Advertisement
০৫ মে ২০২৪
খেলাধূলা...

দিল্লির সে রাতে মনে হয়েছিল আমি অপদার্থ

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং।মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ সপ্তম কিস্তি। ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস কবুল করলেন।

সৌদি আরবের সঙ্গে সেই ম্যাচ।

সৌদি আরবের সঙ্গে সেই ম্যাচ।

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

আমি বরাবর ঈশ্বরে বিশ্বাসী। হাতটাত দেখাই একটুআধটু।

তো বিরাশির এশিয়াডের সামান্য ক’দিন আগে কিন্তু এক জন আমার হাত দেখে বলে দিয়েছিলেন, “তোমার এ বার হবে না।”

অরুণ (ঘোষ) একমাত্র ব্যাপারটা জানত। এত বছর বাদে কথাটা ফাঁস করলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বদা ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে গিয়েছিলাম, শেষমেশ পরম শক্তিমান আমাদের উতরে দেবেন দিল্লিতে! কিন্তু ভাগ্য আমার সঙ্গ দেয়নি।

অথচ আগে বারকয়েক ভাগ্যের আশীর্বাদ ফুটবলজীবনে পেয়েছিলাম। সন্তোষ ট্রফি খেলার আগেই আমি ভারতীয় দলে খেলেছি। ফিফার কোচিং কোর্স করার এক বছর পরেই জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছিই শুধু নয়, এশিয়াড ব্রোঞ্জ জিতেছি।

সাতষট্টিতে আমি অবসর নেওয়ার পরের বছরই ডেটমার ক্র্যামার এ দেশে এসেছিলেন কোচিং কোর্স করাতে।

ফিফার শর্ত ছিল, সেই কোর্সের ছাত্রকে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার হতে হবে। তার রাজ্যের সেরা ফুটবলার হতে হবে। আমি বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

পরে টোকিওতে গিয়ে আবিষ্কার হয়েছিল, মোহনবাগান বলেকয়ে চুনী গোস্বামীকেও ক্র্যামারের ফিফা ওয়ার্ল্ড কোচিং কোর্সে পাঠিয়ে দিয়েছে।

যদিও শেষমেশ মহম্মদ বাসা থিওরেটিক্যাল পেপারে ফার্স্ট আর আমি প্র্যাকটিক্যালে ফার্স্ট হয়েছিলাম। ক্র্যামারের একটা প্র্যাকটিক্যাল সেশন ছিল, যেখানে আমাদের পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে টিপ করে বারপোস্টে শট মারতে হত।

যে দিন আমি অমন শট দশটার মধ্যে ন’টা সঠিক মেরেছিলাম, ক্র্যামার সবার সামনে বলেছিলেন, “পিকে-ই ভবিষ্যতে ভারতের কোচ হবে।”

সত্যিই, এক বছর পরেই সেই সময়ের ভারতীয় ফুটবলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা বেচু দত্তরায় আমাকে ব্যাঙ্কক এশিয়াডে ভারতীয় দলের দায়িত্ব দেন।

তবে বাসাদাও দারুণ দক্ষ ছিলেন। ম্যাথমেটিক্সে এমএসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আমার বড় দাদার মতো ছিলেন। সত্তরের এশিয়াডে আমার প্রথম ইন্ডিয়া টিমকে কোচিং করানো থেকেই বাসাদা আমার সঙ্গী কোচ।


সৌদি আরবের সঙ্গে সেই ম্যাচ

ব্যাঙ্ককে জাপানকে হারিয়ে ভারত ফুটবলে ব্রোঞ্জ জেতার পর টিমের চিফ কোচ হিসেবে কোচিং স্টাফেদের মধ্যে শুধু আমার গলায় মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন সংগঠকেরা।

একটা কথা কেউ এত বছর ধরেও জানেন না সেই মেডেল আমি কিন্তু বাসাদাকে দিয়ে দিয়েছিলাম! কোচিং স্টাফের মধ্যে তিনি বয়সে সবচেয়ে বড় বলে।

ফলে ফুটবলার হিসেবে এশিয়াড মেডেল আমার থাকলেও, কোচ হিসেবে আমার কোনও মেডেল নেই বাড়িতে। যদিও সেই মেডেল আমি অর্জন করেছিলাম মাত্র আট বছর পরেই। বাষট্টির এশিয়াডে ফুটবলার হিসেবে সোনা, সত্তরের এশিয়াডে কোচ হিসেবে ব্রোঞ্জ।

কিন্তু বিরাশির এশিয়াডে ব্যর্থতা কোচ হিসেবে আমার সব অতীত সাফল্য নিজের মন থেকে যেন ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছিল।

সৌদি আরবের কাছে ছিয়াশি মিনিটের একমাত্র গোলে হারের সেই রাতে বারবার নিজেকে মনে হচ্ছিল, আমি এক জন অপদার্থ! ব্যর্থ কোচ! কোনও সাফল্যই নেই আমার! দেশকে কিছুই দিতে পারিনি! নিজেকে সারাক্ষণ ধিক্কার দিচ্ছিলাম।

এত বছর বাদে আজ স্বীকার করছি, বিরাশি এশিয়াডে ভারতীয় দলের ব্যর্থতা আমার কোচিং সত্তার সমস্ত আগ্রহ, যাবতীয় প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছিল।

তার পরেও আমি দু’দশক মাঝেমধ্যে ভারতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কখনও চিফ কোচ হিসেবে। কখনও টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হয়ে। ইন্ডিয়ার শেষ দায়িত্ব নেওয়া আমার ২০০৫ সাফ ফুটবলে পাকিস্তানে। নইমুদ্দিন চিফ কোচ ছিল। মূলত কোচকে সামলাতে আমাকে টিডি করে ওয়াঘার ও-পারে পাঠানো হয়েছিল। কড়া অনুশাসন অনুসরণ করা নইম বরাবর আমার সব কথা যা শুনতটুনত! অন্যদের পাত্তা দিত না।

যাক গে, যেটা বলছিলাম! দিল্লি এশিয়াডের পর যে কুড়ি-বাইশ বছর আমি মাঝেসাঝে ভারতীয় দলের দায়িত্বে এসেছি, সেখানে নিজের কাজে আমার বিন্দুমাত্র ফাঁকি না থাকলেও মনে-মনে বুঝতে পারতাম, সেই বিরাট কিছু করে দেখাবার স্বপ্ন, সেই আবেগ, সেই খিদে আমার ভেতর আর অবশিষ্ট নেই। গ্রামোফোন রেকর্ডের হ্যান্ডেলটা ধরে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে তাতে দমটা পুরো দিয়ে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু একটা সময় গ্রামোফোনটা যেন তাতেও ঘোরে না। তার থেকে গানের সুর ভেসে ওঠে না আর। ভারতীয় দলে আমার কোচিং কেরিয়ারের শেষের বছরগুলোতে আমার যেন সেই গ্রামোফোনটার দশাই হয়েছিল!

তখনও ক্লাব কোচিংটা মোটামুটি ভাল ভাবেই চালিয়ে গিয়েছি। কিন্তু ক্লাব আর আন্তর্জাতিক ফুটবলের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। সেটা সত্তরে প্রথম ইন্ডিয়া টিমের দায়িত্ব পাওয়া ইস্তক খুব ভাল বুঝে ফেলেছিলাম। মনে আছে, চুয়াত্তরে তেহরান এশিয়াডে জাতীয় দলকে কোচিং করানোর জন্য ইস্টবেঙ্গল থেকে কয়েক মাস ছুটি চাওয়ায় ক্লাবের সর্বেসর্বা কর্তা ডা. নৃপেন দাস বলেছিলেন, “এক সপ্তাহ বড়জোর ছুটি দিতে পারি। আর ইন্ডিয়া টিমে তো সবই তোমার ক্লাবেরই ফুটবলার। তার পর আবার আলাদা কোচিং কীসের দরকার? মাঝেমধ্যে টুক করে ইন্ডিয়া টিমে যাও আর কোচিং করাও। তা হলেই হবে।” বুঝুন ঠ্যালা!

এ রকম সব আজব প্রতিবন্ধকতা সামলে ভারতীয় দলের কোচিং করেছি। তাতেও ইন্দোনেশিয়ার কাছে মারদেকায় ১-৭ হারার পিঠোপিঠি পেস্তা সুকানে ওদেরই আমার ভারত ৫-১ হারিয়েছিল। মারদেকার ম্যাচটায় সেন্টার ফরোয়ার্ড মগন সিংহ খারাপ খেলায় প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে পেস্তা সুকানে ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে স্ট্রাইকারে নইমকে খেলিয়েছিলাম। ভারতের সর্বকালের অন্যতম ফাইনেস্ট স্টপার নইম সে দিন হ্যাটট্রিক করেছিল।

পেস্তা সুকান চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়াও আমার কোচিংয়ে সেই সময় মারদেকায় পরপর দু’বার ফাইনাল খেলেছে ভারত। এ সবগুলো কি আকাশ থেকে পড়েছে? ভারতীয় দল হীনমন্যতায় ভুগে কেবল আলট্রাডিফেন্সিভ খেললে কি এই সাফল্যগুলো আসত?

আবার নিজের রেস্তো না বুঝে লড়াই করলে কী সর্বনাশ হয় সেটা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম চুয়াত্তরে তেহরান এশিয়াডে। চিনের কাছে ০-৭ হেরেছিলাম।

ওদের রাইট আউট প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে আমার লেফট ব্যাক প্রবীর মজুমদারকে টপকে তিনটে গোল করেছিল। পরে আরও একটা। আসলে সে দিন প্রবীরের ওভারল্যাপিং দক্ষতার ভরসায় ওকে আমার খেলানোটা ভুল হয়েছিল। ভেবেছিলাম সাইডব্যাকের অ্যাটাকিং ক্ষমতাকে কাজে লাগাব।

প্রবীর আসলে লেফট উইং, লেফট হাফে খেলতে খেলতে লেফট ব্যাক হয়ে উঠেছিল। যার জন্য একটা সহজাত অ্যাটাকিং কোয়ালিটি ছিল খেলার মধ্যে। কিন্তু সেই লোভেই আমি সে দিন দলকে ডুবিয়েছিলাম।

একই সঙ্গে অন্য একটা শিক্ষাও পেয়েছিলাম নিজের রেস্তো বুঝে বিপক্ষের উপর ঝাঁপানো উচিত। সে দিন চিন প্রথম দশ মিনিটে ৩-০ এগিয়ে যাওয়ার পর রিজার্ভ বেঞ্চে বাসাদারা আমাকে টানা বলে যাচ্ছিলেন, “অ্যাটাক বাড়াও... অ্যাটাক বাড়াও। নইলে গোল শোধ হবে কী করে? কী ভাবে ম্যাচে ফিরব?”

সেটা শুনতে গিয়ে আরও চার গোল হজম করেছিলাম। পরে বাসাদা আমার কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, “প্রদীপ, তোমার ইনটিউশনকে আর কখনও অবজ্ঞা করব না।”

আরে মশাই, ব্রাজিল যে ব্রাজিল, তারা পর্যন্ত এ বার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিজেদের রেস্তো না বুঝে পিছন খুলে রেখে খেলতে গিয়ে জার্মানির কাছে সাত গোল হজম করল! ও সব হীনমন্যতা... আলট্রাডিফেন্সিভ... সাহসের অভাবটভাব-এর কথা মুখে বলা যতটা সহজ, যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে তার উল্টোটা করে দেখানো ততটাই কঠিন বাবা!

তবে এখন জীবনের এক রকম প্রত্যন্তে পৌঁছে যদি সত্যি সেটা যদি স্বীকার না করি, তা হলে আর কবে করব?

তাই সরাসরি বলছি, ক্লাব কোচিংয়ে আমার যে সাফল্য তার অর্ধেক সফল আমি ইন্ডিয়া টিমের কোচিংয়ে নই। তা হলে কি আমি আন্তর্জাতিক স্তরের কোচিংয়ের যোগ্য নই? তা-ও নয়।

তা হলে ইস্টবেঙ্গল কী ভাবে পিয়ং ইয়ং কিংবা ডক রো গ্যাংয়ের মতো প্রচণ্ড শক্তিশালী কোরিয়ান টিমের বিরুদ্ধে আমার কোচিংয়ে জিতেছিল?

অথবা, মোহনবাগান আমার কোচিংয়ে কসমস বা আরারাত ম্যাচে চিরস্মরণীয় সাফল্য পেয়েছিল? এত বছর পরে ওই ম্যাচগুলোর পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, ঘরের মাটিতে আমার ছেলেরা যতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত, বিদেশে গিয়ে ততটা পারত না।

আবার সত্তরের দশকে ভারতীয় দলে আমার কোচিংয়ের প্রথম দশ বছরে সুধীর, গৌতম, হাবিবরা যেমন আন্তর্জাতিক ম্যাচে নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার উদাহরণ রাখত, আশি-নব্বইয়ের দশকে কৃশানু-বিকাশ-সুদীপ-ভাইচুংরা অতটা পারেনি।

আসলে রাহুল দ্রাবিড় যতই দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান হোক, সচিনের চেয়ে যেমন নীচের লেভেলের, তেমনই কৃশানু-বিকাশরা যতই ভাল ফুটবলার হোক, গৌতম-হাবিবদের চেয়ে নীচের লেভেলের রয়ে গিয়েছে বরাবর।

অনেকটা সে কারণে ভারতীয় দলে আমার প্রথম ইনিংসের সাফল্যের মতো দ্বিতীয় ইনিংসে ভাল স্কোর নেই। যদিও তার মধ্যেও আমার কোচিংয়ে কৃশানু মারদেকায় হ্যাটট্রিক করেছে। প্রথম নেহরু কাপে আমার কোচিংয়ে ভারত চিন, কোরিয়ার সঙ্গে ড্র করা ছাড়াও যুগোস্লাভিয়ার মতো ইউরোপিয়ান দেশকে হারিয়েছিল।

আবার সত্তরের এশিয়াড সেমিফাইনালে যে দিন কোরিয়ার বিরুদ্ধে ২-০ এগিয়ে থেকেও চন্দ্রেশ্বর প্রসাদের ভুলে ২-৩ হেরেছিলাম, তার পরে ব্রোঞ্জ মেডেলের ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে প্রসাদকে বসিয়ে দিতে চাওয়ায় আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল সঙ্গী কোচ বাসাদার কাছে।

জাপানের কোচ ছিলেন আমারই কোচিং-গুরু ক্র্যামার। জাপানের বিশ্ববিখ্যাত স্ট্রাইকার কামামোতোকে আটকে দিয়েছিলাম সুধীর কর্মকারকে সাইড ব্যাক থেকে সরিয়ে এনে স্টপারে খেলিয়ে। ছ’ফুটের ওপর লম্বা কামামোতোকে আটকাতে গিয়ে সে দিন অবিশ্বাস্য খেলেছিল সাড়ে পাঁচ ফুটের সুধীর!

ক্র্যামার পর্যন্ত ম্যাচের শেষে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে এসে বলে গিয়েছিলেন, “আই অ্যাম ফিলিং প্রাউড টু লুজ এগেইনস্ট মাই স্টুডেন্ট’স টিম।” আর বাসাদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “প্রদীপ তোমার ইনটিউশনের জবাব নেই। ওটা তোমার কোচিং প্রজ্ঞার একটা স্পেশ্যাল অস্ত্র।”

আর একটা কথাও এখানে বলব। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইন্ডিয়া টিমকে আমি নাকি আলট্রাডিফেন্সিভ খেলিয়ে খেলিয়ে দলের আক্রমণাত্মক মেজাজটাই নষ্ট করে দিয়েছিলাম। তা হলে রহিম সাহেব কী করেছিলেন?

অত মহান কোচও ছাপ্পান্ন অলিম্পিকে যুগোস্লাভিয়া ম্যাচে মাঝমাঠে তিন জনকে রেখে খেলিয়ে ছিলেন ভারতকে। নিখিল নন্দীকে পর্যন্ত লেফ্ট ইনসাইডে খেলিয়ে মূলত মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে রেখেছিলেন। নুরও মাঝমাঠে। কেম্পিয়া রাইট হাফ। অনেক সামনে শুধু একা নেভিল ডি’সুজা। রহিম সাহেবের সেই স্ট্র্যাটেজিতে আমার স্বাভাবিক খেলার পর্যন্ত সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। একা পড়ে যাচ্ছিলাম। বলই পাচ্ছিলাম না। তাতেও আটষট্টি মিনিট পর্যন্ত ভারত এক গোলে এগিয়ে ছিল।

আসলে এখানেও সেই অকাট্য যুক্তি, যা রহিম সাহেবের আমলে ছিল, আবার আমার সময়েও ছিল নিজের রেস্তো বুঝে লড়াই করো।

সে দিন ডিফেন্সে রহমান টানা লড়তে-লড়তে শেষের দিকে ক্লান্ত হয়ে না পড়লে আমরা ১-৪ হারতাম না। রহমান ক্লান্তিতে একটা করে ড্রিবল করতে যাচ্ছে অপোনেন্টের অ্যাটাকারকে আর বল জমা দিচ্ছে। এবং একবার করে বিপক্ষের পায়ে বল জমা পড়ছে আর সেটার থেকে একটা করে গোল খাচ্ছে ভারত।

সে দিন শেষ মিনিট কুড়ি সামলে দিতে পারলে ভারত অলিম্পিক ফাইনালে উঠে যেত। সোনা বা রুপো সিওর। সে ক্ষেত্রে ভারতীয় ফুটবলের চালচিত্রটাই পাল্টে যেত।

তার বদলে এখনও ভারতীয় ফুটবল, সর্বভারতীয় ফুটবল কর্তারা জগদ্দল পাথর হয়েই রয়েছে। বিদেশি কোচেরাও কিছু দিন কাটিয়ে বুঝে ফেলেন, এই আবহে তাদের দ্বারা বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয় এখানে। কোভারম্যান্স তার টাটকা উদাহরণ। সাহেব যেই বুঝলেন, আর কিছু করতে পারবেন না, পালালেন। ভারতকে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে আরও নামিয়ে দিয়ে।

আমার মতো জাত্যভিমানে ভরপুর ভারতীয়ের পক্ষে জাতীয় দল ফেলে পালানো সম্ভব ছিল না। তাই নিজের কাজে বিন্দুমাত্র ফাঁকি না মারলেও, সমালোচকদের গালাগালের টার্গেটটা আমিই হয়েছি সর্বদা। কী আর বলব, আমার অদৃষ্ট!

নইলে বিরাশির এশিয়াডের আগে যখন কোরিয়ায় একটা প্রস্তুতি টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম, তখন আমার টিম কী দুর্দান্ত ফর্ম আর কন্ডিশনে! কারও চোট নেই। পুরো ফিট টিম। যারা পুরো শক্তির পিএসভি আইন্দোভেনের মতো পৃথিবী বিখ্যাত ডাচ টিমের সঙ্গে ২-২ করে এসেছিল। দুটো গোলের একটা হরজিন্দর আর একটা সাব্বির করলেও খেলেছিল বটে প্রসূন! বাঁ পায়ে একবার করে বল অপোনেন্টের দিকে বাড়িয়েই সেটাকে ছোঁ মেরে ফের কেড়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণে গিয়েছে যে কত বার তার ইয়ত্তা ছিল না সে দিন।

ইঁদুর-বিড়াল খেলার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। কিন্তু দেখেছেন কি? প্রসূন আইন্দোভেনের বিখ্যাত ফুটবলারদের সঙ্গে সেই ম্যাচে ওই রকম ইঁদুর-বিড়াল খেলেছিল। বিড়াল একবার নিজের মুখে ইঁদুরকে ধরেই তাকে ছেড়ে দিয়ে যেই সেটা পালাতে যায়, খপ করে আবার মুখে পুরে নেয়। এতটাই বিড়ালের ‘রিচ’ আর সেই রিচের গতি!

প্রসূনও সে দিন বাঁ পায়ে সে রকমই অবিশ্বাস্য ‘রিচ’ আর গতি দেখিয়েছিল অসংখ্যবার। এগুলো কী আর দিনের পর দিন কোচিং ছাড়া শুধু শুধু কারও প্রাপ্ত হয়? না কি আকাশ থেকে কারও কোলে এসে পড়ে!

অথচ সেই টিমটাই আসল সময়ে কী ভাবে ভেঙে পড়েছিল! স্রেফ একটা ম্যাচে। শেষ পনেরোটা মিনিট!

ওহো, ঈশ্বর! বত্রিশ বছরেও দিল্লি এশিয়াডের স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আমার বুকে এতটুকু কমল না!

(চলবে)

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pradipkumar bondhopadhyay supriya mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE