ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
ঝপ করে আসা এই নৈঃশব্দ্য, এই অন্ধকারটা অসহ্য। ক’দিনের জন্য স্বপ্ন-স্বপ্ন হয়ে ওঠা চার দিক। রাস্তাঘাটে সবার মুখ ঝলমলে, মেজাজ মোলায়েম। পাড়ার ইঁট বার করা, অপরিচ্ছন্ন, সরু রাস্তা টুনিবাল্বে সেজে সাক্ষাৎ বেহস্ত।
তার পরই আচমকা অন্ধকার! উৎসব শেষ। বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে, কান্না পায় ভীষণ। অষ্টমীর রাত পার হলেই কষ্টটা দলা পাকাতে থাকে পারমিতা-অনুত্তমাদের। সারা বছর একটানা সংসারের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। কাজের লোক, বরের অফিস, মেয়ের কোচিং, ফ্যামিলি পলিটিক্স, টিভি-র সিরিয়ালের রুটিনবদ্ধ দুনিয়া।
উৎসবের আগের এক-দেড় মাসে পাল্টে যায় তাঁদের পৃথিবী। ফ্ল্যাটবাড়ির কমিউনিটি হলে রিহার্সাল শুরু। বাচ্চাদের নাচের স্টেপ তোলানো, নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা, সবাই মিলে কস্টিউম বানাতে দিতে যাওয়া—সব ঠিক করা।
পাশাপাশি পুজোর আয়োজন, ফল কাটা, ভোগ সাজানো, মাঝরাত পার করে আড্ডা-গান। “এই একটা সময় আমার আমিকে খুঁজে পাই। মনে হয়, আমি ঘরে বসে থাকা একটা ফালতু মানুষ নই। উৎসব শেষ মানে আবার ক্লিশে দৈনন্দিনতায় ঢুকে পড়তে বাধ্য হওয়া। ভীষণ কষ্ট হয়।”— বলছিলেন সল্টলেকের পারমিতা।
এক বছর ধরে এই উৎসবের মরসুমের জন্য এত অপেক্ষা, এত পরিকল্পনা। অথচ, আসামাত্র চোখের নিমেষে দিনগুলো পেরিয়ে যায়। এর থেকে বরং আসছে-আসছে, হবে-হবেই ভাল। এসে গেলেই শেষ। আর সেই শেষ হওয়ার প্রাথমিক অভিঘাতে গুঁড়ো হয়ে যায় অনুভূতি। কাঁকুরগাছির ফাঁকা মণ্ডপের সামনে গোল হয়ে আড্ডায় বসা সায়ন্তনী, রূপ, আদিত্য, মীরা, তরু-রা নিজেদের পর্যবেক্ষণের কথা শোনাচ্ছিল— “রবিবার ফুরিয়ে এলেও আমাদের অনেকটা এই রকম কষ্ট হয়, কিংবা কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের বিয়েতে খুব হুল্লোড়ের পর অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করে। এই উৎসবের মরসুম তুলনায় দীর্ঘতর বলে হয়তো তা ফুরিয়ে যাওয়ার পরের মনখারাপ আরও গাঢ়।”
বরানগরের শিক্ষিকা মোনালিসার একটা নিজস্ব থিওরি রয়েছে। সেই থিওরি বলে, উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক ধাক্কা যাতে মন সামলাতে পারে সেই জন্যই প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় শোভাযাত্রা, নাচ-গান, সিঁদুরখেলা, ভাঙ খাওয়া, পরিচিত বাড়ি ঘুরে মিষ্টিমুখ-প্রণামের মতো প্রথার প্রচলন। উৎসবের রেশ যতটা টেনে নিয়ে যাওয়া যায়, মন ভার হওয়া যতটা ঠেকিয়ে রাখা যায় আর কী। কিন্তু তা-ও ইদানীং উৎসবের মরসুম শেষে খুব কষ্ট হয় অমিতাভ ভট্টাচার্যের। পেশায় চিকিৎসক অমিতাভ আটষট্টি পেরিয়েছেন। এখন বার-বার মনে হয়, পরের উৎসব কি দেখতে পারবেন? এটাই প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো শেষ পুজো বা উৎসব নয় তো? সময়গুলো দু’হাতে আটকে রাখতে চান। তা-ও এক সময় খালি মণ্ডপে একা প্রদীপ জ্বলে ওঠে।
ফাঁকা মণ্ডপের ধারেকাছে থাকতে চান না শ্রীরামপুরের দেবায়ন মিত্রের মতো অনেকে। থাকলেই মায়ের কথা মনে পড়বে, দাদাইয়ের কথা মনে পড়বে, যাঁরা এক সময় ঘিরে ছিলেন, এখন নেই, সেই সব কাছের মানুষদের কথা বেশি-বেশি করে মন বোঝাই করে আসবে।
মনে পড়বে মা প্রতিমা বরণ করছেন, পানপাতা আলতো করে মূর্তির দুই গালে বুলোচ্ছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। কেন কাঁদতেন? দুর্গা শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাচ্ছেন বলে? দুর্গা চলে যাওয়া তো প্রতীকী। আসলে সেই অনুসঙ্গ ধরে নিশ্চয়ই চলে আসত অনেক মানুষ, মহার্ঘ মুহূর্ত হারিয়ে ফেলার স্মৃতি।
প্রতিমা লরিতে ওঠানোর পর থেকেই একের পর এক ছবিগুলো মনে পড়তে থাকে অনিন্দিতার। দিদার হাত ধরে ঠাকুর-বরণ দেখতে যাচ্ছে, বাবা গঙ্গার ধারে ঘাড়ের উপর বসিয়ে প্রতিমা জলে ফেলা দেখাচ্ছেন, বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় বিজয়া দশমীর ফাংশান, দেদার নাড়ু-ঘুঘনি খাওয়া। হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য উৎসব মুহূর্ত ফিরে আসবে না কখনও। কান্না পায়।
উৎসব শেষ মানেই অভিনন্দন, তিতাসদের ফেরার সময় হয়ে গেল। বছরে মাত্র একবার বিদেশ থেকে বাড়ি ফেরা। সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন বাবা-মা, ছেলে বা মেয়েকে একবার সামনাসামনি দেখা, ছোঁওয়ার জন্য। আবার লম্বা বিচ্ছেদের শুরু। মন ভাল থাকা সম্ভব?
পরম শান্তিতে কয়েকটা দিন কাটানোর পর আবার অসহ্য অফিস শুরু। ঋক, দিয়া, দেবদত্তদের সামনে খুলে যায় হোমওয়ার্কের খাতা। শিবানী মাসি, অনিতা মাসিদের আবার কাজের বাড়ি যেতে হয়। মনখারাপ যায় সবার পিছুপিছু।
আসলে মনখারাপের শুরু শুধু উৎসব শেষ হলে নয়, বরং বলা যায় উৎসবের মরসুমের আরম্ভের থেকেই। এই সময় একা মানুষের আরও বেশি করে একাকিত্বের অনুভব হয়।
আবার চার দিকে সমবেত হুল্লোড়ের মাঝে বন্ধুহীন মানুষটির নিজেকে নেহাত ব্রাত্য মনে হতে থাকে। মনে হয়, উৎসব থেকে পালিয়ে খাটের তলায় ঢুকে যাই। পুরনো কথা, অতৃপ্তি, আফসোস, না-পাওয়া, পুরনো সম্পর্কের টান বড্ড বেশি নাড়া দেয়।
আহিরিটোলার একটি মেয়ে, বাংলা মাধ্যম স্কুলের মধ্যম মানের ছাত্রী। বন্ধুবান্ধব কম। পুজোর সময় তারও খুউব ইচ্ছে করত বাড়ির সামনে দিনরাত স্রোতের মতো ভেসে যাওয়া খুশিয়াল মানুষের ভিড়ে মিশে হইহই করে হেঁটে বেড়াতে। কিন্তু সঙ্গী পেত না। নব্বইয়ের দশকের সেই কিশোরী এখন কলকাতার এক কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা। এখন পুজোয় তাঁর সঙ্গে বেরোনোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু ইচ্ছেটায় চড়া পড়ে গিয়েছে। “এখনও যখন আলোর মালায় সাজানো রাস্তায় একদল কিশোর-কিশোরীকে আনন্দে ঝলমল করতে-করতে হাঁটতে দেখি, পুরনো সেই না-পাওয়াটা মুচড়ে ওঠে।”— বলেন মধ্য তিরিশ পার করা সেই অধ্যাপিকা।
উৎসবের সঙ্গে আসা পুরনো আনন্দের স্মৃতিও দুঃখ নিয়ে আসে। “শরতের বাতাসে এমন একটা গন্ধ রয়েছে যা উদাস করে দেয়, পুরনো অনেক কথা মনে পড়িয়ে মন খারাপ করে দেয়, কী যেন চেয়েছিলাম, কী যেন পাইনি, সব মাথায় ভিড় করে আসে”— বলছিলেন প্রবীণ লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
শরীর এখন বেশ খারাপ তাঁর। কোথাও বেরোনো বা ঘোরা হয়ে ওঠে না। দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী মায়ের কাছে গিয়ে উৎসবের দিনগুলি কাটিয়ে আসেন। লেখিকার কথায়, “আজকাল পুজোর মরসুমটায় ছোটবেলার কথা, ভাই-বোন-বন্ধুদের কথা, মারা যাওয়া আত্মীয়-পরিজনদের কথা মনে পড়ে। খুব কষ্ট হয়।”
এক সময় বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে গোটা কলকাতা ঘুরে বেড়াতেন অভিনেতা আবীর চট্টোপাধায়। তখন সবাই ঝাড়া হাত-পা। পকেটে পয়সা কম, কিন্তু মনে অফুরান খুশি। এখন উৎসবের কোনও একটা দিন সেই বন্ধুদের এক জায়গায় করতেই কালঘাম ছোটার জোগাড়। দামি মদ, দামি খাবার থাকে, কিন্তু মন বোঝে আবেগ-অন্তরঙ্গতার যাবতীয় ফাঁকিবাজি।
বুকের ভিতরটা খালি হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy