বাংলার মা রত্নগর্ভা। যে দিকেই ফিরে তাকানো যায়, আমরা পেয়েছি অসাধারণ সব প্রতিভা—সাহিত্যে, রাজনীতিতে, চিত্রশিল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি শাখায়। খেলাধুলোয় যেটুকু অপরিপূর্ণতা ছিল, তা-ও ভরিয়ে দিয়েছেন লিয়েন্ডার পেজ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আলাদা ভাবে বলছি সঙ্গীতের কথা—এই বাংলার মতো শিল্পীসমন্বয় আর কোথাও ঘটেনি। শুধু আধুনিক গানের পুরুষ শিল্পীদের কথাই ধরুন। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি—পঙ্কজ মল্লিক, সুধীরলাল, রবীন মজুমদার, জগন্ময় মিত্র, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সত্য চৌধুরী, অখিলবন্ধু, মানবেন্দ্র, শ্যামল, সতীনাথ—সর্বোপরি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে। শ্রোতা মাত্রই বলবেন, অসাধারণ, কালজয়ী কত গান আমরা উপহার পেয়েছি এঁদের কাছ থেকে। আনন্দে শেয়ার করেছি, বিরহে কেঁদেছি সেই সব গানে—সব সত্যি। কিন্তু সবার থেকে আলাদা মান্না দে এবং মান্না দে-র গান। তিনি একক, তিনি অনন্য। সবার থেকে আলাদা। মান্না দে।
মান্না দে নিজেকে সব সময় বলতেন আধুনিক গানের শিল্পী। রাগ সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন, যখন যে ভাষায় গান গেয়েছেন, সেই ভাষাটি সযত্নে শিখেছেন। মুম্বই তাঁর অন্যতম সঙ্গীত ক্ষেত্র ছিল বলে উর্দু ভাষা শিখেছিলেন মাতৃভাষার মতোই। কিন্তু সবই আধুনিক ও সিনেমার গান অনায়াসে গাইবার জন্য। কোথাও যেন কোনও ভাবে না আটকায়।
মান্নাদার প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড ১৯৫৩ সালে। শেষ অ্যালবাম ২০১০ সালে। এই বিশাল ব্যাপ্ত সময়ে মান্না সৃষ্টি করেছেন এক অতুলনীয় ইতিহাস। প্রথম অ্যালবামেই চমক। একটু স্মরণ করে দেখুন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যে আধুনিক গান হত, প্রায় সব গানেরই বিষয় ছিল প্রেম। সেই প্রথা ভাঙলেন মান্নাদা। প্রথম গানটিই ফিলজফিকাল। সেই সময়ের নিরিখে যা একটা ট্রেন্ড সেট করেছিল— কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল, কোথায় পথের প্রান্ত/ ঠিকানা হারানো চরণের গতি/হয়নি কি আজো শ্রান্ত।’ তখন তো দুটি করে গান হত—অন্য গানটিতে আরও বৈচিত্র। ইংরাজি গানের প্রতি মান্নাদার ভালবাসা এবং টান নিয়ে আগে লিখেছি। মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় একটি ইংরেজি গান, যে গান তিনি শিখেছিলেন সুলোচনাদেবীর কাছে, সেই ‘I was dancing’ গানের সুরে গৌরীপ্রসন্নকে দিয়ে লেখালেন—‘হায়, হায় গো, রাত যায় গো, দূরে তবু রবে কি।’ লতা মঙ্গেশকরের জন্য গান দুটি তৈরি করেছিলেন। লতাজি সে গান গাইতে না-পারার জন্য মান্নাদাই গান দুটি রেকর্ড করেন। সেই বিশেষ পরিস্থিতির কাছে বাংলা সঙ্গীত চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ রইল।