Advertisement
০৬ মে ২০২৪

ঠেসে আর খাওয়ায় না কেউ

মিষ্টির প্লেট হাতে মাসিমার তাড়া। পাতে-মুখে জবরদস্তি চালান আম ও মাংস। সে-কালের খাওয়ানোর গপ্পে পেট আইঢাঁই! লিখছেন ঋজু বসুবাংলার ঘরে-ঘরে এই মায়েদের নামে অভিযোগের কমতি নেই। জগৎ-সংসার-চাকরি-পরীক্ষা-প্রেম— এক ধারে, তো অন্য ধারে মাতৃহৃদয়। যত বড় সঙ্কটই সামনে থাকুক, এই মায়েদের এড়িয়ে সাত-সকালে শুক্তো থেকে অম্বল— পাঁচ পদ না-গিলে বাড়ির বাইরে পা-রাখা মুশকিলই নয়, ‘না-মুমকিন’ জেনে এসেছিল বাঙালি।

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

যাঁর ছবি ঘরে টাঙিয়ে দেশে-বিদেশে অজস্র বাঙালি মাতৃভক্তিতে বি হ্বল, সেই তিনিই যদি এমন হন তো বাকিদের আর কী বলা যায় !
দক্ষিণেশ্বরে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র আসামাত্র ঠাকুর যেই ‘তুই আজ থাকবি’ বলেছেন, শুনতে পেয়ে সারদামণি ময়দা মাখতে বসে গিয়েছেন। নরেন যে মোটা-মোটা রুটি ও ছোলার দাল পছন্দ করেন! ভক্তদের দেওয়া সেবার দানে রামকৃষ্ণের সংসারে নিত্য হাসিমুখে যজ্ঞিবাড়ির ধকল সামলাতেন মা ঠাকরুন। কার মুখে কী রোচে সব তাঁর নখদর্পণে।
তবে যে যুববাহিনী রাতবিরেতে সাধন-ভজনের জন্য পড়ে থাকতেন, তাঁদের প্রত্যেকের বপুর বহর খেয়াল রেখে স্বয়ং গুরুই ডায়েট ঠিক করে দিয়েছিলেন। সারদামণিকে ঠাকুরের কড়া নির্দেশ, রাখালকে ছ’টা, লাটুকে পাঁচখানা, বাবুরাম ও বুড়ো গোপালকে চারখানার বেশি রুটি দেবে না। এর বেশি খেলে ওদের সাধন-ভজনে ব্যাঘাত ঘটবে। ক’দিন বাদে তদন্ত করে ঠাকুর কিন্তু জানলেন, রোগাপাতলা বাবুরাম রোজই পাঁচ-ছ’খানার কম রুটি খাচ্ছেন না। এর পিছনে কার ইন্ধন বুঝে নিয়ে রামকৃষ্ণ এ বার স্বয়ং সারদাকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন। তাঁর বিবেচনাহীন স্নেহেই তো ছেলেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে !

তাতেই স্বমূর্তি ধরলেন সারদাদেবী। মাতৃত্বের উপরে এ সব নিষেধের ‘হুইপ’ জারি মোটেও সহ্য করবেন না তিনি। খোদ ঠাকুরের কথার প্রতিবাদ করে পাল্টা শুনিয়ে দিলেন, ‘তুমি ওদের খাওয়া নিয়ে কোনও গালাগালি করবে না। দু’খানি রুটি বেশি খেয়েছে তো কী হয়েছে, আমি ওদের ভবিষ্যৎ দেখব।’ স্বামী গম্ভীরানন্দের লেখা মাতৃজীবনী সাক্ষী, শ্রীমার এই সর্ববিজয়িনী মাতৃশক্তিকে সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক ঠাকুর স্মিত মুখে হার স্বীকার করে নিলেন।

