Advertisement
E-Paper

বড়ে গোলাম আলির গাওয়া পছন্দ না হওয়ায় দ্বিতীয় বার রেকর্ড করান

এতটাই স্পষ্টবক্তা ও আপসহীন ছিলেন বিকাশ রায়। তাঁর কথা বলছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়আমি চলে যাচ্ছি, আমায় মনে রাখবেন। তাঁর বাঁ হাতে ধরা কালো ছড়িটি কেঁপে উঠল।—এ ভাবেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিকাশদা। অনেকেরই মনে হয়েছিল, বহু স্বপ্নভঙ্গের অভিমান এবং ব্যথা থেকে বিকাশ রায় রেডিয়ো, টিভি, মঞ্চ, মাস মিডিয়ার রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কারও কারও ধারণা হয়েছিল, বিকাশ রায় বয়সের জন্য সরে গেলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমি জানতাম মুখে কোনও নালিশ না জানালেও টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়া আর তার লোকজনকে ঘিরে ওঁর দুঃখবোধ, অভিমান যথেষ্টই ছিল।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০০:১৫

আমি চলে যাচ্ছি, আমায় মনে রাখবেন।

তাঁর বাঁ হাতে ধরা কালো ছড়িটি কেঁপে উঠল।

—এ ভাবেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিকাশদা।

অনেকেরই মনে হয়েছিল, বহু স্বপ্নভঙ্গের অভিমান এবং ব্যথা থেকে বিকাশ রায় রেডিয়ো, টিভি, মঞ্চ, মাস মিডিয়ার রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ালেন।

কারও কারও ধারণা হয়েছিল, বিকাশ রায় বয়সের জন্য সরে গেলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমি জানতাম মুখে কোনও নালিশ না জানালেও টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়া আর তার লোকজনকে ঘিরে ওঁর দুঃখবোধ, অভিমান যথেষ্টই ছিল।

আমায় বারবার বলতেন, “আমি চাই না আমার কোনও সন্তান এই অভিনয় জগতে আসুক। আমাদের পরিবারে আমাকে দিয়ে যা শুরু তার শেষও যেন আমাকে দিয়েই হয়।’’

আমার চোখে অন্তত এই সরে যাওয়া, এই স্ব-নির্বাসন নিজেকেই যেন তীব্র তিরস্কার করার মতো ছিল।

বিকাশদা সাত ঘাটের জল খাওয়া মানুষ। ১৯৩৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি এ পাস করেছিলেন। ওই কলেজে রবীন্দ্র পরিষদের সহকারী সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ওঁর উৎসাহেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেসিডেন্সি কলেজের সাহিত্য সভায় কবিতা পাঠ করেন। তখন কবির কাব্যগ্রন্থ ‘পুনশ্চ’র কাব্যছন্দ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলছে।

বিকাশদা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের বরাহনগরের বাড়ি গিয়ে কবিকে প্রথম দেখেছিলেন। জীবনের শেষ অবধি সেই দেখার কথা বলতেন।

একবার জানতে চেয়েছিলাম, “কেমন লেগেছিল আপনার কবিকে দেখে?” বিকাশদা আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, “মনে হল তীর্থে গিয়েছি। আর তীর্থ-দেবতা দয়া করে দর্শন দিয়েছেন।”

প্রেসিডেন্সি থেকে পাশ করার পরে ঠিক করেছিলেন ওকালতি করবেন। সেই মতো ১৯৪১-এ ল’পাশ করেন। চকচকে কালো কোট আর ঝকঝকে গাউন চাপিয়ে কোর্টে যাতায়াত করে বুঝেছিলেন ওকালতি তাঁর দ্বারা হবে না। অথচ আমার মনে হয় ওঁর মতো ভাল আইনজ্ঞ খুব কম লোকেই হতে পারতেন।

উত্তরফাল্গুনী

একটা অন্য ঘটনা বলি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনেতৃ সংঘ’ ভেঙে যায়। অনেকে তো তখন উত্তমকুমারকে ‘চোর’ বলে গালি দিয়েছিলেন। বিকাশদা উত্তমকুমারের পাশে এসে দাঁড়ান। উত্তমকুমারের নেতৃত্বে জহর গাঙ্গুলি আর বিকাশদা মিলে তৈরি করেন ‘শিল্পী সংসদ’। কেন অভিনেতৃ সংঘ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হল সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য ক্যালকাটা প্রেস ক্লাবে একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়। ওই সভায় শিল্পী সংসদ-এর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভার পড়েছিল বিকাশ রায়ের ওপর। সাংবাদিকদের ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্নে কী আশ্চর্য কৌশলে বিকাশদা জবাব দিয়েছিলেন, আজও মনে আছে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শিল্পীরা রাজনীতিকদের পথে কোনও দিনই হাঁটবেন না। তাঁদের প্রতিবাদ হবে নাট্যমঞ্চে। মনুমেন্টের নীচে ঝান্ডা ঘাড়ে করে নয়।

সোজা কথাটা সোজা করে বলতে জানতেন বিকাশদা। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে। ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে নায়কের গলায় বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে ‘আয়ে ন বলম’ গাওয়ানোর বড় সাধ ছিল পরিচালক বিকাশ রায়ের। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তবে প্রথম রেকর্ডিং তাঁর পছন্দ হল না। সেটা অত্যন্ত বিনয়ের সুরে তিনি বড়ে গোলামকে জানিয়েওছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ছবির দৃশ্য অনুযায়ী তাঁর গান গাওয়া ঠিক হয়নি। ওঁর কথায় বড়ে গোলাম দ্বিতীয়বার গান রেকর্ডিং-এ বসেন। তারপর বিকাশদার মনে হয়েছিল সেই গানে সুরমণ্ডল থেকে সুরের ঝর্না নেমে এল।

এরকমই আরেকটি ঘটনা। চন্দ্রাবতী দেবী অভিনয় করবেন ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে। ভৈরবী চরিত্রে। পরিচালক বিকাশ রায়। তিনি চেয়েছিলেন ‘ভৈরবী’ যেন একদম নো-মেকআপ লুকে থাক। সেই মতো চন্দ্রাবতী দেবীকে সাবধানও করেছিলেন বহুবার। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বিকাশদাকে লুকিয়ে যেই না চন্দ্রাবতী দেবী মুখে পাউডারের প্রলেপ লাগিয়েছেন, অমনি সকলের সামনে বিকাশদা প্রচণ্ড ধমক দিলেন মেক-আপম্যানকে। শেষ পর্যন্ত প্যারাফিন দিয়ে মেক-আপ তুলতে হয়েছিল। কাজের সময় স্পষ্টবক্তা বিকাশদা কোনও আপস করতেন না।

১৯৫২ সালে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিখবেন বলে সামান্য পারিশ্রমিকে ‘চিরকুমার সভা’য় অভিনয় করেছিলেন বিকাশদা। কিন্তু নাটকে তাঁর মন বসেনি। বলেছিলেন, “মঞ্চে চড়া অভিনয় করে লোকে ক্ল্যাপ পায়, আমি অমন অভিনয় পারব না।”

‘সূর্যমুখী’ ছবির শুটিং চলছে। ছবি বিশ্বাসের সূর্যের আলোয় শট দেওয়ার কথা। এ দিকে সন্ধে নেমে এল। লোক পাঠিয়েও ছবি বিশ্বাস তো নয়ই, যাঁরা তাঁকে ডাকতে গিয়েছিলেন, তাঁরাও ফিরছেন না। বিকাশদা রেগে আগুন। ছবিদা সন্ধের পর এসে বললেন, “রাগ করিস না রে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠানোর কাজ চলছিল যে। আমি চুমকি বসাচ্ছিলাম। আর তোর ছেলেদেরও কাজে লাগিয়েছিলাম, ওদের বকিস না।” ছবিদাকে সেদিন বিকাশদা কিছুই বলতে পারেননি। এমনই অন্ধ ভালবাসা ছিল ওঁর প্রতি।

অন্য দিকে পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গে ছিল বিকাশদার রাগ-অনুরাগের সম্পর্ক। পাহাড়ী সান্যাল প্রায়ই ‘হারামজাদা’ বলে ডাকতেন বিকাশদাকে। পাহাড়ী সান্যাল ছিলেন লখনউ-এর বাসিন্দা। তো লখনউ-এর নাম করে বিরূপ কিছু বললেই উনি খেপে যেতেন। বিকাশদা কিন্তু সেটাই করতেন।

অভিনয়ে আসার আগে রেডিয়োয় প্রোগ্রাম অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে বিকাশদা বেশ কিছু দিন কাজ করেছিলেন। আমার মনে হয় রেডিয়োর অভিজ্ঞতা পরবর্তী অভিনয় জীবনে তাঁর অসম্ভব কাজে লেগেছিল। ভিলেন হিসেবে চিবিয়ে চিবিয়ে অথচ স্পষ্ট উচ্চারণের কায়দাটা তিনি রেডিয়ো থেকেই পেয়েছিলেন।

প্রদর্শনী ম্যাচে

শুনেছি তখনকার সাউন্ড রেকর্ডিস্ট অবনী চক্রবর্তী বলতেন, “বিকাশ সেটে থাকলে সাউন্ডের ব্যাপারে আমার কোনও প্রবলেমই হয় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ও চার-পাঁচরকম ভঙ্গিতে ভয়েস থ্রো করতে পারে।”

রেডিয়োয় চাকরি করতে করতেই বিকাশদার সঙ্গে সাহিত্যিক জ্যোতির্ময় রায়ের পরিচয় হয়। জ্যোতির্ময় রায়ের তখন জমাট বাজার। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে বিমল রায়ের পরিচালনায় তাঁর লেখা ‘উদয়ের পথে’ দুর্দান্ত হিট করেছে।

জ্যোতির্ময় রায় ঠিক করলেন ‘অভিযাত্রী’ বলে একটা ছবির কাজ শুরু করবেন, আর সেই ছবিতেই বিকাশদা পর্দায় প্রথম মুখ দেখানোর সুযোগ পেলেন। সে ১৯৪৭ সালের কথা।

কিন্তু ১৯৪৮-এ হেমেন গুপ্তর ‘ভুলি নাই’ ছবিতে বিকাশদা প্রথমবারের মতো সকলের নজরে আসেন। ওখানে ‘মহানন্দ’ নামে এক বিপ্লবীর চরিত্র করেছিলেন তিনি। পুলিশের লাঠি খাবার পরে তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা শুনে মনে হত আওয়াজটা যেন এক মানুষের হৃৎপিণ্ড চৌচির করে বেরিয়ে আসছে। ওই ছবিরই শেষ দিকে দেখা গেল নায়কের হাতে গুলি খেয়ে মৃত্যুর আগে বাঁচার জন্য তিনি ছটফটিয়ে উঠছেন, দর্শকদের চোখ তখন জলে টলটল করত। আবার ১৯৫১ সালে হেমেন গুপ্তর ‘বেয়াল্লিশ’ দেখে শুনেছি বহু দর্শকই নাকি পর্দার বিকাশদাকে দেখলে জুতো ছুড়ে মারতেন! অভিনয়ে ক্রুঢ়তাকে এতটা তীক্ষ্নভাবে ফুটিয়ে তুলতেন তিনি।

বিকাশ রায় মানেই কিন্তু সকলে ভাবেন শুধুমাত্র ভিলেন। আমি বলব, ওর মতো মনোমুগ্ধকর রোম্যান্টিক ভিলেন বাংলা ছবিতে ক’জন আছেন!

স্টুডিয়ো পাড়ায় তখনও নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে নানা মুচমুচে গসিপ চলত। বিকাশদার স্ত্রী কমলা বৌদির মুখে শুনেছি বাড়িতে ওঁর কাছে নাম না করে প্রচুর ফোন আসত। একবারের কথা বলি। ফোন বাজতে ধরলেন বৌদি। ওপাশ থেকে কথা ভেসে এল, “বউদি আপনি কি বিকাশদার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছেন? আসলে দেখলাম বিকাশদা মদ খেয়ে, অনুভা গুপ্তকে সামনে বসিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন।”

এই শুনে কমলাদি কিন্তু একটুও বিচলিত হননি। কেবল বলছিলেন, “উনি মদও খান না আর গাড়িও চালাতে পারেন না ভাই। তাই তোমার কথাটি ঠিক জমল না, পরের বার একটু ভেবেচিন্তে না হয় বোলো।”

দুজনের ভালবাসা আর বিশ্বাস ছিল দেখার মতো। তবে বিকাশদার প্রেমে পড়া নিয়ে কমলা বৌদি রীতিমতো ঠাট্টা করতেন। বলতেন, “দমাদ্দম প্রেমে তো পড়ো, নিজের চেহারাটা একবার দেখেছ?”

নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করছি আমি আর বিকাশদা। ছবিতে বিকাশদা আমার স্বামী, যাকে আমি খুন করব। শটের মাঝে থেকে থেকেই বিকাশদা সফট ড্রিংক খেতেন। সেই কালো রঙের তরল পানীয় হাতে দেখে অনেকেই ভাবত উনি বুঝি খুব ড্রিঙ্ক করেন!

যাই হোক উনি তো শটের মাঝে থেকে থেকেই কোল্ড ড্রিঙ্ক খাচ্ছেন। আর নব্যেন্দু সমানে বেশ জোর দিয়ে সকলের সামনে ওঁকে বলছেন, “শুনুন বিকাশদা, আমি চাইছি না আপনি ওটা খান।’’ তাতেও বিকাশদার ভ্রুক্ষেপ নেই। গ্লাসটা একটু রাখছেন, আবার খাচ্ছেন।

এ দিকে নব্যেন্দুও ছাড়ার পাত্র নয়। ও তো বুঝে বসেছে, ওটা মদিরা ছাড়া আর কিছু নয়। বারবার নব্যেন্দু অমন বলতে থাকায় শেষমেশ আমি থাকতে না পেরে বললাম, ‘‘বিকাশদা আপনাকে এ ভাবে বলছে, আর আপনি কিছু বলছেন না?”

বিকাশদা সুর করে তখন বললেন, “দোষ কারওর নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।” এতটাই রসিক ছিলেন বিকাশদা। বাইরে থেকে যতই কঠিন লাগুক, ভেতরের মানুষটা ছিল একদম অন্যরকম।

ওঁকে এত সম্মান করতাম যে, গুরু বাগচীর ‘তিন ভূমি’ ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আবার ‘সুবর্ণলতা’ প্রযোজনা করার সময় বড়ভাইয়ের চরিত্রে আমি কিছুতেই বিকাশদা ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনি।

শুধুই কি রোম্যন্টিক ভিলেন? আমার মনে হয় তিনি আমাদের প্রথম এবং শেষ অ্যান্টি-হিরো, যাঁর অভিনয়ের মধ্যে অদ্ভুত রকমের বৈপরীত্য কাজ করত। ওর চেহারায়, চাউনিতে, হাঁটাচলায়। খানিক ভেবে দেখলে বোঝা যাবে দুর্গাদাস, উত্তমকুমারের মতো তিনি রমণীয় নন, প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো চেহারায় তাঁর মায়াময় বিষাদও ছিল না। বাঙালি রোম্যান্টিক স্বপ্নের কোনও আপাত সমর্থনই পাওয়া যায় না তাঁর হাবেভাবে। অথচ ‘আমার বৌ’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘ছেলে কার’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘কাঁচকাটা হীরে’ প্রভৃতি ছবিতে বিকাশ রায়ের রোম্যান্টিকতাকে ছাপিয়ে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

বিকাশদার ‘জিঘাংসা’ ছবিতে অভিনয় নিয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্য একবার বাঁকা সমালোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, “প্রেমেন্দ্র মিত্রর পরিচালনায় ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ ছবিতে আমার খেয়ালি প্রফেসরের চরিত্র হুবহু কপি করে তো বিকাশ দিব্যি বেরিয়ে গেল!”

আজ যদি কোনও অভিনেতা সম্পর্কে কেউ এমন মন্তব্য করেন, বিলক্ষণ জানি, তুলকালাম হয়ে যাবে। অথচ বিকাশদা কিন্তু রাগারাগির ধারপাশও মাড়াননি। শুধু বলেছিলেন, “ধীরাজদা আমার সিনিয়র আর্টিস্ট। আমি ওঁর অভিনয়ের অ্যাডমায়ারার। কিন্তু আই বেগ ট্যু ডিফার। ওঁর অভিযোগ ঠিক নয়। উনি কমেডির ফর্মে অ্যাক্টিং করেছেন। আর আমি সিরিয়াস ফর্মে। তবে ওঁর খারাপ লাগলে আমি ক্ষমা চাইছি!” ব্যস্, শুধু এইটুকুই।

বিকাশদা ‘জিঘাংসা’ ছবির অন্যতম প্রযোজক ছিলেন। ওই ছবির সাফল্য ওঁর মনে প্রযোজনার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল।

বিকাশ রায় প্রোডাকশনের প্রথম সফল প্রযোজনা অজয় করের পরিচালনায় ‘সাজঘর’। এ ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় খ্যাতি ছড়িয়েছিল। বিকাশদা কেবল ফুরফুরে মেজাজের ছবি তৈরি করতেন তা কিন্তু নয়। যেমন ‘কেরি সাহেবের মুন্সি’। প্রমথনাথ বিশীর লেখা এই উপন্যাস নিয়ে ছবি তখনকার বাংলা ছবিতে দুঃসাহসিক কাজ।

একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা বিকাশদা, প্রায় তিনশো ছবিতে তো অভিনয় করেছেন। কোন চরিত্র আপনার সবচেয়ে প্রিয়?”

তাতে বিকাশদা বলেছিলেন, “এ কেমন যেন জামাই ঠকানো প্রশ্ন।”

আমি বললাম, “কেন?”

বিকাশদা বললেন, “আরে, আমার সব ক’টা ছবির নামই আমি বলতে পারব না তো চরিত্র কোন ছার।”

এর পরও জোর করাতে উনি বলেছিলেন, “বেস্ট-ফেস্ট কিছু নয়, তবে একটা চরিত্র আমার রাতের ঘুম, দিনের খাওয়া সব কেড়ে নিয়েছিল। সেটা হল ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর জীবনমশাইয়ের চরিত্র। বাইরে শান্ত সমাহিত, অন্তরে অগ্নিময়। আমার মতো ‘ব্যাড ম্যান’-এর ‘গুড ম্যান’ চরিত্রে অভিনয় করা সহজ কাজ ছিল না।” ওই ছবিতে বিকাশ রায়ের ক্যারেক্টর অ্যাক্টিং আমায় মুগ্ধ করেছিল।

কল্পনাশক্তি, ফ্রেমিং, কাহিনি বাছাই, অভিনয়, সাহিত্যবোধে, পরিচালক বিকাশ রায় কখনও কখনও মনে হয় অভিনেতা বিকাশ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন।

জীবনের উপান্তে এসে, তিনি যখন বুঝতে পারছিলেন আর বোধহয় বেশি দিন নেই, তখন একবার বলেছিলেন, “হে আমার ভগবান, আমার দর্শক, অতীতের মতো সামনের দিনও তোমাদের দক্ষিণমুখ আমার দিকে যেন উন্মোচিত করে রেখো।”

আজ বলতে ইচ্ছে করছে, বিকাশদা, তুমি তো আমাদের সামনে নেই, তবু আজও তোমার মাধুরীতে, সৃষ্টিতে ছড়ানো মধু, তোমার মৃত্যুর মধ্যেও অমৃত হয়ে জেগে আছে...

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy