Advertisement
E-Paper

মঞ্চে ট্রয়ের মহাযুদ্ধ

মহলা দেখে লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়নামেই প্রেমের জন্য যুদ্ধ। আসলে ক্ষমতার লড়াই। যার এক দিকে স্পার্টা। অন্য দিকে ট্রয়। কে কার দখল নেবে? স্পার্টার সেনাধ্যক্ষ আগামেমনন, না কি ট্রয়ের দুই ভাই, রাজা প্রায়মের পুত্র হেক্টর আর প্যারিস? স্পার্টার রাজা মেনেলাউয়ের সুন্দরী স্ত্রী হেলেন তো সেখানে উপলক্ষ মাত্র। যিনি কিনা ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের প্রেমে পড়ে সে-দেশে পালান। আর তাঁকে স্পার্টায় ফিরিয়ে আনতেই শুরু হয় যুদ্ধ!

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: কৌশিক সরকার

ছবি: কৌশিক সরকার

নামেই প্রেমের জন্য যুদ্ধ।

আসলে ক্ষমতার লড়াই।

যার এক দিকে স্পার্টা। অন্য দিকে ট্রয়। কে কার দখল নেবে?

স্পার্টার সেনাধ্যক্ষ আগামেমনন, না কি ট্রয়ের দুই ভাই, রাজা প্রায়মের পুত্র হেক্টর আর প্যারিস?

স্পার্টার রাজা মেনেলাউয়ের সুন্দরী স্ত্রী হেলেন তো সেখানে উপলক্ষ মাত্র। যিনি কিনা ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের প্রেমে পড়ে সে-দেশে পালান। আর তাঁকে স্পার্টায় ফিরিয়ে আনতেই শুরু হয় যুদ্ধ!

তিন হাজার বছরের পুরনো এই যুদ্ধ চলে দশ বছর। তারই শেষ বছরের কাহিনি নিয়ে হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে তৈরি ‘ট্রয়’।

কাহিনিটি ঘিরে খানকতক দুনিয়া কাঁপানো ফিল্ম হয়ে গিয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটা সম্ভবত ১৯৫৬-র। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের। পরিচালক রবার্ট ওয়াইজ। আর একেবারে শেষতমটি ২০০৪-এর। জার্মান পরিচালক উল্ফগ্যাং পিটারসনের। যেখানে স্পার্টার প্রবাদপ্রতিম বীর অ্যাকিলসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্র্যাড পিট।

কিন্তু ট্রয় নিয়ে বাংলায় থিয়েটার? যতদূর জানা যাচ্ছে, ‘আরশি’ নাট্যদল ও নবেল অ্যাসিসিয়েটস্-এর এই প্রযোজনার আগে বাংলা থিয়েটারে কখনও ‘ট্রয়’ হয়নি। ‘ট্রয়’-এর প্রথম শো ১৪ সেপ্টেম্বর। রবিবার। রবীন্দ্রসদন। সন্ধে সাড়ে ছ’টায়।

‘রাজা অয়দিপায়ুস’ কী ‘আন্তিগোনে’র বাইরে এত বড় গ্রিক থিয়েটারই বা বাংলায় শেষ কবে হয়েছে, মনে করতে পারছেন না বাংলা নাটকের বহু প্রবীণ রসিকও।

নির্দেশক অবন্তী চক্রবর্তীর গ্রিক নাটকের প্রতি অনুরাগ আকস্মিক নয়। এর আগে তিনি ‘রক্তগাথা’ বা ‘মেডেয়া’ নামে যে দুটি থিয়েটার করেছেন, সেগুলিও ছিল গ্রিক কাহিনি নির্ভর।

২০১০-এ আমেরিকার ইয়েল স্কুল অব ড্রামা-য় পড়ার সময় পৃথিবী বিখ্যাত গ্রিক বিশারদ রবার্ট উডরুফের কাছে গ্রিক ট্র্যাজেডি নিয়ে বিশেষ পাঠও নেন অবন্তী। যে ইয়েল-এর ফসল মেরিল স্ট্রিপ থেকে মার্লন ব্রান্ডোর মতো অভিনেতা। সব মিলিয়ে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসে ভর করে এ বারে অবন্তী ঝুঁকিটা নিয়ে ফেললেন মহাকাব্যকে বাজি ধরে।

জাঁকজমক, গথিক স্ট্রাকচারের সেট যদি গ্রিক নাটকের পূর্বশর্ত হয়, এ থিয়েটারে রয়েছে সেই ভাবনার আমূল ভাঙাগড়া।

দিনকতক আগে নিরঞ্জন সদনে মহলায় গিয়ে দেখা গেল, প্রথামতো কোনও ফিক্সড্ সেটই নেই। বদলে আট-দশটি পালতোলা নৌকা (হয়তো বা জাহাজ) ভেসে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। হাতে হাতে ঘুরছে নানান জ্যামিতিক আকারের বড় বড় কাটআউট, পুরুলিয়ার ছৌ নাচের ঘোড়া। পিছনের দুধসাদা সাইক্লোরামায় মাঝে মাঝেই চলতে থাকছে তিন রঙের খেলা। ট্রোজানদের রং নীল, গ্রিকদের বেলায় সবুজ। আর ধ্বংসের ও হত্যালীলার জন্য লাল।

আলোআঁধারিতে রঙের খেলা যত ঘন হচ্ছে, জমে উঠছে কুঠার, তলোয়ার নিয়ে যোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধ।

মঞ্চের এক ধার থেকে বেজে উঠছে ধামসা, ড্রাম, ব্যাঞ্জো। তারই মাঝে কখনও মুহুর্মুহু গাঢ় প্রেম-চুম্বন, তো কখনও মঞ্চে ফেটে পড়ছে বিশ্বাসভঙ্গের আক্রোশ, অস্ত্রের ঝনঝনানি। কখনও আবার গুমরে ওঠা কান্নায় বুকের ভেতর হাপর টানার শব্দ তুলে দিচ্ছে মায়াবী কোনও সুর। মানানসই অসম্ভব নান্দনিক কুশীলবের পোশাকআশাকও। সেখানেও যেন চিরাচরিত প্রথা একটু হলেও ভাঙা।

২০০২ সালে ‘মেফিস্টো’য় যে মেগা স্টারকাস্ট দেখেছিল বাংলার থিয়েটার-দর্শক, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে ২০১৪-র এই ‘ট্রয়’।

এ নাটকের সূত্রেই প্রথম বারের জন্য মঞ্চে উঠছেন অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী। বেশ কয়েক বছরের অভিনয় জীবনে তিনি অনেকগুলি ফিল্মেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন। যার কয়েকটা যেমন, ব্যোমকেশ-সিরিজে সত্যবতী, রঞ্জনা আমি আর আসব না-য় দীপান্বিতা, বেডরুম-এর ঈপ্সিতা, কাঙাল মালসাট-এর কালী। ট্রয়-এ তাঁকে দেখা যাবে দেবী আফ্রোদিতির ভূমিকায়। শুধু এ নাটকের কথা ভেবেই পিঠে বড়সড় ‘ট্যাটু’ করিয়েছেন তিনি। মহলায় গিয়ে বোঝা গেল, শুধু চটকে নয়, প্রথম মঞ্চে নেমেও অভিনয়ের মুকুটে নতুন পালক জুড়তে তৈরি হচ্ছেন ঊষসী।

আগামেমনন হয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। সিরিয়াল, সিনেমার বাইরে ‘চার্বাক’ নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি আছেন কয়েক দশক ধরে। রুপোলি পর্দার পাশাপাশি মঞ্চেও তাঁর সাবলীলতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। আগামেমনন-এর ঔদ্ধত্য, দম্ভ, ক্রঢ়তা মেশানো রাজসিক প্রচণ্ডতা, আভিজাত্যকে প্রতিটি মুহূর্তে ফুটিয়ে তুলতে যত্নবান সব্যসাচী।

এঁদের সঙ্গে প্রায়ামের কন্যা কাসান্দ্রার ভূমিকায় তুর্ণা দাস, হেক্টর অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাজা মাইনেসের স্ত্রী ব্রিসিস অঙ্কিতা মাজি, হেলেন সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়, তাঁর বোন ক্লাইতেমেনেস্ত্রা তমালি কক্কর, অ্যাকিলিস অর্ণ মুখোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে উনত্রিশ জন। এ নাটকে এক ভিন্ন ধারার চমক আছে সূত্রধারের চরিত্রটিকে ঘিরে। সে-চমক না হয় উহ্যই থাক, শুধু এটুকু বলা যাক, অভিনয়ে অনির্বাণ চক্রবর্তী।

অসম্ভব ভারসাম্যে ভরা, টানটান এবং ধারালো সংলাপের বুননও। যেখানে ফোকাসটা বার বার পড়েছে ক্ষমতার ভাষায়। পুরুষতন্ত্রের ওপরে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের ঠুনকো দেখনদারিতে। আর শেষমেশ নারীকে যুদ্ধের উপলক্ষ সাজিয়ে রাষ্ট্র দখলের চেষ্টার ওপর। যে কারণে প্রতিটি হানাদারি আক্রমণের মূল খাদ্য হয়ে যায় মহিলারা। নাটকে সমকাল ধরা পড়ছে এখানেই। গাজা-প্যালেস্তাইন-ইজরাইল-মিশর হয়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধ— কোথাও সরাসরি উচ্চারিত না হয়েও নাটকে জানান দেয় বারবার।

আরও যা জানাবার, তা হল এই থিয়েটারের সূত্র ধরে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে বাংলা রঙ্গমঞ্চে। এত দিন রুপোলি পর্দায় লগ্নি করা সংস্থা ‘নবেল অ্যাসোসিয়েট্স’ এ বার থিয়েটারের প্রযোজনায় এলেন। এমন ঘটনাও সম্ভবত প্রথমবার। অন্তত এই শহরে।

debshankar mukhopadhyay play troy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy