মন্দিরের কর্মীর দাবি অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সাল— এই সময়কালের মধ্যে একশোরও বেশি মহিলা এবং নাবালিকার দেহ পুঁতে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মস্থলার আশপাশে। এই কাজের বরাত দিয়েছিলেন মন্দিরের প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৫ ১৫:২৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৩
২০০৬ সালে দিল্লির নিঠারি-কাণ্ডের অভিঘাতে কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ। নৃশংসতার শেষতম পর্যায়ে গিয়ে একের পর এক খুন। খুনের আগে ভয়ঙ্কর নির্যাতন, ধর্ষণ। সেক্টর ৩১-এর ডি-৫ বাংলোর মালিক মণিন্দর সিংহ পান্ধেরের নির্দেশে গৃহকর্মী সুরিন্দর কোলি চালিয়ে গিয়েছিলেন নারকীয় হত্যালীলা। সেই নিঠারি-কাণ্ডের ছায়া এ বার কর্নাটকে।
০২২৩
দক্ষিণের এই রাজ্যের পবিত্র এক ধর্মস্থল ঘিরে চাঞ্চল্যকর সব অভিযোগ উঠে আসছে। বেলথাঙ্গাডি তালুকের নেত্রাবতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি মন্দিরশহর ধর্মস্থলা। শতাব্দীপ্রাচীন এই মন্দিরে মঞ্জুনাথরূপে পূজিত হন দেবাদিদেব মহাদেব। প্রতি দিন হাজার দুয়েক ভক্তের সমাবেশ ঘটে ৮০০ বছরের পুরনো দেবালয়ে।
০৩২৩
১১ জুলাই মন্দিরের এক সাফাইকর্মীর বিস্ফোরক অভিযোগে টলে গিয়েছে এই মন্দিরশহর-সহ গোটা দেশ। ৪৮ বছর বয়সি ওই কর্মী একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্য এবং ‘প্রমাণ’ নিয়ে কর্নাটকের বেলথাঙ্গাডি থানায় হাজির হন। তাঁর অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে দেশের ভয়াবহতম অপরাধের তালিকায় সংযোজিত হবে ধর্মস্থলার নাম।
০৪২৩
সাফাইকর্মীর দাবি, এই ধর্মস্থলাতেই তাঁকে বিগত দু’দশক ধরে গণহত্যা, যৌন নির্যাতন এবং সেই দেহ গোপনে কবর দেওয়ার মতো অপরাধে নিয়োগ করা হয়েছিল। সেই নির্দেশ দিতেন মন্দিরেরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আত্মগোপন করার পর ধর্মস্থলার সাফাইকর্মী ৩ জুলাই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
০৫২৩
তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে মনের গোপনে চেপে রাখা অপরাধের ভার বইতে পারছেন না। সেই অপরাধ থেকে মুক্ত হতে তিনি তদন্তে সহায়তা করতে চান। ১১ জুলাই আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা ওই কর্মী বেলথাঙ্গাডির একটি আদালতে তাঁর বক্তব্য জানাতে হাজির হন।
০৬২৩
মন্দিরের ওই কর্মীর দাবি অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সাল— এই সময়কালের মধ্যে একশোরও বেশি মহিলা এবং নাবালিকার দেহ পুঁতে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মস্থলার আশপাশে। এই কাজের বরাত তাঁকে দিয়েছিলেন মন্দিরের প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই।
০৭২৩
যাঁরা খুন হয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই মৃত্যুর আগে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বলে আদালতে জানিয়েছেন মন্দিরের প্রাক্তন এই কর্মী।
০৮২৩
তাঁর বয়ান অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা ওই ব্যক্তি মন্দিরের সাফাইকর্মী হিসাবে যোগ দেন। চাকরির গোড়ার দিকে তিনি নদীর ধারে প্রায়ই মৃতদেহ দেখতে পেতেন। অনেক মৃতদেহে কাপড় বা অন্তর্বাসটুকুও থাকত না। বেশ কয়েকটি মৃতদেহে যৌন নির্যাতন, আঘাত ও শ্বাসরোধের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।
০৯২৩
অভিযোগ, বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনার পর তাঁরা কর্মীকে মারধর করেন ও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তাঁকেও টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয়, কর্তৃপক্ষের কথা না মেনে চললে রেহাই পাবে না তাঁর পরিবারও। ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকির চাপের মুখে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন ওই সাফাইকর্মী। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নির্দেশ মেনে মৃতদেহ ও খুনের প্রমাণ লোপাট করতেও বাধ্য হন বলে দাবি অভিযোগকারীর।
১০২৩
তিনি দাবি করেন, তত্ত্বাবধায়কেরা তাঁকে নির্দিষ্ট স্থানে ডেকে পাঠাতেন, যেখানে মৃতদেহগুলি পড়ে থাকত। নাবালিকা মেয়েদেরও রেয়াত করা হত না। অন্তর্বাসের অনুপস্থিতি, ছেঁড়া কাপড় এবং তাঁদের যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন প্রমাণ করে দিত তাঁদের উপর নৃশংস যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। ওই কর্মী জানান, কিছু দেহে অ্যাসিডে পোড়ার চিহ্নও লক্ষ করেছিলেন তিনি।
১১২৩
মন্দিরে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করার সময় তিনি ধর্মস্থলা এলাকার বিভিন্ন স্থানে মৃতদেহ সমাহিত করেছেন। বিভীষিকাময় দিনগুলির কথা স্মরণ করতে গিয়ে কেঁপে উঠেছেন কর্মী। হাড়হিম করা একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, ২০১০ সালে তাঁকে ধর্মস্থলা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কালেরির একটি পেট্রল পাম্প থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে একটি স্থানে পাঠানো হয়েছিল।
১২২৩
সেখানে তিনি এক কিশোরীর মৃতদেহ দেখতে পান। তার বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। পরনে ছিল ইউনিফর্মের শার্টটুকু। স্কার্ট এবং অন্তর্বাস অনুপস্থিত। মৃতার শরীরে যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল। শ্বাসরোধের প্রমাণও মিলেছিল গলায়। একটি গর্ত খুঁড়ে তার স্কুল ব্যাগ-সহ তাকে কবর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারেননি তিনি।
১৩২৩
তার কয়েক বছর পর ২০ বছর বয়সি এক মহিলার মৃতদেহ লোপাট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তরুণীর মুখ অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেহটি সংবাদপত্র দিয়ে মোড়া ছিল। মৃতদেহটি পুঁতে ফেলার পরিবর্তে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়কেরা জুতো এবং তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র সমেত পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আদালতে উল্লেখ করেন ওই কর্মী।
১৪২৩
২০১৪ সালে এমন একটি মৃতদেহ লোপাট করার নির্দেশ আসে, যা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি তিনি। অসহায় মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাঁকে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি। কারণ যে দেহ সরিয়ে ফেলার জন্য উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছিল সেটি তাঁর পরিবারেরই এক নাবালিকার। সে দিনই তিনি স্থির করেছিলেন এই নরকের জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে।
১৫২৩
পরিবার নিয়ে রাতারাতি অন্য শহরে গা-ঢাকা দেন আদালতে হাজির হওয়া ব্যক্তি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কাকপক্ষীও টের পায়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে বার বার তাঁকে বাসস্থান বদল করতে হয়েছে। এতগুলি অপরাধের বোঝা বইতে তিনি অপারগ, তাই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আদালতের সম্মুখে হাজির হয়ে তদন্ত চালানোর জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি, এমনই দাবি মন্দিরের প্রাক্তন সাফাইকর্মীর।
১৬২৩
ধর্মস্থলায় ধর্ষণ ও খুনের কেলেঙ্কারির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর গণদাবির চাপে পড়ে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠন করে সিদ্দারামাইয়া সরকার। মন্দিরের কর্মীর নির্দেশমতো ধর্মস্থলার একাধিক জায়গায় তল্লাশি শুরু করেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা।
১৭২৩
অভিযোগকারী নিজেও পুলিশের কাছে আসার আগে প্রমাণস্বরূপ একটি কঙ্কাল তুলে আনেন। সেই দেহাবশেষের ছবি ও বর্ণনা আদালতের সামনে পেশ করা হয়েছে। ১ জুলাই এসআইটির খননের সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে কঙ্কাল পাওয়া যায়। অভিযোগকারী নিজেই তল্লাশি অভিযানে সিটের সঙ্গে জঙ্গলে যান। পরে ৪ অগস্ট আরও একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে সিট।
১৮২৩
ধর্মস্থলাকে ঘিরে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ওই এলাকায় পদ্মলতা নামের ১৭ বছরের এক কিশোরী নিখোঁজ হয় ১৯৮৭ সালে। পরে জানা যায়, তাঁকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। সেই ঘটনার জন্য প্রচুর আন্দোলন হলেও পদ্মলতার খুনের সমাধান আজও হয়নি।
১৯২৩
২০০৩ সালে মেডিক্যাল পড়ুয়া অনন্যা ভাট নিখোঁজ হন। তাঁর হত্যারহস্য নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয় সেই সময়। সেই সময়েও মন্দির কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনন্যার মা সুজাতা ভাট, সিবিআইয়ের প্রাক্তন স্টেনোগ্রাফার ১৫ জুলাই ধর্মস্থলা থানায় একটি নতুন অভিযোগ দায়ের করেছেন।
২০২৩
২০১২ সালে ১৭ বছরের আর এক কিশোরী সৌজন্যাকে ধর্ষণ ও হত্যা করার অভিযোগ উঠে আসে। সেই তদন্তের আজও কোনও কিনারা করা সম্ভব হয়নি। মন্দিরের প্রাক্তন কর্মীর জবানবন্দি উঠে আসার পর সমস্ত হত্যারহস্য মন্দিরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ।
২১২৩
বহু বছর ধরে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে ধর্মস্থলা মন্দিরের প্রশাসকদের বিরুদ্ধে। কর্নাটকের এই বিখ্যাত মন্দিরের সমস্ত চাবিকাঠি রয়েছে প্রভাবশালী হেগ্গডে পরিবারের হাতে। ১৯৬৮ সাল থেকে বীরেন্দ্র হেগ্গডে ২১তম ধর্মাধিকারী হিসাবে প্রশাসকের দায়িত্ব সামলে আসছেন।
২২২৩
পদ্মবিভূষণ প্রাপক বীরেন্দ্র রাজ্যসভার সদস্য। ২০২২ সালে বিজেপির টিকিটে সাংসদ মনোনীত হন তিনি। সৌজন্যা মামলায় নাম জড়িয়েছিল তাঁরও। সৌজন্যার পরিবার ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ করে আসছে যে মন্দিরের নেতৃত্বের সঙ্গে অপরাধীদের যোগসূত্র ছিল। বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হতেই ২০ জুলাই মন্দির কর্তৃপক্ষ বিবৃতি জারি করে।
২৩২৩
সেখানে লেখা হয়, “স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের পক্ষে রয়েছে মন্দির কর্তৃপক্ষ। সমাজের নৈতিক ভিত্তি সত্য ও বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে। সিট-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং নিরপেক্ষ তদন্তে প্রকৃত সত্য প্রকাশ হোক, এটাই আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।’’