Advertisement
১১ মে ২০২৪
স্মরণ ১...

অনুপ-ম

অনুপকুমার। উত্তমকুমার তাঁকে একটি ছবিতে বাদ দিয়েছিলেন। তিনি এড়িয়ে চলতেন সুচিত্রা সেনকে। বহু অকথিত কাহিনি বললেন সহধর্মিণী অলকা গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় সালটা যদ্দুর মনে পড়ছে ১৯৯২। ‘মহাশয়’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। মুকুল দত্তর পরিচালনা। শাম্মী কপূর এসেছেন কলকাতায়। বাংলা ছবি করতে। তাতে অনুপবাবুও আছে। একটা কম্পোজিশন ঠিক হয়েছে। টেক শুরু হবে। মুনমুন সেন, তাপস পাল, শাম্মী আর অনুপবাবু। হঠাৎ টেকনিশিয়ানদের কেউ একজন বলে উঠল, “অনুদা...।” তাতেই ও যা বোঝার বুঝে গেল। লাইটটা ঠিক নেওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। আমি নিয়ে নেব।” অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ছিল তো সবার সঙ্গে!

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ১২:২৪
Share: Save:

সালটা যদ্দুর মনে পড়ছে ১৯৯২।

‘মহাশয়’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। মুকুল দত্তর পরিচালনা।

শাম্মী কপূর এসেছেন কলকাতায়। বাংলা ছবি করতে। তাতে অনুপবাবুও আছে।

একটা কম্পোজিশন ঠিক হয়েছে। টেক শুরু হবে। মুনমুন সেন, তাপস পাল, শাম্মী আর অনুপবাবু।

হঠাৎ টেকনিশিয়ানদের কেউ একজন বলে উঠল, “অনুদা...।” তাতেই ও যা বোঝার বুঝে গেল। লাইটটা ঠিক নেওয়া হয়নি।

সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। আমি নিয়ে নেব।” অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ছিল তো সবার সঙ্গে!

আবার যে যার মতো পজিশন নিল। ক্যামেরা যাবে। হঠাৎ শাম্মী কপূর থেমে গেলেন। একটু বোধহয় রাগই দেখালেন। বললেন, “আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। ব্যাপারটা কী হল? অনুপবাবু লাইট নিতে পারছেন না! উনি যেদিন লাইট নিতে পারবেন না, আমি সেদিন ফিল্ম করা ছেড়ে দেব।”

ওর ওপর এতটাই আস্থা, এতটাই বিশ্বাস, শ্রদ্ধা দেখেছি সবার মধ্যে।

আরেকটা দিকও ছিল। অভিনেতা হিসেবে যে কোনও প্রোডাকশনে ও থাকা মানেই যে আলাদা একটা রসায়ন এসে যাওয়া, তাকে যেমন সম্ভ্রম করত লোকে, তেমন উল্টোটাও যে হত না, তা নয়। খোদ উত্তমকুমারের একটা ঘটনা বলি।

অগ্রগামী-র প্রযোজনায় ছবি। নায়ক উত্তমকুমার। পরিচালক অনুপবাবুকে নেবেন ঠিক করলেন। স্টুডিয়োতে সবার সামনে একদিন এমনও বলে দিলেন, “অনুপ, তুমি কিন্তু তোমার পার্টটা দেখে নিয়ো।”

এর দিন কয়েক বাদে বললেন, “না অনুপ, ছবিটায় তোমায় নেওয়া যাচ্ছে না। উত্তম বলেছে ও অনেক খেটেখুটে ছবিটা করছে, তারপর তুমি ঢুকে যদি...।” পরিচালক থেমে গেলেন।

তাতে অনুপবাবু শুধু বলল, “উতু এ কথা বলল?” তারপর সটান উত্তমদার কাছে, “কী গো, তুমি নাকি আমায় বাদ দিতে বলেছ?”

উত্তমদা সোজাসাপটা বলে দিল, “হ্যাঁ, বলেছি।” তারপর সেই এক কথা, “দ্যাখ, আমি অনেক খেটেখুটে করছি, এর পর তুই ঢুকলে...।” উত্তমদা কেন এ কথা বলেছিলেন, আজও আমার কাছে রহস্য।

আর কথা বাড়ায়নি অনুপবাবু। প্রতিদানে আবার উত্তমদা যখন ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’ করছেন, অনুপবাবুকে একটা রোলে ডেকেছিলেন। এর পরেও বহু বার উত্তমদার সঙ্গে ও কাজ করেছে, সমস্যা হয়নি।

বরং রমাদিকে (সুচিত্রা সেন) খানিকটা বোধহয় এড়িয়ে চলত ও। তার কারণটা অবশ্য একেবারে অন্য। রমাদি খুব পিছনে লাগত ওর। ফ্লোরে দেখা হলেই ডাক দিত, “এই যে ভাল ছেলে, এ দিকে এসো।’

কখনও ‘তুই’, কখনও ‘তুমি’। রমাদির কোনও ঠিক থাকত না। ওর কাছে শুনেছি, আড্ডায় বসলে রমাদি নাকি ভীষণ আদিরসাত্মক কথা বলতেন। অনুপবাবু তো এমনিতে খুব লাজুক প্রকৃতির ছিল, তাই ওর অল্পতেই কান-টান লাল হয়ে যেত। তাই রমাদির কাছে ও বোধহয় একটু গুটিয়েই থাকত।

এক দিকে প্রচণ্ড লাজুক। অন্য দিকে আবার অসম্ভব গার্জেনি করত। যে জন্য শুভেন্দুদা (চট্টোপাধ্যায়) ওর একটা নামও চালু করে দিয়েছিল— জেঠু। তারপর থেকে অনেকেই ওকে জেঠু বলে ডাকত। কারও কিছু সমস্যা হলেই ‘অনুদা’ আছে।

এই তো কিছু দিন আগের কথা। ওর একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে চিনুদা (চিন্ময় রায়) বলেছিলেন। চিনুদাদের একটা গ্রুপ ছিল। চিনুদা, সমিত ভঞ্জ...। তপন সিনহার কাজ যাঁরা বেশি করতেন, তাঁদের একটা দলের একসঙ্গে ওঠাবসা ছিল। ওঁদের জীবনে নিয়ম বলে কিছু ছিল না।

অনুপবাবু নাকি চিনুদাকে প্রায়ই বোঝাত, শ্যুটিঙের পর এটা করবি না। ওটা করবি না। বন্ধু বাছবি দেখে শুনে। চিনুদা সে দিন বলছিলেন, “তখন শুনিনি। ভাবতাম জেঠু জ্যাঠামি করছে। এখন বুঝি শুনলে বোধহয় জীবনটা অন্য রকম হত।”

সবাই যেমন ভালবাসত, তেমন ভয়ও করত। সে ভানুদা (বন্দ্যোপাধ্যায়), জহরদা (রায়) পর্যন্ত।

ওরা তো খুব ড্রিংক করত, আর অনুপবাবু ওসবের ধারকাছ দিয়ে যেত না। ও সামনে থাকলে ভানুদা-জহরদাদের কিচ্ছুটি করার উপায় থাকত না। লুকিয়ে চুরিয়ে, ডাবের ভেতর নিয়ে খেত।

কত বার হয়েছে, আউটডোরে, কী কোনও কল শো-য় কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। ভানুদা-জহরদার স্ত্রীরা কেবলই ওকে বলত, “অনুপ, তুমি একটু দেখো বাবা।”

‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিটার কথা মনে পড়ে। এলাহাবাদে গিয়ে শ্যুটিং করেছি। আবার হরিদ্বার থেকে শ্যুটিং করতে করতে ফিরেছি। ট্রেনেরই ভেতরে। পাশাপাশি টানা চারটে বগি নিয়ে কাজ।

তাতে ভানুদা পড়েছিল মহা মুশকিলে। অতক্ষণ ড্রিংক না করে থাকতেও পারছে না, আবার ওর সামনে খেতেও পারছে না। শেষমেশ বলেই ফেলল, “অনুপরে সরা তো এইখান দিয়া, আমি একটু ওই দিকে যামু।”

ওর এই ‘জেঠু’ মার্কা স্বভাবটার জন্য কত যে সমস্যাও মিটে যেত, বলার নয়।

মৃণালদার (সেন) কথা বলি। গীতাদি অনুপবাবুর মামাতো বোন। তাই মৃণালদা ওর ভগ্নিপতি। পাইকপাড়া থেকে বাসে করে স্টুডিয়ো পাড়ায় যেতে অসুবিধে হত বলে, অনুপবাবু একটা সময় মনোহরপুকুরে মৃণালদারা যে বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন, সেখানে থাকত।

দেশপ্রিয় পার্কে মৃণালদাদের একটা আড্ডা ছিল। সেখানে গণনাট্য সংঘ-র লোকজন জড়ো হতেন। ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেনদের সঙ্গে সম্ভবত ওই আড্ডা থেকেই অনুপবাবুর ঘনিষ্ঠতা।

ঋত্বিকদার সঙ্গে তো এতটাই ওর কাছের সম্পর্ক তৈরি হয়, হাসপাতালে ঋত্বিকদা যখন মারা যাচ্ছেন, তখন ওঁর শিয়রে মৃণালদার সঙ্গে আর যে ছিল, সে অনুপবাবু।

বিয়ের পর আমিও মৃণালদার বাড়িতে গিয়েই উঠি। ছোট্ট এক টুকরো ফ্ল্যাট। দেওয়ালগুলোর এমন অবস্থা যে খসে খসে পড়ত। ভাঙা দেওয়াল ঢাকা দিতে মাদুর ঝুলিয়ে রাখতাম।

দেওয়ালে মাদুর দেখে লোকে অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে সবাই বলত, “ও অলকার শখ। ও একটু সাজিয়েগুছিয়ে থাকতে ভালবাসে, তাই।”

এ দিকে দেওয়াল ভরতি ড্যাম্প। তাতে ঘরের ভেতর এত ঠান্ডা লাগত যে ভরা গরমেও রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে মাথায় টুপি পরে ঘুমোতে হত।

মৃণালদার তখন খুবই খারাপ অবস্থা। হাতে ছবি নেই। গীতাদি খুব অসুস্থ। বাবু (ছেলে) হয়ে গেছে। তখনই হঠাৎ ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির কাজ পাওয়া গেল। হেমন্তদা (মুখোপাধ্যায়) প্রডিউসার। ছবির জন্য হেমন্তদা একটা গান বানালেন, ‘ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’।

তাতে মৃণালদা বেঁকে বসলেন, “আমার ছবিতে গান? অসম্ভব।”

অবস্থা এমন দাঁড়াল, সব ভেস্তে যায় আর কী! শেষে সামাল দিল অনুপবাবু। মৃণালদাকে ধমকে-টমকে রাজি করালো।


‘হাইহিল’ ছবিতে

পরিচালকদের মধ্যে বোধহয় তনুদার (তরুণ মজুমদার) সঙ্গে আলাদা রকমের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল ওর। অথচ তনুদার সঙ্গে প্রথম বার কাজে কিন্তু বেশ মন কষাকষিই হয়েছিল ওর।

তনুদা অনুপবাবুর থেকে এক বছরের ছোট। তবু ও দাদা ডাকত। শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারে যখন ‘দেবর’ ছবি করে অনুপবাবু, তখন থেকে তনুদার সঙ্গে আলাপ। ওই ছবিতে পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্যর সহকারী ছিলেন তনুদা।

তনুদার কাজ ছিল ডায়লগ পড়ানো। তনুদার মত ছিল স্ক্রিপ্টে যা আছে, তাই বলতে হবে। কোনও অদলবদল করা যাবে না।

এ নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হত ওদের মধ্যে। সেই তনুদার সঙ্গে পরের দিকে অনুপবাবুর কী যে হল! তনুদা বলতেন, “অনুপকে বেঁধে দিলেই বিপদ। ওকে ওর মতো করতে দাও।”

উল্টো দিকে অনুপবাবু বলত, “তনুদার কম্পোজিশন, ডিটেলমেন্টের জবাব নেই। ও তো খুব ভাল ছবি আঁকে, তাই বোধহয় বুঝতে পারে, কোথায় কোনটা থাকলে ভাল দেখায়।” তনুদাকে এত ভালবাসত যে ওর সিনেমা করবে বলে স্টার থিয়েটারের পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল।

ও মনে করত, তনুদার ‘বরযাত্রী’ ছবিই ওকে কমেডিয়ান বানিয়ে দেয়। ওর বিশ্বাস ছিল, কমেডি অভিনয় সবার দ্বারা হয় না। আবার উল্টো দিকে ‘কমেডিয়ান’ ছাপ্পাটা ওঁকে একসময় হাঁফ ধরিয়ে দিয়েছিল।

তনুদাকেই তো একবার বলেছিল, “দেখো, আমার প্রবলেম হচ্ছে, আমি অনুপকুমার হয়ে গেছি। কারও কাছে গিয়ে কাজ চাইতে তো পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমাকে বাঁচাতে পারো। আমার এই স্ট্যাম্পটা মুছে দাও।”

এই ঘটনার পরেই ‘পলাতক’। নায়ক বসন্ত যেখানে উদাসী এক বাউলের মতো। যার শিকড়ের কোনও টান নেই। অদ্ভুত আলাভোলা চরিত্র। ওর অসম্ভব প্রিয় ছবি।

‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র সদানন্দ করেও ও খুব তৃপ্তি পেয়েছিল। সদানন্দও আপনভোলা। কিন্তু তার মধ্যেও গভীরতা আছে। বেদনাবোধ আছে। সেটাকে ঠিকঠাক করে ফোটাতে পেরে ওর মনটা ভরে গিয়েছিল।

একটা সময় বেশ কিছু ট্র্যাজিক রোলও করেছিল, চিত্ত বসুর ছবিতে। তারপর এমনও হয়েছিল দেখা গেল সন্ধ্যাদি (রায়) আর ও পর পর নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছে।

ও বলত, “ওটা যদি ধরে রাখতে পারতাম, অন্য ছবির কাজ নেব না, শুধু নায়ক হিসেবেই কাজ চালিয়ে যাব, তা হলে হয়তো ভাল একটা জুটি তৈরি হত। তা আর হল কই!”

আসলে ওর কাছে কোনও দিনই বাছাবাছির সুযোগ বলে কিছু ছিল না। বারো বছর বয়েস থেকে রোজগার করতে হয়েছে। সাত ভাই, পাঁচ বোনের সংসার।

বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দাস ছিলেন গ্রামাফোন কোম্পানির ট্রেনার। কাজি নজরুল ইসলামকে কোম্পানির বড়বাবু ভগবতী ভট্টাচার্য, গায়ক কে মল্লিক আর উনিই গ্রামাফোনে নিয়ে আসেন। নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ তখন সুপার হিট। কোম্পানি থেকে হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজা হচ্ছিল। গ্রামাফোনে জয়েন করার সময় নজরুলের শর্ত ছিল, তাঁর গান তিনি নিজে লিখবেন, তারপর সেটা ধীরেন্দ্রনাথ দাসকে শেখাবেন। এর পর ধীরেন দাস অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াবেন।


‘দাদার কীর্তি’র শ্যুটিঙে

এমন গুণী মানুষ ধীরেন দাস অফিস-রাজনীতির শিকার হয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এই একই কারণে নজরুলকেও চলে যেতে হয় আকাশবাণীতে। কিন্তু অনুপবাবুদের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা থেকেই যায়। ওরা ওঁকে কাজি জ্যাঠামশাই ডাকত।

অনুপবাবুদের বড় সংসার। বাড়ির কর্তার চাকরি নেই। এই অবস্থায় অনুপবাবুকে প্রাণপাত করতে হত।

এক-একটা দিন এমনও গেছে, সারা রাত পায়চারি করেছে আর ভেবেছে, পরের দিনটা কী করে চলবে। রেশনটা ওঠাবে কী করে, ভাইদের স্কুলের মাইনে দেবে কী করে। নিজের পাওয়া সোনার মেডেল বন্ধক দিয়েও টাকা এনেছে বাড়িতে। দিনের পর দিন স্টুডিয়োয় গিয়ে বিনা পয়সায় পাওয়া খাবার খেয়েছে। যাতে বাড়ির খাবার একটু হলেও বাঁচে।

তার মধ্যেও কত কী করেছে! শুধুমাত্র সিনেমা-থিয়েটার করার কথা বলছি না, ওর মতো উপুড়-হস্ত লোক আমি সত্যিই কম দেখেছি। টাকাপয়সা দিয়ে কত লোকের যে অসহায় মুহূর্ত সামাল দিয়েছে! সে শুধু নিকটজনের নয়, একেবারে অনাত্মীয়, অপরিচিত তা’ও।

আর একটা মস্ত গুণ ছিল, ওর ডান হাত কী করছে, বাঁ হাত টের পেত না। ওর কত যে দানধ্যানের কথা আমিই জানতে পেরেছি ও চলে যাওয়ার পর, বলে শেষ করতে পারব না।

অনুপবাবু মারা যাওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক পরের কথা। দেখি, আমাদের সল্টলেকের বাড়িতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, একটি অল্পবয়েসি মেয়েকে নিয়ে রিকশা করে এলেন।

কোথা থেকে আসছেন? শুনলাম, মুর্শিদাবাদ থেকেও দূরে। সমুদ্রগড় থেকে।

বললেন, “দিদিভাই, বাবা (অনুপবাবু) ও দিকে যাত্রা করতে গেছিলেন। আমার তখন মেয়ের বিয়ে। পয়সাকড়ির জন্য খুব মুশকিলে পড়েছিলাম। অনেক কষ্টে ওর কাছে গিয়ে বলতে উনি সাহায্য করেছিলেন। আজ শুনলাম, বাবার কাজ, বাড়ি কোথায় জানতাম না। তবু খুঁজে পেতে এসেছি। ওঁর ছবিতে একটা মালা অন্তত দিই।”

শ্রাদ্ধশান্তি ওর কিছু হয়নি। সে ও বিশ্বাস করত না, তাই। কিন্তু ওই ভদ্রলোক আর তাঁর মেয়ের কথাটা ভাবলে আমার আজও চোখ ফেটে জল এসে যায়।

এখানে একটা কথা না বললেই নয়। অনুপবাবু চলে যাওয়ার পর ওর দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী একটি অদ্ভুত অভিযোগ আনেন। কেন ওঁর মরদেহ স্টুডিয়োতে নিয়ে যাওয়া হয়নি, তা নিয়ে তখন জলঘোলা শুরু হয়।

ওঁদের বক্তব্য ছিল, যদি এ ব্যাপারে অনুপবাবুর কোনও ‘ইচ্ছাপত্র’ থেকে থাকে, তা হলে আলাদা কথা। কিন্তু তা যদি না থাকে, ব্যাপারটা নাকি খুব খারাপ করেছে পরিবারের লোকজন।

না, কোনও ইচ্ছাপত্র ওর ছিল না। কিন্তু বিকাশদা (রায়) মারা যাওয়ার পর ও টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে গিয়ে হাতজোড় করে বলে, “আজ দয়া করে কাজ বন্ধ রাখুন।” কেউ শোনেনি। ও খুব আহত হয়েছিল তাতে। বাড়ি ফিরে বলছিল, “আমি মারা গেলে তোমরা কিছুতেই কোনও স্টুডিয়োতে আমার দেহ নিয়ে যাবে না।”

কাননদি (দেবী) যখন মারা যান, তখন গুটিকয়েক লোক ওঁকে দেখতে যান। এ ঘটনাও ওকে কষ্ট দেয়। স্মরণসভায় দাঁড়িয়ে তাই বলে, “ভুলে যাবেন না, এই দিনটা প্রত্যেকের জীবনে আসবে।” সে দিনও বাড়ি ফিরে ওর মুখে ছিল একই কথা। ওর মারা যাওয়ার পর আমরা শুধু ওর সেই কথাকে সম্মান জানিয়ে ছিলাম।

ওর আরেকটা ব্যাপার ছিল, লোককে কথা দিলে হাজার কষ্ট হলেও সে কথা রাখত।

একটা ঘটনা বলি। ভদ্রকালীতে ছিল গীতাদিদের (সেন) বাপের বাড়ি। অনুপবাবুদের মামার বাড়ি। ওর অনেক বন্ধুবান্ধব ওখানে থাকত। অনুপবাবু ঠিক করল, ওদের নিয়ে একটা নাটকের দল করবে।

তখন কলকাতায় একটা নাট্যপ্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল। নাম ‘নাট্যচক্র’। সেখানে গীতাদি তো ছিলই, অন্য যাঁরা ছিলেন তাঁদের কয়েকজন হলেন সুধী প্রধান, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, মৃণাল সেন, শোভা সেন, এঁরা। অনুপবাবু নিজের দলের নাম দিয়েছিল ‘ভদ্রকালী নাট্যচক্র’। ওই দলেও যোগ দিয়েছিলেন মৃণালদা, তাপসদাদের কেউ কেউ।

নাটক-সিনেমার কাজ শেষ হলে অনুপবাবু চলে যেত ভদ্রকালী। রিহার্সাল দিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত। তখন দলের কোনও ছেলে ওকে সাইকেলে করে ডানলপ ব্রিজ পর্যন্ত দিয়ে যেত। সেখান থেকে বাস পেল তো ভাল, নইলে সোজা হাঁটতে হাঁটতে বেলগাছিয়ার বাড়ি।

একদিন রিহার্সাল দিতে দিতে রাত দুটো বেজে গেল। মৃণালদা, তাপসদা ওখানেই থেকে গেল। ও থাকল না। পরের দিন আউটডোর। সকাল ছ’টায় গাড়ি আসবে বলা আছে যে!


ইডেনে প্রদর্শনী ম্যাচে দিলীপকুমার, সায়রাবানু, চিন্ময় রায়ের পাশে অনুপকুমার

সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তখন মাঝরাত পেরিয়েছে। বালি ব্রিজ থেকে ডানলপ রাস্তাটা ছিল খুব খারাপ। ধু ধু ফাঁকা। প্রায়ই ডাকাতি হত। রাত দশটার পর ও দিকে কেউ যেতে ভরসা পেত না। কিন্তু ওর যে কথা দেওয়া আছে। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে!

এমন নাটক-সিনেমা অন্ত প্রাণ মানুষটা কিন্তু যখন পাকাপাকি ভাবে এ লাইনে আসছে, ওর মা খুব কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, “সারা জীবন তোর বাবাকে নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরলাম, এ বার তুইও আমায় জ্বালাবি?”

আসলে অনুপবাবুর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দাস মস্ত বড় গাইয়ে তো ছিলেনই, অভিনয়ও করতেন। বন্ধুবান্ধব নিয়ে খুব আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডায় ইন্দুবালা-আঙুরবালাও থাকতেন।

এই গাইয়ে-বাজিয়েরা এক জায়গায় হলে যা হয় আরকী! এদের ওঠাবসা তো আর সাধারণ মানুষের মতো নয়। খুব মদ্যপানও করতেন ধীরেন দাস। শুনেছি এতই খেয়ালি ছিলেন, ছেলেমেয়ের নামও ভুলে যেতেন।

তো, এমন একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করা তো সোজা কথা নয়। তাই অনুপবাবু যখন থিয়েটার-সিনেমায় নামছেন, খুব ভয় পেয়েছিলেন মা।

অনুপবাবু মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, “মা তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, আমি জীবনে কোনও দিন মদ খাব না। আর মহিলাসংক্রান্ত ব্যাপারে কোনও দিন জড়াব না।”

পরে আমার সঙ্গে যখন ওর বিয়ে হল, মজা করে বলত, “বাবাহ্, কত ঘাট থেকে বেঁচে ফিরেছি, শেষে তোর কাছে গিয়ে যে মাথা মুড়োব কে জানত!”

আসলে ও এমন একটা স্বভাবের মানুষ ছিল, বহু জনেই ওর প্রেমে পড়েছে। তাঁদের মধ্যে এক-আধজন এখন দিব্যি ঘর-সংসার করছেন। নামধাম বলা উচিত হবে না। এটুকু বলি, ওর প্রেমে পড়ে একজন এতই পাগল-পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, যে ওকে না পেয়ে শেষমেশ নাকি আত্মহত্যা করবেন বলে ঠিক করেন। ছাপ্পান্ন বছর বয়সে ও যখন আমায় বিয়ে করে আমার তখন ছত্রিশ।

’৭২ সাল থেকে আমাদের আলাপ। চোদ্দো বছর মেলামেশার পর আমিই ওকে বিয়ের কথা বলি। ছোট থেকে ওর মতো আমিও খুব কষ্ট করে বড় হয়েছি। সংসারের ভার নিয়েছি। ওই একটা জায়গার মিল আমাদের দু’জনকে বোধহয় একটু বেশিই কাছে এনে দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কথা বলতে ও বলল, “আগে বাড়িতে কথা বলি।” আসলে মানুষটার কাছে বাড়ি-মা-ভাই-বোন যে কতটা জুড়ে ছিল, বলার নয়।

ধীরেন দাস এমনিতে যতই আপনভোলা হন, ছেলের জীবনের মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজটা কিন্তু ওঁর সূত্রেই হয়েছিল। ছেলের কর্মকাণ্ড ছোট থেকে দেখে নিশ্চয়ই ধীরেন দাসের ধারণা হয়, এ ছেলের অভিনয়টা হবে। যে জন্য তখন থেকে এ ব্যাপারে ওঁর যেমন কমবেশি নজরদারি ছিল, তেমন বোধহয় প্রশ্রয়ও ছিল।

নাট্টাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী, ধীরেন দাস মারফতই অনুপবাবুকে তাঁর কাছে ডেকে পাঠান। ও তখন সম্ভবত স্টার থিয়েটারে নাটক করত। এ দিকে নাট্টাচার্য তাঁর দল শ্রীরঙ্গম-এ ‘ঘরে বাইরে’ নাটক করবেন, ঠিক করলেন। তার জন্য তাঁর শিশু অভিনেতা দরকার। ওঁর দুই ভাই হৃষীকেশ আর ভবানী ভাদুড়ী অনুপবাবুকে মঞ্চে দেখে নাট্টাচার্যের কাছে ওর নাম সুপারিশ করেন। তার পরই ধীরেন দাস মারফত ওকে তলব করেন তিনি।

শিশির ভাদুড়ী ওকে যে কী স্নেহ করতেন, ভাবা যায় না! একবারের কথা অনুপবাবু খুব বলত।

তখন শ্রীরঙ্গম-এর অবস্থা তেমন ভাল নয়। অনুপবাবুও সেখানে তেমন অভিনয়ও পাচ্ছে না। টাকাপয়সা তো কালেভদ্রে জুটছে। তা’ও দশ-বারো টাকার বেশি নয়। এ দিকে সংসার চালাতে তো টাকা লাগছে জলের মতো।

তখন মিনার্ভায় ‘ক্ষত্রবীর’ নাটক হবে। তাতে তরণীসেন-এর চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী ওকে মনোনীত করেন। মাস গেলে আড়াইশো টাকা। সঙ্গে ফ্লাইং পোস্টারে প্রচুর প্রচার।

পুত্রবৎজ্ঞান করা অনুপকে শিশিরকুমার জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তুই আমায় ছেড়ে যাসনি। জানি তোকে ভাল পার্ট দিতে পারছি না। তবু তুই থাক। তুই অনেক বড় হবি।” শুধু এই কথায় অনুপবাবু ভেতর থেকে টলে গিয়েছিল।

ঘটনাটা বলতে গিয়ে বলত, “আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। গ্রিনরুমে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। কিন্তু সে কান্নার যে কী তৃপ্তি!”

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নাট্টাচার্যকে অনুপবাবু ভগবানের জায়গায় বসিয়ে রেখেছিল। হাতে ধরে অভিনয় শেখানো যাকে বলে, অনুপবাবুকে শিশির ভাদুড়ী তাই-ই শিখিয়েছেন।

আজকে কত জনকে দেখি, শিশির ভাদুড়ীর ছাত্র বলে দাবি করে কত কথা বলে বেড়ান। গুরুশিষ্যর এই সম্পর্কটা নিয়ে অনুপবাবু কত যে ভাঙিয়ে খেতে পারত, ইয়ত্তা নেই।

অথচ এক মুহূর্তের জন্য অমন করতে দেখিনি ওকে। ‘ভগবান’-এর সঙ্গে সম্পর্ক তো ভাঙিয়ে খাবার নয়, হয়তো তাই!

তার ওপর উনি যে অনুপকুমার, অদ্ভুত রকমের এক নিঃশব্দচারী মানুষ। বললাম না, ওর ডান হাত কী করত, বাঁ হাত টের পেত না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

memorial memory anup kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE