Advertisement
১১ মে ২০২৪

দিন যে হল দীন

হারিয়ে যাওয়ার ভিড়ে এ বার বাংলা দিনপঞ্জিকাও। লিখছেন সমরেশ মজুমদারজানুয়ারির শেষ তারিখে মিলনমেলার মাঠে কলকাতা পুস্তক মেলায় লোকটিকে দেখেছিলাম। চিটচিটে ময়লা ছেঁড়া জামাকাপড়, একমুখ জট পাকানো দাড়ি, চুলে চিরুনি পড়েনি বহুকাল। টিকিট কেটে ঢুকতে হয় না বলে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু দু’চার জন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই লোকটা সোজা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করছিল, ‘আজকের বাংলা তারিখ কত? কোন মাস চলছে?’ যাঁরা প্রশ্ন দু’টো শুনছিলেন তাঁরা চুপচাপ সরে যাচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল উত্তরটা কারও জানা নেই। সেই লোকটা, নিশ্চিত পাগল, মেলার পরের দিনগুলোতে তাকে দেখিনি।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮
Share: Save:

জানুয়ারির শেষ তারিখে মিলনমেলার মাঠে কলকাতা পুস্তক মেলায় লোকটিকে দেখেছিলাম।

চিটচিটে ময়লা ছেঁড়া জামাকাপড়, একমুখ জট পাকানো দাড়ি, চুলে চিরুনি পড়েনি বহুকাল।

টিকিট কেটে ঢুকতে হয় না বলে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু দু’চার জন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই লোকটা সোজা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করছিল, ‘আজকের বাংলা তারিখ কত? কোন মাস চলছে?’

যাঁরা প্রশ্ন দু’টো শুনছিলেন তাঁরা চুপচাপ সরে যাচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল উত্তরটা কারও জানা নেই। সেই লোকটা, নিশ্চিত পাগল, মেলার পরের দিনগুলোতে তাকে দেখিনি।

আমার মা যত দিন বেঁচেছিলেন, চৈত্রমাসে আমাকে বলতেন, ‘একটা বাংলা ক্যালেন্ডার এনে দিস।’ সেইসঙ্গে পঞ্জিকাও।

মা গত হয়েছেন বহু বছর। এখন বাড়িতে বাংলা ক্যালেন্ডার ঝোলে না। পঞ্জিকাও কেনা হয় না। বাংলা তারিখের হদিশ জানতে আনন্দবাজারের প্রথম পাতার ওপরের দিকে তাকাতে হয়।

যে কোনও বঙ্গসন্তানকে যদি প্রশ্ন করেন তিনি ক’টা বাংলা তারিখ জানেন? যদি তাঁর বয়স পঞ্চাশের উপর হয় তাহলে অবশ্যই তিনটে তারিখ তাঁর মনে থাকবে। এক পয়লা বৈশাখ, দুই পঁচিশে বৈশাখ, তিন ভদ্রলোকের নিজের জন্মতারিখ যা ইংরেজির পাশাপাশি ঠিকুজির কল্যাণে বাংলাটাও তাঁর জানা হয়ে আছে।

চল্লিশের নীচে যাঁদের বয়স তাঁদের ক’জনের ঠিকুজি হয়, আমি জানি না। আজকালকার কিশোর বা তরুণদের জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, হয়নি। তবে কম্পিউটারের মাধ্যমে ঠিকুজি তৈরি করার চল এখন হয়েছে যেখানে বাংলা তারিখের প্রয়োজন হয় না। এঁরা অবশ্যই পয়লা এবং পঁচিশে বৈশাখের কথা জানে খবরের কাগজ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে।

আর একটা তারিখ কেউ কেউ জানেন। সেটা বাইশে শ্রাবণ, কিন্তু বাইশে শ্রাবণ কোন ইংরেজি মাসে তা জানা নেই।

স্কুলের সার্টিফিকেটে, ভোটার কার্ডে, পাশপোর্টে, ইংরেজি তারিখ বসানো থাকে। অতএব বাংলা তারিখ জানার তো কোনও প্রয়োজন নেই। স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয়। জীবনের কোন কাজে লাগে তা পরে?

কিন্তু বেশির ভাগ বয়স্ক বাঙালি আজকাল মুশকিলে পড়ছেন। ধুতি-পাঞ্জাবি না পরলেও, বাংলা কথায় ইংরেজি শব্দ চললেও তিনি তো নিজেকে বাঙালি বলেই মনে করেন। যে শহরে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সেই শহরের রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোর উপরে বাংলায় সাইনবোর্ড না লেখা থাকলেও নিজের বাঙালিত্ব তিনি ভুলবেন কী করে? তিনি জানেন একটা বাংলা ক্যালেন্ডার প্রতি বছর ছাপা হয় যাতে মা-ঠাকুমা’রা একাদশী-পূর্ণিমার হদিশ পেতেন। বিধবারা অম্বুবাচী কবে তা জানতেন।

কবে থেকে ওই ক্যালেন্ডার চালু হয়েছিল? বাংলা ক্যালেন্ডারের পূর্বসূরির সূত্রপাত হয়েছিল মোগল সম্রাট আকবরের উদ্যোগে।

পনেরোশো চুরাশি খ্রিস্টাব্দের দশ অথবা এগারো মার্চ আকবর তারিখ-ই-এলাহি নামে একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। কারণ রাজস্ব আদায় করতে একটা আধুনিক ক্যালেন্ডারের খুব প্রয়োজন হয়েছিল।

হিজরি ক্যালেন্ডার কৃষকদের চাষ আবাদের সময়ের তাল রাখতে পারছিল না। রাজস্ব আদায় হত চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী আর শস্য উৎপাদিত হত সৌরবর্ষের নিয়ম মেনে।

চন্দ্রবর্ষ এবং সৌরবর্ষের মধ্যে বারো দিনের পার্থক্য ছিল। আকবর তাঁর সময়ের বিখ্যাত সৌরবিজ্ঞানী আমির ফাতুল্লাহ সিরাজিকে দায়িত্ব দেন একটা নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করে দিতে।

আকবর বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যালেন্ডার দরকার যা অনুসরণ করলে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে সুবিধে হবে। তারিখ-ই-এলাহি যখন তৈরি হয়েছিল তখন বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি নাবালক অবস্থায়। বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা কেউ শোনেনি বা ভাবেনি।

আকবরের অনেক পরে শাহজাহান মাসের বদলে সপ্তাহকে গুরুত্ব দিতে চাইলেন। মাসের তিরিশ বা একত্রিশ দিনের কোনও নামকরণ হয়নি। হলেও তা মনে রাখা সম্ভব নয়।

শাহজাহান চাইলেন প্রতিটি সপ্তাহ শুরু হবে রবিবার থেকে। বিভিন্ন গ্রহ অথবা উপগ্রহের নাম অনুসারে সপ্তাহের দিনগুলোর নামকরণ করা হল। যেমন রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র) ইত্যাদি। আবার বারো মাসের নামকরণ করা হল নক্ষত্র বা রাশির নাম অনুযায়ী।

তারপর অনেকগুলো বছর চলে যাওয়ার পর গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করতে।

বাংলা ক্যালেন্ডারের দিনের সংখ্যা ৩৬৫। কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটে। এই বাড়তি সময়টাকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসে একটি দিন বাড়িয়ে দিয়ে। বাংলা ক্যালেন্ডার এই পথে হাঁটল না। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস একত্রিশ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র তিরিশ দিনে মাস গণ্য করা হল।

ঘাটতি মেটাতে চৈত্র মাসে আর একটি দিন চার বছর অন্তর যোগ করা হল। চৈত্রমাসের শেষ তারিখের মধ্যে প্রজাদের সব কর মেটাতে হত। নতুন বছর শুরু হত বৈশাখের প্রথম দিনে। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ অথবা পহেলা বৈশাখ গুরুত্ব পেল।

হিন্দু-বৈদিক সৌর ক্যালেন্ডার ‘সূর্য সিদ্ধান্তের কাছেও বাংলা ক্যালেন্ডার ঋণী। ইংরেজি এপ্রিলের মধ্যভাগে বছরের প্রথম দিন শুরু হচ্ছে। এই প্রথম দিনটার গুরুত্ব এই ভূখণ্ডে নয়, অসম, বার্মা, কম্বোডিয়া, মণিপুর, নেপাল, ওড়িশা, মিথিলা, তামিলনাড়ু, শ্রীলঙ্কা এবং তাইল্যান্ডে এই দিনটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

ক্রমশ বাংলা পঞ্জিকার জন্ম হল যা ধর্মাচরণ, লৌকিক ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিল। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে বছর, মাস এবং দিনের কথা বলা হয়েছে। বাংলা পঞ্জিকা প্রতিটি দিনকে ভাগ করেছে।

কিন্তু এই জটিলতা কাজের ক্ষেত্রে অসুবিধে তৈরি করেছে।

দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত বাঙালি তাই ইংরেজি ক্যালেন্ডারকেই গ্রহণ করেছে। চাকরি এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল।

কিন্তু এই সেদিনও বাংলা ক্যালেন্ডার আমাদের বাড়ির দেওয়ালে ঝুলত। আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিতেও তার প্রভাব পড়ত। চৈত্রমাস এলেই বাড়ির তুলসীতলায় তিনকাঠি তৈরি করে মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হত উপরে, তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ত গাছের উপরে। আমরা বুঝতাম এটা চৈত্রমাস।

চৈত্রের শেষ সপ্তাহে মেলা বসত রাজবাড়ির মাঠে। গাজনের মেলা। পিঠে বঁড়শি বিঁধিয়ে মানুষ বনবন করে ঘুরত। শিবের সাজে কেউ কেউ ঘুরে বেড়াত মেলায়। আমরা বুঝতাম এটা চৈত্রমাস। ক্যালেন্ডার দেখতে হত না।

এখন তুলসীতলা নেই, গাজনের মেলা কোথাও কোথাও টিকে আছে এই যা। আর চৈত্রের প্রচণ্ড গরমে যখন পড়লাম, রবীন্দ্রনাথকে ঠিক বুঝতে পারিনি। এই চৈত্রমাসের প্রহর শেষের আলোয় তিনি কারও চোখে নিজের সর্বনাশ দেখেছিলেন। কিন্তু ঘন না হওয়া পর্যন্ত যেখানে গরম হাওয়া বইছে, মাটি তপ্ত, তখন কি কোনও মেয়ে সর্বনেশে চোখে তাকাতে পারে? সে তো গরমে হাঁসফাঁস করবে।

সময়টা যদি ফাল্গুনের গোড়ায় হত, অথবা শ্রাবণের শেষ বিকেলে যখন বৃষ্টি ধোওয়া আকাশ এক মোলায়েম আলো পৃথিবীতে কিছুক্ষণের জন্য পাঠায় তাহলে তার চোখে আরও ভয়ঙ্কর সর্বনাশের আহ্বান কি ফুটে উঠত না?

এখনও কি আগের মতো ঘটা করে কলকাতায় হালখাতা হয়? মফস্সলে হতে পারে। ছেলেবেলায় পয়লা বৈশাখ মানে ছিল ঠাকুর্দার পেছন পেছন দোকানে দোকানে গিয়ে মিষ্টি আর শরবত খেয়ে আসা। পয়লা বৈশাখের সকালে স্কুলের সমবেত গানে গাল ফুলিয়ে গাওয়া, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ এর জন্য ক্যালেন্ডার দেখতে হত না।

কয়েক জনকে ফোন করে জানতে চেয়েছেলাম নজরুলের বাংলা জন্মতারিখ কবে? সবাই অক্ষমতা জানিয়েছেন, শুধু এক জন বলেছিলেন, “জ্যৈষ্ঠ মাসে। কারণ ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ নামে নজরুলের উপর একটি বই আছে।”

ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করি না। কিন্তু আমরা যাঁরা সারা বছর বাংলা ক্যালেন্ডার দেখি না, দিন বা মাসের সময় রাখি না, সেই আমরাই পৈতে, বিয়ে এবং শ্রাদ্ধের সময় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা তারিখ কার্ডে লিখে চলেছি।

হঠাৎ নিজেকে বাঙালি প্রমাণ করতে এই ছটফটানি কেন? বাংলা ক্যালেন্ডার অথবা পঞ্জিকা পুরোহিতদের অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁদের যে কাজ তাতে সাহায্য হয়। এখনও পঞ্জিকা বিক্রি হয় এই কারণে। মা মাসি চলে যাওয়ার পর নিয়মিত বা অনিয়মিত পঞ্জিকা দেখে চলেন এমন বাঙালির সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।

গত বছর পয়লা বৈশাখে ঢাকায় ছিলাম। ভোর চারটের সময় থেকেই প্রভাতফেরি শুরু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে লক্ষ মানুষ রসনায় অথবা শহবাগে জমা হতে লাগলেন।

নতুন বছরকে বরণ করতে সারা দিন চলল গান কবিতার উৎসব। ধর্মের বিভেদ রইল না, রাজনীতির খোলস খুলে গেল। ভাল লেগেছিল। ওখানে দোকানের নাম বাংলায় পড়ে ঢোক গিলেছি।

এর কয়েক মাস পরে ঢাকায় গিয়েছিলাম। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজকের বাংলা তারিখ কত?’

ভদ্রলোক আকাশের দিকে তাকালেন। শেষে বললেন, ‘আষাঢ়ের শেষ। তারিখটা মনে নেই।’

এইটুকুই যথেষ্ট। বাঙালির অনেক কিছু একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই একই পথে বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা হয়তো পরের প্রজন্ম জানতেও পারবে না।

হয়তো তাই। কিন্তু পয়লা বৈশাখ আর পঁচিশে বৈশাখ বাঙালির রক্তে বেঁচে থাকবে।

মিলন মেলার সেই পাগল তার প্রশ্নের জবাব পাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE