Advertisement
E-Paper

পছন্দ করতেন মিষ্টি রোমান্টিক গানে সুর করতে

সুরের তুলিতে এমন ছবি আঁকলেন, মনে হল চোখের সামনে অপরূপ নিসর্গ ও প্রেয়সীকে দেখা যাচ্ছে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমান্নাদাকে সুরকার হিসেবে পাওয়া আমার জীবনে এক পরম প্রাপ্তি। আমার লেখা ৩১টি গানে মান্নাদার সুরারোপ ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এ জন্য অনেক আলোচনা, ভাঙা-গড়া, নানা সময়ে এক নতুন মান্নাদাকে আবিষ্কার করা।

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৫ ০০:১০

মান্নাদাকে সুরকার হিসেবে পাওয়া আমার জীবনে এক পরম প্রাপ্তি। আমার লেখা ৩১টি গানে মান্নাদার সুরারোপ ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এ জন্য অনেক আলোচনা, ভাঙা-গড়া, নানা সময়ে এক নতুন মান্নাদাকে আবিষ্কার করা।

বৌদির স্মরণে অসাধারণ ৪টি গানে সুর করেছিলেন মান্নাদা। সবাই জানেন, মিউজিক ট্র্যাকও সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত গানগুলি গাওয়ার আগেই মান্নাদা চলে গেলেন। একদিন দুপুরবেলা মান্নাদার ফোন : ‘আপনার একটা গানে সুর করছি, কেমন লাগছে দেখুন তো!’ মান্নাদা গাইতে থাকলেন ‘তোমার জন্য না-মেলা হিসাব সহসা মিলে যায়/তোমার জন্য বিবর্ণ ফুল রং আজো ফিরে পায়...’। সত্যি, অপূর্ব সুর। হঠাৎ মনে হল, দুপুরবেলা, এই সময় মান্নাদা তো একটু ঘুমান। আজ কী হল? বললাম সে কথা। শুনে মান্নাদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঘুম আর আসে কই? এই যে সুলু (বৌদি) শুয়ে আছে, বলতে গেলে কোনও জ্ঞান নেই, হয়তো ভিতরে ভিতরে কত কষ্ট পাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সুরটা করছিলাম।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মরণাপন্ন প্রিয়তমা সহধর্মিণী, তাঁর জীবনে ভালবাসার প্রেরণা। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে মান্নাদা সুরে বাঁধছেন ভালবাসার গান। এই গানটি মান্নাদা বৌদির স্মরণিকায় রেখেছিলেন। টাইটেল সং—‘জানি, জানি আবার দেখা হবে’, মান্নাদা দ্বিতীয় অন্তরাটা আর একবার লিখতে বললেন। মান্নাদার পছন্দ হল না। বারবার লিখছি কিন্তু হচ্ছে না। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত মান্নাদা একদিন বললেন, ‘‘দেখুন, সারাজীবন অনেক সাজানো গোছানো কথায় সুর করেছি, গান গেয়েছি। এই গানে আমি সে রকম কথা চাই না। পরিষ্কার করে লিখুন—আমি মৃত্যু চাই। যত তাড়াতাড়ি হয় আমি সুলুর কাছে যেতে পারব।’’ আমি বড় দুঃখে মান্নাদার কথা রেখেছিলাম।

একটা গান লিখেছিলাম ‘চলো রে মন বৃন্দাবনে’। মান্নাদা গানটা পড়ে বললেন, ‘এ কী রকম গান লিখেছেন বলুন তো!’ ১০ লাইনের সঞ্চারী! মনে হচ্ছে একটা মানুষের মুখটা ছোট, শরীরটা ছোট, আর পেটটা ইয়া বড়, যেন পিলে হয়েছে।’ আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘দাদা, ভুল হয়ে গেছে। ঠিক করে দিচ্ছি।’ মান্নাদা কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি একবার গানটা পড়ুন তো!’ ঈশ্বরের নাম করে গানটা পড়লাম। মান্নাদা শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি তো একটা ছন্দ ভেবে গানটা লিখেছেন। দেখুন, গানটাতে কেমন সুর করি!’ কথার এতটুকু পরিবর্তন না করে কীর্তনের রসে চুবিয়ে অসাধারণ সুর করলেন মান্নাদা। সুরকারের সুবিধার জন্য মান্নাদা কোনও সময়ে বলতেন না—এটা কাটুন ওটা ছাঁটুন। বলতেন, গীতিকারেরা কত চিন্তাভাবনা করে লেখেন। তাঁদের তো একটা রেসপেক্ট দিতে হবে।

মান্নাদার খুব পছন্দের লেখা ছিল—‘এক নির্জন সৈকতে’। সব সময়ই বলতেন মিষ্টি রোমান্টিক গানে সুর করতে এবং গাইতে পছন্দ করেন। লেখাটি পড়ে বললেন, ‘মেয়েটি সূর্যাস্তের শোভা দেখছে। তার মুখে সূর্যের শেষ আলো। আকাশও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। জমিয়ে সুরটা করতে হবে।’ ২০০৬ সালে মান্নাদার শেষ পুজোর অ্যালবাম ‘ঠিক ছবির মতো’-তে এই গানটা গেয়েছিলেন নিজের সুরে। সুরের তুলিতে এমন ছবি আঁকলেন, মনে হল চোখের সামনে আমরা অপরূপ নিসর্গ ও প্রেয়সীকে দেখছি।

মান্নাদা সুর করছেন। আমি বসে আছি। মাঝে মাঝে জিগ্যেস করছেন, ‘কেমন লাগছে?’ আগে প্রথম থেকে সব সময় ‘দারুণ দারুণ’ বলে মান্নাদার কাছে ম়ৃদু ধমক খেয়েছি। বলতেন, ‘শুধু দারুণ দারুণ বলবেন না। কথাগুলো সুরে ঠিকমতো ফুটছে কি না দেখুন।’ আমি না বলে পারলাম না, ‘আম্পায়ার স্বয়ং ভগবান’ গানটিতে সত্যি অপূর্ব সুর করেছেন আপনি। মান্নাদা তবু বলছেন, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান। ব্যাটাকে ধরতে হবে। কোথায় পালাবে!’ প্রায় আধঘণ্টা বাদে, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে মান্নাদা তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এত সময়ে বাগে পেয়েছি। এবার শুনুন।’ যা শুনলাম তা সুরের অমৃত। ঘুরে বেড়ায় চারপাশে। যে জানে সে ধরতে পারে। যেমন পারতেন মান্নাদা।

কেমন ভাবে সুর করতেন মান্নাদা? আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথমেই হারমোনিয়ম নিয়ে বসতেন না। বলতেন, ‘তা হলে পছন্দের রিডে হাত চলে যায়। লেখা পড়তে পড়তেই গানের ছন্দ আর সুর চলে আসে। গানের বাণী ভাল করে বুঝতে হবে, তবেই তো ঠিক সুরটা আসবে।’

গতকাল গিয়েছিলাম সানফ্র্যান্সিস্কোয়। কাছেই থাকেন রমাদি (মান্নাদার বড় মেয়ে)। খুবই অসুস্থ। তাই আর বিরক্ত করিনি। ২০১০ সালের আগে মান্নাদা এখানে প্রায় প্রতিবছর আসতেন। থাকতেন কয়েক মাস। আমাকে এখানে গান পাঠাতে বলতেন। রমাদির সিলিকন ভ্যালির এই বাড়িতে বসে মান্নাদা সুর করেছিলেন—‘আকাশ দ্যাখে মুখ’। কলকাতায় এসে মান্নাদা বললেন, ‘দেখুন তো সঞ্চারীটা একটু অন্য রকম ভাবে লেখা যায় কি না।’ আমি বেশ কয়েকটা সঞ্চারী লিখে মান্নাদাকে দিলাম। মান্নাদা শুধু বললেন, ‘দেখছি’। রেকর্ডিঙের সময় আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মান্নাদা সেই পুরনো সঞ্চারীটাই রেখেছেন। আমাকে বললেন, ‘যেটা ছিল সেটাই রেখে দিলাম, পাছে আপনি আবার বলেন, মান্নাদা সুর করতে পারেনি। তাই নতুন করে লিখতে বলছে।’ আমি বুঝলাম নতুন করে লেখা আমার সঞ্চারীগুলো ‘বেটার’ হয়নি। এও বুঝলাম ভাল না-লাগার কথাও এমন ভাবে বলা যায়।

মান্নাদার সুর করা এবং গাওয়া ‘হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা/.বাংলা থেকে সুদূর আমেরিকা/অনেক ঘুরেছি আমি।’ এই গানটি সুরকারদের কাছে শিক্ষার বিষয় হতে পারে। গানটা দু’একবার শোনার পর সুরের রহস্য আমার কাছে উন্মোচিত হয়। হিমালয় ও কন্যাকুমারিকা-র বৈপরীত্য—একটি পর্বত, একটি সমুদ্র। ওদিকে আবার ‘বাংলা’র মাটির গন্ধ, আমেরিকার দূরত্ব— মান্নাদার সুরে প্রতিটি জায়গায় যথাযথ সুরপ্রয়োগ....ভাবতে ভাবতে মাথা ঘুরে যাবে! কত চিন্তা করে মান্নাদা সুর করতেন। শুনলে মনে হবে না কোনও জটিলতা আছে, শ্রোতাদের ভাল লাগানোর পাশাপাশি মান্নাদা তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিকই করে যেতেন।

হাল আমলের শিল্পীরাও মান্নাদার সুর থেকে বঞ্চিত হননি। মান্নাদার সুরে নিউ ইয়র্কের আইরিন ঝুমুরের জন্য পাঁচটি গান লিখেছিলাম। মান্নাদা নিজে আমাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ঝুমুরের হোটেলে। ‘আহা! মেয়েটা এত কষ্ট করে এসেছে। আমি গিয়েই গানটা শিখিয়ে দিয়ে আসি’। ভাবতে পারছেন, এক অচেনা গায়িকা, আর মানুষটি হলেন মান্না দে।

অশোক ভট্টাচার্যের জন্য মান্নাদা ৪টি গানে সুর করে দিয়েছিলেন। এ সব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সুরকার গানগুলো ক্যাসেটে গেয়ে শিল্পীকে দিয়ে দেন। ওখানেই তার কাজ শেষ। মান্নাদা কিন্তু অত ব্যস্ততার মধ্যেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অশোককে গানগুলো শিখিয়েছেন। শেষ তিনটে গান তো বেঙ্গালুরুতে বসে সুর-করা এবং অসুস্থ শরীরেও অশোককে সামনে বসিয়ে শিখিয়েছেন।

নচিকেতা ঘোষের কন্যা শ্রাবণীর জন্য মান্নাদা অসাধারণ দুটি গানে সুর করেছিলেন। সবাই ধন্য ধন্য করেছে। সুর তো অসাধারণ, অনেকে আমার লেখারও প্রশংসা করেছে। আমি নিজের কাছেই খুব লজ্জিত হয়েছি। সত্যি কথাটা তো আমি জানি। লেখাটা খুব সাধারণ। মান্নাদার সুরের গুণে সেই লেখাই অসাধারণ মনে হয়েছে।

মান্নাদার করা অপূর্ব চারটি সুরে সুদেব দে-র জন্য চারটি গান লিখেছি। ওই একই ব্যাপার। এমনই সুর যে কথাও প্রাণ পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। যেমন, ‘আমাকে নতুন করে চিনেছি’, আবার অন্য আঙ্গিকের ‘সবই যদি হয় অভিনয়’।

এটা ঘটনা, শুধু প্রচারের অভাবে মান্নাদার শেষদিকের গানগুলো অনেকে জানতে পারেননি। এ নিয়ে মান্নাদার খুবই দুঃখ ছিল। তাঁর তো নতুন করে কিছু পাওয়ার ছিল না। শুধু সুরের স্রোতে ভাসতে চাইতেন, চাইতেন সবাইকে ভাসাতেও। শেষ দিকে তাঁর সেটুকু চাওয়া বেশি ছিল কি?

Manna Dey Debprasad ananda plus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy