Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ

মন ভাল নেই

ভেসে আসা কোনও গান, হঠাৎ দেখা স্বপ্ন, এক টুকরো না-পাওয়া সব কেমন ওলটপালট করে দেয়। ভাল্লাগে না কিছুই। নিজের অভিজ্ঞতা গাঁথলেন সমরেশ মজুমদারসাতসকালে বিপ্লবের ফোন এল, “তুই কেমন আছিস রে?” চায়ে চুমুক দিয়ে বলাম, “হঠাৎ কী হল তোর?” “একটু আগে বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম আমি, তুই, রজত, মৃন্ময় একটা নরকে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” বিপ্লবের গলার স্বর ভাঙল। “নরক?” “হ্যাঁ রে। তুই তো জানিস মৃন্ময়টা মানে স্কটিশের মৃণ্ময় কিছু দিন আগে মারা গিয়েছে, ওই আমাদের গাইড করছিল। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়...!”

অলংকরণ: শেখর রায়

অলংকরণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

সাতসকালে বিপ্লবের ফোন এল, “তুই কেমন আছিস রে?”

চায়ে চুমুক দিয়ে বলাম, “হঠাৎ কী হল তোর?”

“একটু আগে বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম আমি, তুই, রজত, মৃন্ময় একটা নরকে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” বিপ্লবের গলার স্বর ভাঙল।

“নরক?”

“হ্যাঁ রে। তুই তো জানিস মৃন্ময়টা মানে স্কটিশের মৃণ্ময় কিছু দিন আগে মারা গিয়েছে, ওই আমাদের গাইড করছিল। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়...!”

বিপ্লবকে আর কথা বলতে না দিয়ে রিসিভার রেখে দিলাম। কিন্তু তার পর থেকে একটু একটু করে মনে ভার জমতে শুরু করল। তারপর বুঝলাম কিছুই ভাল লাগছে না।

সেই কুড়ি বছর বয়সে যখন স্কটিশে আমরা পড়তাম তখন কেউ সত্তর বছর বাঁচব বলতাম না। আরও পঞ্চাশ বছর এই পৃথিবীতে থাকব? ভাগ্।

এখন সত্তরে পা দিয়েও আমার জীবনযাপন ওই কুড়ি-একুশের মতো ব্যস্ততায় কাটছে। অনেকগুলো কাজ পর পর করব বলে ভেবে রেখেছি। সেগুলো শেষ করতে অন্তত পনেরো বছর লাগবে।

শরীরে অসুখ-বিসুখ নেই, না সুগার না প্রেসারের কমা-বাড়া। একশো তিরিশ-সত্তরে দাঁড়িয়ে আছে রক্তস্রোত বহুকাল। কিন্তু বিপ্লবের ফোন পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। জন্মালেই মরতে হবে জানি, কিন্তু কেউ মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিলে মন কেন ভাল থাকে না?

অথচ বেঁচে থাকাটা আমি উপভোগ করি, কিন্তু কবে কখন মরব তা জানি না। জানতেও চাই না। তবু লোকে গায়ে পড়ে জানিয়ে দেয়।

স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম, ছোট মেয়ে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা, তোমার চুল পেকে গিয়েছে। তুমি বুড়ো হয়ে গিয়েছ।” কী উল্লাস ছিল ওর গলায়! আমার মনে হয়েছিল ক্যানিবালরা মানুষকে সেঁকে খাওয়ার সময় ওই রকম উল্লসিত হত। আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাশটা বছর দিব্যি কালো থেকে হঠাৎ দুটো চুল সাদা হয়ে গেল কেন? আর হওয়ার আগে আমি টের পেলাম না, অন্যের মুখে জানতে হল। মনকে বোঝালাম, ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ় হলাম। তবু ঠিক একটা দিন কিছুই করতে ইচ্ছে হয়নি। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিয়েছি, “মন ভাল নেই।” ব্যাখ্যা করিনি।

একজন প্রকাশক আমার গোটা পাঁচেক বই ছেপেছেন। প্রথম বছর ভাল বিক্রি হয়েছে বলে টাকাও দিয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বছর থেকে নাকি বিক্রি খুব খারাপ হচ্ছে। বললেন, “আপনি ভাল বই আনন্দ-কে দিয়ে দেন, তাই এই সব ছোট বই বিক্রি হচ্ছে না।”

শুনে মন খারাপ হয়নি। ভাবলাম পরের বার একটা বড় উপন্যাস ভদ্রলোককে দেব। তার কিছু দিন পরে এক জন বাইন্ডারের সঙ্গে পরিচয় হল। আমি প্রকাশককে চিনি। কিন্তু তিনি যে প্রেসে আমার বই ছাপেন, যে বাইন্ডারকে দিয়ে বই বাঁধান তাঁদের চোখেও দেখি না।

ওই বাইন্ডার ভদ্রলোক বললেন, ‘প্রতি মাসে আপনার বই বাঁধিয়ে দিতে হয়। বিশেষ করে...।’ যে বইটির নাম বললেন সেটি প্রকাশকের দেওয়া হিসেবে গোটা বছরে নব্বই কপি বিক্রি হয়েছে। শোনার পর আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি একটুও রেগে গেলাম না। প্রকাশকের সঙ্গে ঝগড়া করলাম না। দু দিন মন খারাপ থাকল। তার পর স্থির করলাম, ওঁকে নতুন বই তো দেবই না, নোটিস দিয়ে পুরনো বই তুলে নেব। আর এইটে ভাবামাত্র দেখলাম একটু একটু করে মন হাল্কা হয়ে গেল।

আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর প্রথম সন্তান মেয়ে হয়েছে শুনে অভিনন্দন জানাতে গেলে বন্ধু বলল, “কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছিস! মন ভাল নেই রে!”

তাকে ভর্ৎসনা করলাম। সে মাথা নাড়ল, “আমি যদি একান্নবর্তী পরিবারে থাকতাম তাহলে সংসারে মেয়ে এলে কষ্ট হত না। খুশি হতাম। আমরা দু’জন এই ফ্ল্যাটে একটু একটু করে, মেয়েটাকে বড় করব। আমরা যা জানি সব ওকে শেখাবো। তারপর পড়াশুনো শেষ করে ও অন্য একটি ছেলের সঙ্গে গিয়ে বাকি জীবন কাটাবে। তুই ভেবে দ্যাখ, সেই সময় শূন্যতা আমাদের গ্রাস করবে, উঃ, ভাবতেই পারছি না। তাই মন খারাপ হয়ে গেছে।” আমি হতভম্ব। এত দূর কেউ ভাবে? ভেবে মন খারাপ করে?

তখন সবে লিখছি। দেশে গল্প ছাপা হয়েছে অনেকগুলো। কফি হাউসে ঢুকছি এক বিকেলে, ডাক শুনলাম, “শুনুন!” পিছন ফিরে যাকে দেখলাম, চোখ বলল ধন্য হলাম।

মেয়েটি হাসল। গজদাঁতটা চলকে উঠল, “আপনি সমরেশ মজুমদার?”

“হ্যা।”ঁ নিজের নামটা ওর মুখে শুনেও কী যে ভাল লাগল!

“আপনার গল্প আমার কী যে ভাল লাগে! ‘পলাশবাড়ি’ পড়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আচ্ছা, আপনি কবে আবার কফি হাউসে আসবেন?’

মন বলল, রোজ আসব। মুখে বললাম, “শনিবার বিকেলে।”

“আমি যদি তখন আপনার কাছে আসি তাহলে কি আপত্তি করবেন?”

নীরবে মাথা নেড়ে না বলেছিলাম। সে চলে গেল কিন্তু যাওয়ার সময় যেন আমাকে নিয়ে গেল।

উপরে উঠে বন্ধুদের টেবিলে বসে মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা কী সুন্দর! পাঁচটা কফির দাম আগবাড়িয়ে আমিই দিয়ে দিলাম। সেই রাতে একটা নতুন গল্প লিখে ফেললাম। গল্পের নাম রেখেছিলাম, ‘সামনের শনিবারে’।

আমার তখন একটা অভ্যেস ছিল। লিখেই সম্পাদকের হাতে গল্প দিতাম না। সাত দিন পরে পড়ে দেখতাম। তখন ভাল লাগলে তবেই ‘দেশ’-এর সম্পাদকের কাছে হাজির হতাম। শেষ পর্যন্ত দিনটা এল।

সেজেগুজে বিকেল হওয়ার আগেই কফিহাউসে পৌঁছে তিন তলায় চলে গেলাম। ওখানে বন্ধুরা যেত না। খালি টেবিল পেয়ে বসে আছি। সে এল। আজ তাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। বললাম, ‘বসো।’

সে বলল, ‘বসছি। আর একজন সঙ্গে এসেছে। তাকে নিয়ে আসি?’

সম্মতি জানাতেই সে বেরিয়ে গিয়ে একটি লম্বা যুবককে নিয়ে এসে সামনের চেয়ারের দখল নিল। মেয়েটি বলল, ‘ওর নাম অমলকান্তি। খুব ভাল কবিতা লেখে। কিন্তু আমি চাই ও গল্প উপন্যাস লিখুক। আপনার মতো লিখতে পারলে ওকে কোনও দিন চাকরি করতে হবে না। প্লিজ ওকে গাইড করুন।’

শুকনো মেঝেতে যেন আছাড় খেলাম। ঢোঁক গিলে বললাম, “গল্প উপন্যাস পড়ুন, পড়তে পড়তে লেখা এসে যাবে। এই ব্যাপারটা কাউকে শেখানো যায় না।”

“এক কাজ করো অমল, তুমি দাদাকে একটা গল্প লিখে দেখাও। আমি জানি আপনি ভুল সংশোধন করে দেবেন। ওকে লেখক হতেই হবে। সামনের মাসে আমি একটা স্কুলে জয়েন করছি। টাকাপয়সা নিয়ে ওকে এখন ভাবতে হবে না। আপনি আবার সামনের শনিবারে আসবেন তো। তখন ও গল্প নিয়ে আসবে। আচ্ছা, চলি।” মেয়েটি ছেলেটির পাশে হেঁটে চলে গেল।

আশ্চর্য ব্যাপার, আমার মনে ভার জমল না, খারাপ লাগল না, শুধু নিজেকে একটি গর্দভ বলে মনে হচ্ছিল।

এর পর থেকে শনিবারে কফিহাউসে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম।

বছর সাতেক পরে ট্রেনে দুর্গাপুরে যাচ্ছিলাম একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন থামলে একটি টাকমাথা খাটো চেহারার ভদ্রলোককে দেখলাম দুটো শিশুর হাত ধরে কামরার পেছন দিকের দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছেন।

ওদের পিছনে রোগা শরীর নিয়ে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছেন যে মহিলা তাঁকে দেখে স্তম্ভিত।

কামরায় উঠে বড়টি ডাকছে, ‘মা, মা তাড়াতাড়ি ওঠ।’ কেন জানি না, আমি সামনের দরজা দিয়ে নেমে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে লাগলাম।

সেই মেয়েটির চোখমুখ চিনতে একটুও ভুল হয়নি। বুঝলাম কবি যুবককে গল্পকার করার স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু এই আমি, আমার কেন মন খারাপ হয়ে গেল। উদ্যোক্তাদের ফোন করলাম। “আমায় মার্জনা করবেন, আমার মন ভাল নেই।” প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়া ট্রেনের শেষ বগিটাকে দেখতে এত অসুন্দর লাগছিল!

অথচ এই আমি যখন চোদ্দো বছর বয়সে লুকিয়ে চরিত্রহীন পড়ে ফেলেছি তখনও মেয়েদের সম্পর্কে সামান্য কৌতূহলী হইনি। ঠাকুরদা-পিসিমার সৌজন্যে সাত বছরের সারল্য চৌদ্দতেও থেকে গিয়েছিল।

দূর সম্পর্কের এক চোদ্দ-পনেরো বয়সের আত্মীয়া ক’দিন আমাদের বাড়িতে থাকতে এল।

দ্বিতীয় দিন থেকেই আমাকে একা দেখলে সে গেয়ে উঠত, “হয়তো কিছুই নাহি পাব...।” আমার খুব রাগ হত। পিসিমার কাছে নালিশ করেছিলাম। তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

এর বছর দশেক পরে কলকাতার মেসে রাত সাড়ে দশটায় ঘুমোতে যাচ্ছি, কানে এল রেডিয়োতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইছেন ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’। তড়াক করে উঠে বসলাম। আচমকা আবিষ্কার করলাম আমার মন ভাল নেই। সেই মেয়েটির জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব। সে কোথায় আছে। কেমন আছে, জানি না। পরের জীবনেও তার দেখা পাইনি। কিন্তু এখনও গানের ওই লাইনগুলো কানে এলেই মন খারাপ হয়ে যায়, যা চোদ্দো বছর বয়সে হয়নি।

আমি জন্মেছিলাম চা-বাগানে। সেখানকার চা গাছ, শেড ট্রি, ঝরনা দেখে বড় হওয়ার সময় চার বছর বয়সে জলপাইগুড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। খুব কেঁদেছিলাম।

আসার সময় ওখানকার মাটি রুমালে বেঁধে নিয়ে এসেছিলাম, মাঝে মাঝে দেখতাম সেই মাটির রং বদলে গেছে।

তারপর জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় পড়তে এসে মনে হয়েছিল আমার শেকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে। আমি এখানে শূন্যে ভাসছি। কিন্তু এই দুই জায়গার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এখনও, সেই চা-বাগানে গিয়ে ঝরনার পাশে যখন দাঁড়াই, চায়ের বাগানের ভিতর দিয়ে যখনই হাঁটি, তখনই বুকের ভেতরে চাপ বাড়তে থাকে। তখন কথা না বলে ওদের জানাই, ‘মন ভাল নেই।’

তিন বছর বয়সে বাবার কাছে নটি বয় শু্য-এর বদলে ছুঁচলো জুতো চেয়ে পাইনি, ওইটুকু বয়সে না পাওয়াটাকে বিশাল ব্যাপার মনে হওয়ায় এক দিন খাইনি। পিসিমা গায়ে হাত বুলিয়ে বলেছেন, ‘খেয়ে নে, মন খারাপ করিস না।’

আর এই আমি সকাল থেকে যখন আকাশের গোমড়া মুখ দেখি, ভরদুপুরে কালো মেঘমাখা আকাশটাকে নেমে আসতে দেখি তখন রবীন্দ্রনাথকে বন্ধু বলে মনে হয়, ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার/ দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার।’

নতুন নতুন বোধ জন্মাচ্ছে, আর নতুন করে মন খারাপ হচ্ছে। এখন এই মন আর আমার শরীরে বাস করে না। সে তার ইচ্ছে মতো আবরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বিপ্লবের ফোন পাওয়ার পর থেকে সেই মন ভাল নেই। হঠাৎ ভাবলাম, যখন আমি থাকব না, তখন আমার মন তো থেকেই যেতে পারে এই পৃথিবীতে। এই আকাশে, গাছের পাতায়, ঝরনায়, শিশিরে...। তখন যদি আমার কথা ভেবে সে ভাল না থাকে তখন না হয় রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে।

এখন যেমন আমি তাকে শোনাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

samaresh majumdar Dr. Ranjit Basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE