Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মুখোমুখি...

শ্রীশ্রী

বাংলা বেসিক গান মানেই সুখী গৃহকোণ মার্কা ধাঁচ। আর অধিকাংশ বাঙালির দাবি, বাবার জমিদারি নেই বলেই গান লিখে নোবেলটা পাওয়া হল না। নতুন পুরোনোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুগলবন্দি এক গায়ক ও এক গীতিকারের দুই শ্রী। শ্রীকান্ত আচার্য ও শ্রীজাত।শ্রীজাত: বাংলা গান নিয়ে আড্ডা দিতে বসলে তো থই খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তাই একটা চৌকাঠ থেকে শুরু করলে বোধ হয় এগোতে সুবিধে হবে, যে চৌকাঠের দু’দিকেই গানের উঠোন।/ শ্রীকান্ত: তুমি ঠিক কী রকম চৌকাঠের কথা বলতে চাইছ? সেটা কি একজন মানুষ? নাকি একটা সময়? নাকি গোটা একটা যুগ?

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

শ্রীজাত: বাংলা গান নিয়ে আড্ডা দিতে বসলে তো থই খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তাই একটা চৌকাঠ থেকে শুরু করলে বোধ হয় এগোতে সুবিধে হবে, যে চৌকাঠের দু’দিকেই গানের উঠোন।

শ্রীকান্ত: তুমি ঠিক কী রকম চৌকাঠের কথা বলতে চাইছ? সেটা কি একজন মানুষ? নাকি একটা সময়? নাকি গোটা একটা যুগ?

শ্রীজাত: একজন মানুষও, একটা প্রজন্মও, আবার গোটা একটা যুগও। আমি সুমনদা’র কথা বলছি। বাংলা গানকে তো সুমন নামক চৌকাঠটা ডিঙিয়ে একটা নতুন ঘরে ঢুকতে হয়েছে, সেটা আজ আর কেউ অস্বীকার করেন না নিশ্চয়ই। তুমি তো ওঁর পরে পরেই বাংলায় বেসিক গান গাইতে এসেছ। এবং এত দিন ধরে এই রকম জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গেয়ে চলেছ। ওঁর অবস্থান বা উপস্থিতি তোমাকে কী ভাবে ভাবিয়েছে?

শ্রীকান্ত: আড্ডাটা বেসিক বাংলা গান নিয়ে বটে, কিন্তু সুমনদাকে দিয়ে শুরু করে ভালই করেছ। আসলে পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত বেসিক গানের একটা চালু ধাঁচ ছিল, যেটা শুনলেই বোঝা যেত। সেটা হয়তো এক ধরনের একঘেয়েমি তৈরি করেছিল। সে সব গানের গীতিকার-সুরকারদের অনেকেরই কাজের ধার কমে আসছিল, গায়ক-গায়িকারাও আর আগের মতো গাইতে পারছিলেন না। সব মিলিয়ে বেসিক গান তার জৌলুস হারিয়েছিল। এই সময়ে সুমনদার আসাটা বাংলা গানের একটা বড় বাঁক। সেটা তো আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে অবশ্যই।

শ্রীজাত: কিন্তু সেই জৌলুসহীনতাকে সুমনদার ভিত্তি ভাবলে আমরা ভুল করব। ওঁকে, ওঁর গানকে একক ভাবে দেখাই ভাল। কারণ তার পিছনে একটা অন্য জীবন, অন্য যাপন রয়েছে। ওঁর আসাটা বাংলা গানে ঐতিহাসিক ভাবে মানানসই হয়েছে, এই যা। কিন্তু তা ছাড়া বেসিক গান বলতে আমরা চিরকাল যেটা বুঝে এসেছি, সেটার বিষয়ে আমার একটা অভিযোগ আছে।

শ্রীকান্ত: এই রে! আবার অভিযোগ কেন?

শ্রীজাত: শোনোই না। অভিযোগটা হল, বাংলা বেসিক গান কিন্তু কখনওই একটা টিপিকাল সুখী গৃহকোণ মার্কা ধাঁচ থেকে বেরোতে চায়নি, বা পারেনি। সে তুমি পঞ্চাশের দশকেই বলো আর নব্বইয়ের দশকই বলো। সব সময় একটা আদুরে নিশ্চিন্ততা আর বিরহের প্রলেপ নিয়ে মেতে থেকেছে। এইটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারি না। সুমনদা তো অনেক পরের কথা। লালন থেকে রবীন্দ্রনাথ আমরা কিন্তু তাঁদের সময়ের ছাপ পেয়েছি। নজরুল থেকে সলিল চৌধুরীতেও সেটা আছে। কিন্তু বাকি বেসিক গান শুনলে তার রচনাকাল বোঝা ভার। ১৯৩৭ হোক বা ২০০৭, বাঙালি মোটামুটি একটা সুখী ক্রাইসিস নিয়ে গান বেঁধেছে।

শ্রীকান্ত: একেবারে ঠিক বলেছ। তুমি তো মূলত গান লেখার দিক থেকে বলছ, আমি তো এটাও বলব, সুরের স্ট্রাকচারও বরাবর বেশ গোলগাল, আরামদায়ক হয়ে এসেছে। আমার মনে হয়, স্বাধীনতার উত্তাল সময়টা পেরিয়ে এসে বাঙালি বোধ হয় একটু রিল্যাক্স করতে চাইল। বেশ একটা বালিশে মাথা এলিয়ে দুপুর কাটানোর মতো। এখন ঝামেলাটা হল কী, ওই ধাঁচটা বাজারে হিট করে গেল। ফলে আজ অবধি তার ধারা কায়েম রয়েছে।

শ্রীজাত: অথচ বাংলা কবিতায়, নাটকে বা সিনেমায় সময়ের টানাপড়েন ধরা পড়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বেসিক গান অনেকটাই পিছিয়ে থাকল।

শ্রীকান্ত: মোক্ষম কথাটা বলেছ। দ্যাখো, সিনেমায় বা থিয়েটারে শুধু স্টলওয়ার্টরা সেটা করেছেন, বাকিরা নন। কবিতায় ধারাবাহিক ভাবে সেটা হয়েছে, কারণ কবিতার সঙ্গে বাণিজ্য বা বিপণন জুড়ে নেই। বেসিক গানের হাত সেখানেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সফল ব্যবসার নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ ছেড়ে তাই সে আর নতুন কথা বলার ঝুঁকি নেয়নি।

শ্রীজাত: আরেকটা ব্যাপারও আছে। সলিল চৌধুরী বা সুমনের গানের সঙ্গে কিন্তু খুব স্পষ্ট ভাবে তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শের একটা যোগ থেকেছে। বাকিদের বেলায় সেটা হয়নি। এটাও বোধ হয় তফাতের একটা বড় কারণ। কিন্তু এ সবই তো আগের কথা। সুমনদা আসার পর বাংলা বেসিক গান কি আদৌ কোনও বাঁক নিল? ওঁরই একটা গান ছিল, ‘তুমি গান গাইলে বিশেষ কিছুই হল না, যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল’। এই কথাটা কিন্তু ফলেও গেল। বাংলা গান একটু নতুন সুরে আর কথায় ওই প্রেমের ব্যথা আর সুখী আকুলতার কথাই বলে চলল। সব গানে নয়, বেশির ভাগ গানে।

শ্রীকান্ত: এই ব্যাপারটা আমাকেও খুব হতাশ করেছে। কিন্তু আমি দেখেছি, আমাদের বা তার আগের প্রজন্মের মানুষজন একটু এলিয়ে পড়া গানই পছন্দ করেন। গান যদি ভাবাতে শুরু করে, তখন হয়ে যাবে মুশকিল। যে গান কখনও নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায় না, কোনও প্রশ্ন তোলে না, তাঁরা বরাবর সেই গানকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। আর এখানেও ব্যবসার কথা, মুনাফার কথা এসে পড়ে। অধিকাংশ মানুষ যা শুনতে চায়, সেটাই তো বেশি করে তৈরি হয়, তাই না? তবে এখানে কিন্তু আরেক জনের কথাও বলতে হবে, সেটা হল নচি।

শ্রীজাত: অবশ্যই। নচিদা যেমন একটা নিজস্ব সুরের ধাঁচ নিয়ে এল, তেমনই লেখায় পাওয়া গেল একটা কলার-তোলা তোয়াক্কাহীন দুঃসাহস।

শ্রীকান্ত: একদম ঠিক। ওই গানটার কথাই ভাবো না, ‘তুমি কি আমায় ভালবাসো’। ওর দ্বিতীয় লাইনেই নচি লিখছে, ‘যদি না বাসো, তবে পরোয়া করি না’। এই এত দিনের প্যানপেনে বিরহের ট্র্যাডিশনকে একটা লোক বুড়ো আঙুল দেখাল। এইটা নচি করেছে। এই অ্যাটিটিউডটা বাংলা গানে ছিল না।

শ্রীজাত: বা ধরো যেখানে নচিদা লিখছে, ‘অমরত্বের লোভ করুক বিক্ষোভ/ আমার মৃতদেহে ঝুলবে নোটিস বোর্ড/ কর্তৃপক্ষ দায়ী না’ এই যে সব তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য, এটাও নতুন। একটা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, প্রতারিত, দিক-হারানো প্রজন্মের ভাষা। কিন্তু তুমি খেয়াল করে দ্যাখো, এই অন্য কথা বলতে চাওয়া গানগুলোকে কিন্তু আলাদা প্যাকেজিং-এ নিয়ে যাওয়া হল। মূলস্রোতের বাংলা আধুনিক গানের সঙ্গে রাখা হল না। এটা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েও হয়েছে। ওই রকম আধুনিক গান তো বাংলা ভাষায় আর তৈরি হয়নি, কিন্তু তাকেই আগেভাগে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নাম দিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। আসলে এই সব গানবাজনাকে আলাদা ভাবে লেবেল না করলে বাকি বাংলা আধুনিক গানের সাফল্য কিন্তু বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত।

শ্রীকান্ত: এটা তো রেকর্ড সংস্থাগুলোর নীতি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও দ্যাখো না, পাঁচ রকম প্যাকেজিং না করলে মুনাফাটা আসবে কোত্থেকে?

শ্রীজাত: আরও একটা ব্যাপার এখানে লক্ষ করার মতো, ঠিক এই সময়টায় প্রচুর রিমেকে বাজার ছেয়ে গেল।

শ্রীকান্ত: কখনও ভেবে দেখেছ সেটা কেন হল? আমি নিজে এক সময়ে রিমেকের মধ্যে ছিলাম, তাই ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। যেটা আগেই বলছিলাম, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বাংলা বেসিক গানে একটা ভাঁটার টান পড়ল। পাশাপাশি হল কী, রেকর্ড চলে গিয়ে ক্যাসেট এল। যে মুহূর্তে ক্যাসেট এল, প্রোডাকশনের কোয়ান্টিটি বেড়ে গেল। তা ছাড়া, একটা রেকর্ড প্লেয়ারের চাইতে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার অনেক সস্তা। ফলে রেডিয়োর বাইরে ঘরে ঘরে গানের ডিমান্ড তৈরি হল। এখন কোয়ান্টিটি তো বাড়ল, কোয়ালিটিটা কোথায়? অনেক বেশি সংখ্যক গানের একটা চাহিদা তৈরি হল, কিন্তু জোগান আগের মতোই কম। ফলে সহজ উপায়, রিমেক। কারণ তথাকথিত স্বর্ণযুগের বাংলা গানের কোনও মার নেই, তাই নতুন বোতলে পুরে আবার তার বিক্রি শুরু হল। তবে রিমেকের কিন্তু একটা ভাল দিকও ছিল। রিমেক এমন অনেক গানকে তুলে আনল, যেটা তার নিজের সময়ে তত প্রচার পায়নি। হয়তো খুব ভাল গান, কিন্তু সে যুগে জনপ্রিয় হয়নি। মানুষ কিন্তু নতুন করে সেই গানগুলো আবিষ্কার করল।

শ্রীজাত: আসলে ব্যাপার কী জানো, নস্ট্যালজিয়ার মধ্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় আছে। যা ইতিমধ্যেই জানা, তা তোমাকে অতিরিক্ত ভাললাগাই দেয় শুধু, ভাবায় না আর। বাঙালি চিরকাল স্বর্ণযুগমুখী। ফলে এমন একটা জাতির জন্য বোধ হয় রিমেকই আদর্শ প্রোডাক্ট।

শ্রীকান্ত: নস্ট্যালজিয়া খারাপ না, যত ক্ষণ না অতি মাত্রায় হচ্ছে। এই করেই কোম্পানিগুলো গানের বাজারটা শেষ করে দিল। এক সময় তারাই বাজারের হাল ধরেছিল, আর আজ যে বেসিক বাংলা গানের বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার দায়ও কিন্তু ওই মিউজিক কোম্পানিগুলোকেই নিতে হবে। আগে অডিও কোম্পানিগুলোয় গানবাজনার সমঝদার মানুষ ছিলেন। তাঁরা জানতেন কোন গানটা কাকে দিয়ে সুর করালে বা লেখালে ভাল হয়। আজ সে সব মানুষ কোথায়? গীতিকার? তাকে আবার পয়সা দিতে হবে? এই হচ্ছে এখনকার লোকজনের ভাবনাচিন্তা।

শ্রীজাত: তুমি দেখছি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিলে। গীতিকারদের যে একেক সময়ে কত নিচু নজরে দেখা হয়, সেটা তো আমি জানি। গানবাজনার অন্দরমহলে তার প্রবেশই নেই, তাকে উঠোন থেকেই বিদেয় করো। একজন গায়ক বা সুরকারের যে কদর, তার ছিটেফোঁটাও তো গীতিকারের নেই। তাহলে ‘লা লা লা লা’ করে গাইলেই হয়, খামোকা লোক ডেকে এনে গান লেখানোর কী দরকার? আমি নিজে গান লিখতে গিয়ে এমন সব শর্ত আর পারিশ্রমিকের কথা শুনেছি যে ভয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে। হয়তো বেশ দামি একটা প্রজেক্ট, কিন্তু গীতিকারের সঙ্গে গড়িয়াহাট ফুটপাথের দরাদরি। অর্থ তো নেইই, সম্মান দিতেও কোথায় যেন বাধে। এখন যদিও অবস্থা একটু ভাল, আমরা যারা গান লিখি, তাদের কথাও আলাদা করে ভাবা হচ্ছে, বলা হচ্ছে।

শ্রীকান্ত: তা হলেই বলো, গান লেখার জন্য তুমি কাউকে মোটিভেট করতে পারবে? তার উপর একটা চালু ধারণা আছে, গান লেখা খুব সহজ কাজ। সহজ বলেই রবীন্দ্রনাথ ২,২০০ গান লিখেছিলেন।

শ্রীজাত: শুধু সহজ বলেই নয়, ওঁর হাতে অঢেল সময় ছিল আর বাবার জমিদারি ছিল বলে। অনেকেই ভাবেন, নেহাত অফিস যেতে হয় আর বাবার জমিদারি নেই বলেই বাংলা গানটা লেখা হল না। নোবেলটাও ফসকে গেল।

শ্রীকান্ত: যা বলেছ!

শ্রীজাত: আচ্ছা, এই সবের পাশাপাশি কিন্তু আরেক ধরনের গানবাজনার একটা চল হল। ব্যান্ড।

শ্রীকান্ত: একদম ঠিক। কিন্তু ব্যান্ডের কথায় আসার আগে আমি বলব, সুমনদা বা নচির পরের সময়কার বাংলা গানবাজনায় বড্ড বেশি পাশ্চাত্যের প্রভাব শুরু হল। বাংলা গানের একটা অ্যংলেসাইজড ভার্সান যেন। ইংরেজিপনার চূড়ান্ত। এটায় হল কী, গানের চাইতেও তার আনুষঙ্গিকের দিকে বেশি করে ফোকাসটা সরে গেল।

শ্রীজাত: অঞ্জনদার গান কিন্তু পশ্চিমের ধাঁচ নিয়েই তৈরি। অথচ দ্যাখো, একেবারে মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো করে কথা বলেছে তাঁর গানগুলো। হয়তো তার বেশির ভাগই শহুরে, কিন্তু আবেগটা খাঁটি। তবে হ্যাঁ, সকলের গানে এই ভারসাম্যটা বজায় থাকেনি।

শ্রীকান্ত: ওই ভারসাম্যটাই তো আসল। হঠাত্‌ করে ইংরেজিপনার একটা জোয়ার এল। এটা কেবল গানের ব্যাপার নয়। এখনকার কত জন ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়ে বলো তো? চারপাশটা হুট করে কেমন বিলেতমার্কা হয়ে উঠল। ব্যান্ডের আর দোষ কী, সে তো সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। তাই তাদের গানবাজনাতেও সেই ছাপটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।

শ্রীজাত: আমি অবশ্য বলব, বেশ কিছু না হলেও, ব্যান্ডের কিছু কাজ আমার ভাল লেগেছে। একক ভাবে শিলুদার কিছু গানের কথাও আসতে পারে। একটা একরোখা ধাঁচ ওর গানকে বরাবর অন্য রকম করে রেখেছে। তবে আলাদা করে বলতেই হবে চন্দ্রবিন্দুর কথা। ওরা কিন্তু নতুন একটা স্পেস তৈরি করল। আমরা একটা বিবর্তন পেলাম গানে। একেবারে আমাদের প্রজন্মের ভাষা নিয়ে ওরা এল। আর যেটা নিয়ে এল, সেটা হচ্ছে উইট। যা বাংলা গানে খুব কম ছিল।

শ্রীকান্ত: এইখানে আমি একমত। আমারও ওদের গান খুব ভাল লাগে।

শ্রীজাত: ভাল লাগা মানে তো রিলেট করতে পারা। আমি ওদের সঙ্গে নিজের বেঁচে থাকা, নিজের চারপাশটা রিলেট করতে পারি। তার মানে এই না যে ক্যাকটাস বা ফসিলস-এর সঙ্গে পারি না। আবার মহীনের বহু গান বহু সময়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। ভাবতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমার বড় হয়ে ওঠার বাস্তবতা আর মজার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুর অ্যাপ্রোচটা খুব মেলে।

শ্রীকান্ত: আহা, মহীনের কথা যখন বললেই, কী সব গান বানিয়ে গিয়েছেন বলো তো! আর গৌতমদার ওই রকম সব লেখা। বাংলা গানে মহীন একটা মনে রাখার মতো ঘটনা। আমার তো ভারি প্রিয়। আসলে কী জানো, মজা না থাকলে যে কোনও শিল্পই শুকনো। বিলায়েত্‌ খান সাহেবের একটা ঠুমরিতেও কিন্তু সেই মজা তুমি পেতে পারো।

শ্রীজাত: রবীন্দ্রনাথের গানেও মজা লুকিয়ে রয়েছে। সুরে, ভাষায়, অ্যাপ্রোচে। কিন্তু ওঁর প্রসঙ্গ এলেই সকলে কেমন গম্ভীর হয়ে যায়।

শ্রীকান্ত: ওটাও একটা প্যাকেজিং।

শ্রীজাত: এই প্যাকেজিং-এর চক্করে একটা চমত্‌কার ব্যাপার কিন্তু পুরোপুরি মুছেই গেল। আর সেটা নিয়ে কারও মনে কোনও আক্ষেপও দেখি না।

শ্রীকান্ত: কী বলো তো?

শ্রীজাত: বাংলা রাগাশ্রয়ী গান। বাংলা গানবাজনার কত বড় সম্পদ বলো! আজ চেষ্টা করেও কোথাও শুনতে পাবে না। আমি তো ছোট থেকে আসরে আসরে গান শুনে বেড়িয়েছি। তুমিও শুনেছ। খুব কম রাতই বাড়িতে ঘুমিয়ে কাটাতাম। সে সময়ে বড় হোক ছোট হোক, মিউজিক কনফারেন্সে বাঙালি গায়ক মানে রাগাশ্রয়ী বাংলা গান থাকবেই। আর শ্রোতারাও মুখিয়ে থাকতেন শুনবেন বলে।

শ্রীকান্ত: সে আর বলতে! তোমার মামা, মানস চক্রবর্তীর মুখেই তো কত বার অসামান্য সব বাংলা গান শুনেছি। অজয়দা একটা সময়ে রেগুলার রাগাশ্রয়ী গেয়ে গিয়েছেন, অনবদ্য সে সব গান। জটিলদাও কম্পোজ করেছেন মনে রাখার মতো রাগাশ্রয়ী। আবার ওদিকে আমি শিপ্রাদি-র কথাও বলব। কিন্তু সেটা একটা অন্য সময় ছিল।

শ্রীজাত: আমি তো মামাকে কত বার আসরেই নতুন গান বেঁধে নিয়ে গাইতে শুনেছি। সন্ধের পর সন্ধে তাঁকে দেখেছি বাংলা গান কম্পোজ করে যেতে। এতদিনকার একটা ধারা। ভাবো, তারও আগে, তারাপদ চক্রবর্তী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বা জ্ঞান গোঁসাই কেমন হুট করে বন্ধই হয়ে গেল যেন, না?

শ্রীকান্ত: কত জন বাঙালি ছেলেমেয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করছে এখন? ক’টা অনুষ্ঠান হয় এখানে? কে গাইবে, এটা যেমন একটা প্রশ্ন, কোথায় গাইবে, সেটাও তো জানা নেই। আসলে কী জানো, সার্বিক ভাবেই আমাদের সেনসিভিটি অনেক কমে গিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই।

শ্রীজাত: চর্চাও তো নেই। আগে মধ্যবিত্ত পাড়ায় সন্ধে নামলেই বাড়ি বাড়ি গলা সাধার আওয়াজ পাওয়া যেত। বহু দিন আর কানে আসে না। গানের সঙ্গে গোড়া থেকে এখন আর যোগ তৈরি হয় না বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের।

শ্রীকান্ত: আক্ষেপ করে লাভ নেই, জানো তো। নিজেরা যে এখনও মনের মতো গানবাজনা নিয়ে মেতে থাকতে পারছি, এটাকেই প্রাপ্তি বলে ভেবে নিতে হবে।

শ্রীজাত: ঠিক বলেছ। আমাদের আড্ডায় হয়তো আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বেশি হল, কিন্তু এত কথার ফাঁকে একটা কথা স্বীকার করে নিতেই হবে শ্রীকান্তদা।

শ্রীকান্ত: অনেক স্বীকারোক্তি তো হল। আবার কী?

শ্রীজাত: সেটা হল এই যে, বেশ কয়েক বছর যাবত্‌ বাংলা ছবির গান কিন্তু মানুষ আবার শুনছেন। একটা খুব খারাপ সময় গিয়েছে ছবির গানে। এখন আবার মানুষ ছবির গানের জন্য আলাদা করে ছবি দেখতে যাচ্ছেন। ছবির গান ভাল ব্যবসা করছে। সবচেয়ে বড় কথা, লোকে মনে রাখছে। অন্তহীন বলো বা অটোগ্রাফ, জাতিস্মর বলো। মানুষ ছবির গান নিয়ে আবার কথা বলছে।

শ্রীকান্ত: দ্যাখো, অনেক নেগেটিভ কথা আমরা বলে ফেলেছি। একটু পজিটিভ নোটে শেষ করা যাক। এই বাঁকটাও খুব জরুরি ছিল। আরেকটা জরুরি জিনিস যেটা হয়েছে, তোমার সামনেই বলছি, সেটা হল তুমি গান লিখতে এসেছ।

শ্রীজাত: বোঝো! আমি গান লিখতে এসে আমার ছাড়া কারও কোনও উপকার হয়নি।

শ্রীকান্ত: উপকারের কথা নয়। এক দিকে কবি এবং আরেক দিকে গানবাজনা বোঝে, এমন মানুষ গান লিখতে এলে খুব ভাল ঘটনাই বলতে হবে সেটা। তুমি দ্যাখো না, রবীন্দ্রনাথ থেকে সুমনদা, আগে কিন্তু কবিই। তবে একা তুমি হলে চলবে না। তোমার মতো আরও অনেকে যদি এগিয়ে আসে, বাংলা গানের ভাল বৈ মন্দ হবে না।

শ্রীজাত: এ নিয়ে আমার কোনও বক্তব্যই নেই, কিন্তু গরম আড্ডার ফাঁকে চা জুড়িয়ে গেল। আরেক কাপ বলি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

srikantaacharya srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE