Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

তোমার পাড়ায় বসত করে কয় জনা

কেউ জানে। কেউ খবরই রাখে না। সম্পর্ক কারও প্রীতির, কারও’বা ভয় কি বিতৃষ্ণার! পাড়ায় পাড়ায় সারমেয়-সংবাদে কান পাতলেন মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যকেউ জানে। কেউ খবরই রাখে না। সম্পর্ক কারও প্রীতির, কারও’বা ভয় কি বিতৃষ্ণার! পাড়ায় পাড়ায় সারমেয়-সংবাদে কান পাতলেন মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

এলাহাবাদ স্টেশনে দাঁড়িয়ে কলকাতাগামী বম্বে মেল। গার্ড চেঁচাচ্ছেন, “এক কুত্তে কে লিয়ে ট্রেন রুকা রহেগা ক্যয়া!”
এ দিকে, মাংস-ভাত মাখা বাটি হাতে স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটছেন এক মহিলা। তাঁর সামনে দৌড়চ্ছে এক কিশোর। তারও আগে, কিশোরের নাগালের বাইরে থাকতে মরিয়া, উদ্ভ্রান্ত এক দিশি সারমেয়। ট্রেন আর স্টেশনের যাত্রীরা তারিয়ে তারিয়ে দেখছেন দৃশ্যটা।

বলতে বলতে হেসে খুন ‘কুত্তে কি মা’ মালা চক্রবর্তী। শোনাচ্ছিলেন তাঁর আদরের ‘ভঁদু’র ট্রেনের ডগ বক্সে চড়ে মুম্বই থেকে রানিগঞ্জ পৌঁছনোর কাহিনি।

মুম্বইয়ের কোয়ার্টার চত্বরে রাস্তার চতুষ্পদ মরাঠি বীর ভঁদুর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁদের স্নেহ-বন্ধন। সম্পর্কটা এমনই দাঁড়ায়, মালার স্বামী পার্থপ্রতিমের বদলি অন্য শহরে হওয়ার পর ভঁদুকে একা মুম্বইয়ে ফেলে আসতে পারেননি ওঁরা।

রাস্তার কুকুর নিয়ে অন্য রকম কাহিনি অবশ্য দুর্লভ নয়।

বাইপাসের ধারের এক আবাসন। রাস্তায় মাস দেড়েকের এক ছানাকে বড় কুকুর তাড়া করেছে।

রক্ষাকর্তা হয়ে তাকে কোলে করে তুলে এনেছিল বছর এগারোর ঋজু। কিন্তু ঋজুর চরম মনখারাপ অগ্রাহ্য করেই কয়েক মাসের মধ্যে তাকে কাছের এক শেল্টারে রেখে আসতে বাধ্য হন ওর বাবা-মা।

কারণ? প্রবল প্রতিরোধ ছিল আবাসনের কিছু বাসিন্দার। বাগান নোংরা করতে পারে, কামড়ে দিতে পারে, ইত্যাদি নানা গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা মাস কয়েকের কুকুরটি নিয়ে।

কামড়ে দেবে!— কুকুর যাঁদের না-পসন্দ, এটা তাঁদের প্রথম শঙ্কা। ভয়ের শিকড়টা কারও কারও ক্ষেত্রে এতটাই গভীর যে দরজার উল্টো দিকে রাস্তায় কুকুর দেখলে বাড়ি থেকে বেরোনোর ভরসা পর্যন্ত পান না।

পেশায় ড্রাইভার, হাওড়ার এক বাসিন্দা চাঁদুর তো ভয়ঙ্কর ‘সারমেয়াতঙ্ক’! গাড়ি গ্যারেজ করতে একটু রাত হলে অন্য কাউকে সাইকেলে করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়।

কিছু পাড়ায় আবার সন্ধ্যা নামলেই সক্রীয় ‘কম্যান্ডো-বাহিনী’। কেউ আসছে দেখলে দলবদ্ধ তাড়া করে। কিছু ক্ষেত্রে চেনা লোকজনেরও নিস্তার মেলে না। উত্তর কলকাতার এক সাবেক পল্লিতে একবার রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে কুটুমবাড়ি যেতে গিয়ে এমনই এক বাহিনীর হাতে প্রচণ্ড হেনস্থা হয়েছিলেন সরকারি চাকুরে প্রশান্ত চৌধুরী। শেষে হাঁড়ি ফেলে ছুটতে হয় তাঁকে। কম্যান্ডোরা রসগোল্লা খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে যাত্রা তিনি প্রাণে বাঁচেন!

অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কুকুরের তাড়ায় জেরবার, এমন অনেকেই আছেন। প্রশান্তবাবু যে পাড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেখানকারই এক বাসিন্দা বলছিলেন, “মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরসভায় খবর দিয়ে তুলে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু শুনেছি পুরসভা নাকি গলায় সাঁড়াশি চেপে খুব নির্মম ভাবে ধরে। সেটা ভাবলেই মায়া হয়। ফোনটা করতে পারি না।’’ (পুরসভার তরফে এখন অবশ্য আর ওই সাঁড়াশি-অভিযান নেই। ওদের ধরতে ব্যবহার করা হয় মোটা দড়ির ফাঁস)।

অন্য দিকে, বাকড়ার লয়াবাদের মঞ্জু একবার কুকুরের কামড় খেয়েও আজ স্বীকার করেন, দোষটা তাঁর নিজের ছিল। আয়া সেন্টারের এই কর্মী এক সন্ধ্যায় ডিউটিতে যাওয়ার তাড়ায় রাস্তার কুকুরের পা মাড়িয়ে ফেলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কামড়।

নাকতলা এলাকার বাসিন্দা মিলন ভট্টাচার্য অফিস যাওয়ার পথে এক কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে বাইক নিয়ে উল্টে পড়ে কনুই ভেঙেছেন। বছর দেড়েক হয়ে গেল, এখনও কনুই ভোগাচ্ছে। তবু আজও মিলনের স্বস্তি, “কিন্তু কুকুরটা তো বেঁচে গেল, সেটাই ঢের!’’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাব নিলে দেখা যাবে, কুকুরকে যাঁরা ভয় পান, তাঁদের তুলনায় কুকুর যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরা কামড় খেয়েছেন অনেক বেশি। এবং তার পরেও বহাল তবিয়তে আছেন।

অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় রাস্তার কুকুরদের জন্য ফাউন্ডেশন গড়েছেন কয়েক বছর হল। বছর দুই আগের কথা। একটি কুকুরকে কেউ আধমরা করে পুঁতে দিয়ে গেছে বলে কালীঘাট থানা থেকে ফোন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। সেই সারমেয়কে বাঁচানো যায়নি। তবে সে দিন থানার অফিসারদের অনুরোধে রাস্তার অসুস্থ কুকুরকে ওষুধ দিতে গিয়ে মারাত্মক কামড় খেয়েছিলেন। উনি বলেন, “কুকুর তো কামড়াবেই। আমার ইনজেকশন নেওয়াই থাকে।’’

এত অবলীলায় ‘কুকুর তো কামড়াবেই’ বলাটা অবশ্য মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে কুকুরে যাঁরা স্বচ্ছন্দ নন, তাঁদের পক্ষে। “কিচ্ছু করিনি। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। অযথা তাড়া করল।’’ কিংবা “চুপ করে শুয়ে ছিল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কামড়ে দিল,” এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এমনই তাগড়াই এক নেড়ির বুদ্ধির বহর দেখে পাড়ার লোকে নাম রেখেছিলেন গজা। সে পাশে বসে বিস্কুট খাবে, মাথায় হাত বোলাতে দেবে। কিন্তু উঠতে গেলেই চল্লিশ দাঁতের অন্তত কয়েকটার নিশান বসিয়ে দেবে আপনার ‘তশরিফ’-এ!

শেষে তাকে চেনে বেঁধে রাখা হত। একদিন পাড়ার ছেলেরা খেলছে, তখনই হঠাৎ চেন খুলে যায় গজার। কিশোর-বাহিনীর সিংহভাগ পত্রপাঠ পাশের পুকুরে ঝাঁপ। প্রাণরক্ষায় এক জন লাফিয়ে ওঠে পাশের এক ল্যাগব্যাগে গাছে।

ব্যাপারটা দাঁড়ায়, ছেলেটি গজার নাগাল ছাড়াতে যত মগডালের দিকে উঠছে, তত ডালটা নুয়ে পড়ছে। তার পশ্চাদ্দেশটা ঝুলে আসছে গজার মুখের সামনে। বিস্ময়কর, গজা কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলেনি সে দিন!

কেন গজার মতো কুকুরদের আচরণ এমন অস্বাভাবিক?

‘মৈত্রী’র রানা গঙ্গোপাধ্যায় শোনালেন সম্ভাব্য এক কারণের কথা। কলকাতার পশু জগতের সঙ্গে রানার সম্পর্ক আশৈশব। বলছিলেন, “ছোট বয়সে পর্যাপ্ত মায়ের দুধ না পেলে কুকুরদের মধ্যে ফেরোমোনের (এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় তরল) অভাব হয়। যা থেকে পরে কুকুরটির মধ্যে অদ্ভুত ভয় কাজ করে। সে যাকে তাকে তাড়া করতে পারে। কামড়াতে পারে। আবার নিজের খাবার রক্ষায় অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক হয়ে যেতে পারে। যাকে বলা হয় ফুড অ্যাগ্রেশন।’’

ওয়েব ডিজাইনার দম্পতি গৌতম আর নন্দিতা সেনগুপ্তের পরিবারটাই রাস্তার স্ট্রে-দের নিয়ে। দিল্লির ওখলা উড়ালপুলের উপর মাস দু’য়েকের এক ফুটফুটে সারমেয় শাবক, নিজে গৌতমের গাড়িতে উঠে এসেছিল। সেই থেকে ‘মিঠি’ তাঁদের পরিবারেরই সদস্য হয়ে যায়। গৌতম বলছিলেন, “মিঠি খারাপ মন ভাল করে দিত। একদম মায়ের মতো ছিল।’’ মিঠি মারা গিয়েছে। কিন্তু সংসারের দায়িত্ব নাকি দিয়ে গিয়েছে বরফিকে! বছর দুই আগের এক তেইশ ডিসেম্বর বাইপাস থেকে ওঁরা তুলে আনেন ছোট্ট বরফিকে। গৌতম বলছিলেন, ‘‘বরফির কিছু হাবেভাবে স্পষ্ট, ফেরোমোনসের অভাব আছে। তবে চিকিৎসায় অনেক স্বাভাবিক ও।’’

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পাশে গৌতমবাবুদের বাড়ির সিঁড়ির তলায় ছোট-বড় মিলিয়ে রাস্তা থেকে রাতে শেল্টার নেয় প্রায় এগারো জন। যাদের মধ্যে সুইটি ‘সমাজসেবিকা’। পাশের গলির অনাথ বাচ্চাকে নিজের খাবারের বাটি মুখে নিয়ে খাইয়ে আসে। আর আছে সুগায়ক পাগলু। “পাগলুর গান শুনতে আসবেন একদিন। বড্ড ভাল গায়। বিশেষ করে রাতে গলাটা দারুণ খোলে,” নেমন্তন্ন করে রাখলেন গৌতম।

তবে পাগলুদের গানে রাতের ঘুম ভেঙে গেলে মেজাজ যে রকেট গতিতে সপ্তমে যাবেই, এটা ঠিক। তাকে ধমকে থামানোর চেষ্টা করা ছাড়া উপায় থাকে না।

সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত রবি কিচলুর পুত্রবধূ যোগিতা অবশ্য অন্য অভি়জ্ঞতার কাহিনি বললেন। সারমেয়-চিৎকারে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তিনি রাস্তার মিটার বক্স থেকে তামার তার কাটতে আসা চোর ধরেছিলেন।

যোগিতার বত্তব্য, “কুকুর রাতে পাড়ার নিরাপত্তার জন্য চেঁচায়। রাস্তাটাই ওদের বাড়ি। আপনার বাড়িতে রাতে অচেনা লোক ঢুকে এলে, আপনি কি আপ্যায়ন করে বসাবেন? ওরা শুধু নিজেদের এলাকা রক্ষা করে!”