বাংলার ঘরে-ঘরে এই মায়েদের নামে অভিযোগের কমতি নেই। জগৎ-সংসার-চাকরি-পরীক্ষা-প্রেম— এক ধারে, তো অন্য ধারে মাতৃহৃদয়। যত বড় সঙ্কটই সামনে থাকুক, এই মায়েদের এড়িয়ে সাত-সকালে শুক্তো থেকে অম্বল— পাঁচ পদ না-গিলে বাড়ির বাইরে পা-রাখা মুশকিলই নয়, ‘না-মুমকিন’ জেনে এসেছিল বাঙালি। বঙ্কিম-শরতের নভেলের স্ত্রী-চরিত্র মাত্রেই মাতৃশক্তির অবতার। যাঁর ইহকাল-পরকাল জুড়ে একটাই চিন্তা, না-খেলে ছেলের ‘দেহ কী করে থাকবে’! ‘আমার মাথা খাও তবু খেয়ে যাও’— নারীর এই মিনতি যেন আদেশ!

এ হেন নাছোড় আর্তির সামনে সম্ভবত রাগী মুনি দুর্বাসাও ঘোর ফ্যাসাদে পড়তেন। মহাভারতে বনবাসী পাণ্ডবদের জব্দ করতে অবেলায় গাদাখানেক শিষ্যসুদ্ধ তাঁকেই পাঠানো হয়েছিল। তখন সবে স্বামীদের চাছিপুঁছি খাইয়ে-খেয়ে দ্রৌপদী হেঁসেলের পাট বন্ধ করেছেন। মতলবটা ছিল, খেতে না-পেয়ে ক্রুদ্ধ দুর্বাসা পাণ্ডবদের ভস্মই করে দেবেন। সে-যাত্রা, সখা-কাম-ভগবান কৃষ্ণ কী একটা তুক করে দুর্বাসা-বাহিনীকে পাল্টা চাপে ফেলে দেন। দ্রৌপদী কিছু বন্দোবস্ত করার আগেই অতিথিদের বেমক্কা পেট ভরে গিয়েছিল!

এই পরিস্থিতিতে বাঙালি মা নির্ঘাত কৃষ্ণের সাহায্য ছাড়াই মুশকিল আসান করে ফেলতেন। শ্যামবাজারের সেই স্বর্গগত জেঠিমা যেমন! কাছেই ইলেকট্রিকের অফিসে কেউ বিল জমা দিতে গেছে দেখলেও তিনি প্রায় ঘাড় ধরে বাড়িতে হাজির করাতেন। বহু বছর আগে বাপ-কাকাদের সঙ্গে তাঁর হাতে বার কয়েক ‘অ্যারেস্ট’ হতে হয়েছে। কথায়-কথায় ভুলিয়ে কোন্‌ ফাঁকে পেশ করতেন গাদাখানেক চিংড়ির বড়া বা মেওনিজ ঠাসা পেল্লায় মামলেট। দুপুরে ভরা পেটে সে জিনিস, গেলা বা ফেলা দু’টোই ভয়ানক কঠিন ছিল। আর খেতে-খেতে একবার ‘ভাল হয়েছে’, বলে ফেললে তো রক্ষে নেই। পুরো খাবারটাই অবধারিত মুখ বুজে দ্বিতীয় বার খেতে হত। জ্যাঠামশাই যে খুব বিরাট চাকরি করতেন, বলা যায় না। কী করে এই গণভোজ সম্ভব হত, খোদাই জানেন।

জনৈক ঢাকাইয়া বন্ধুর খালাম্মাই বা কম কীসে! তাঁর সামনে পাত আগলে এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হলেই অতর্কিত হামলা চলত। বাড়িতে কেউ হঠাৎ এসে পড়লে কক্ষনও অপ্রস্তুত হননি। হেঁসেলের ঝরতি-পড়তি মাছ-মাংস কি ছাদের বাগানের সর্ষে শাকে ঝটপট ফুলকোর্স ভোজের বন্দোবস্ত করে ফেলতেন। বহু বছর আগে পরীক্ষার আগের বিকেলে কী একটা বই ফেরত দিতে এসে তাঁর পুত্রের বন্ধুর শোচনীয় দশা হয়েছিল! ছেলেটির শুকনো মুখ দেখে তাঁকে গুনে-গুনে চারটে আস্ত হিমসাগর খাইয়ে ছেড়েছিলেন মাসিমা। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ঘরে-ঘরে ভালবাসার এই অত্যাচারে অনেক খাইয়ে মহারথীই নাজেহাল হয়েছেন।

পয়লা বৈশাখের এক সকালে উত্তমকুমারকেও না কী মিষ্টির থালা হাতে তাড়া করেন লেখক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মা তরুবালাদেবী। ভাইফোঁটার দুপুরে বিভিন্ন প্রজন্মের কাছের-দূরের ভ্রাতৃকুলকে তিনি ভারী যত্নে খাওয়াতেন নির্মম ভাবে। বুক দিয়ে পাত আড়াল করলেও লাভ হত না। জাঁদরেল ব্যাট‌সম্যানকে ঠকানো গুগলির মতো তরুবালা ঠিক মাছটা-সন্দেশটা পাতে চালান করে ছাড়তেন। মার্বেল প্যালেসের মল্লিক-বাড়ির হীরেন মল্লিকেরও মনে পড়ে, তাঁর শ্বশুরবাড়ির সেই সব বয়োজ্যেষ্ঠ শ্যালিকা-বউদির কথা। পরিবেশনের সময়ে ‘না’ শব্দটা তাঁদের অভিধানেই ছিল না। বেশি গাঁইগুঁই করলে মিষ্টি-মাংস সটান মুখে গুঁজে দেবেন। পুরো পাতা গুটিয়ে ফেলেও রেহাই মিলত না। শোভাবাজার রাজবাড়ির অলককৃষ্ণ দেবের শাশুড়িমা প্রমীলা বসুরও কে কী খাচ্ছেন, নজর এড়াত না। বেচারি ন’জামাই কাঁটা বাছতে পারে না, দেখে ‘মা’ নিজেই মাছ বেছে আদর করে ভাত মেখে দিতেন।

শুধু বচ্ছরকার দিনে নিজের জ্ঞাতি-কুটুমের খাতিরদারি নয়, এমন মাতৃহৃদয়ের দরজা পাড়াময় সবার জন্য অষ্টপ্রহর খোলা থাকত।

বছর ৪৫ আগে আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মধ্যবিত্ত সংসারের ঘটনা। তেতলার ঘরে পুলিশকে এড়াতে ‘প্রদীপদা’ নামে তখন অজ্ঞাতবাসে আছেন সিপিএম নেতা দীনেশ মজুমদার। হঠাৎ পাড়ায় নকশাল-কংগ্রেস বোমাবাজি! থানার বড়বাবু মিতাশ চট্টোপাধ্যায়ের পিস্তলের গুলি ছিটকে হাঁটুতে জখম কংগ্রেসের তরুণ তুর্কি, পরবর্তীতে ইস্টবেঙ্গল কর্তা পল্টু দাস। পল্টুকে ডাক্তার দেখিয়ে পুলিশের ঝামেলা এড়াতে পার্টির ছেলেরা ওই বাড়িতেই ধরাধরি করে নিয়ে এলেন। গিন্নি কত্তাকে বোঝালেন, আ-হা কোথায় যাবে ছেলেটা! একতলায় পল্টুর থাকার বন্দোবস্ত হল। শুম্ভ-নিশুম্ভের এই নিঃশব্দ সহাবস্থানের কাহিনি কিন্তু পাড়ার কেউ মায় ওঁরা দু’জনও জানলেন না। দুই আশ্রিতের সেবা পরিপাটি জারি থাকল। আবার বাড়িতে চার ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজ-সাঁতার-গানের ক্লাসের বন্ধুদের আনাগোনাও রোজ বিকেলের পার্বণ। একটু নিমকি ভেজে বা লুচি-পরোটা-চিঁড়ের পোলাও করে, কখনও বা নীলমণি মিষ্টিওলার তিলকূট-দরবেশ কি কেকম্যানের কেকযোগে গিন্নি কোন্‌ ম্যাজিকে বাড়ন্ত বয়সের অতিথিদের রাক্ষুসে খিদের জোগান দিয়ে গেলেন।

তখন যৌথ পরিবারে গিন্নিদের খেতে বসতে বিকেল গড়িয়ে যেত। সবার জলখাবারের পাট-কত্তাদের অফিসটাইমের ভাত-কুচোকাচা-রুগি-বুড়োদের মধ্যাহ্নভোজ চুকলে দেখা যেত মেয়ে-বউদের জন্য ছ্যাঁচড়ার কাঁটা-চচ্চড়ির ডাঁটা, পাতলা ডাল বা পুঁটি-মৌরলার তলানি অম্বল ছাড়া কিছু পড়ে নেই। কল্যাণী দত্তের ফিরিস্তি— প্রমীলা-বাহিনী তাতেই তৃপ্তি করে খেয়ে উঠতেন, কোনও দিন বা ভাতের সঙ্গে পাড়ার দোকানের তেলেভাজা আনিয়ে নিতেন।

এই সর্বংসহা উজাড় করা মাতৃত্বের ছবিটা বাদল সরকার তাঁর বিখ্যাত একাঙ্ক ‘শনিবার’-এ নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন। আটপৌরে ‘মাসিমা’ সারা ক্ষণ মঞ্চে দুধের গেলাস হাতে ঘুরছেন। ছেলে, মেয়ে, স্বামী, ছেলের বন্ধু— পালিয়ে বাঁচেন। যাবতীয় উৎকণ্ঠার মাঝে জীবনের বয়ে চলার ফাঁকে সেই মায়ের ‘খা-বাবা, খাবি না’-র কাতর মিনতিটুকুই যেন নাটকের মূল সুর। শেষে পুত্রের চাকরি ঘুচে যাওয়ার খবর আসার পরেও মায়ের প্রতিক্রিয়া, একটু লুচি ভেজে আনি? হালুয়া না বেগুনভাজা কী দিয়ে খাবি তুই ! ছেলে যে খেতে রাজি হয়েছে এটুকু জেনেই তাঁর আহ্লাদের শেষ নেই।

বঙ্গললনার এই বিখ্যাত স্নেহবৃত্তির প্রকাশ, বলা বাহুল্য শুধু লুচি-হালুয়ার অবতারেই আটকে থাকেনি। সে-কালের আটপৌরে বাড়িতেও কাসুন্দি, বড়ি, আচার, আমসত্ত্বের ছড়াছড়ি। রকমারি মোরব্বা, জ্যাম, জেলি থেকে পিঠে-পুলি মায় সন্দেশ, পান্তুয়া, চমচম, খাজাগজা সৃষ্টিতেও ঘরোয়া-শিল্পীদের জয়জয়কার। আর সাহেবি সংস্পর্শে আসা বড়-বাড়ি হলে কথাই নেই। উনুনে লোহার পাত, বাক্স তন্দুর চাপিয়ে কেক, বিস্কুট, পুডিং, মুরগির স্ক্যালপের চর্চাও জমজমাট। লীলা মজুমদারের ‘গুপি’র জন্মদিনের মোগলাই পরোটা, শামি কাবাব বা আলু মাকাল্লাই হোক, বা পরশুরামের ‘রটন্তীকুমার’-এর দিদির সঙ্গে ভাব করতে আসা খগেনবাবুর জন্য তৈরি বাদামের নিমকি, মাছের কচুরি, মটন প্যাটি, পেস্তার বরফি, ল্যাংড়া আমের ল্যাংচা—প্রত্যেকটিই নিখাদ ‘হোমমেড’।

এ সব ভোজ্য সুচারু ভাবে সাজিয়ে দিতে জানলে যে-সে ভোজন, ভোজনাতীত ভাবে সুখের হয়ে ওঠে তা জানতেন বুদ্ধদেব বসু। আর লীলা মজুমদার তো বলেই দিয়েছেন, ‘নিজে খেতে যত না আনন্দ পরকে খাওয়ানোতে তার চাইতেও বেশি...!’ রান্নাখাওয়াকে মানুষের ‘শ্রেষ্ঠ কীর্তি’র মর্যাদা দিয়ে পিরামিড, পিসার ট্যারা মিনার বা তাজমহলের চেয়েও ঢের কাজের জিনিস বলে গিয়েছেন ‘পদিপিসি’র স্রষ্টা।

রান্না না জানলে যে সম্পূর্ণ মানুষ হয় না তা বিশ্বাস করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতারত ২৩ বছরের এমএ পাশ লীলা আর পূর্ণিমা ঠাকুরকে ডেকে তিনি এর পরীক্ষাও নিয়েছিলেন। কবিগুরুর জন্য আটপৌরে নির্ঝাল দুপুরের মেনু রেঁধে লীলা ডিস্টিংশন সমেত পাশ করেন। শীতের তরকারি দিয়ে ভাজা মুগের ডাল, ভাজা, নারকোল দিয়ে চালকুমড়োর ঘণ্ট, পার্শে মাছের ঝাল, টমাটোর চাটনির পরে পেঁয়াজের পায়েস খেয়ে রবীন্দ্রনাথ চমৎকৃত হয়েছিলেন। শীতকালে লিচুর পায়েস এল কী করে ভেবে খুব আশ্চর্য হন তিনি।

রাজ্যের প্রাক্তন শীর্ষ আমলা প্রসাদরঞ্জন রায় ও তাঁর স্ত্রী শিখাও তাঁদের প্রিয় মেজপিসির (লীলা) বিশেষ ভক্ত। পিসি-র বাড়িতে প্রথমবার কফি ও ঘরোয়া আইসক্রিম চাখার গল্প বলতে বলতে শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে ওঠেন।

এ সব প্রাইভেট ভোজের বাইরে সে-কালের খানদানি সাহিত্যসভা বা ঐতিহাসিক লগ্নও নারীর কল্যাণহস্তে রসাত্মক হয়ে উঠেছে। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, কালিদাস নাগ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেনদের নিয়ে সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ‘মণ্ডা ক্লাব’-এর আপ্যায়নের ভার বাড়ির মেয়েরাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বিশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় কংগ্রেসি সম্মেলনে বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখ শাকাহারী মরাঠা নেতারা মেছো বাঙালির হাঁড়ির ছোঁয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন! বাঙালি মেয়েদের হাতের রকমারি মিষ্টির আস্বাদ তাঁদের কলকাতাবাস মাধুর্যে ভরে দিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির বিদ্বজ্জনসমাগম সভা, খামখেয়ালি সভা বা শান্তিনিকেতনের চা-চক্রও বাড়ির মেয়ের মুখরোচক সৃষ্টিতে ভরপুর। রবীন্দ্রজায়া মৃণালিনী দেবীর হাতের দইয়ের মালপো, মানকচুর জিলিপির আত্মপ্রকাশও না কী এ সব আসরেই।

এ সব কথায় পরশুরামের গল্পের পার্শিবাগানকেও মনে পড়বে। আড্ডা ঘন হয়ে উঠলে, সন্ধের বয়স বাড়তেও ভেতর-বাড়িতে একবারটি খবর দিলেই হল।

বর্ষার ঝমঝমে আবহে জমে উঠবে ইলিশ কোর্স ডিনার।

পাকপাড়ায় লেখক নরেন মিত্তিরের বাড়িতে আবার সবার অবারিত দ্বার। গৃহকর্তার সঙ্গে ফরিদপুরী কানেকশনের টানে প্রায়ই আসতেন ও-পার বাংলার ভিনধর্মী ছাতাওয়ালারা। কিংবা নৈহাটির ট্রেন ফেল করা প্রতিভাবান অনুজ লেখক সমরেশ বসু। অপ্রত্যাশিত অতিথিকে বাড়ির ছেলেরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিছানা ছেড়ে দিতেন। ২০২, রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের কবিতাভবন-এর আড্ডার মেজাজটিও বিশিষ্ট। হোস্টেস তথা বুদ্ধদেব বসুপত্নী প্রতিভা বসুর স্নিগ্ধ পরিশীলিত আতিথেয়তায় পীড়াপীড়ি নেই। অতিথিরাও যেন ঘরেরই লোক। বেলা ১১টার পরে ঢুকলে তিনি যেই হোন, সেখানেও ভাত খেয়ে যাওয়াটিই ছিল নিয়ম।

ঢেঁকুরপর্ব

সত্যি বলতে আমরা যারা আশির শেষ বা নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কৈশোর থেকে যৌবনের দিকে পা ফেলছিলুম, অতিথির এই আগাম খবর না-দিয়ে আসার অভদ্র দিকটা বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল। তখনও মোবাইল-যুগের ঢের দেরি। মুম্বইয়ে ইংরেজি ভাষার এক নামজাদা ভারতীয় লেখকের বাড়ির দরজায় না কি লেখা থাকত, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ভুলেও বেল বাজাবেন না! শুনে আমরা হতভম্ব।

তখনও ভরসন্ধেয় শিলিগুড়িতে নেমে বিনা নোটিসে মা ও বোনসুদ্ধ নির্ভাবনায় স্কুলফ্রেন্ড কৌশিকের বাড়ি ঘাঁটি গাড়া যায়। মাধ্যমিকের ছুটিতে আসানসোলে ‘সারপ্রাইজ’ দিয়ে অর্ণব বা জয়সূর্যদের বাড়ি নরক গুলজার করাটাও অতি স্বাভাবিক। সোদপুরে কৃশানুর মা-বাবা জোরদার খাওয়ার পরে ছেলের বন্ধুদের জন্য ভিসিপি ভাড়া করে নতুন ক্যাসেট আনিয়ে রাখেন।

মাঝেমধ্যেই মাটিতে টানা বিছানা পেতে ছেলের বন্ধুদের গোটা ফুটবল টিমের লম্বা হওয়ার ব্যবস্থা করেন মা। পুঁচকে বাড়িতে চার গুণ লোক হাজির হলে গৃহকর্ত্রী হাসিমুখে তাঁর ছোট হাঁড়িতে দু’বার-তিন বার ভাত চাপাতেন। থালা মেজে দফায় দফায় খেতে দিতেন।

ঐতিহাসিক নিয়মেই সে-সব দিন বোধহয় ফিরে আসা উচিত নয়। এ কালের নারী-পুরুষ বাইরে-ঘরে ঢের বেশি ব্যস্ত। বাড়িতে কাসুন্দি-চর্চা বা অভাবিত অতিথিকে নিয়ে খুশি হওয়ার সময়ই কোথায়! বু.ব. ঠিক বলেছিলেন, মেয়েদের দাসী বানিয়ে রেখে গাধা-খাটুনির ধকলেই বিকশিত হয়েছিল রান্নাঘরের সেই ললিতকলাও। তবু একালেও হয়তো টিকে থাকেন, দু’-চারজন বিক্ষিপ্ত সেকালিনি। আমি ‘মায়ের মেয়ে’ প্রমাণ করতে বেতো হাঁটু সামলে কোনও দিন বা পঞ্চাশ জনের বিরিয়ানি রেঁধে ফেলেন টালার সত্তুরে দিদিমা। জয়পুরিয়া কলেজের গলিতে ঢুকলেও প্রবীণ নন্দিনীদিদির অফুরান লুচি-ডালপুরির আশ্বাসে মনটা ভাল হয়ে যায়। তবু ধরে-বেঁধে খাওয়াতে-খেতে এ কালে নিরন্তর চোখ পাকায় কোলেস্টেরল, সুগার, ট্রাইগ্লিসারাইডের অসুর।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সে-দিন বলছিলেন, ‘‘সে-কালে খাওয়ার ঘটাপটা যা-ই থাক, আয়ুর মেয়াদও কিন্তু বেশি ছিল না।’’ মধ্যজীবনের ভাঙা মনে অগত্যা পদিপিসির গল্পে সেজদিদিমার নাতির মতো রেগে যাই! লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ফুলকপির ডালনা, চিংড়ির মালাইকারি, চালতার অম্বল, রসগোল্লার পায়েস,—এক নিশ্বাসে রাশি রাশি খেয়ে ফেলি মনে মনেই।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE