একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শনের জন্য এলেন স্যর অ্যাসলি ইডেন।

ক্লাসে ছাত্ররা মন দিয়ে সাহেবের কথা শুনছে, নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

হঠাৎ ইডেন সাহেব খেয়াল করলেন প্রায় পিছনের দিকের বেঞ্চিতে বসা একটি ছেলে তাঁর কোনও কথাই শুনছে না, মাথা নিচু করে আপন মনে সে কিছু একটা করছে।

শিক্ষকমশাইরা তো ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, না জানি সাহেব কী মনে করবেন।

সন্তর্পণে ইডেন ছেলেটির কাছে এসে দেখলেন তার খাতায় একটি প্রতিকৃতি এঁকেছে সে। পেনসিল স্কেচে খাতার বুকে জ্বলজ্বল করছে স্যর অ্যাসলি ইডেনের পোর্ট্রেট।

খুব খুশি হলেন সাহেব। উপেন্দ্রকিশোরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বিশেষ উৎসাহিত করে বললেন, “আঁকা কখনও ছেড়ো না। এটাই চালিয়ে যেয়ো তুমি।”

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর (প্রথম সারিতে ডান দিকে) ও অন্যরা ছবি: সৌজন্যে হিমানিশ গোস্বামী

ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। উপেন্দ্রকিশোরের সহপাঠী সেখানে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পরে যিনি পরিচিত হবেন ‘বাংলার বাঘ’ নামে।

আশুতোষ চমৎকার ‘নোটস্’ তৈরি করতেন। তার জন্য অন্য ছেলেরা তাঁকে ভারী জ্বালাতন করত। ক্রমাগত সেই ‘নোটস্’ চেয়ে নিয়ে যেত, তাঁর নিজের দরকারে তিনি পেতেন না।

আশুতোষ তাই চুপিচুপি উপেন্দ্রকিশোরের কাছে নোটের খাতা রেখে দিয়ে বলতেন, “তুমি তো এ সব পড় না বলেই সবাই জানে, তোমার কাছে থাকলে কেউ খোঁজ পাবে না।”

উপেন্দ্রকিশোর যত্ন করে রেখে দিতেন সেই খাতা, কোনও দিন খুলে দেখবারও প্রয়োজন বোধ করেননি।

একবার গোটা মসুয়া গ্রাম জুড়ে রটে গেল কলকাতায় গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন।

এমন রটনার কারণও ছিল।

ময়নমনসিংহ জেলা স্কুলে পড়বার সময়েই উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন।

শরচ্চন্দ্র রায় ছিলেন ময়মনসিংহের খ্যাতনামা ব্রাহ্ম। তিনি গগনেন্দ্র হোমকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু উপেন্দ্রকিশোরকে ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে আসতে হবে।

এ দিকে বাড়ি থেকে উপেন্দ্রকিশোরকে বলা হয়েছে, ব্রাহ্ম মনোভাবাপন্ন গগনের সঙ্গে সে যেন কখনওই না মেলামেশা করে। অথচ উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সঙ্গেই বেশি মিশতেন।

কলকাতায় পড়তে এসে উপেন্দ্রকিশোর কলুটোলার কাছে এক মেসবাড়িতে কিছু দিন থেকে চলে এলেন সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। সেটি আবার এক রকম ব্রাহ্ম-মেস। গগনচন্দ্র হোমও এখানে থাকতেন।

গগনচন্দ্র ‘জীবনস্মৃতি’–তে লিখছেন, ‘‘বাড়ি ভাড়া করিয়া সকলে একত্রিত হইলাম। উপেন্দ্রকিশোর, হেমেন্দ্রমোহন বসু, প্রমদাচরণ সেন, মথুরানাথ নন্দী, কালীপ্রসন্ন দাস এবং আরও কতিপয় ব্রাহ্মধর্মে অনুরাগী যুবক সেখানে জুটিলেন।… ৫০ নং সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট শীঘ্রই এক ব্রাহ্ম কেল্লা হইয়া উঠিল।’’

রটনা শুনে বিচলিত পালকপিতা হরিকিশোর। পুত্রকে চরমপত্র দিলেন তিনি— ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সম্পত্তির কণামাত্র পাবেন না।

তাতেও ছেলেকে টলানো গেল না!

ব্রাহ্মধর্মেই দীক্ষা নিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ক্ষুব্ধ হরিকিশোর তাঁর সম্পত্তির মাত্র এক–চতুর্থাংশ দিলেন দত্তকপুত্রকে। হরিকিশোরের মৃত্যুর পর অবশ্য এই উইল ছিঁড়ে ফেলেন তাঁর স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী। পুত্রদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেন সম্পত্তি।

সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির সামনে সত্যজিৎ রায়

কলকাতায় উপেন্দ্রকিশোর–গগন হোমদের ব্রাহ্মধর্মের নেতা ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখী দেবীকে বিয়ে করলেন উপেন্দ্রকিশোর। এর পর সপরিবার বাস করতে লাগলেন ১৩নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ‘লাহাবাবুদের বাড়ি’-তে। স্ত্রী কাদম্বিনীকে নিয়ে তিন তলায় থাকতেন দ্বারকানাথ।

কাদম্বিনী দেবী ছিলেন আবার প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক। দোতলায় কয়েকটি ঘর নিয়ে থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর ছোট দুই ভাই, বিধুমুখীর প্রতিবন্ধী ভাই সতীশচন্দ্র, বিধুমুখীর এক অবিবাহিত মামাবাবু এবং নানা প্রয়োজনে কলকাতায় আসা আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই থাকেন উপেন্দ্রকিশোরের সংসারে। তাছাড়া ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রথম পাঁচ জনেরই জন্ম এই বাড়িতে।

বাড়িটির বিরাট ছাদে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করে। সন্ধেবেলা পড়াশোনার শেষে গল্প শোনে।

১৩ নম্বরের অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছেও উপেন্দ্রর ছেলেমেয়েদের অবাধ যাতায়াত। তিন তলার একটি ঘরে ছিল ওষুধপত্র, আর একটি কঙ্কাল। ডা. কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ঘরটিকে ছেলেমেয়েরা বলত ‘কঙ্কালের ঘর’।

বাড়িতে গৃহশিক্ষক আসেন, কিন্তু ছেলেমেয়েদের সব থেকে ভাল লাগে উপেন্দ্রকিশোরের পড়া বোঝানো। ধীর স্থির উপেন্দ্রকিশোর নানা বিষয় সহজ–সরল করে বুঝিয়ে দেন। বড়রাও অনেকে দরজার ও পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শোনেন সেই বোঝানো।

নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্কটি ভারী অদ্ভুত।

একবার মেয়ে সুখলতার খুব অসুখ করল। তীব্র যন্ত্রণা। ঘুম নেই চোখে। ঘুমের ওষুধেও কাজ হয় না।

মেয়ের এই কষ্ট দেখে সব বাবা–মা উদ্বিগ্ন হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর এতটুকু বিচলিত না হয়ে, শান্ত মনে মেয়ের পাশে বসলেন। হাতে বেহালা নিয়ে একমনে বাজাতে লাগলেন। সুখলতা বাজনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল।

সুখলতা, সুকুমার, পুণ্যলতা, সুবিনয়, শান্তিলতা এবং সুবিমল— তিন কন্যা ও তিন পুত্রের পড়াশোনা, ছবি আঁকা, গান–বাজনার প্রতি পিতা উপেন্দ্রকিশোরের ছিল সজাগ দৃষ্টি। তবে সেখানে জোর–জবরদস্তি বা কড়া চোখরাঙানির কোনও জায়গাই নেই। ছবি আঁকতে উৎসাহ দিতেন। বাড়ি বয়ে আঁকবার সরঞ্জাম এনে দিতেন।

আবার, সুকুমার বিলেত যাবেন, তার জন্য উপেন্দ্রকিশোর কী না করেছিলেন! ছেলেকে টাই বাঁধা, কলার পরা শিখতে পর্যন্ত সাহায্য করেছেন বাবা।

শুধু স্নেহময় পিতা নয়, আচার-আচরণে উপেন্দ্রকিশোর এক্বেবারে যেন সেকেলে বাড়ির বড় কর্তাটি।

প্রতিবছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতেন। সদলবলে। খুড়তুতো-পিসতুতো ভাইবোন এবং স্বজন–পরিজন মিলিয়ে সে বিরাট দল!

যাওয়ার জায়গাগুলি ছিল মসুয়ায় দেশের বাড়ি কিংবা পুরী, দার্জিলিং, চুনার, মধুপুর। যেখানেই যেতেন বাড়ি ভাড়া করে সেখানে উঠতেন।

দেশের বাড়ি ময়মনসিংহ যেতে প্রায় দু–দিন লেগে যেত। এ নিয়ে পুণ্যলতা লিখেছেন, ‘‘রাত্রে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে চড়ে সকালবেলায় গোয়ালন্দে স্টিমার ধরতাম। বিকেলের দিকে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে ট্রেনে উঠতাম। রাতদুপুরে কাওরাইদ স্টেশনে নেমে নৌকায় চড়তে হতো। কাছাকাছি গভীর জঙ্গল। স্টেশন থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত রাস্তায় শুনতাম নাকি ‘ভয় আছে’। আলো নিয়ে, লম্বা লম্বা লাঠি হাতে, অনেক লোকজন সঙ্গে থাকত— ঘুমচোখে গিয়ে আবার নৌকার মধ্যে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়তাম। নৌকা যখন গিয়ে ঘাটে লাগত, তখনও বাড়ি অনেক দূর। ঘাটে হাতি, পাল্কি–ডুলি অপেক্ষা করত। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হতো, কারা যেন শাঁখ বাজাত। ঠাকুরমা, পিসিমারা এগিয়ে এসে আমাদের আদর করে ঘরে নিয়ে যেতেন।’’

বেড়াতে গিয়ে উপেন্দ্রর অনেক ক’টি স্মৃতিই বেশ বিচিত্র রকমের।

গিরিডির বারগেন্ডার কাহিনিটি বলা যাক।

হাওয়াবদলের জন্য গিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর। উঠেছেন নানুবাবুর ‘নর্থ ভিউ’ বাড়িটায়। বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের ছোট ভাই এই নানুবাবু।

উপেন্দ্রকিশোর এলে এখানকার ছেলেমেয়েদের আনন্দের সীমা থাকে না। জেঠু তাদের বেড়াতে নিয়ে যাবেন। চড়ুইভাতি হবে। দেশ–বিদেশের গল্প, রামায়ণ–মহাভারতের গল্প বলবেন। নদীর ধারে সবাইকে জড়ো করে রাতের আকাশের দিকে আঙুল তুলে গ্রহ–নক্ষত্র চেনাবেন— কোনটি কালপুরুষ, কোনটি সপ্তর্ষিমণ্ডল।

উশ্রী নদীর বুকে যে চরা পড়েছে, সেখানে অনেক রকমের খেলাধুলো হয় বিকেলবেলা। তার মধ্যে একটি সবার খুব প্রিয়— যষ্টিহরণ—লাঠি চুরি করা। লাঠিটা জেঠামশাইয়েরই।

কুড়ি–পঁচিশ হাতের একটা চক্র করা হতো বালির উপর দাগ কেটে, তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে পুঁতে রাখা হতো লাঠিটা। একজন থাকবে পাহারাওয়ালা, সে লাঠিটা পাহারা দেবে, অন্য সবাই চেষ্টা করবে লাঠিটা চুরি করে আনতে। আনতে পারলে পাহারাওয়ালার হবে শাস্তি।

বিচারকের ভূমিকায় নিজেই থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর।

শাস্তিও ছিল খুব মজার— ষোলোবার জোরে জোরে লাফাতে হবে। দলের মধ্যে ছিল তেরো–চোদ্দো বছরের কয়েকজন মেয়ে। তারা লাফাতে লজ্জা পেত। তাদের শাস্তি ছিল একটা গান গাওয়া।

ছোটদের সঙ্গে মেলামেশাতে উপেন্দ্র ছিলেন দড়। এমনকী ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেও তাঁর ছিল সেই শিশু-কাতরতা। আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটিও তারই ফল।

মুদ্রণ শিল্পে উপেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য যে কী পর্যায়ের ছিল, বোঝাতে দু’-একটি কথা জানানো যাক।

সেকালের মুদ্রণজগতের লোকের কাছে ‘পেনরোজ’ পত্রিকা ছিল বাইবেলের মতো। এই পত্রিকায় ১৮৯৭ থেকে ১৯১২–র মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের নয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। যার বিষয় ছিল ‘ছবি মুদ্রণ’।

‘ইউ. রায়’ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ক্রমশই বড় হতে লাগল। এ বার প্রয়োজন একটা বড় বাড়ির। ১৯০১–এ উপেন্দ্রকিশোর চলে এলেন ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে।

বাড়ির একতলার সামনের অংশে অফিস, প্রেস, ছবি বানানোর নানারকম রাসায়নিক। মাঝখানে উঠোন, তার পশ্চিম ধারে ফটোগ্রাফির ডার্করুম আর উপরে যাবার সিঁড়ি।

পিছনের অংশে খাবার ঘর, চাকরবাকরদের থাকবার ঘর, রান্নাঘর, উঠোন, স্নানের ঘর।

ছাদের উত্তর অংশে কাচের ছাদওয়ালা স্টুডিয়ো। মেঘলা দিনে আর রাতে ছবির কাজ চালাবার জন্য আনা হয়েছিল বড় বড় আর্কল্যাম্প।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছেন নানা সময়ে। আর আসতেন কুন্তলীন–খ্যাত এইচ বোস বা হেমেন্দ্রমোহন বসু। এমনকী রবীন্দ্রনাথও। উপেন্দ্র-পুত্র সুবিমল রায়ের স্মৃতিচারণায় তার একটি বর্ণনা, “রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪০/৪১ বছর হবে। বাবা তাঁকে আগে থেকেই চিনতেন। রবীন্দ্রনাথের তখন কালো চুল, কালো দাড়ি। তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর আমি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে একটু দেখছিলাম। তিনি বাবার বেহালা শুনতে বড় ভালবাসতেন।”

ছোটদের প্রতি উপেন্দ্র ছিলেন উদার। কোমলমনা। কিন্তু নিজের বিশ্বাসে ছিলেন কঠোরপন্থী।

পালকপিতা হরিকিশোর রায় মারা যাওয়ার সময়ের কথা। কিছুতেই শ্রাদ্ধশান্তি তিনি করবেন না, জানিয়ে দিলেন উপেন্দ্রকিশোর। তখন তাঁর বয়স কুড়ি। তবু নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের নেতার শ্রাদ্ধে যত রকম আয়োজন, সমারোহ, দানধ্যান করা যায়, সবরকম ব্যবস্থা হল। শ্রাদ্ধের দিন নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আসতে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠান বাড়ি লোকে লোকারণ্য।

এমন সময় যুবক উপেন্দ্রকিশোর বলে বসলেন, “আমি প্রচলিত দেশাচার–মতে পিতৃশ্রাদ্ধ করব না।”

অনুষ্ঠান বাড়িতে যেন বজ্রপাত। আত্মীয়স্বজনেরা ক্ষুব্ধ। সমাজ তাঁর নিন্দায় সরব। এমন পাপাচারের শাস্তি কী হওয়া উচিত, কথা উঠল তা নিয়েও। তবু উপেন্দ্রকিশোরকে টলানো গেল না। তিনি কিছুতেই পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন না।

দ্রুত পেরিয়ে যাই চল্লিশটি বছর।

গিরিডির ভাড়াবাড়িতে দু’দিন রোগযন্ত্রণায় একদম অচৈতন্য হয়ে পড়লেন উপেন্দ্রকিশোর।

তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। আসতে চাইছিলেন না, তবু। অতিরিক্ত শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হলেন। তখনও ইনসুলিনের আবিষ্কার হয়নি। বিদেশ থেকে যে ওষুধ আসত, প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে সেই ওষুধ আর আসছে না।

প্রাণপ্রিয় গিরিডিতে সেই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। উঠেছিলেন ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘রুবি লজ’ বাড়িতে।

কনিষ্ঠ পুত্র সুবিমল রায় লিখেছেন, “বাবার অসুখ কিছুতেই সারছিল না, তাই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। বড় বড় ডাক্তারেরা দেখলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কঠিন অসুখের মধ্যেও বাবা শান্ত থাকতেন। বলতেন, “আমি খুব আনন্দে আছি।”

যে দু-দিন অজ্ঞান-অচৈতন্য ছিলেন, সেই দুটো দিন “সকল যন্ত্রণাবিমুক্ত হইয়া আমি কী আনন্দে বাস করিয়াছি— কী অমৃতের আস্বাদ পাইয়াছি— তোমরা তাহা জানো না।’’— মৃত্যুর ছায়া-আচ্ছন্ন এই আনন্দ-অভিজ্ঞতার কথা তিনি নিজেই বলেছেন; পরে তাঁর জবানিতে লিখেছেন জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকুমার রায়।

মৃত্যুর আগের দিন। রবিবার। ভোরবেলা। ছোট ছোট দুটো পাখি জানালার ধারে এসে কিচির-মিচির করছিল।

মৃদুকণ্ঠে উপেন্দ্রকিশোর প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, “পাখি কী বলে গেল তোমরা শুনেছ? পাখি বলল, পথ পা, পথ পা।’’

সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকেল গড়াল। আশার দীপ ক্রমশ ক্ষীণ। আত্মীয়স্বজনেরা জড়ো হতে লাগলেন গড়পারের বাড়িতে।

শেষশয্যার পাশে ঊষালোকে ব্রহ্মসঙ্গীত শুরু করলেন স্বজনেরা। —

‘জানি হে যবে প্রভাত হবে, তোমার কৃপাতরণী লইবে মোরে ভবসাগরকিনারে’—

তখনও তাঁর মৃদুকম্পিত ঠোঁট দুটি যেন এই গানের সঙ্গে যোগ রক্ষা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল সেই কম্পন।

প্রভাত-আলোয় দয়াময়ের কৃপাতরণী উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে যাত্রা করল ভবসাগরের তীরের দিকে।

ঋণ: শঙ্খ ঘোষ, সন্দীপ রায়, কৌশিক মজুমদার, সুজিত দে সিকদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (জীবনী)/হেমন্তকুমার আঢ্য, টুনটুনির বই (সুবর্ণরেখা সংস্করণ)/ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার সাহিত্য সমগ্র/সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত, ছেলেবেলার দিনগুলি/পুণ্যলতা চক্রবর্তী, উপেন্দ্রকিশোর/কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, জীবনস্মৃতি/গগনচন্দ্র হোম, জীবনযাত্রার কয়েক পাতা/ সুনির্মল বসু, পাকদণ্ডী/লীলা মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কথা/সুবিমল রায়, যাঁদের দেখেছি/হেমেন্দ্রকুমার রায়, পূর্বস্মৃতি/শান্তা দেবী এবং সুকুমার রায়, বীণা বসু, সিদ্ধার্থ ঘোষ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় ও সরোজ দরবার লিখিত গদ্যরচনা

Upendrakishore Ray Chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy