Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভালমানুষ

১৯৭৭-এর ১২ মার্চ গঙ্গায় তাঁর তলিয়ে যাওয়া আজও রহস্যাবৃত। কেয়া চক্রবর্তীর সম্মোহনী টান যেন কিছুতেই থিতিয়ে যাওয়ার নয়। কেন? উত্তর খুঁজলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়তুমি আমায় কত বছর বয়েসে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে মা?’’ মেয়ে তখন আর ছোট্টটি নয়। বড়। মা বলত, ‘‘তখন তুই দুই কী তিন।’’ শুনে চমকে চমকে উঠত মেয়ে। মা-ছাড়া ছেলেবেলা তখনও যে তাকে ফিরিয়ে দিত তিন তলার বদ্ধ কুঠুরিটাতে। যখন তখন বাইরে থেকে শিকল টানা। ভেতরে একা মেয়ে। সঙ্গী বলতে বই আর ছোট্ট পুষ্যি ‘জ্যাকি’। ঘুমন্ত মেয়ের মাথার পাশে একবার সাপও বসেছে ফণা উঁচিয়ে!

কেয়া ১৯৭১

কেয়া ১৯৭১

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

তুমি আমায় কত বছর বয়েসে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে মা?’’

মেয়ে তখন আর ছোট্টটি নয়। বড়। মা বলত, ‘‘তখন তুই দুই কী তিন।’’ শুনে চমকে চমকে উঠত মেয়ে।

মা-ছাড়া ছেলেবেলা তখনও যে তাকে ফিরিয়ে দিত তিন তলার বদ্ধ কুঠুরিটাতে। যখন তখন বাইরে থেকে শিকল টানা। ভেতরে একা মেয়ে। সঙ্গী বলতে বই আর ছোট্ট পুষ্যি ‘জ্যাকি’। ঘুমন্ত মেয়ের মাথার পাশে একবার সাপও বসেছে ফণা উঁচিয়ে! ভাগ্যিস, ঠাকুমা দেখতে পেয়েছিল!

বারান্দায় দাঁড়ানোর হুকুম নেই। চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে যাওয়া মানে, শুধুই ইস্কুল। পাড়ায় মেলামেশা তো কোন ছার। উল্টে কারণে-অকারণে প্রহার জুটত মাঝে মধ্যেই। কত বার পালাতে চেয়েছে বাড়ি ছেড়ে!

এ ভাবেই বড় হল মেয়ে। ক্রাইস্ট চার্চ-এ দিদিমণির চাকরি নিল। হেড দিদিমণি দেখে শুনে বললেন, ‘‘এ পাখি বেশি দিন থাকার নয়।’’

তাই হল। মাস সাত-আট পরে স্কটিশ কলেজে অধ্যাপনায় গেল সে। কিন্তু দিনে দিনে থিয়েটারই হয়ে পড়ল তার উপাস্য! গুণিজনরা বলতে লাগলেন, তৃপ্তি মিত্রের পর এত বড় অভিনেত্রী বাংলায় কম এসেছেন।

’৭৩ সালে বার্লিনের ব্রেখট থিয়েটার মিউজিয়ামের গ্যালারিতে তার দু’হাত ছড়ানো ব্লো-আপ আবিষ্কার করেন তারই কলেজের এক শিক্ষক, পরে সহকর্মী।

আবার লিটল ম্যাগাজিনে ওই মেয়েরই লেখা ‘মেটলে’ নামের গল্প পড়ে চমকে ওঠেন সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ।

তার ‘আন্তিগোনে’ দেখে বিস্ময়াবিষ্ট কবিতা সিংহ লিখে ফেলেন— ‘‘একবার শুধু একবার/ চুম্বন করতে চাই আন্তিগোনে/তোমার ওই কলাপাতার রং পোশাকের প্রান্তদেশ...।’’

কেয়া চক্রবর্তী। ’৭৭-এর ১২ মার্চ শ্যুটিং করতে গিয়ে সাঁকরাইলের কাছে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া বছর পঁয়ত্রিশের যুবতী। যে ভেসে যাওয়ার কার্যকারণ নিয়ে তোলপাড় কম হয়নি— হত্যা, আত্মহত্যা, না নিছক দুর্ঘটনা— কিনারা হবার আগেই চাপা পড়েছে তদন্ত। কেন, কী, কী জন্য, সে অন্য প্রশ্ন, অবাক হতে হয় অন্য খানে— দশকের পর দশক ধরে তাঁর সম্মোহনী জাদুর বহমানতায়!

চার-চারটে দশক পার। তবু ওঁকে নিয়ে আজও ছবি হয়। সে-ছবি উৎসবে যায়। ওঁর নামে গ্রন্থ বিকোয়!

এই আশ্চর্য-জীবনের উত্তাপ, তার বিকিরণ কোথায় যেন অবাক করে দেয় শঙ্খ ঘোষের মতো বহুদর্শী ঋদ্ধজনকেও। তিনি লেখেন, ‘‘কেয়ার মৃত্যুর পরদিন সকালে, কোনও এক বাড়ির পরিচারিকা তার গৃহিণীকে এসে বলেছিল, শুনেছেন কেয়া চক্রবর্তী মারা গেছেন? একটু অবাক হয়ে গৃহিণী তাকে জিজ্ঞেস করেন: শুনেছি, কিন্তু তোমরা জানলে কী করে? ‘বাঃ আমরা শুনব না? খবর পেয়ে আমাদের বস্তিসুদ্ধ লোক কেঁদে সারা। আমরা যে সব দল বেঁধে ওর ‘ভালোমানুষ’ দেখতে গিয়েছিলাম। উনি তো আমাদের কথা বলতেন। উনি তো আমাদেরই লোক ছিলেন। আমরা জানব না?’’

সবেতেই ছিলেন দলছুট। স্বভাবে, অভাবে, প্রকাশে। কবিতা সিংহের কথা শোনা যাক—

‘‘৭৩-এ স্কটিশ কলেজে আমন্ত্রিত কবি সম্মেলনে গেছি। সামনের চেয়ারে জ্ঞানীগুণী অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের সঙ্গে কেয়া। এখনও মনে পড়ে, তার পরনে আকাশ-নীল জরিপাড় একটি পাটভাঙা শাড়ি। আমি যে কবিতাটি পড়েছিলাম— ‘মা আমার হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিয়েছি শেষবারের মতো/ দুচোখ ছাপিয়ে নামা চোখের জলের বৃথা দাগ/ বেণীর সার্টিন খুলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেছি আমি/ অশ্বক্ষুরে ঝন ঝন নারীদের দর্পণ/খরকরবালে একা পিতার রক্ষিতার মুণ্ড এনে দিতে।’ সদ্য লেখা। ডায়েরিতেই ছিল। আমি নেমে আসতেই কেয়া বলল, ‘তোমার কবিতাটা দেখতে দেবে? এটা তোমার হাতের লেখা?’ কোনও কথা না বলে ফর ফর করে ছিঁড়ে নিল ডায়েরির পাতাটা। ‘কবিতাটা আমার। তোমার হাতের একটা লেখা আমার কাছে থাক।’ আমি বললাম, ‘কবিতাটা দেশ-এ পাঠিয়েছি, কপি নেই আমার। কেয়া বলল, ‘না থাক। আমি এটা দেব না।’’’

আইএ পাশ করার পর হঠাৎ ঠিক করলেন রাতের কলকাতা দেখতে বেরোবেন। তাই-ই করলেন। বোধ হয়, ‘স্বাধীন’ হয়ে ওঠার শংসাপত্র, নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন এ ভাবেই!

অধ্যাপনার চাকরি পেলেন। নিজেরই কলেজে। কৃতজ্ঞতা জানাবেন মাস্টারমশাইকে। সটান চলে গেলেন স্টাফ রুমে। ‘গুরু’ তরুণ সান্যালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এলো চুল তাঁর পায়ে বিছিয়ে দু’পায়ে চিমটি কেটে বললেন, ‘‘গুরুদক্ষিণা।’’

প্রাক্তন প্রেমিক এমএ পরীক্ষা দেবেন। তার আগে কোনও এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করা চাই। বন্ধু বলল, ‘‘কেন যাবি, শুধুমুধু?’’ উত্তর: ‘‘ও মনে জোর পাবে।’’

দেখা করলেন। ছেলেটি পাত্তাও দিল না। কেয়ার বন্ধুর সঙ্গে দু’চার কথা বলে, নতুন বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল ছেলেটি। বন্ধুটি রেগে অস্থির, ‘‘আর যদি ওর নাম মুখে এনেছিস, তোর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।’’ উত্তর এল, ‘‘নতুন বউদিকে বেশ দেখতে নারে!’’

দেওয়াল পত্রিকায় বন্ধুরা যখন কাঁচা হাতে মকশো করে, তখন তিনি লেখেন নিখুঁত সনেট। হইহই পড়ে যায় তা নিয়ে।

যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধের বিষয় হয় ‘রবীন্দ্রমানসে মৃত্যু’। তিনি লেখেন, ‘অন্ধকারের ঝরনা থেকে আমাদের জীবন শুরু। অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যেই মৃত্যুর আক্রমণ। মানুষ কিন্তু কোনও দিনই মেনে নিতে পারেননি মৃত্যুর এই আক্রমণ।’’

এই আদ্যন্ত সিরিয়াস চরিত্রের কেমন যেন বদল ঘটে যায় অন্যত্র।

শিবপুরে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছেন। দেখা করেই চলে যাবেন। সঙ্গের প্রেমিককে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। পাছে জানাজানি হয়। সে সময়টা তো তেমনই ছিল। সে-বাড়িতে বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তায় অন্যদের সামনে প্রেমিককে আড়াল করছেন, ‘পিসিমা’ সম্বোধন করে, ‘‘পিসিমার কথা আর বলিস না। আমার সঙ্গে তোদের বাড়ি আসবে। বললাম, একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি। তোমাদের বাড়ি যাব।’’

বন্ধুর দিদি শুনে বললেন, ‘‘পিসিমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলি কেন? ওঁর বাড়ি কি এ দিকেই?’’ এ বার উত্তর: ‘‘না না বাড়ি যাব না রাস্তায় হাঁটব। জানো দিদি, আমার পিসিমার না ইয়া বড় গোঁফ।’’ ‘‘সে কী?’’ দিদি তো আকাশ থেকে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ‘‘এই যাঃ,’’ বলেই কেয়ার দৌড়।

কালে কালে অভিনয়ের নেশা ওঁকে বুঁদ করে ফেলল। পড়ুয়া থাকার সময়ই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এলেন। উনিশ বছর বয়েসে নান্দীকার-এর প্রযোজনায় ‘চার অধ্যায়’-এর এলা হলেন। সেই শুরু।

তার পর থেকে মাঝের ক’টা বছর পড়াশুনো-পরিবারের কারণে বাদ দেওয়াটুকু ছেড়ে দিলে কী প্রবলভাবে যে টানা জড়িয়ে ছিলেন! আর তাও শুধু যে অভিনয়, তা নয়। দলের প্রত্যেকের সুখদুঃখ, টাকাপয়সা, সেটসেটিং, পোশাকআশাক, বিজ্ঞাপন লেখা, টিকিট ছাপানো, এর পরে কী নাটক হবে, কেমন করে হবে, সবেতেই তিনি। এমনকী আলাপ-আলোচনায় তর্কযুদ্ধেও। সে’ও ভারী সিরিয়াস ঢঙে। একবারের কথা যেমন। নান্দীকার-এর ঘরে তমুল তর্ক সে দিন। অজিতেশ বনাম কেয়া। সন্ধে পেরিয়ে রাত গড়াল। তর্ক থামে না। বাধ্য হয়ে সে দিনের মতো মুলতুবি।

পরদিন দেখা গেল কেয়া আসছেন রিকশা চেপে। সঙ্গে অসংখ্য বই। তার পাতায় পাতায় কাগজের ‘ফ্ল্যাপ’ লাগানো। এ দিনও তর্ক শুরু হতে একের পর এক বই খুলে নমুনা, উদ্ধৃতি দিতে থাকলেন। একটা সময়ের পর হার মেনে নেন কেয়ার ‘অজিতদা’।

রুদ্রপ্রসাদ ও কেয়া

এত কিছুর পরেও অভিনয়টা যখন করতেন তাতে যে কতটা সম্পৃক্ত হতেন, দেখা যেতে পারে সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের বয়ান থেকে।— ‘‘আন্তিগোনে দেখবার স্মৃতিটা আমার সাঙ্ঘাতিক। সাধারণত কেয়া-রুদ্র (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) যখন আমাকে নেমন্তন্ন করত তখন একটু আগেই আমি যেতাম। ব্যাপারটা হত অদ্ভুত। কেয়া তখন শিশু হয়ে যেত। অপেক্ষা করত যে ও স্টেজে ঢোকবার আগেই যাতে আমার সঙ্গে দেখা হয়। ... ওই দিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ... ঢোকার মুখেই রুদ্রর সঙ্গে দেখা। রুদ্র আমাকে একেবারে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল সাজঘরে। আমি কেয়াকে খুঁজে পাইনি। এ রকম আমার একদম হয় না। তারপর আমি দেখলাম, কেয়া আর নেই। আন্তিগোনে বসে আছে। পুরোপুরি। কেয়া আমার হাতটা চেপে ধরল।’’

ওঁর ‘ভালোমানুষ’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা আজও বর্ণনায় গেলে ভেতরে ভেতরে যেন বিস্ফোরিত হন।

শান্তাপ্রসাদ। তাঁর বাংলা উচ্চারণে মারোয়াড়ি টান। পোশাক আধুনিক। চোখে সানগ্লাস। ঠোঁটে সিগারেট।

ওই মেকআপেই কিছুক্ষণের স্বগত বিলাপে কেয়া শান্তা হয়ে উঠতেন। কণ্ঠস্বর, শরীরী বিভঙ্গ— সবটা দিয়ে।

তাঁর ‘তিন পয়সার পালা’ দেখে গৌরকিশোর সোজাসুজি বলে দেন, ‘‘সব রকম চরিত্রে আমি কিন্তু তৃপ্তিকে এমন সাবলীল অভিনয় করতে দেখিনি। ... লঘু চরিত্র, কমেডি বা সিরিও-কমিকে আমি ওঁকে (তৃপ্তি মিত্র) আজ পর্যন্ত কখনও দেখিনি। কেয়াকে আমি দুই ক্ষেত্রেই দেখেছি, বিশেষ করে বলব, ‘তিন পয়সার পালা’র কথা।’’

আরেক জায়গায় তিনি আরও স্পষ্ট, ‘‘তৃপ্তির সময়কাল বেশি, কেয়ার অনেক কম। তবু বলব, কেয়ার মতো অভিনেত্রী বাংলায় আসেনি।’’

অবশ্য এ কথা মানতে পারেন না অনেকে। তাঁর সমকালের এক নির্দেশক যেমন বলেন, ‘‘(ওঁর অভিনয়ে) কিছুটা উত্তেজনা মিশে থাকত। রিল্যাক্সড অ্যালার্টনেসের অভাব ছিল। সু-অভিনেত্রী, কিন্তু তৃপ্তি মিত্র, প্রভাদেবী বা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় নন।’’

কেয়ার আন্তিগোনে ‘অসম্ভব স্পর্শ’ করলেও আরেক নির্দেশক অশোক মুখোপাধ্যায় আবার তার মধ্যে ‘কাঁচা ছটফটানি’ খুঁজে পান। কিন্তু এ নিয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই যে, অভিনয়ের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। নিজেকে বলতেন, ‘‘বলিপ্রদত্ত।’’

নইলে মায়ের ‘পেসমেকার’ বসানোর দিন শো করতে পারেন কেউ? তা’ও আবার একটা নয়, দু-দুটো! পৌনে তিনটে নাগাদ হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকলেন। দুটো শো করে কাউন্টারের সামনের সিঁড়িতে বসে পরের দিনের বিজ্ঞাপনের ‘ম্যাটার’ তৈরি করলেন। তার পর আবার ছুটলেন হাসপাতাল।

বিয়েতে শুভদৃষ্টি হচ্ছে। তখনও নাটক। এমনিতে পুরোহিত ইত্যাদি ছিল না। বোধ হয় লঘুচ্ছলে ওই আচারটুকুই হচ্ছিল। ‘‘সেই সময় অজিতেশবাবু এলেন। সম্ভবত তখন ‘তিন পয়সার পালা’ চলছে। ...কেয়া চেঁচাতে লাগল... ‘পরের শো কবে? কী? কোথায়?’ কোনও ক্রমে দু’জনকে থামানো গিয়েছিল,’’ স্মরণ বন্ধু ইন্দিরা দে-র।

অভিনেত্রী কেতকী দেবীর একটি লেখা পড়ে কেয়া জানতে পারেন, ওঁর মা প্রভাদেবী, নিজের মেয়ের মৃতদেহ বাড়িতে রেখে দাহ করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সেই দিনই শ্যুটিং করতে গিয়েছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে কেয়া বলেন, ‘‘কত বড় সাধিকা ছিলেন প্রভাদেবী!’’ এতটাই কি থিয়েটারের উপাসিকা হয়ে উঠতে চাইতেন তিনি?

মঞ্চ তো ছিলই। সঙ্গে রেডিয়োয় নাটকও। তারও টান যে কী প্রবল, একটা ঘটনা শুনলেই বোঝা যায়।

বেতারে তখন একটা পরীক্ষামূলক সাহিত্য-অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। রিডিং ড্রামা। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী একটি নাটক একাই পড়ে যাবেন। সংলাপের মাঝে দৃশ্য-নির্দেশও পড়তে হবে নির্লিপ্ত গলায়। নাটক ঠিক হল কবি কৃষ্ণ ধরের ‘বনজ্যোৎস্না’। চারটি চরিত্র। দু’জন পুরুষ। দু’জন নারী। এক খ্যাতনামা নটের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু প্রচারের দু’দিন আগে তিনি বললেন, ‘‘পারব না।’’

কেয়াকে ধরলেন প্রযোজক। উনি তখন ঘোরতর শয্যাশায়ী। তাতে কী, শুনেই বললেন, ‘‘বাহ্, বেশ নতুন রকমের তো। আমি করব।’’

তাঁর অসুখের কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট পাঠানোর কথা উঠল বাড়িতে। তারও দরকার পড়ল না। আধ ঘণ্টার মধ্যে ট্যাক্সি করে হাজির হয়ে গেলেন ‘আকাশবাণী’। সে দিনের মতো আলোচনা সেরে পরদিন দিব্যি রেকর্ডও করলেন।

***

কেয়ার যখন বছরখানেক বয়স, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়, তখনই বাবার সঙ্গে অশান্তির জেরে বাপের বাড়ি চলে যান ওঁর মা। ‘‘পরে অবশ্য কেয়ার বাবা আমাকে দু’মাস অন্তর অন্তর নিয়ে আসত। কেয়াকে তখন পেতাম চার-পাঁচ দিন। আবার অশান্তি। শাশুড়ি বলতেন, ‘তুমি চলে যাও।’ যখন আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসতাম, দেখতাম ছোট্ট কেয়া ছাদের কোণে, একা একা কোনও শব্দ না করে কাঁদছে।... ১৯৫৭ সালে আমি যখন বিএ পরীক্ষা দিই, কেয়ার তখন স্কুল ফাইনাল। ওই সময় বাগবাজারে আমার স্কুলে আসত। শ্যামবাজারে কফিহাউসে বসতাম। কেবল বলত, ‘মা তুমি বাড়ি চলো,’’’ মেয়ের কথা লিখেছেন মা লাবণ্য চক্রবর্তী।

মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক তো বটেই, ওঁর ছেলেবেলার আরও দুটি ঘটনা কেয়াকে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরেছিল।

জন্মের এক বছরের মাথায় ওঁর অন্তঃসত্ত্বা মেজ মাসি কাপড়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করেন। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে।

তাঁর জ্যেঠতুতো দিদি পনেরো বছর ক্লাসিক্যালের তালিম নিয়ে বিয়ের পর সব ছেড়েছুড়ে দেন।

বড় হয়ে কেবলই ভেবে গেছেন, কেন মাসি ও ভাবে নিজেকে শেষ করে দিল? বাড়ি ছেড়ে চলেও তো আসতে পারত! দিদিই বা গান ছেড়ে দিল কেন? কম পয়সাওয়ালা কোনও গানপ্রিয় লোককে তো বিয়ে করতে পারত। তা হলে কি দিদি আপস করেছিল?

কেয়া বলতেন, ‘‘বিয়ে-ফিয়ে আমি মানি না। চেস্টিটি-ফেস্টিটি আবার কী জিনিস?— সতীত্ব? সতীত্ব শুধু থাকে মেয়েদের। পুরুষদের জন্য কোনও টার্ম নেই।’’

মধ্যবিত্তপনা দু’চক্ষের বিষ, ‘‘আহা মানুষ কত মুখরোচক চায়। একটা মেয়ে রংচং মেখে স্টেজে অভিনয় করে। সে কি আর ব্যক্তিজীবনে ধোয়া তুলসীটি? নিশ্চয়ই স্টেজের বাইরে— অর্থাৎ গ্রিনরুমের ভিতরে দারুণ সব অসামাজিক কাজ করছে, তাই না?...স্টেজের উপরে উঠে যখন অভিনয় করি, তখন লোকে আমায় মেনে নেয়, কিন্তু থিয়েটার সেরে মধ্যরাতে যখন বাড়ি ফিরি, তখন লোকে আমায় নিতে পারে না। পারে না বলেই, পরিচিত লোকজন দেখলেই, আমায় পৌঁছে দেবার জন্য যে পুরুষটি থাকে, ইচ্ছে করেই তার কাঁধে হাত রাখি। জনগণ যাতে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে আনন্দ পায়।’’

কবিতা সিংহ এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘শরীর, যৌনতা, সতীত্ব এ সব ব্যাপারে তার বোধ অভ্যস্থ সংজ্ঞার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। খুব সহজেই— সাবলীলতার সঙ্গে— পুরুষের সামনে, এমনকী নিজের ছাত্রদের উপস্থিতিতেও, সে শরীর বা ঋতু সংক্রান্ত এমন কথা বলতে পারত, যা কোনও বাঙালি মেয়েই উচ্চারণ করতে পারে না।’’

১৯৭২-এ ক্যামেরায় ধরা কেয়া

হঠাৎই হয়তো এক দিন এসে বললেন, ‘‘আই কনসিভড বিফোর মাই ম্যারেজ ‘ভালোমানুষ’ করতে সুবিধে হবে বলে।’’ কবিতা অনেক সময়ই বলতেন, ‘‘বাজে কথাগুলো বলো কেন? লোকে সত্যি মনে করে তো?’’

ঘাড় বেঁকিয়ে উত্তর দিতেন, ‘‘ক’দিনের দেখা? বড়জোর পাঁচ বছর, দশ বছর। তার পর তো সব পুড়েঝুড়ে শেষ হয়ে যাবে। তবে এত কীসের কমপ্রোমাইজ?...’’

একটি সাক্ষাৎকারে কেয়াকে বলতে দেখা যায়, ‘‘যদি মহিলা প্রকৃত অর্থেই সাধিকা হন, তা হলেই কিন্তু তাঁকে সামাজিকভাবে নিন্দিত হতে হবে। তাঁর স্বামী হয়তো, যে গান শুনে এক কালে তাঁকে ভালবেসেছিলেন, সেই গানের চর্চায় বেশি মন দেবার অপরাধে, পাশের বাড়ির বৌটিকে দেখে আহ্লাদিত হবেন— ভাববেন— আহা বৌটি কেমন সুন্দর, সংসার করে, রাঁধাবাড়া করে, সেজেগুজে থাকে। আর যে-মা অসুস্থ ছেলেকে ছেড়ে শো করতে গেল, তাকে তো ডাইনি মনে করা হবে।’’ স্পষ্ট ভাষায় কেয়া বলে দেন, বিছানা, রান্নাঘর, আঁতুড়ঘরের বাইরের জীবনে যেতে স্ত্রীদের ভূমিকা স্বামীরা কতটা মানতে রাজি, তার ওপরেই নির্ভর করে ঘরনির চৌকাঠ পেরনো!

পৌরুষের উদাসীনতা, আস্ফালন, অবজ্ঞার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা, যন্ত্রণা, ক্ষোভই কি তাঁকে দিয়ে ‘মেটলে’ লিখিয়ে ছিল? যে গল্পে আছে বিবাহিত এক পুরুষের সঙ্গে এক অনুঢ়ার প্রেম। তাঁদের ভ্রূণটিকে যখন নষ্ট করা হচ্ছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে। তাঁর ‘পুরুষ বন্ধুটি’ তখন তাঁর পাশে নেই। সরে পড়েছে ভয়ে, ‘সামাজিক লজ্জা’ লুকোতে, ঠুনকো অছিলায়।

এই মনই কি তাঁকে দিয়ে ব্রেখটের ‘মারী ফারারের ভ্রূণহত্যা সম্পর্কে’ অনুবাদ করতে বাধ্য করেছিল? হতে পারে।

***

মঞ্চটা তাঁর মন্দির হলেও কলেজে পড়াতে যে কোনও খামতি ছিল, তা কিন্তু নয়। বরং তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা ‘ইনোভেশন’ কাজ করত। ভাবনার ঋজুতা, জিতে নেওয়ার জেদ, আগলে রাখার মন চোখে পড়ত।

সত্তর দশক। উত্তাল কলকাতা। এক ছাত্রকে মারতে ধাওয়া করে বন্দুক উঁচিয়ে কলেজের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল বাইরের লোক। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাঁচান তিনি। এক অতি সরল গ্রামের ছেলে লাজুক চোখে, চোরা চাউনিতে বারবার দেখে ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট মেয়েটিকে। এ সব নিয়ে লুকোছাপা পছন্দ হত না কেয়ার। ওঁদের মিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রী, যারা ইংরিজি বলতে গিয়ে থমকায়, কলেজ বসার আগে তাদের লাইব্রেরিতে আলাদা ক্লাস নিতেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে ‘ওথেলো’, ‘হ্যামলেট’-এর রেকর্ড আনিয়ে শোনাতেন। উচ্চারণ শুধরে দিতেন। আবার কাউকে সিমন দ্য বোভ্যেয়েরের ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর মতো নারীবাদী বই পড়তে দিয়েছেন, এমনও হয়েছে।

‘‘(কেয়াদি) ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ পড়াতেন জেনারেল ইংলিশ ক্লাসে। অনার্সে ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’। ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। তাদের তর্কবিতর্কে টানতেন। এটাই ওঁর পড়ানো,’’ একটি লেখায় বলেছেন তাঁর ছাত্রী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। কেউ কেউ আবার বলেন, এক-এক সময় মনে হত, ক্লাসের ডায়াসটা হয়ে উঠেছে নাটমঞ্চ।

পড়ানোর আগে-পরে চলত নানা ধরনের গল্প। ঠিক গল্প নয়, শিল্পীর আত্মদানের কাহিনি। ‘‘লরেন্স অলিভিয়ার যখন ওথেলো অভিনয় করেন, তখন কী ভাবে হরমোন ইনজেকশন নিয়ে চেহারার বদল এনেছিলেন... ওঁর বলাতে গায়ে কাঁটা দিত,’’ স্মৃতি বোলানের।

এত জড়িয়ে পড়া, এতটাই ভাল লাগার এই জগৎটাও এক সময় ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আর অধ্যাপনা নয়, শুধুই থিয়েটার। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘‘দু’নৌকায় পা রেখে কিছু হয় না।’’ দিনে দিনে থিয়েটারকে এতটাই জাপটে ধরছিলেন, কলেজে সময় দেওয়াটা কমে আসছিল। তখন কেবলই মনে হত, তাঁর ভালবাসার ছাত্রছাত্রীদের ঠকানো হচ্ছে। তার সঙ্গে এ প্রশ্নও কুরে কুরে খাচ্ছিল, ‘‘বেশির ভাগ ছাত্রই চাকরির জন্য ডিগ্রি পেতে আসে। তা হলে পড়াচ্ছি কেন? কার কোন কাজে লাগে এই সিলেবাস?’’

প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত বার বার বারণ করেছেন। বাড়িরও কারও মত নেই। সবাই জানতেন, পরের বছরই বেতনও বাড়তে চলেছে। এ সময় চাকরি ছাড়াটা বোকামি। ‘চালাকি’র ধার ধারতেন না যে মানুষ, তিনি এ সবের তোয়াক্কা করবেন কেন?

চাকরি নেই। অল্পস্বল্প রোজগারের জন্য অনুবাদের কাজ করতেন। জুতো কোম্পানির বিজ্ঞাপন লিখতেন। এক বণিক সংস্থার হোম জার্নাল সম্পাদনা করেছেন। তার বাইরে? থিয়েটার, থিয়েটার আর থিয়েটার। থিয়েটারের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা গেছে। কানের মাকড়ি, হাতের বালা কখনও বন্ধক, কখনও বেচতেও দ্বিধা করেননি। কমার্শিয়াল থিয়েটার ডেকেছে। যাননি। যাত্রা থেকে অফার এসেছে। ফিরিয়েছেন। দলের ক্ষতি হয়ে যাবে না!

শেষমেশ মায়ের অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে ‘জীবন যে রকম’ ছবি করতে গেলেন। আর তাতেই হারিয়ে গেলেন ‘ভালমানুষ’!

***

রাস্তায় রাস্তায় চাপ চাপ মানুষ শুধু। উদ্ভ্রান্তের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দুপুর গড়ানোর আগে থেকেই। বারান্দায় উপচে পড়া থমথমে মুখ। সন্ধে নামার একটু আগে শেষবারের মতো কেয়া তাঁর বাড়িতে এলেন কাঁচের গাড়িতে। গোটা শরীরে ফুলের ভার। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। মুখটুকু শুধু জেগে আছে। শ্যাওলা রঙের সে-মুখ যাঁরা দেখেছেন, আজও ভুলতে পারেননি।

মানিকতলার এ তল্লাটে বহু বাড়িতে সে দিন অরন্ধন ছিল!

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জয়তী ভট্টাচার্য, আগুনের খেয়া (সম্পাদনা: মধুময় পাল, প্রকাশক: সেতু),

কেয়া (সম্পাদনা: দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক: দীপ প্রকাশন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE