Advertisement
০২ মে ২০২৪
স্মরণ.....

ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে

তাঁর শেষ গানের কলিটি ছিল এমনই। আজও রহস্য ঘোরতর সংসারী হয়েও নিজেকে কেন শেষ করে দিয়েছিলেন তিনি? পান্নালাল ভট্টাচার্য। বলছেন তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের পুত্র সঙ্গীতশিল্পী দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। শুনলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।৬৬ সাল। পুজোর গান। বাবার সুর করা, কাকা রেকর্ড করলেন, ‘অপার সংসার, নাহি পারাপার’। বাড়ি ফিরলে মা বলল, “কী রে, কেমন হল রে পানু?” ঠোঁট বেঁকিয়ে কাকা বলল, “ওই হল আর কী।” তারপরই আমার মাকে তলব, “চারটে ফিশ ফ্রাই আনাও তো।” বলেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

৬৬ সাল। পুজোর গান। বাবার সুর করা, কাকা রেকর্ড করলেন, ‘অপার সংসার, নাহি পারাপার’।

বাড়ি ফিরলে মা বলল, “কী রে, কেমন হল রে পানু?”

ঠোঁট বেঁকিয়ে কাকা বলল, “ওই হল আর কী।”

তারপরই আমার মাকে তলব, “চারটে ফিশ ফ্রাই আনাও তো।” বলেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বসন্ত কেবিনের ফিশ ফ্রাই, কাটলেট ছাড়া ওর যে চলত না, সে আমরা বিলক্ষণ জানতাম। তাও এক সঙ্গে কম করে চার পিস। তখনই অর্ডার গেল।

এ দিকে কাকার ভাবগতিকে কিচ্ছুটি না বুঝে মা বাবাকে বলল, “পানু কেমন গাইল গো?”

উত্তরে বাবা বলেছিল, “বাঁদরটার কাছে যা চেয়েছিলাম, তার ষাট ভাগ পেলাম।”

এখনও যখন গানটা শুনি, ভাবি, ওই যদি ষাট হয়, তবে একশোটা কী হতে পারত!


ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য

সেই সঙ্গে কাকার জবাবটা আজও কানে বাজে। ঘরে ঢুকে কাকা বলেছিল, “শোনো মেজদা, তুমি যেটা চেয়েছিলে, সেটা যদি পেতে, তা হলে আমি হতাম ধনঞ্জয়, তুমি হতে পান্না।”

দেখনদারি কথা নয়, মেজদাকে এতটাই শ্রদ্ধা করত তার ভাই পানু।

এমন অনেক বার হয়েছে, কোনও অনুষ্ঠানে গিয়েছে কাকা। সেখানে বাবারও গাইবার কথা। পৌঁছেই জিজ্ঞেস করে নিত, “মেজদা এসেছে?”

যদি শুনত আসেনি, বলত, “তা হলে শিগ্গির আমাকে গাইতে দাও। ওর পরে আমি গাইতে পারব না, ও সামনে থাকলেও না।”

যে সময়ের কথা বলছি, তখন কিন্তু পান্নালাল ‘পান্নালাল’ হয়ে গিয়েছে। শ্যামাসঙ্গীত বললে প্রথমেই তার নাম আসে। তবু মেজদা বলতে, সে ছিল অজ্ঞান।

শুধু শ্রদ্ধা-ভক্তি নয়, বাবার সবটুকু যেন হুবহু নকল করত কাকা। গান গাওয়া তো বটেই, হাঁটাচলা, কথা বলা, এমনকী হাতের লেখা পর্যন্ত। বা ধুতির কোঁচাটা যেমন করে হাতে নিত বাবা, সেটাও। মেজাজটাও ছিল তার মেজদার মতো। বদরাগী।

এই নকল করতে গিয়ে কাকা জীবনে অন্তত একবার বাবার হাতে থাপ্পড়ও খেয়েছে।

সে ঘটনা বলি। তত দিনে বাবা কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছে। পাশের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, লেডিস সিট, নববিধান...। নববিধান-এ আবার স্বয়ং কাননদেবী বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর ভাইয়ের রোলটা বাবা যেন করে দেয়!

এ সব দেখে শুনে কাকারও বোধহয় সাধ হয়েছিল ছবিতে নামার। তখন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির কাস্টিং পর্ব চলছে। ’৫১ কি ’৫২ সালের কথা। কাকার তখন কতই বা বয়েস, বড় জোর একুশ-বাইশ। ছবিতে তার তিন প্রাণের বন্ধু অভিনয় করবে। সন্তু কাকা (সনৎ সিংহ), মানব কাকা (মানবেন্দ্র মুখোপাধায়), শ্যামল কাকা (শ্যামল মিত্র)। ওরাই বোধহয় তাতিয়ে ছিল কাকাকে।

কাকা তো এক কথায় রাজি। শুধু বাড়ির অনুমতি জুটলেই হয়। জেঠুকে জিজ্ঞেস করল। ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করল।

ঠাকুমা সটান বলে দিল, “আমি বলতে পারব না। তুই ধনাকে বলে দেখ। ও যদি রাজি হয়, তবে করবি।”

স্ত্রী ও বড় মেয়ের সঙ্গে

কাকা এ বার বাবার কাছে গিয়ে পড়ল। বাবা এক কথায় ‘না’ করে দিল। তার পরও ভাইয়ের ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ হচ্ছে না দেখে, এক চড়। জীবনে ওই এক বারই।

সক্কলের ছোট ভাইকে তার বড়দা প্রফুল্ল আর মেজদা ধনঞ্জয় যেমন প্রায় পিতার মতো স্নেহ দিয়েছে, তেমন শাসনও করেছে। এগারো ভাই-বোনের কনিষ্ঠতম পানু যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে, তখনই তার বাবা সুরেন্দ্রনাথ মারা যান যে!

বাবাই তাকে হাতে ধরে এইচএমভি-তে নিয়ে যায়। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখতে পাঠায়। বাবারই সুপারিশে আমাদের জেঠা প্রফুল্ল, কাকাকে মেগাফোনে জেএন ঘোষের কাছে নিয়ে যায়। বাবারই বুদ্ধিতে কাকা ভক্তিগীতি গাইতে গিয়ে আসর মাত করে দেয়।

বাবা বুঝেছিল পঞ্চাশের দশকের পর কে মল্লিক, ভবানী দাস কী মৃণাল কান্তি ঘোষের পর ভক্তিগীতিতে একটা ভাটা এসেছে। সেখানেই তার ভাই পানু যশ কুড়োতে পারবে। আর তাই নিজে পরের পর ছবিতে অসংখ্য হিট গান গাওয়ার পর, হাজার অনুরোধ-উপরোধেও ভক্তিগীতি গাইতে চাইতেন না। “ওটা পানুর জায়গা। আমার নয়।” যা কিছু ভক্তিগীতি গেয়েছে, সব কাকা চলে যাওয়ার পরে। বেসিক গান গেয়েছে ’৮১ সালে।

আবার এমন কথাও বাবার মুখে শুনেছি, “পানুকে আমি জীবনে একবার অন্তত ঈর্ষা করেছি।”

সে বার বিখাত গায়ক কে মল্লিকের গ্রামে অনুষ্ঠান। তখন প্রায় সব জলসারই উদ্যোক্তা ছিল বাবা। সবাই জানত, একবার ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য অবধি যেতে পারলেই হল। অনেককে পাওয়া যাবে। তখনকার দিনে প্রায় সব নামকরা শিল্পী এ ভাবেই জড়ো হয়ে চলেছেন বাসে করে। কে মল্লিকের গ্রামে।

মেন রাস্তা থেকে মোরাম পথ ধরে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। একে একে সবাই বাস থেকে নেমে চলেছেন হাঁটতে হাঁটতে। মধ্যমণি বাবা। ছেলেরা একেবারে ঘিরে ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উদয় হলেন। ধবধবে সাদা চুল। দাড়ি। কে মল্লিক। দল বেঁধে চলা শিল্পদের মধ্যে কেবলই উঁকিঝুঁকি মারছেন তিনি। কাউকে যেন খুঁজছেন।

সবাই ওঁকে বাবাকে দেখিয়ে বলছেন, “এই তো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, এই দিকে দেখুন।”


গায়ক-সাধক পান্নালাল। অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

তাতে দু’পাশে ঘাড় নেড়ে আবার সেই উঁকিঝুঁকি বৃদ্ধর। আর ধীরে ধীরে বলছেন, “সে আসেনি? সে আসেনি?”

তার পর বার দু’য়েক পান্নালালের নাম করতেই লোকজন দেখিয়ে দিল, “এই যে পান্নালাল, এই তো।” এ বার বিখ্যাত প্রবীণ ভক্তিগীতি শিল্পী কে মল্লিককে দেখতে হয়। দু’হাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন কাকাকে। তারপর অঝোরে কান্না। শিশুর মতো। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চললেন, “তুই এ ভাবে কী করে গাস, বলতো? কী করে গাস?” আসলে এর আগে কে মল্লিক ‘সাধ না মিটিল’ গানটা গেয়েছিলেন, কিন্তু কাকার রেকর্ড শুনে উনি কেমন পাগল হয়ে যান।

ঘটনাটা বলতে গিয়ে বাবা বলেছিল, “সঙ্গীত জগতে আমি তখন উল্কা। আমাকে একটু ছোঁওয়ার জন্যও লোকে পাগল। সেই আমাকে উনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আমারই সামনে পানুকে নিয়ে যা করলেন, আমার সত্যিই সেদিন হিংসে হয়েছিল। বাকি সারাটা জীবন আমি গর্বিত, পান্নালালের দাদা হতে পেরেছি বলে।”

আরেক প্রখ্যাত শিল্পী দিলীপ রায়ের কথা বলি। গানের জগতে ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত সৎ একজন স্পষ্ট কথার মানুষ। কাকার নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত বা রজনীকান্তের গানগুলো ওঁরই প্রশিক্ষণে গাওয়া। উনি বলতেন, “আমি বহু শিল্পীর সঙ্গে মেলামেশা করেছি। কিন্তু ওই দুই ভাইয়ের ধারে কাছে কাউকে রাখতে পারি না। ধনঞ্জয় আর পান্নালাল।”

তাতে কেউ এক বার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “আর যদি একজনের কথা বলতে হয়?” খানিক চুপ থেকে নাকি দিলীপ রায় বলেন, “অবশ্যই পান্নালাল।”

এই মাপের একজন ভক্তিগীতি শিল্পী কিন্তু একটা সময়ে শুধুই ভক্তিগীতি গাইতে হচ্ছে বলে, ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

খুব চাইতেন আধুনিক গাইতে। যে জন্য সুধীরলাল চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে বেশ কিছু আধুনিক গান রেকর্ড করেছে। সেখানেও প্রায় সমান খ্যাতি। মুশকিলটা হল কী, যশখ্যাতি বেড়ে গেলে তো ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’র অভাব হয় না। তাদেরই কয়েকজন কান ভাঙিয়েছিল কাকার।

তারা বুঝিয়েছিল, “তোর মেজদা কখনই চায় না তুই ওকে আধুনিক গানে টপকে যাস।”

কী জানি কেন, তাদের এই কুমন্ত্র কাজও করেছিল। কাকা আমাদের বাড়ি আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু বিজয়ার সময় এসে প্রণামটা করে যেত। বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ। ফোন করে আমাদের কাছে শুধু খোঁজ নিত। ব্যস্। প্রায় দু-তিন বছর এমন চলে ছিল। তারপর কাকার অবশ্য ভুল ভাঙে।

এখানে একটা কথা না বললেই নয়, মাকেও কিন্তু অসম্ভব ভালবাসত ভক্তি করত কাকা। বলত, “তুমি আমার বৌদি নয়, আমার মা।”

এই বলাটা বোধহয় শুরু হয় একটা ঘটনার পর থেকে। আমাদের বালির বাড়ি বারেন্দ্র পাড়ায়। সেখানে একটা বিশাল ফুটবল মাঠ ছিল। যেখানে চুনী গোস্বামীও বহু বার অফিস লিগ খেলেছেন।

ফুটবল বলতে কাকা ছিল অজ্ঞান। পাঁড় মোহনবাগান ভক্ত। বাবার মতো হয়তো নয়। কিন্তু প্রায় কাছাকাছি। মোহনবাগান হারলে বাড়ি ফিরে বাবা দুটো অ্যানাসিন আর এক গেলাস চা খেয়ে যখন বিছানা নিত, তখন তাকে ডাকে কার সাধ্য! মোহনবাগান হারলে অনুষ্ঠানে গাইতে যাওয়াও বাতিল করে দিত।

খেলার দিন অনুষ্ঠান থাকলে, উদ্যোক্তারা পুজো দিত, আর ঠাকুরকে ডাকত, এক গোলে হলেও যেন মোহনবাগান জেতে। বাবার মতো এতটা না হলেও মোহনবাগান বলতে কাকাও ছিল অজ্ঞান। আবার একটুআধটু রাগও ছিল ক্লাবের ওপর। যেহেতু অনেক বলার পরও মান্নাদা (শৈলেন মান্না) মেম্বরশিপ দেননি। কাকা কমপ্লিমেন্টরিতে অথবা বাবার কার্ডে নিয়ম করে খেলা দেখত। ফুটবলার বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল কাকার ছেলেবেলার বন্ধু।

বারেন্দ্র পাড়ার মাঠে খেলতে গিয়ে এক বার কাকা দুর্ঘটনায় পড়ে। সজোরে বল এসে লাগে কাকার চোখে। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসায় কোনও ফল না দেওয়ায় বাবার কাছে ফোন আসে। আমরা তখন কলেজ স্ট্রিটে সিসিলি হোটেলের বাড়িতে থাকি। বাবা কাকাকে সোজা কলকাতায় নিয়ে আনতে বলে। দেড় মাস থাকতে হয় মেডিক্যাল কলেজে।

ডাক্তাররা প্রথমে ভেবেছিলেন, দুটো চোখই চলে যাবে। কিন্তু পরে দৃষ্টিশক্তি বেঁচে যায় বটে, কিন্তু এক চোখের মণিটা একটু সরে যায়। এই সময় মা অসম্ভব সেবা করেছিল কাকাকে। ঠাকুমার পক্ষে তো বালি থেকে রোজ আসা সম্ভব ছিল না, মা-ই যা করার করত। সেই থেকেই বোধহয় মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল খুব নিবিড়।

ফুটবল তো খেলতই। ঘুড়ির জন্য ছিল পাগল। সরস্বতী পুজোয় বালি-উত্তরপাড়া এ সব অঞ্চলে ঘুড়ি ওড়ানো হত। এখনও তাই হয়। প্রতি বছর ওই দিন অন্তত ঘুড়ি ওড়াবেই কাকা। যে করে হোক। অনেক বড় বয়স অবধি। একবার তো তা নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড।

কাকার তখন রীতিমতো সাড়াজাগানো নামডাক। প্রচুর জলসার অগ্রিম নেওয়া। বাবা তো বাড়িতে জনে জনে বলে রেখেছে, “পানু এলে এক পয়সা হাতে দেবে না। তাহলেই ঘুড়ি ওড়াবে। গলার বারোটা বেজে যাবে।”

বলা বাহুল্য, সে সময় রোজগার করলেও কাকার সব টাকা ঠাকুমার কাছে রাখা থাকত। তক্কে তক্কে ছিল কাকা। বাবা বেরিয়ে গেলেই বাড়ি মাথায় করে তুলল। “কুড়িটা টাকা দিতেই হবে।” ঠাকুমা তো সোজা হাত তুলে দিল। শেষে এমন কাণ্ড বাধালো টাকা না দিয়ে মা পার পায়নি।

অসম্ভব মাছ ধরার নেশা ছিল কাকার। সে অবশ্য দুই ভাই-ই তাই। বাবার আবার মাছ ধরার ভাল সঙ্গী ছিল শচীন দেববর্মন, সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়।

কত লোক যে বাবা-কাকার এই নেশার সুযোগ নিয়ে ওদের ঠকিয়েছে, ইয়ত্তা নেই।

কেউ হয়তো বলল, আমাদের বাড়ি চলুন। বিশাল পুকুর। কম করে আট-ন কেজির মাছ পাবেন। অথচ গিয়ে দেখা গেল, পুকুর কই, ডোবাও বলা যায় না। এক চিলতে খাল। গোরু পেরিয়ে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে।

আসলে এই সব লোকজনের মতলবটা থাকত অন্য। ধনঞ্জয়-পান্নালালকে বাড়িতে ডেকে এলাকায় একটু নিজেদের জাহির করা। তারপর সন্ধে হলে হারমোনিয়ামটা এগিয়ে দিয়ে গান গাওয়ানো। মাছ ধরানোর গল্পটা থাকত পুরো বানানো।

তবে বাবা-কাকা কী যে মাছ ধরার পাগল ছিল, একটা ঘটনা বললে বুঝবেন।

দমদমের বি কে পালের বাগান বাড়ি। বাবা লোকজন নিয়ে পুকুর পারে মাছ ধরতে বসেছে। ছিপে মাছও উঠল। বেশ তাগড়াই। অনেক খেলিয়ে খেলিয়ে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না কেউ। দোতলার ছাদে বসে কাকা সব লক্ষ করছিল। ব্যাপারটা সুবিধের নয় দেখে, দোতলা থেকেই এক ঝাঁপ পুকুরে। পেল্লাই মাছটাকে জাপটে ধরে ঘাটে তুলে তবে ছাড়ল।

এক দিকে পুরোমাত্রায় বাউণ্ডুলে, খেয়ালি, আবেগপ্রবণ, অন্য দিকে প্রচণ্ড বন্ধুবৎসল।

এক বারের কথা মনে পড়ে। এইচএমভি-তে পুজোয় কাকার গানের রেকর্ডিং চলছে। রেকর্ডিং শেষে বেরিয়ে দেখে মানবকাকা দাঁড়িয়ে।

বলল, “তুই?” মানবকাকা বলল, “তুই গাইছিস জেনে বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম।”

শুনে কাকা বলল, “আজ তোরও রেকডির্ং? তবে দাঁড়া।” বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে ঠাকুরের ফুল মোড়া একটা কাগজ বের করে বলল, “এটা পকেটে নিয়ে গাইবি।”

বছরটা যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৫৮। কাকার পুজোর গান, ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে’ আর ‘চাই না মাগো রাজা হতে’। আর মানব কাকার? ‘আমি এত যে তোমায় ভাল বেসেছি’। মানবেন্দ্র নামটা উচ্চারণ করলে যে গানের কলি ভেসে ওঠে। এত বাম্পার হিট গান মানবকাকার হয়েছে কি না জানি না! মায়ের ফুল নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বাদ দিন, একই পেশায় থাকা বন্ধুর জন্য এই শুভকামনা, কতটা হৃদ্যতা থাকলে দেখানো সম্ভব? এ সব বোধ হয় ওদের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে।

উদাসী হোক, ভাবপ্রবণ হোক, সব কিছুর পরেও প্রচণ্ড সংসারী ছিল আমার কাকা। মেয়েদের চুল পর্যন্ত বেঁধে দিত। পছন্দ করে ওদের জামাকাপড় কিনত। কাকিমার জন্য শাড়ি। আর রান্নার হাত ছিল অপূর্ব। কালীপুজো এলে খুব বাজি বানাত। তুবড়ি, রংমশাল।

সেই মানুষ কেন যে ছত্রিশ বছর বয়সে নিজেকে শেষ করে আচমকা চলে গেল! ইহলোকের সব মায়া কাটিয়ে এ ভাবে ওর চলে যাওয়াটা আজও রহস্য! আজও স্পষ্ট বুঝি না, কী ভুল করেছিলাম আমরা, কী পাপ করেছিল ওর কাছের জন, যাতে এ ভাবে চল যেতে হয়।

তবে এ নিয়ে আজও যারা আমার কাকিমার দিকে আঙুল তোলে, তাদের চেয়ে ইতর, নরাধম এ পৃথিবীতে আর নেই। চৌত্রিশ বছরের অসম্ভব রূপবতী, ভরা যৌবন নিয়ে আমার পতিহারা কাকিমা যদি সে দিন বিপথে চলে যেতেন, কেউ আটকাতে পারত!

বদলে কী করলেন? তিন শিশু কন্যাকে আগলে বড় করে তুললেন। শর্বরী তখন দু’বছর, কাকলি সাড়ে চার-পাঁচ। কাজরী সাতের মধ্যে। বছর চারেক হল কাকিমা চলে গেছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে গুঞ্জন আজও থামেনি। আশ্চর্য! শর্বরী-কাকলি এখন মুম্বইতে। গানবাজনা নিয়েই আছে। কাজরী পুরোপুরি ঘরনি।

শেষ দিকে প্রায়ই শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতেন কাকা। কখনও কেওড়াতলা, কখনও সিরিটি, কখনওবা আমাদের বারেন্দ্র পাড়ার শ্মশান ঘাটে। বসে থাকত, আর কাঁদত। বিড়বিড় করে বলত, “আমি তো চিরকাল ঈশ্বরের গান গেয়ে বেড়ালাম। আমার ঈশ্বর দর্শন হবে না কেন? কেন আমায় দেখা দিবি না মাগো?” বাবার জীবনে বহু বার অলৌকিক কিছু ঘটেছে, যা ব্যাখ্যার অতীত। কাকার জীবনে কেন তেমন হল না, এ ছিল তার অসীম বেদনা, অনর্গল আকুতি।

শুধু একবারের কথা বলি। সুপ্রীতি ঘোষের কাছে শোনা। কাকা প্রোগ্রাম করে ফিরছেন। সঙ্গে মানবকাকা, তরুণ কাকা (বন্দ্যোপাধ্যায়) আছেন। নির্মলা পিসি (মিশ্র), বোধ হয় ইলা বসুও আছেন। সুপ্রীতি ঘোষ বলেছিলেন, পান্নালাল থাকা মানে সব সময় হইহই ব্যাপার। খুব মজা করত ও। সে বারও তাই। রাত্তিরে থাকতে হয়েছে। পরদিন ফেরা। ট্রেনে করে বালি নামার একটু আগে হঠাৎ কাকা চুপ। গুম মেরে বসে আছে। মুখচোখ লাল। কোনও কথাই বলছে না।

সবাই তরুণকাকাকে এগিয়ে দিল। “কী হয়েছে রে পান্না? হঠাৎ গুম মেরে গেলি? কোনও কথা নেই!” তখন কাকা থমথমে মুখে বলল, “মাকে কেন তুঁতে রঙের বেনারসিটা পরালো?” তরুণকাকা শুনে হেসে উঠলেন। ঠাট্টাও করলেন। বললেন, “তুই আছিস ট্রেনে। আর এখান থেকেই কি না বুঝে ফেললি এ সব?”

শুনে কাকা কেমন ছটফট করে উঠল। বলল, “শোনো, তোমাদের যদি মিথ্যে মনে হয়, এখনই সবাই নামো। চলো দক্ষিণেশ্বর। আমি সবার বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া দেব।” তাই করেছিল সবাই। আর গিয়ে দেখেছিল, সত্যিই তাই। ভবতারিণীকে তুঁতে রঙের বেনারসিই পরানো হয়েছে!

একটা সময় জাগতিক সব মায়ার টান ছিঁড়ে ফেলেছিল কাকা। শেষ দিকের গানগুলোও যেন কিছুটা তার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। রেডিয়োতে কাকার শেষ গানের কলিটুকু একবার দেখুন। “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে”। এত দরদি একটা গানে কোথায় যেন চলে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার সুর ঘোরেফেরে। ঠিক তেমন দুটো শ্যামাসঙ্গীত। “এ কেমন করুণা কালী বোঝা গেল না/দুর্গা দুর্গা বলি যত দুঃখ আমার ঘোচে নাতো”, কিংবা “বিপদে পড়েছি শ্যামা/শ্রী পদে তাই ঠাঁই চেয়েছি।” এক রকমের হাহাকার, যন্ত্রণাকাতর এক আর্তি যেন প্রত্যেকটি শব্দের অন্তরে গুমরে বেড়াচ্ছে।

এ গানগুলো যখন প্রথমবারের মতো রেডিয়োতে বাজছে, তখন কাকা আর এ পৃথিবীতে নেই। পড়ে আছে শুধু ওর সাধের সংসার। বিধ্বংসী ঝড়ের তাণ্ডব শেষে খাঁ খাঁ প্রান্তরে ছিন্নমূল বৃক্ষের চেহারা যেমন হয়, ঠিক তেমন করে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE