Advertisement
০৮ মে ২০২৪
বড় একা লাগে-২

মন ঠিক করতে বেরিয়ে পড়ুন এদিক-ওদিক

সন্তানরা সব দেশ-বিদেশে চলে যাচ্ছে। একাকীত্বে দিশেহারা বাবা-মা। কী করবেন? মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের সঙ্গে কথা বললেন সোমা মুখোপাধ্যায়।প্র: একাকীত্বের সমস্যা নিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের মূল বক্তব্যটা কী? উ: বক্তব্য মোটামুটি একই রকম। কথা বলার কেউ নেই। যে ছেলেমেয়েরা এক সময় তাঁদের ঘিরে থাকত, তারা কি এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মা তাই বাঁচার অর্থটাই হারিয়ে ফেলছেন।

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

প্র: একাকীত্বের সমস্যা নিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের মূল বক্তব্যটা কী?

উ: বক্তব্য মোটামুটি একই রকম। কথা বলার কেউ নেই। যে ছেলেমেয়েরা এক সময় তাঁদের ঘিরে থাকত, তারা কি এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মা তাই বাঁচার অর্থটাই হারিয়ে ফেলছেন।

প্র: এঁদের সকলেরই কী ছেলেমেয়েরা চাকরি বা পড়াশোনা সূত্রে কি ভিন শহরে বা ভিন দেশে থাকে?

উ: না, সব ক্ষেত্রে তা নয়। ছেলে বা মেয়ে পাশের বাড়িতে থাকে, তাও নিয়মিত দেখা বা কথা হয় না, এমনও আছে। আমার মা আমার বাড়ির পাশেই একা থাকতেন। যখনই মায়ের কাছে যেতাম, দেখতাম গাঁক-গাঁক করে টিভি চলছে। তখন হয়তো মা অন্য. কিছু করছেন। হয়তো রান্না করছেন। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, তুমি তো দেখছ না, তা হলে টিভিটা চলছে কেন? মা বলতেন, ‘ওটা বুঝবি না। টিভিটা চললে মনে হয় বাড়িতে কেউ আছে, কেউ কথা বলছে।’ আসলে ফোন আর টিভি-এটাই এখন বহু বয়স্ক মানুষের জীবনের অন্যতম অবলম্বন হয়ে গিয়েছে।

প্র: একাকীত্ব থেকে আসা এই অবসাদ কি পুরোপুরি মানসিক সমস্যা?

উ: না, পুরোটা তা নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে কিছু ‘বায়োলজিকাল’ পরিবর্তন আসে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ‘ইনভলিউশনাল মেলানকোলিয়া’ বা বৃদ্ধ মস্তিষ্কের কষ্ট। এই পরিবর্তনটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনিই আসে। তার পর যখন সেই মানুষেরা দেখেন নিজের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার জন্য চারপাশে কাছের মানুষেরা নেই, তখন মস্তিষ্কের চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা এমনিই কমে যায়। মজার বিষয় হল, অবসাদে ডুবে থাকা এই মানুষগুলোই রাতারাতি অন্যরকম হয়ে যান, যখন ছুটিছাটায় ছেলেমেয়েরা তাঁদের কাছে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যায়। তখন তাঁরা ফের তরতাজা।

প্র: নিয়মিত ফোন করে বা স্কাইপে কথা বলে বাবা-মাকে এই খুশিটা নিশ্চয় দেওয়া যায় না?

উ: না, সেটা সম্ভব নয়। বয়স বাড়লে কিছু অনিশ্চয়তা বোধ আসে। ধরা যাক, যে অফিসে আমাকে দেখলে ক’দিন আগেও অনেকে উঠে দাঁড়াতেন, অবসর নেওয়ার পরে সেই অফিসেই আমি গেলে বিশেষ পাত্তা পাই না। অফিস আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে ‘তোমার দিন শেষ’, আর বাড়িতে ছেলেমেয়েরা দূরে গিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘তোমাকে ছাড়াই থাকতে পারি’। এই বোধটাই আসলে মারাত্মক। এ থেকে অসুস্থতার ভয় আসে, মৃত্যুভয় আসে। ফোন করে সেই ভয় কাটানো যায় না।

প্র: কিন্তু এ জন্য ছেলেমেয়েদের পক্ষেও তো সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে চলে আসা সম্ভব নয়?

উ: নয়ই তো! সেই কারণেই তো বাবা-মাকে নিজেদের মতো করে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পেতে হবে।

প্র: সেটা কী ভাবে?

উ: সেটা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। মূল কথা হল, যে ভাবে হোক নিজেকে সক্রিয় রাখা দরকার। শরীর যদি নিতান্তই অসহযোগিতা না করে তা হলে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা যায়। এমন প্রচুর এনজিও আছে, যারা ভাল কাজ করে, কিন্তু টাকার জোর নেই বলে তাদের ভাল কর্মী নেই। তাদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে বা কম পারিশ্রমিকে কাজ করা যেতে পারে। আবার নিজে উদ্যোগী হয়েও কিছু কাজ শুরু করা যায়। যেমন, আমার পরিচিত একজন আছেন। তাঁর পাড়ার ক্লাবে একদল অল্পবয়সি ছেলে রাতদিন ক্যারাম খেলত। তিনি এক দিন বললেন, ‘তোমাদের এ ছাড়া কাজ নেই?’ তারা বলল, ‘কী করব বলুন? চাকরি-বাকরি তো পাচ্ছি না। পাবও না।’ এর পর তিনি ক্লাবের ওই ঘরে ওই ছেলেদের পড়াতে আরম্ভ করলেন। চাকরির পরীক্ষায় বসার জন্য পড়ানো। এখন ক্লাবটার পরিবেশটাই বদলে গেছে। ভদ্রলোকও খুব ব্যস্ত। বাঁচার অন্যরকম অর্থ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

প্র: বাবা-মাকে মানসিক ভাবে ভাল রাখার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

উ: দেখুন, একটা কথা বুঝতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেমেয়েরা যে বাবা-মাকে সময় দিতে পারে না, সেটা তাদের অনিচ্ছা থেকে নয়, অক্ষমতা থেকে। প্রথমত, তাদেরও টিকে থাকার লড়াই রয়েছে। চাইলেই যখন-তখন তারা চলে আসত‌ে পারে না। তা ছাড়া অনেক সময়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার মতো বিষয়ও খুঁজে পায় না তারা। কী ভাবে ‘কমিউনিকেট’ করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা মনে হয়, ‘কমিউনিকেট’ করার এই দায়িত্বটা শুধু ছেলেমেয়ের নয়, বাবা-মায়েরও। তাঁদেরও নতুন নতুন বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে। ছেলে বা মেয়ে যেখানে থাকে, যেখানে চাকরি বা পড়াশোনা করে, সেই জায়গা, সেখানকার মানুষজন সম্পর্কে জানার ইচ্ছা তৈরি করতে হবে।

প্র: আচ্ছা, ছেলেমেয়েরা কাছে থাকবে না, এটা তো এখন জানা কথা। বাবা-মায়েদেরও কি নিজেদের মানসিক ভাবে তৈরি রাখা উচিত?

উ: অবশ্যই। ৪০ পেরনোর পরেই এটা নিয়ে ভাবা উচিত। অনেকেই আছেন, যাঁদের সারা দিন অফিস আর বাড়ি, এর বাইরে কোনও জীবন নেই। যেই অফিস থেকে অবসর নিলেন তখন সারা দিন বাড়িতে বসে টিভি দেখা। আর যে মহিলারা চাকরি করতেন না, তাঁদের শুধু সংসার নিয়েই সময় কাটত। যেই সংসারে দায়িত্ব কমল, তখন তাঁদেরও টিভিকে ঘিরে জীবন শুরু হল। এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। দৈনন্দিন জীবনকে কী ভাবে অর্থবহ করে তোলা যায়, সেটা তাঁদেরই খুঁজে বার করতে হবে।

প্র: যেমন?

উ: যেমন, নিজের সৃজনশীল দিকটাকে পরিচর্যা করতে হবে। যাঁর যা কিছু ভাল লাগার জায়গা, তা সে ছবি আঁকা, ফুলগাছের পরিচর্যা, লেখালেখি যা-ই হোক না কেন, সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রোজকার আড্ডার একটা গ্রুপ তৈরি করতে পারেন। সেই গ্রুপ নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করার পাশাপাশি এলাকার কোনও ভাল কাজেও অংশ নিতে পারে।

প্র: অর্থাৎ বাঁচার আনন্দ খুঁজে পাওয়ার দায়িত্বটা নিজেরই, তাই তো?

উ: একদম তাই। জীবন আপনার। তাকে ভাল রাখার দায়িত্বও তো আপনার ওপরেই বর্তাবে। অবসরের পরে কী খাবেন, কোথায় থাকবেন তা যদি আগাম ভেবে রাখতে পারেন, তা হলে একাকীত্ব কাটানোর ভাবনাটাও আগেই ভেবে রাখা উচিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mind
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE