Douglas Mawson leader and sole survivor of the most terrible polar exploration ever dgtl
Antarctica expedition
ভয়ঙ্কর তুষার অভিযানে দুই সঙ্গীর মৃত্যু! কুকুরের মাংসে প্রাণ বাঁচিয়ে, বরফের সমুদ্র পেরিয়ে ফেরেন অভিযাত্রী
সবচেয়ে বিভীষিকাময় ও ভয়ঙ্করতম আন্টার্কটিকা অভিযানের সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে তাঁর। সবচেয়ে বিপদপূর্ণ মেরু অন্বেষণের ইতিহাসে ডগলাস মাওসনের নাম তালিকার সর্বাগ্রে রয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৮
যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই তুষারশুভ্র বরফের চাদর। মাইলের পর মাইল বরফে ঢাকা। সবুজের প্রায় কোনও চিহ্ন নেই। বরফের রাজ্যে যে কোনও মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় ভয়ঙ্করতম তুষারঝড়। এর কবলে পড়লে বেঁচে ফেরা দুঃসাধ্য।
০২২৮
ভয়ঙ্কর আন্টার্কটিকা। এখন মাসের পর মাস সূর্যহীন আকাশের আন্টার্কটিকা। শুধুই রাত। গড় তাপমাত্রা -৭৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই আন্টার্কটিকায় ছ’মাসের বেশি সূর্যের আলো পড়ে না। তার মধ্যে তিন মাস, মার্চ থেকে জুন, থাকে নিকষ কালো রাত্রি।
০৩২৮
এমন এলাকায় গিয়ে বসবাসের তুলনায় পাণ্ডবদের বনবাসও সামান্য। লোক নেই, জন নেই। গাছপালা থাকা সম্ভব নয়। কয়েকটি মাত্র প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর বাস। প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দুর্গম স্থানে অভিযানের হাতছানি এড়াতে পারেননি বহু অভিযাত্রীই।
০৪২৮
আধুনিক প্রযুক্তি, উপযুক্ত শীতপোশাক ও অন্যান্য সুযোগ -সুবিধার কারণে এখন আন্টার্কটিকা অভিযান অনেকটাই সহজ। কিন্তু ১০০ বছর আগে হেঁটে আন্টার্কটিকা অভিযান প্রায় দুঃস্বপ্ন মনে করা হত। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়া প্রথম আন্টার্কটিকা অভিযান শুরু করে।
০৫২৮
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে রোমহর্ষক কুমেরু অভিযানের উদাহরণ ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন স্কটের মেরু অভিযান। ভাগ্যের পরিহাসে নরওয়ের অভিযাত্রী রোনাল্ড আমুন্ডসেনের হাতে পরাজিত হন স্কট। সেই স্কটের মেরু অভিযানকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আরও এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী।
০৬২৮
স্কটের অভিযান প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও সবচেয়ে বিভীষিকাময় ও ভয়ঙ্করতম আন্টার্কটিকা অভিযানের সঙ্গে সেই অভিযাত্রীর নাম জড়িয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মেরু অন্বেষণের ইতিহাসে সেই ডগলাস মাওসনের নাম তালিকার সর্বাগ্রে রয়েছে।
০৭২৮
ডগলাস মাওসন ছিলেন এক জন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় ভূতত্ত্ববিদ, অ্যান্টার্কটিকার অভিযাত্রী। রোনাল্ড আমুন্ডসেন, রবার্ট ফ্যালকন স্কট এবং আর্নেস্ট শ্যাকলটনের সঙ্গে একই সারিতে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম।
০৮২৮
কাহিনির শুরু স্কটের মেরু অভিযানে দুই বছরের মধ্যে। ১৯১২ সালে মাওসন আন্টার্কটিকা অভিযানে পাড়ি দেন দুই সঙ্গী বেলগ্রেভ নিনিস এবং জেভিয়ের মার্টজ়কে নিয়ে। এই অভিযানে মূল উদ্দেশ্য ছিল কুমেরু অঞ্চলের একটি নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করা। এই অভিযানের জন্য মাওসন ব্রিটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ান সরকারের থেকে অর্থসাহায্য পেয়েছিলেন।
০৯২৮
এ ছাড়াও কুমেরুর খনিজ ও তিমি শিকারে আগ্রহী এমন ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক সংস্থার কাছ থেকে এক বছরে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। মাওসন এই অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য দুই সঙ্গীকে বেছে নেন।
১০২৮
লেফটেন্যান্ট বেলগ্রেভ নিনিস ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক পদস্থ আধিকারিক। এই অভিযানে তাঁর ভূমিকা ছিল স্লেজ কুকুরগুলি পরিচালনা করা। নিনিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেভিয়ার মার্টজ় ছিলেন এক জন ২৮ বছর বয়সি সুইস আইনজীবী।
১১২৮
তিন জনের জন্য তিনটি স্লেজে মোট ১৬টি হাস্কি প্রজাতির কুকুরকে এই অভিযানে সামিল করা হয়। ৭৮০ কেজি খাবার, নানা যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সমেত ১০ নভেম্বর, ১৯১২ সালে কমনওয়েলথ বে থেকে যাত্রা শুরু হয় তাঁদের। প্রথম দিকে তাঁরা ম্যাপিংয়ের কাজে বেশ ভালই এগোচ্ছিলেন।
১২২৮
১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁরা প্রায় ৪৮০ কিমি পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই দলের এক সদস্য নিনিস তিন বার ক্রেভাস বা বরফের লুকোনো ফাটলে পড়ে গিয়েও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। স্লেজটানা হাস্কি কুকুরগুলির কয়েকটি অসুস্থ হতে শুরু করে।
১৩২৮
১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁরা একটি হিমবাহের মাঝখানে শিবির স্থাপন করেন। পর দিন আলো ঝলমল দিনে তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করেন। দিনটি ছিল উষ্ণ, তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের মাত্র ১১ ডিগ্রি নীচে। দুপুরে মাওসন তাঁদের অবস্থান নির্ধারণের জন্য বিরতি নেন। তিনি দেখেন মার্টজ়, যিনি স্লেজের আগে স্কিইং করছিলেন, তিনি হঠাৎ থমকে গিয়েছেন।
১৪২৮
একটি স্কি পোল বাতাসে উঁচিয়ে ইঙ্গিত দেন যে তিনি একটি ক্রেভাসের সম্মুখীন হয়েছেন। নিনিসকে সতর্ক করার জন্য মাওসন ফিরে আসার আগেই দেখেন মার্টজ বিপদের আশঙ্কা করে এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছেন। কয়েক মুহূর্ত পর মাওসন দেখেন, নিনিস তাঁর স্লেজ এবং কুকুরগুলিসমেত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।
১৫২৮
বিপদ যে ঘনিয়ে এসেছে তা বুঝে মাওসন উন্মত্ত ভাবে নিনিসের নাম ধরে বার বার ডাকতে থাকেন। কিন্তু প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই ফিরে আসেনি। তিনি এবং মার্টজ পালাক্রমে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নিনিসের ফেরার জন্য অপেক্ষা করেন। ৫০ মিটার নীচে একটি খাদে মার্টজ় এবং মাওসন একটি মৃত এবং একটি আহত কুকুরকে দেখেছিলেন। কিন্তু নিনিসকে আর কখনও দেখা যায়নি। যে ক্রেভাসটি তাঁরা দুজনেই পেরোতে পেরেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেই খাদে পড়েই তলিয়ে যান নিনিস, সঙ্গে তাঁদের রসদ ও স্লেজ।
১৬২৮
বেশির ভাগ খাদ্য সরবরাহ বহনকারী স্লেজটি নিনিসের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুই অভিযাত্রীর পক্ষে বেস ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাঁদের কাছে পড়েছিল স্লিপিং ব্যাগ এবং মাত্র দেড় সপ্তাহের খাবার।
১৭২৮
বাধ্য হয়েই তাঁরা নিনিসকে ছাড়াই বেস ক্যাম্পের দিকে এগোতে থাকেন। বেঁচে থাকার জন্য বাকি ছয’টি কুকুরকে মেরে খাওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনও উপায় ছিল না। খাবারের অভাবে মেটাতে তাঁরা কুকুরের দলের সবচেয়ে দুর্বল কুকুরটিকে মেরে তাঁর যকৃৎ ও মাংস দিয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন। বাকি কুকুরদের জন্যও মৃত কুকুরের মাংস ব্যবহার করেন তাঁরা।
১৮২৮
এই ভাবে কিছু দিন চলার পর অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে পড়ে। তুষারঝড়ের কারণে মাওসন প্রায় অন্ধ হয়ে যান। দু’জনেরই শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে।
১৯২৮
৬ জানুয়ারি ডায়েরিতে মাওসন লেখেন, মার্টজ়ের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে তিনি চলার শক্তিও হারিয়েছেন। এই অবস্থা চললে দু’জনেই মারা পড়বেন। অথচ সঙ্গীকে এই অবস্থায় ফেলে যেতেও মন চাইছে না।
২০২৮
পরদিন মার্টজ়ের প্রলাপ বকা শুরু হয়ে যায় এবং তিনি উন্মত্তের মতো আচরণ শুরু করেন। প্রবল ডায়রিয়ার কবলেও পড়েন তিনি। এই অবস্থায় মার্টজ় তাঁবুর খুঁটি ভেঙে ফেলার তোড়জোড় করতে থাকেন। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে মাওসেনের সঙ্গীর। ৯ জানুয়ারি রাত দুটো নাগাদ মৃত্যু হয় মার্টজ়ের। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় তুষারঝড়।
২১২৮
১১ জানুয়ারি বাতাসের বেগ বন্ধ হলে মার্টজ়কে বরফের রাজ্যে সমাধিস্থ করে অর্ধেক স্লেজ নিয়ে অন্তহীন দিগন্তের দিকে যাত্রা শুরু করেন একাকী মাওসন।
২২২৮
কয়েক মাইল যাওয়ার পর মাওসনের পা এতটাই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় যে, প্রতিটি পদক্ষেপ তাঁর কাছে নরকযন্ত্রণা ভোগ করার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। স্লেজের উপর বসে বুট এবং মোজাগুলি খুলে দেখেন পায়ের নীচে চামড়া বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই
২৩২৮
১৩ জানুয়ারি তিনি আবার যাত্রা শুরু করেন। নিজেকে হিমবাহের দিকে টেনে নিয়ে যান। এই হিমবাহ তিনি মার্টজ়ের নামে নামকরণ করেছিলেন। সেই দিনের শেষে তিনি বহু দূরে বিশাল মালভূমির উচ্চভূমি দেখতে পান। এর খুব কাছেই ছিল বেস ক্যাম্পটি।
২৪২৮
২৯ জানুয়ারি তিনি বেস ক্যাম্প থেকে ৬৪ কিমি দূরে এসে উপস্থিত হন। ১ ফেব্রুয়ারি একটি গুহার প্রবেশদ্বারে পৌঁছে তিনি তিনটি কমলালেবু এবং একটি আনারস আবিষ্কার করেন। এগুলি দেখে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। ডায়েরিতে লেখেন, বহু দিন পর এমন কয়েকটি জিনিসের দেখা পেলাম যাদের রং সাদা নয়।
২৫২৮
মাওসন সেই রাতে বিশ্রাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া আবার প্রতিকূল হয়ে যায় এবং পাঁচ দিনের জন্য তিনি সেই গুহায় আটকে পড়েন।
২৬২৮
যখন ঝড় কমে যায়, তখন তিনি বেস ক্যাম্পে যাওয়ার পথ খুঁজে পান। এর পর তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাহাজ ‘অরোরা’কে দেখতে পান। সেই জাহাজেই তাঁকে উদ্ধার করে আনা হয়।
২৭২৮
নিজের দেশে ফিরে এসে মাওসনের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। টানা কুকুরের যকৃৎ খাওয়ার ফলে দেহে অতিরিক্ত ভিটামিন এ জমা হয়। এর ফলে তাঁর হাইপারভিটামিনোসিস হয়। চিকিৎসকদের একাংশের ধারণা ছিল এর প্রভাবেই মার্টজ়ের মৃত্যু হয়। মাওসনের শরীরে এই রোগ প্রভাব ফেললেও প্রাণঘাতী হয়নি।
২৮২৮
১৯১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসার পর মাওসন তাঁর কৃতিত্বের জন্য জনসাধারণের প্রশংসা অর্জন করেন এবং নাইট উপাধি লাভ করেন। ১৯১৫ সালে তাঁর অ্যান্টার্কটিক অভিযানের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ১৯২৩ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। মাওসনই প্রথম আন্টার্কটিকা উপকূলের বেশির ভাগ অংশের সঠিক মানচিত্র তৈরি করেন। ১৯৫৮ সালে মারা যান এই অভিযাত্রী।