রক্ষা করতে গিয়ে মাসুলও দিতে হয় ওদের। উত্তাল সত্তর দশকে হাওড়ার এক পাড়ার প্রহরী ছিল নাকি কালী-চুহা জুটি। অসম সাহসী। এক রাতে কোনও নির্মম নিশানাবাজ ছুরি বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ওদের বুকে।

খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক বাড়ির দারোয়ান রাতে শোয়ার জায়গা দিত রাস্তার একটি কুকুরকে। ও দিকে বাড়ির ড্রাইভার ঘোর কুকুর-বিরোধী। এক রাতে মদ্যপ হয়ে সে এসে বাড়ির একতলায় শোয়ার দাবি তোলে। দারোয়ান রাজি হননি। পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুটা ভৌ ভৌ করেছিল কুকুরটিও। তখনকার মতো ফিরে গেলেও সেই চালক পরে ফিরে এসে পাঁচিল টপকে ঢুকে দারোয়ানের ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে ইঁট মেরে থেঁতলে খুন করেছিল সেই কুকুরটিকে।

এটা কারও নারকীয় মনে হলে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কালীপুজোর রাতে বাজির শব্দে আতঙ্কিত এক কুকুরছানা ঢুকে পড়েছিল চেতলার রাখাল দাস আড্ডি রোডের এক বাড়িতে। অনধিকার প্রবেশের শাস্তি হিসাবে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো হয়েছিল। ভাতের ফ্যান ঢেলে দেওয়া বা ইঁট মারার ঘটনা তো এর সামনে নস্যি! তবে দুই ক্ষেত্রেই দারুণ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। দু’টি ঘটনাতেই অপরাধীদের গ্রেফতার করে প্রিভেনশন অব ক্রুয়েল্টির অন্তর্গত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২৮ ও ৪২৯ ধারায় মামলা করা হয়।

এমনও হয়েছে, বাগুইহাটির খুনের অভিযোগে এক যুবক গ্রেফতার হলে জামিন না-হওয়া পর্যন্ত তাঁর পোষা পাঁচ-ছ’টা কুকুরকে নিয়মিত খাইয়েছেন, দেখভাল করেছেন স্থানীয় থানার পুলিশ। পশুপ্রেমীরা বলছেন, “লোকে প্রথমেই ধরে নেয় কুকুর নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ গুরুত্ব পাবে না। তা কিন্তু নয়।’’

আইন অনুযায়ী রাস্তার কুকুর দেখে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে যেমন পুলিশের কাছে যাওয়া যায়, তেমনি কোনও কুকুরের উপর অত্যাচার করা হলেও এফআইআর নিতে পুলিশ কিন্তু বাধ্য।

শুধু পুলিশ নয়, প্রাণীটিকে পাল্টা আঘাত করার বদলে কলকাতা পুরসভা এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছেও সাহায্য চাওয়া যায়।

ইতিহাসে কুকুরের সঙ্গে মানুষের প্রথম মিতালির সন-তারিখ-বছর নিয়ে দু’টি মত। এক দল বলেন বন্ধুত্বটা হাজার তিরিশ বছর প্রাচীন। অন্য মত, মৈত্রী চুক্তি প্রথম স্বাক্ষর হয় চিনে, হাজার চোদ্দো বছর আগে।

ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী দক্ষের কন্যা দেবী সরমা সমস্ত কুকুরকুলের আদি মাতা। সরমার সন্তান, তাই সারমেয়। ঋক বেদেও সরমা আছেন। সত্যের পথে যিনি ইন্দ্রের চুরি যাওয়া গরুদের ফিরিয়ে এনে মানবজাতির পুষ্টি রক্ষা করেছিলেন। আনুগত্যের প্রতীক সরমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় প্রখর। তিনি আলোর দিশারি, ঊষা।

এর যেটাই ঠিক হোক, মানুষ-সারমেয় বন্ধনটা দীর্ঘকালের। অথচ এমন যুগান্তরের সম্পর্কেই নাকি ফাটল দেখা যাচ্ছে ইদানীং!

পাড়ার পুরনো ধাঁচাটা যত পাল্টে বহুতল হচ্ছে, ততই নাকি সংঘাত বাড়ছে। কালী-চুহার বংশধরদের চিৎকারে রাতে আর নিরাপত্তা বোধ করছেন না, বরং বিরক্ত হচ্ছেন মানুষ।

উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্রসরোবরই। চেনা নাম ‘লেক’। ক’বছর হল তিলোত্তমার এই বিউটি স্পটের সৌন্দর্য্যায়ণ চলছে। “কিন্তু সবটাই হচ্ছে লেকের বরাবরের বাসিন্দা কুকুরদের বাদ দিয়ে,” বলছিলেন জয়শ্রী।

বেথুনের ফিজিক্সের প্রাক্তন হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট, বছর চৌঁষট্টির জয়শ্রী নিজের খরচে প্রতিদিন লেকে চল্লিশেরও বেশি কুকুরের অন্তত এক বেলার খাদ্য সংস্থান করেন। “বাইরে ডেকে খবরের কাগজের উপর বাটি পেতে খাওয়ানো হয়। সব পরিষ্কার করে তুলে নিয়ে তবে ফিরি।’’

কেন এত আয়োজন? কারণ সৌন্দর্যায়নপন্থীদের একাংশের মত, বংশ পরম্পরায় তিরিশ বছরেরও বেশি লেক নিবাসী ওই সারমেয়রা বাঁধানো রাস্তা, সাজানো বাগানের সঙ্গে বড্ড বেমানান। তাই লেকে কুকুর নিয়ে ঢোকা বা খাওয়ানোয় ফতোয়া জারি। কাজটা যতই বেআইনি হোক, কুকুর দেখলেই খেদাও, নীতি। খাদ্য না পেলে তারা অন্যত্র সরবেই, মত উচ্ছেদে বিশ্বাসীদের।

জয়শ্রীদের পাল্টা প্রশ্ন, কেন যাবে ওরা? দেশের আইন বলে, নিজের এলাকায় থাকার, খাদ্য সংগ্রহের, বংশ বিস্তারের অধিকার রয়েছে সারমেয়দের। লেকটা শুধু মানুষের নয়, ওদেরও! বিরোধের চেহারাটা কয়েকবার এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে পুলিশের সাহায্য নিয়ে নিরাপত্তার বাড়তি বন্দোবস্ত করে খাবার খাওয়াতে হয়েছে।

‘‘ওরা পুরোপুরি অসহায়। আমরা না দেখলে কে দেখবে?” বলছিলেন দেবশ্রী রায়। ওঁর সংস্থা জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকা থেকে নানা রকম চিকিৎসা করে দেবী সরমার রাস্তার সন্তানদের। দেবশ্রী বলছিলেন, “ফোন পাই, দিদি কুকুরটাকে তুলে নিয়ে যাবেন? বড্ড গন্ধ। হয়তো কামড়াকামড়ি থেকে ঘা। ফোনগুলো আগেই করলে তো সময়ে ওষুধের বন্দোবস্ত করা যায়। আসলে এঁরা শুধু নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য চান। পশুর কষ্টটা ওঁদের কাছে কিছু নয়।’’

এই রকম আরও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে, যাঁদের খবর দিলে পাড়ায় এসে কুকুরের চিকিৎসা করবে বা তুলে নিয়ে গিয়ে নির্বীজকরণের ব্যবস্থা করবে।

চেতলার রুকসানা খানুম বা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা অফিসার, দমদমের নিবেদিতা ঘোষরা আবার চিকিৎসার বন্দোবস্তে নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। দেবশ্রীর মতো মৃদু স্বরে নয়, একেবারে তিতিবিরক্ত নিবেদিতা বলছিলেন, “রাস্তা দিয়ে বাইক চড়ে যেতে যেতে স্রেফ মজা করে কুকুরের পা মাড়িয়ে দিয়ে যায়। পা না থাকলে ও খাবার সংগ্রহ করবে কী করে? এটাই কি স্বামী বিবেকানন্দের দেশ? জীবসেবাকে যিনি ঈশ্বরের সেবা বলেছেন?”

নিবেদিতার স্বামী একবার সিঁড়িতে গুটিসুটি শুয়ে থাকা এক সারমেয়ের মাথায় বুট পায়ে লাথি মেরেছিলেন। ওঁদের সম্পর্কের চিড় ধরা তখনই শুরু।

বলছিলেন, “স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু প্রাণীদের জন্য কাজ করা বন্ধ করতে পারব না।” ব্যাগেই থাকে নানা ওষুধ। ইন্ডিয়ান মংগ্রেলদের (ভারতে রাস্তার কুকুরদের ব্রিড) জরায়ুর ক্যানসার খুব বেশি হয়। নিবেদিতা চিকিৎসা করান রাস্তায় সেই সব রুগ্ণ কুকুরের। এক পশুরোগ বিশেষজ্ঞ সপ্তাহে এক দিন সময় দেন। সাহায্যে আরও কেউ কেউ এগিয়ে আসায় বছর দুই হল ‘ক্রুজি’ নামে এক সংস্থা গড়েছেন উনি।

রুকসানা আবার চেতলার বেশ কিছু কুকুরকে খাওয়াতে মাসে সাত-আট হাজার টাকা সরিয়েই রাখেন। ছোটখাট অসুখের ওষুধও কেনেন। সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের এই আত্মীয়া বলছিলেন, “কুকুর না থাকলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে, এটা ভুলছি কেন আমরা?” বর্ধমানের গ্রাম থেকে শহরে এসে দেখেছেন, ফ্ল্যাট-সংস্কৃতিতে বড় ব্রাত্য সারমেয়কুল। “ওরা শুধু দু’টো খাবারের জন্য মার খায়।” রুকসানা বলছিলেন, “সবাই ওদের একমুঠো করে দিলে কিন্তু কারও উপর চাপ পড়ে না।”

পণ্ডিত রবি কিচলু ফাউন্ডেশনের পশুসেবামূলক উদ্যোগ, ‘মায়া’-র দায়িত্বে থাকা যোগিতা আবার বলছেন সমস্যার মূলে বর্ণবৈষম্য! “ভারতীয় ব্রিডের নামটা যে ইন্ডিয়ান মংগ্রেল, সেটাই জানে না আমাদের শিক্ষিত সমাজ। দেশের ব্রিডকে অচ্ছুৎ করে বিদেশি কুকুর কিনছে। দিশির দাম নেই, তাই কদরও নেই!” অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, বস্তির বা মাটির কাছাকাছি থাকা লোকেরা দিশিদের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। সমস্যাটা বরং বিভিন্ন বহুতলের নানা কমিটির কর্তাদের নিয়েই। “আবাসনের বাইরের ফুটপাথে কুকুর জন্মালেও এঁরা বস্তায় পুরে ফেলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। রাস্তায় কুকুর খাওয়ালেও গাত্রদাহ। আরে বাবা, আমার টাকায় আমি খাওয়াচ্ছি, তোমার কী?”

দেবশ্রীদের বক্তব্য, কুকুর নিজের এলাকা রক্ষা করতে চেঁচাবে, তেড়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। পাড়ার লোক স্টেরিলাইজেশনের কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের সঙ্গে একটু হাত মেলালে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সমস্যার তীব্রতাও কমবে।

গৌতম সেনগুপ্ত বা রানা আবার মনে করেন প্রাণী অধিকারের বিষয়টা নিয়ে প্রচার চাই। গৌতম-নন্দিতা দুই পোষ্যের নামে ‘মিঠি-চিনি’ ফেসবুক পেজ করেছেন। মংগ্রেলদের নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টায়।

রানা বলছিলেন, “সুপ্রিম কোর্টের আইন রয়েছে। এলাকার কুকুরকে তুলে নিয়ে স্টেরিলাইজ করে এলাকাতেই ফেরাতে হবে। হ্যাবিট্যাটের উপর, খাদ্যের প্রতিটা উৎসে ওদের অধিকার রয়েছে। কোনও কুকুরের কাছ থেকে দুধের সন্তানদের সরিয়ে নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। অত্যাচারীর শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু কুকুর যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরা সবাই এই সব আইনি দিকগুলো সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নন।”

কিছু দিন আগে ভবানীপুর থানার সামনে থলেতে বাঁধা ‘বোমা’ নিস্ক্রিয় করতে এসে বোম্ব স্কোয়াড দেখে তার ভেতরে তিনটে সারমেয় শাবক! তাদের এক জন আজ রানাদের বাড়ির আদরের পুঁটি।

থলেতে পুরে যাঁরা ওদের ফেলে গিয়েছিলেন, তাঁদের পাশে পুঁটিদের রক্ষাকর্তারাও কিন্তু এই শহরেরই বাসিন্দা। স্রেফ দাপট দেখিয়ে নিরীহ কুকুরকে পিটিয়ে মারা, ল্যাজে বাজি বেঁধে বিনোদন খোঁজা যদি থাকে, তা হলে কুকুরের আইনি অধিকারের কথাও ভাবছে এই শহর।

মানুষ-সারমেয় মৈত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদও তাই থাকছে।

একই দফতরের কর্মী এবং একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে এক নামী কবির সঙ্গে মাঝে মাঝে অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফেরার সুযোগ হত। সারমেয়রা ছিল ওঁর প্রাণের খুব কাছাকাছি। বলতেন, “ওরা আমাদের মননের অনেকটা জুড়ে! চোখ বুজে একটা কুঁড়ের ছবি ভাবো। দেখবে দাওয়ায় কুন্ডুলি পাকিয়ে সে শুয়ে। পাড়ার চায়ের দোকান ভাবো। দেখবে বিস্কুট প্রত্যাশী অগাধ আস্থায় জুলজুল চোখ রেখেছে তোমার চোখে। মাত্র এক প্যাকেট বিস্কুটের বিনিময়ে সারা জীবনের কৃতজ্ঞতা আর কার কাছে পাওয়া যায়?”

আর বলতেন, দু’টো কালো কুকুর নাকি রাতে ওঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে। “আমি বাড়ি ঢুকে গিয়ে পিছন ফিরলে কিন্তু ওদের আর দেখতে পাই না,” বলতেন উনি।

খুব একাকী, নিঃসঙ্গ এক মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি বছর কয়েক আগে।

কে জানে, সেই কালো কুকুর দু’টো সঙ্গী হয়েছিল কি না!

সমস্যায় সাহায্য যেখানে

কী সাহায্য

পাড়ার কুকুরের নির্বীজকরণ। আহত বা অসুস্থ হলে চিকিৎসা। জলাতঙ্ক প্রতিষেধক সহ বিভিন্ন ভ্যাক্সিনেশন। অনাথ সারমেয় শাবকদের আশ্রয়। এলাকায় কোনও কুকুর আক্রমণ করছে বা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে বলে খবর দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

কী ভাবে সাহায্য

খবর দিলে ওঁরা কুকুর তুলে নিয়ে যান। তবে চিকিৎসা বা নির্বীজকরণের কিছুটা খরচ পাড়ার লোককে দিতে হতে পারে। সুস্থ হলে পাড়ায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জলাতঙ্ক হওয়া কুকুর তুলে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত আছে কয়েকটি সংস্থার।

সাহায্যের কিছু ঠিকানা

সরকারি
কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কেনাইন কন্ট্রোল।

ফোন: ২২৮৬১২১২, ২২৮৬১৩১৩

বেলগাছিয়া ভেটেরেনারি কলেজ ও হাসপাতাল (এমার্জেন্সি বিভাগ)

বেসরকারি
দেবশ্রী রায় ফাউন্ডেশন। ফোন ৬৫৫০৩২৮৫ (বেলা ১১টা-সন্ধ্যা ৭টা)

মুকুন্দপুরে পিপল ফর অ্যানিম্যালসের শেল্টার ‘আশারি’।

ফোন: ২৪২৩৯১০০।

সরশুনায় পার্থ ও শ্রীতমা ভট্টাচার্যের সংস্থা ‘মাদার্স হার্ট’। ফোন: ৯৮৩১৪৭৬৪১৫

পণ্ডিত রবি কিচলু ফাউন্ডেশন-‘মায়া’। ফোন: ৯৮৩০২৫০১৮৬

শ্রীমতী রাধাকৃষ্ণনের শেল্টার ‘ছায়া’। ফোন: ৯৮৩০২৭৯১৩৮

বেহালায় সুস্মিতা রায়ের কেন্দ্র ‘লাভ অ্যান কেয়ার’। ফোন: ২৪৮৮১২২২, ৯৪৩৩০৭৫৭১৫, ৯৮৩০০৩৭৬৯৩

কমপেশনেট ক্রুশেডাস্্ ট্রাস্ট। ফোন: ২৪৬৪৭০৩০

বিরাটিতে শ্যামলী চৌধুরী। ফোন: ২৫১৪২৩৯৯, ৯৭৪৮২৯৮৫৪২

হালিশহরে রমা চক্রবর্তী। ফোন: ৯৩৩১৮৭৬৭৯৭

নিখিল বঙ্গ কল্যাণ সমিতি। ফোন: ২৪৯৫৯১৪৮ (শুধু কবরের জন্য)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mahasweta bhattachariya dog
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE