Advertisement
১১ মে ২০২৪

জোরালো প্রতিবাদী নাটক

ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। লিখছেন মনসিজ মজুমদার।লোককৃষ্টির সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘সিস্টেম’ (রচনা: উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়; পরি: ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়) একটি জোরালো প্রতিবাদী নাটক। প্রতিবাদের লক্ষ্য দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজব্যবস্থা। ঘরে ঘুষখোর স্বামী বা লোভী স্ত্রী, বাইরে লুম্পেনদের দৌরাত্ম্য; বিচারব্যবস্থায়, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র দুর্নীতি। উল্টো পথে হেঁটে ব্যর্থ হয় অনির্বাণ ও তার দিদি সুমিত্রা।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

লোককৃষ্টির সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘সিস্টেম’ (রচনা: উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়; পরি: ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়) একটি জোরালো প্রতিবাদী নাটক। প্রতিবাদের লক্ষ্য দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজব্যবস্থা। ঘরে ঘুষখোর স্বামী বা লোভী স্ত্রী, বাইরে লুম্পেনদের দৌরাত্ম্য; বিচারব্যবস্থায়, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র দুর্নীতি। উল্টো পথে হেঁটে ব্যর্থ হয় অনির্বাণ ও তার দিদি সুমিত্রা। অনির্বাণ সরকারি হাসপাতালের সৎ সুচিকিৎসক, স্বল্প ফি নিয়ে চিকিৎসা বা অপারেশন করেন। তাঁর ঘোর শত্রু ডাক্তার পাল। চড়া ফি নিয়ে, রোগীকে দামি ওষুধ খাইয়ে ও অকারণ ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। তারই চক্রান্তে অনির্বাণ একটি রোগীর মৃত্যুর জন্যে দায়ী সাব্যস্ত হন। ব্যাপক দুর্নীতির পাকেচক্রে শিকার হলেন নির্দোষ অনির্বাণ।

মূলত এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে নাটক গড়ে উঠেছে নানা ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে। বিরতি পর্যন্ত সুলিখিত নির্মেদ স্ক্রিপ্ট, নিরঙ্কুশ গতিময় সুসংবদ্ধ উপস্থাপনা ও নানা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এই প্রযোজনার সাফল্য প্রশ্নাতীত। বিরতির পরের অংশ নাটকের চেয়ে বক্তব্যের তাগিদে অতি-সংযোজন।

যে হত্যা রহস্য নিয়ে নাটকের সূচনা তার কোন প্রত্যয়যোগ্য সমাধান ঘটে না, কেবল প্রতিবাদের ইচ্ছাপূরণ ঘটে এক অতিনাটকীয় ঘটনায় যখন নিহত কিশোর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে বিচারককে, যেন এই সিস্টেমকেই সে আঘাত হানে।

সামগ্রিক বক্তব্য সামাজিক হলেও নাটকের সাব-টেক্সটে আছে কোন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমালোচনা ও সমর্থন, যার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনা দুটি চরিত্রে – শোভনের গোরা ও তার পিসি, রুমকি চট্টোপাধ্যায়ের সুমিত্রা। দুজনের অভিনয়েই উদ্দিষ্ট অভিঘাত সফল হয়েছে। সবচেয়ে নজরকাড়া অভিনয় অবশ্য নিখাদ সততার দেহভাষা সমেত ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের অনির্বাণ, তার পাশে যথাযথ পাল্লা দিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য (খলনায়ক)। প্রযোজনার অন্যতম সম্পদ মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়ের বিশাখা। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রফুল্ল ও রুবি গঙ্গোপাধ্যায়ের তৃপ্তি।

বাংলার মঞ্চ-গান ও শেক্সপিয়র

অ্যাকাডেমি থিয়েটারের পাঁচ দিনের উৎসবে

সম্প্রতি শেক্সপিয়ারের সাড়ে-চারশো জন্মবর্ষে অনুষ্ঠিত হল অ্যাকাডেমি থিয়েটার-এর পাঁচ দিনের উৎসব ‘বাংলার মঞ্চ-গান ও শেক্সপিয়র’। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই পরাধীন ভারতেও শেক্সপিয়র হয়ে ওঠেন বাংলার মঞ্চের প্রধান অবলম্বন। রূপে-রূপান্তরে বারবার বাংলার মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছে তাঁর রচনা। অ্যাকাডেমি থিয়েটারের প্রথম সন্ধ্যায় ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘শেক্সপিয়র’ গ্রন্থ প্রকাশ ও মঞ্চপাঠের আসর। রতনকুমার দাশের অনুবাদে ওথেলো পরিবেশনে গৌতম হালদার (ওথেলো), দ্যুতি ঘোষ হালদার (ডেসডিমোনা) এবং শান্তনু ঘোষ (ইয়াগো)। পরে সৈয়দ শামসুল হকের ভিন্নতর রূপান্তরে ম্যাকবেথ সজীব হল বাংলাদেশের নাট্য-দম্পতি ফেরদৌসী ও রামেন্দু মজুমদারের পরিবেশনায়। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় শেক্সপিয়রের মূল মঞ্চসঙ্গীতের ‘ওভাচার’। সে আবহেই মঞ্চগানের পরম্পরায় সার্বিক শেক্সপিয়র চর্চার প্রয়াস শোনা গেল দেবজিত বন্দোপাধ্যায়ের রচনা ও নির্মাণে। মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী’তে সূত্রপাত কোথাও ‘লিয়রের’ অনুষঙ্গে, কোথাও ‘হ্যামলেটের’ আবার কোথাও ‘ওথেলোর’। সেই ধারা প্রবাহিত আধুনিক কালেও। উৎপল দত্ত এমনকী বাংলাদেশের আলি জাকেবের রূপান্তরে। যা সান্ধ্য পরিসরে যত্নের সঙ্গে গড়েছেন নির্দেশক দেবজিত। রূপান্তরের গানগুলি কখনও রাগসঙ্গীতের ধারায়, কখনও লোকসংগীতে। পরিবেশনায় মাতিয়ে দিলেন দেবজিত ও ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋদ্ধির কণ্ঠে ‘যমুনার কালো জল’, ‘প্রেমের কথা আর বোলোনা’ বেশ আলোড়িত করে। দেবজিতের কণ্ঠে মঞ্চ মাতলো ‘হারে পরথেসে বন্দনা করি’ গানে। ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ অনুসৃত সংলাপ-বদ্ধ গানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সংলাপের মধ্যে দেবজিত-ঋদ্ধির গায়নে ‘পিরিতি নগরে বসতি করিব’ নাটকীয়তা তৈরি করে। সংযোজনায়, অভিনয়ে বা ভাষ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং গৌতমমোহন চক্রবর্তী। যন্ত্রানুষঙ্গে দেবাশিস সাহা, সৌম্যজ্যোতি ঘোষ, কিংশুক বসু, রণজিৎ ধর ও ঋদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।

পদাবলির হাত ধরে

সম্প্রতি যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল তিন দিনের ৩৬ তম মূকাভিনয় উৎসব। পরিচালনায় পদাবলি। উৎসবের শুরুতেই পাকিস্তানের পেশোয়ারে নিহত শিশুদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হল পদযাত্রা। পরে অনুদীপা মুখোপাধ্যায়ের স্তোত্র পাঠের পর রূপশীর্ষ ও রাজশীর্ষ দাসের মাঙ্গলিক সঙ্গীত দিয়ে মূল অনুষ্ঠানের শুরু। এর পরে বেশ কয়েকটি মূকাভিনয় অভিনীত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আর রক্ত নয়’, ‘আমাকে বাঁচতে দাও’, ‘গাছের প্রাণ আছে’ প্রভৃতি। পরিচালনায় ছিলেন যোগেশ দত্ত। অভিনয়ে ছিলেন শ্রীকান্ত বসু।

দ্বিতীয় দিনে ছিল কুমারদীপ্ত মাইতির ‘এক্সপ্রেস’। পরে যোগেশ দত্তের পরিচালনায় ‘স্মৃতি’। শিল্পী শ্রীকান্ত বসু। এ ছাড়াও ছিল প্রিয়াঙ্কুর মুখোপাধ্যায়ের ‘বুটপালিশ’, ‘চোরপুলিশ’। তৃতীয় দ়িনে ছিল ছৌনাচের কর্মশালা। পরে ছিল ‘বর্ধমান নির্বাক’ পরিচালনায় ‌আলমগীর হাবিব মণ্ডল নির্দেশিত ‘ডাইনি’ ও ‘আদিম সভ্যতা’।

তিন দিনের এই অনুষ্ঠানে প্রবীণ ও নবীন প্রতিভামানদের অনেককেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

শুধু লালন দর্শন

গানে ও অভিনয়ে। লিখছেন শিখা বসু

আজ থেকে ২৪০ বছরেরও বেশি আগে অবিভক্ত বাংলায় এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মেছিল এক শিশু, পরবর্তীতে নানা ঘটনা প্রবাহ এবং ঘাত-প্রতিঘাতে যিনি পরিচিত হলেন ফকির লালন শাহ নামে। তাঁর যৌবন কালে তৎকালীন সমাজ তাঁকে ধর্মচ্যুত ঘোষণা করে সমাজ থেকে বিতাড়িত করে। এই ঘটনার পরে লালন কিন্তু কোনও ধর্মের কাছেই আশ্রয় না খুঁজে নিজেকে মানবধর্মে দীক্ষিত করেন, দীর্ঘ জীবন জুড়ে ধর্মেরই সাধনা করে চলেন তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীতের মাধ্যমে। বাংলার লোকায়ত বাউলদের মধ্যে লালন সাঁই বা লালন ফকির অগ্রগণ্য।

দীর্ঘ আড়াই শতক পেরিয়ে এসেও লালন-চর্চা আজও অব্যাহত দুই বাংলাতেই। গোবরডাঙা শিল্পায়ন নাট্যদল প্রযোজিত ‘পড়শি’ (নাটক: উৎপল ফৌজদার) প্রচলিত ছক ভেঙে অন্যভাবে লালন-দর্শনকে ছুঁতে চেয়েছে। আশিস চট্টোপাধ্যায়ের নাট্য বিন্যাস ও নির্দেশনায় মঞ্চে লালনের সশরীর উপস্থিতি নেই, উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর গান। এই নাট্যে একটি মাত্রই চরিত্র কথকের, ভূমিকায় দীপা ব্রক্ষ্ণ। তাঁর গানের গলাটি দরাজ এবং সুরঋদ্ধ। কথকতার অংশেও বাচনিক এবং কায়িক অভিনয় আদ্যন্ত নিপুণ। লালনের গানেই আমরা পাই, ‘অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই’। প্রযোজনায় সহযোগীরা ছিলেন সূর্যজ্যোতি ভট্টাচার্য, শংকর বসু, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়,প্রিয়েন্দুশেখর দাস, শৌভিক সরকার, রাজেশ কর্মকার, রাজু ভট্টাচার্য, নান্টু সরকার প্রমুখ।

এ দিন নাটক শুরুর আগে উপরি পাওনা ছিল চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের বৈদগ্ধপূর্ণ ‘লালন কথা’।

বাস্তবের দৃষ্টিকন্যা

পিনাকী চৌধুরী

সায়নদেব ভট্টাচার্যের ‘দৃষ্টিকন্যা’ নাটকটি বর্তমান বাস্তবের এক কড়া কশাঘাত। ইন্দ্রাশিস লাহিড়ির নাটকে কিছু কঠিন প্রশ্ন দর্শক মন আলোড়িত করে। ‘আরও আলো আরও আলো এই নয়নে প্রভু ঢালো’ – দীর্ঘ ৮ বছর পর দৃষ্টি ফিরে পাবার আশায় অপেক্ষা করে তমসা। স্বনামধন্য ডাক্তার শ্যামল বিশ্বাস-এর অসম্ভব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ‘ব্লু লেন্স’ তমসার জীবনে সৃষ্টি করে এক ম্যাজিক।

ম্যাজিক নাকি অ্যাক্সি়ডেন্ট! ফিরে পাওয়া দৃষ্টি তমসার কাছে নিয়ে আসে এক অবাক পৃথিবী – চেনা মানুষ অচেনা মুখ। প্রতিটি চেনা ও জানা মানুষের মুখ তার কাছে কেমন অচেনা হয়ে যায়। তমসার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আত্মহত্যার দিকেও পা বাড়ায়।

প্রত্যেকেরই অভিনয় নিখুঁত। বিপ্লব কুন্ডু, প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য, সৌমি, সায়নদেব প্রমুখ প্রত্যেকেই নাটকের সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছিলেন। পরিচালকের সাফল্য এখানেই। আবহ মুরারি রায়চৌধুরীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE