Advertisement
০৩ মে ২০২৪

বিয়েগাউনি

ওঁরা গান বাঁধেন। ঢোলক নিয়ে মাত করেন শাদির আসর। এঁরা কারা? খোঁজ পেলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়টিকটিকি পাড়া। মুর্শিদাবাদ। আপাতত এখানেই আস্তানা আদতে বর্ধমানের মেয়ে গোলেমন বিবি-র। বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। প্রায় কুড়ি বছরের বড় বর। আগের পক্ষের দু’-দু’টো বৌ পালিয়েছে ছেলেমেয়ে রেখে। প্রতি রাতে বর আর দুই ভাশুর মিলে পালা করে ধর্ষণ করত তাঁকে। একজন যখন কাজ সারত, বাকি দু’জনে বসে দেখত উদোম হয়।

জীবনের বিয়েগাউনিরা

জীবনের বিয়েগাউনিরা

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

টিকটিকি পাড়া। মুর্শিদাবাদ। আপাতত এখানেই আস্তানা আদতে বর্ধমানের মেয়ে গোলেমন বিবি-র।

বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। প্রায় কুড়ি বছরের বড় বর। আগের পক্ষের দু’-দু’টো বৌ পালিয়েছে ছেলেমেয়ে রেখে।

প্রতি রাতে বর আর দুই ভাশুর মিলে পালা করে ধর্ষণ করত তাঁকে। একজন যখন কাজ সারত, বাকি দু’জনে বসে দেখত উদোম হয়।

শরীর গরম হলে আবার ঝাঁপাত গোলেমনের উপর।

চার বছর সহ্য করে একদিন পালান গোলেমন। হাঘরে এক ফকিরের সঙ্গে। এক দিন সেই সঙ্গও কাটল। এ বার শুরু একা বেঁচে থাকার লড়াই। আর গান বাঁধা।

দিনমানের সব কষ্ট, হতাশা, অভিমান, রাগ কথায় আর সুরে গেঁথে ফেলতে লাগলেন নিরক্ষর গোলেমন। পাড়া-পড়শি-পরিচিতের বিয়ের আসরে ঢোল বাজিয়ে সেই গানই গেয়ে বেড়াতে লাগলেন। গোলেমনের নতুন পরিচয় এখন ‘বিয়েগাউনি’।

মুর্শিদাবাদেরই দীঘল গ্রামের হারানি। বয়স ছেচল্লিশ পেরিয়েছে। বরের নাম সাবুজান। তাঁদের একমাত্র মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পুড়িয়ে মেরেছে। দুই ছেলে। তাঁরা বৌদের নিয়ে ভেগে গেছে।

সাবুজান বেরোজগার। অর্ধেক দিন বাড়ি ফেরেন না। যেদিন ফেরেন সে দিন নেশায় চুর। হারানির টানাটানির সংসারে উনুন জ্বালা দায়। পেটের আগুনে মরিয়া হয়ে চুল বেঁধে হাইওয়ের ধারে দাঁড়াতেন হারানি। ট্রাকওয়ালারা গাড়িতে তুলে নিত। ফিরিয়ে দিত তিন-চার ঘণ্টা পর, হাতের মুঠোয় টাকা গুঁজে।

বাড়ি ফিরে ঘুম আসত না হারানির। গুনগুন করে সুর ভাঁজত। বুকের ভিতরটা পুড়ে-নিংড়ে একের পর এক শব্দ উঠে আসত ঠোঁটে। গান তৈরি হত। তার পর বিয়ের আসরের বায়না আসা শুরু হল সেই ‘গীত’ গাওয়ার। সেই থেকে আর শরীর বেচে না হারানি। আজ যে সে বিয়েগাউনি।

ভরতপুর মীরে পাড়ায় বাহাত্তুরে বুড়ি ওলেমা বেওয়া-র বিয়েগাউনি দল। মূল গায়িকা এখনও তিনিই। সঙ্গে সাবেরা বিবি, তকিরা বিবি, তৈয়বা বিবি, হানিফা বিবি, কালোজিরে বিবি, অঞ্জুরা বিবি আছেন। সকলেই ওলেমার জ্ঞাতি।

সকলেই বিড়ি বাঁধেন। এর পর ধান সিজোনো, ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চালের আটা কোটা, চাটাই বোনা, পাখা তৈরি করা, নকশি কাঁথা সেলাই-এর মতো হাজারো কাজ আছে। এত করেও সংসারে অভাব আর যায় না!

দিনের শেষে এঁরা গানে বসেন। তখনই মনের খোরাক জোটে। ওলেমা, তৈয়বা-রা বলেন, “আল্লা-র যদি জ্বালায়ে-পোড়ায়ে এত সুখ, তা হলে আমরাই বা কেন মনের সুখে গান গাব না? বিয়ে লাগুক-না লাগুক মন চাইলেই ঢোল লিয়ে বসে পড়ি। ঢোল আর গীত ছাড়া আমাদের আর আছে কী! দুখের পাহাড় ঠেলছি গো, ঢোল সঙ্গে করে।”

মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমানের গ্রামেগঞ্জে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন এই বিয়েগাউনিরা, রয়ে গিয়েছে তাঁদের গান। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রামীণ মুসলিম পরিবারে বিয়ের দিনে ডাক পড়ে এঁদের। অনেক সময় বায়না-র তোয়াক্কা না করে বিনে পয়সাতেই পড়শির বিয়েতে চার-পাঁচ দিন যেচে গান গেয়ে আসেন এঁরা।

তবে নামেই বিয়ের গান। আসলে যেন রোজকার চালচিত্র। কী নেই তাতে!— পারিবারের হিংসা থেকে বালবিবাহ থেকে খুন-জখম-পুলিশি হুজ্জুতি, সব!

জেলায় জেলায় এই বিয়েগাউনিদের যিনি খুঁজে ফেরেন, তিনি রত্না রশিদ। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ইংরাজি-দিদিমণি।

অসুস্থ শরীরেও প্রায় ৩৯ বছর মুর্শিদাবাদ থেকে বীরভূম চষে বেড়িয়েছেন রত্না। ইতিমধ্যে চারখণ্ডে বইও লিখেছেন এঁদের নিয়ে।

বর্ধমান শহর থেকে প্রায় ১৭-১৮ কিলোমিটার দূরে কোমলপুর গ্রাম। সেখানে দিন কয়েক আগে হাজির হয়ে দেখা মিলল জনাকয়েক বিয়েগাউনির সঙ্গে।

মাস্টারমশাই শেখ ইদবক্স-এর বাড়ি। চওড়া মাটির দাওয়া। তাতেই বিছানো মাদুর। মাদুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ওঁরা। জাহানারা, সাফিয়া, অঞ্জুমানারা, লায়লি, মর্জিনা, পিয়ারি, মনোয়ারা।

জাহানারার হাতে ঢোলক। ততক্ষণে বিভোর হয়ে আছেন গানে। একের পর এক গান গাইছেন ওঁরা... “ওল বনেতে তুলতে গেলাম ওই না জবা ফুল/ ফুল না তুলিতে যেয়ে আমার এলিয়ে গেল মাথার চুল। পেটি পেরে বাঁধব মাথা, বসব বাজারে/ শত-শত লোক যাবে মা, দেখবে আমারে....।” আবার কখনও “হায় রে আমার কচুবাড়ির পুঁইশাক, কলায় না হলে মজবে না/ হায় রে আমার বড় দিঘির বড় মাছ/ পেঁয়াজ না হলে রচবে না...।”

গলসি থানার আসকরণ গ্রামে শ্বশুরবাড়ি জাহানারা আর সফিয়া-র। বিয়ের গান গাওয়ায় নিষেধ জারি করেছে শ্বশুরবাড়ি। বাড়ির বৌ আবার লোকের দাওয়ায় গিয়ে গাইবে কী! বেহদ্দপনা! মিথ্যে বলে, লুকিয়ে পালিয়ে আসেন জাহানারা-রা। বসে পড়েন ঢোল নিয়ে।

বছর সাতচল্লিশের অঞ্জুমানারা বিধবা হয়েছিলেন সতেরো বছর বয়সে। পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন। সম্পন্ন গেরস্ত বাড়িতে সারাদিন ধান-মুড়ি-চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজার কাজ করতেন। পাটের সময় পাট কাচতেন, কাচতে-কাচতে পচা পাটের গন্ধে বমি আসত। তাতে আবার সুবিধেও ছিল। বাড়ি ফিরে ভাত মুখে রুচত না। খাবারের খরচ যেত বেঁচে।

সন্ধেবেলা বিড়ি বাঁধতেন। ক্লান্তিতে ঝিমুনি এসে মাথা ঠক্ করে পড়ত কোলে রাখা কুলোয়। বিড়ির মশলায়। চোখ জ্বলে হেঁচে-কেশে ঘুম পালাত। এক হাজার বিড়ি বাঁধালে মজুরি চোদ্দো আনা। যে দিন মহাজন মজুরি বাড়িয়ে এক টাকা দিলেন, সে দিন পায় কে! আনন্দে নতুন গান লিখে ফেললেন অঞ্জুমানারা, “হাজার বিড়ি ষোলো আনায়, এমুন সুযোগ হয় না/ ছেলেপুলে জুটিয়ে নিয়ে বাঁধো বিড়ি ময়না...।”

বছর চল্লিশ আগে বীরভূমের পালিটা গ্রামে ননদের বিয়েতে গিয়ে এই বিয়েগাউনিদের প্রথম দেখা পান রত্না।

হিন্দু পরিবারের মেয়ে রত্না বিয়ে করেছিলেন মুসলিম ছেলেকে। গ্রামের বিয়েবাড়ি গিয়ে দেখেন, পড়শি মহিলাদের একটা দল রোজ এসে সবার হাতের কাজ কেড়ে নিজেরাই করে দিচ্ছেন। মন-মন মুড়ি ভাজা হয়ে যাচ্ছে। মশলা কোটা, রান্না করা, ডাঁই বাসন মাজা, অতিথিদের বাচ্চা সামলানো, কাপড় কাচা নিঃশব্দে হয়ে যাচ্ছে।

মঞ্চের বিয়েগাউনি

বিয়ের সব লোকাচার তাঁরাই হাতে হাত মিলিয়ে করছেন। আর প্রতিটি কাজের সময় একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছেন।

হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে প্রতি সন্ধ্যায় ক্লান্তি উড়িয়ে ঢোল নিয়ে গীতের আসর বসাচ্ছেন ওঁরা।

রত্না বলতে থাকেন, “একটা ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে। বছর সাতাশ-আঠাশের একটি মেয়ে। বাজেরা বিবি। চারটি সন্তান। একজন তার পাশে ঘুমে কাদা, আরেকটি ঘ্যান ঘ্যান করে মায়ের বুকে-পিঠে ঘুষি মারছে আর অন্য আরেক বুকের দুধ খাচ্ছে। সারা দিন বিয়ে বাড়িতে খেটে ওই অবস্থাতেও বাজেরা ঢোলটা ডান হাঁটুতে চেপে বাজাচ্ছে। আর বুঁদ হয়ে গান গাইছে। আশ্চর্য আলো খেলে যাচ্ছে ওর মুখে।”

এঁদের দেখতে দেখতেই এক সময় ওঁদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন রত্না। বলতে গেলে তাঁর জোগাড় করা তথ্য নিয়েই থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর নাটক তৈরি হয়েছে ‘বিয়েগাউনি কাঁদনচাঁপা।’

নাট্যকার চন্দন সেন বাবার চাকরিসূত্রে অনেক দিন পলাশিতে ছিলেন। সেখানেই প্রথম বিয়েগাউনিদের দেখেন। পরে নাটক লেখা শুরু করার আগে আবার পলাশি ফিরে গিয়ে বেশ কিছু অমন মহিলার খুঁজে পান। বলছিলেন, “আসলে কী জানেন, এই গানটা ওঁদের ক্ষেত্রে ক্যাথারসিসের কাজ করে। যাবতীয় বেদনা, দুঃখ, ক্ষোভ গানের মধ্যে দিয়ে গলে বেরিয়ে আসে।”

পরিচালক অশোক মুখোপাধ্যায় শোনালেন, নাটকে মনোয়ারা নামে একটি চরিত্র রাখা হয়েছে যার সঙ্গে রত্না রশিদের মিল পাওয়া যায়।

মনে পড়ে যাচ্ছিল জুলেখা বিবি-র কথা। ছেলেটা মরল। বর চলে গেল অন্য মেয়ের সঙ্গে। জুলেখা চোখ দু’টো নামিয়ে বলেছিলেন, “স্বভাব-ইচ্ছায় কখনও শরীর দিইনি। কিন্তু ভাতের অভাবে সেই দেমাকও আমার রইল না। তিন-চার দিন না খেয়ে মুখের ভিতর যখন তিতা পানি বেরুতে থাকল, তখন আমার শরীর নিয়ে ছুঁছিবাই কপ্পুর হয়ে মিলিয়ে গেল।”

সেই জুলেখা ক্রমে বিয়েগাউনি হয়ে নিজের দল খুলেছিলেন। আর শরীর দিতে হয়নি তাঁকে। বায়নার টাকাতেই এখন চলে যায় তাঁর।

ঢোলের তালে কান্নার সমুদ্র পার হয়ে জীবনকে আলিঙ্গন করছে বিয়েগাউনির দল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patrika parijat bandyopadhyay anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE