রবীন্দ্রনাথের এই কথা বারবার আওড়াতেন তিনি। এ ছিল যেন কিঙ্করের জপমালা।
’৭৫ সাল। ঋত্বিক ঘটক শান্তিনিকেতন গিয়ে ১৬ মি.মি. রঙিন একটি তথ্যচিত্র করলেন কিঙ্করকে নিয়ে। অসুস্থ, তবু গেলেন। প্রতি ফ্রেমে নিজের মতো করে ভেঙেচুরে দেখালেন ভাস্করকে। গোড়ার দিকে একটি ফ্রেমে ক্লোজআপে দেখা গেল বুদ্ধের মুখ। ব্যাকড্রপে পাখোয়াজ।
একটু পরেই ফ্রেমে ঢুকল অদূরে ক্ষীণ কটি, দীর্ঘাঙ্গী বনবালা— সুজাতা। ইউক্যালিপটাসের ছায়া সুনিবিড় পথে মাথায় পায়েসের রেকাব নিয়ে সে যেন হেঁটে চলেছে।
মাদল আর বাঁশির আবহে কোপাই নদীর ধারে আদিবাসী গ্রাম, অনম্র বুক— সুঠাম আর ভারী কোমরের সাঁওতাল মেয়ে— ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে ঋত্বিক যেন কিঙ্করের রোদছায়া মাখা আদুল ক্যানভাস এঁকে চলেছেন। একটি ফ্রেমে ধরা দিলেন দুই শিল্পী। জড়ানো গলায় ঋত্বিকের সংলাপ, ‘‘কিঙ্করদা...!’’
‘‘হুঁ।’’
‘‘আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’
রামকিঙ্কর স্মৃতিতাড়িত হয়ে একচোট হাসলেন। তারপর বলেন, বলে চলেন, ‘‘উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’
ছবি এগোয়, কিন্তু শেষ হয় না। দৃশ্য ফুরিয়ে যায়। প্রায় পুরো ছবির শ্যুটিং শেষ করে প্রাথমিক সম্পাদনার পর ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাকের কাজ শুরুর মুখেই চিরবিদায় নিলেন ঋত্বিক। অসমাপ্ত তথ্যচিত্রের স্ক্রিনজুড়ে একসময় নেমে আসে দুই শিল্পীর মুখোমুখি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শোনা যায় ঋত্বিক আর কিঙ্করের কথা।
ঋত্বিক প্রশ্ন করেন, ‘‘এই যে আপনার চাল ভেঙে পড়ছে, জল পড়ছে, কী ভাবে সারাবার চেষ্টা করছেন আপনি?’’
কিঙ্কর বলেন, ‘‘পেনশনের টাকা যেটুকু পাই। সেইটুকু থেকে করছি আর কী!’’
‘‘সেটা কি ছবি টাঙিয়ে করা হচ্ছে?’’
কিঙ্কর হেসে ফেলেন। বলেন, ‘‘সেও আছে।’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘বড় বড় ক্যানভাস যেগুলো, সেগুলো উলটে দেওয়া আছে। অয়েল কালার কিনা। উপরে কোনও ক্ষতি হবে না। বৃষ্টি পড়ে কিনা, তাই ওগুলো ঝুলিয়ে দিই। ... এগজিবিশনের জন্য ক্যানভাসগুলি নিয়ে যেতে হল, তখন আর কী ঝোলাব?...’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘খড় কিনতে হত, কিন্তু যেটুকু টাকা পাই...।’’
এখন কোনও কাজ নেই। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন তো আর আঁকতেও পারি না।... চোখে দেখতে পাই না কিছুই। পড়তেও পারি না, কেউ পড়ে দিলে শুনি। কেউ ধরলে হাঁটতে পারি। সমর্থ বয়সের অত্যাচার তার শোধ তুলে নিচ্ছে। মাঝে মাঝেw অসহ্য মনে হয়। পাগল পাগল লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। একেবারে বাতিল হয়ে গেছি। চোখ চলছে না, হাত চলছে না, চোখ অন্ধ। মনে মনে আঁকছি।