How did Nobel Peace Prize winner Maria Corina Machado flee from Venezuela dgtl
Maria Corina Machado
‘সোনালি ডিনামাইট’-এ বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো! সবার চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে নোবেলজয়ীকে নিয়ে পালায় আমেরিকা, তার পর...
নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মারিয়া করিনা মাচাদোর উপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছিল ভেনেজ়ুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর সরকার। কিন্তু প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে হাড়কাঁপানো শীতের রাতে ছদ্মবেশে উত্তাল সমুদ্রে নৌকায় চড়ে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৫৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
ছদ্মবেশে গুপ্তচরদের সঙ্গে উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি। জোড়া নৌকায় কোনও মতে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাওয়া। তার পর সেখান থেকে সোজা আন্তর্জাতিক পুরস্কার মঞ্চ। নোবেলজয়ী ভেনেজ়ুয়েলার বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদোর ‘অসলো-অভিযান’ হার মানাবে জনপ্রিয় হলিউড থ্রিলারকেও। তাঁর এই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুঁদে গোয়েন্দাদের মস্তিষ্ক। কী ভাবে কারাকাসের যাবতীয় ‘লৌহপিঞ্জর’ ভাঙলেন তাঁরা? সম্প্রতি তা ফাঁস করেছেন এক প্রবীণ মার্কিন সৈনিক।
০২১৮
চলতি বছরের অক্টোবরে শান্তি পুরস্কারজয়ী হিসাবে মাচাদোর নাম ঘোষণা করে নরওয়ে সরকার। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, এর পরই তাঁকে গ্রেফতারের তোড়জোড় শুরু করে দেয় ভেনেজ়ুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর সরকার। ফলে অসলো গিয়ে আদৌ তিনি পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। ঠিক সেই সময় পরিত্রাতা হিসাবে আসরে নামে আমেরিকা। কারাকাস থেকে তাঁকে বার করে আনার গোপন অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র, নাম ‘অপারেশন গোল্ডেন ডিনামাইট
০৩১৮
ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট অভিযান নিয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে মুখ খোলেন মার্কিন স্পেশ্যাল ফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ব্রায়ান স্টার্ন। আমেরিকার ‘গ্রে বুল রেসকিউ ফাউন্ডেশন’ নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। সাক্ষাৎকারে ‘অপারেশন গোল্ডেন ডিনামাইট’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মাদুরো সরকারের কড়া নজরদারিতে ছিলেন মাচাদো। ফলে স্বাভাবিক রাস্তায় কোনও অবস্থাতেই অসলো পৌঁছোতে পারতেন না তিনি। সেই কারণেই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানের ছক কষা হয়ছিল।’’
০৪১৮
বিবিসিকে স্টার্নে জানিয়েছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার পর থেকেই মাচাদোকে আরও কোণঠাসা করা শুরু করে ভেনেজ়ুয়েলা সরকার। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই বিষয়টিতে ‘নাক গলায়’ যুক্তরাষ্ট্র। দ্রুত তাঁকে কারাকাস থেকে বার করে আনতে অন্তত দু’বার মরিয়া চেষ্টা করেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। কিন্তু, দু’বারই ব্যর্থ হন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, এর জেরে মাচাদোর উপর নজরদারি বৃদ্ধি করে মাদুরো প্রশাসন। ফলে ওয়াশিংটন একরকম আশা ছেড়েই দিয়েছিল।
০৫১৮
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হতাশ হলেও হাল ছাড়েননি মার্কিন গোয়েন্দারা। স্টার্নের কথায়, ‘‘ডিসেম্বরের গোড়ায় ফের আমাদের এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মাচাদোর দলের কয়েক জন সদস্য। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হয় পালানোর চূড়ান্ত নীলনকশা।’’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মাত্র চার দিনের মধ্যে তাঁকে ভেনেজ়ুয়েলা থেকে বার করে আনতে সক্ষম হন আমেরিকার গোয়েন্দারা।
০৬১৮
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্টার্নে বলেন, ‘‘মাচাদোর দলের বিশ্বস্ত সদস্যদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল। সেইমতো রবিবার ভেনেজ়ুয়েলার উপকূল সংলগ্ন এলাকায় যাবতীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে হাজির হই। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় (পড়ুন মঙ্গলবার) শেষ হয় ‘অপারেশন গোল্ডেন ডিনামাইট’। কোনও বিপত্তি হয়নি। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানে যে কোনও মুহূর্তে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা ছিল।’’
০৭১৮
প্রবীণ মার্কিন সৈনিকের বয়ান অনুযায়ী, ভেনেজ়ুয়েলা থেকে পালানোর দিনে ছদ্মবেশে উপকূলে গিয়ে পৌঁছোন নোবলজয়ী মাচাদো। তাঁকে অত্যন্ত সন্তর্পণে এবং গোপনে সেখানে নিয়ে আসেন কয়েক জন এজেন্ট। এর পরই শুরু হয় সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযান। উত্তাল সমুদ্রে নৌকায় চড়ে পাড়ি দেন মাচাদো। ক্যারিবিয়ান সাগরের উপরে তখন বইছিল কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। কিছু দূর যাওয়ার পর মাঝসমুদ্রে নৌকাবদল করতে হয় তাঁকে।
০৮১৮
‘গোল্ডেন ডিনামাইট’ চলাকালীন সমুদ্র কতটা উত্তাল ছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন স্টার্নে। তাঁর দাবি, ‘‘ওই সময় উপকূলে আছড়ে পড়ছিল ১০ ফুট উঁচু ঢেউ। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আর নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যেই নৌকায় চড়ে বসেন মাচাদো এবং তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদের পক্ষে ঢেউ কেটে মাঝসমুদ্রের দিকে এগোনো খুবই কঠিন ছিল। যদিও কেউই প্রাণের মায়া করেননি। আমরা অবশ্য তাঁদের অবস্থান খুঁজে পেতে টর্চ ব্যবহার করেছিলাম। তবে সেটা সর্ব ক্ষণ জ্বালিয়ে রাখার মতো ঝুঁকি নেওয়া যায়নি।’’
০৯১৮
‘গ্রে বুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা জানিয়েছেন, অভিযান চলাকালীন মাচাদোর পরিচয় গোপন রাখতে একাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। ছদ্মবেশে একরকম ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি। তার পরও ঝুঁকি এড়াতে একটি কাপড়ে মুখ ঢাকা ছিল তাঁর। যাবতীয় ডিজিটাল চিহ্ন লুকিয়ে ফেলেন তিনি। ভেনেজ়ুয়েলা ছাড়ার সময় মাচাদো সঙ্গে কোনও ফোন রাখেননি। কোনও ভাবেই যাতে তাঁকে ট্র্যাক বা চিহ্নিত করা না যায়, তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।
১০১৮
নিরাপদ জায়গায় পৌঁছোনোর পর মাচাদো একটি বিমানে ওঠেন। সেই সময় মার্কিন সৈনিকদের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই সময় নোবেলজয়ী জানান, প্রবল ঠান্ডার মধ্যে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। নৌকায় থাকাকালীন ঢেউয়ে সম্পূর্ণ ভিজে যান তিনি। তবে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে কারও কাছে কোনও অভিযোগ করেননি তিনি। বরং আগাগোড়া শান্ত ছিলেন ভেনেজ়ুয়েলার বিরোধী নেত্রী।
১১১৮
স্টার্নের দাবি, সংশ্লিষ্ট অভিযানে সরাসরি জড়িত ছিল তাঁর সংস্থা ‘গ্রে বুল’। মাচাদোকে উপকূলে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে বিপদসঙ্কুল সমুদ্রে নৌকায় পাড়ি জমানো, প্রতিটা ক্ষেত্রেই বেশ কয়েক জন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট অভিযানের আদ্যোপান্ত জানা আছে বলে একরকম নিশ্চিত ছিলেন তাঁরা। যদিও কেউই পুরো পরিকল্পনার কথা জানতেন না। নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ওই প্রবীণ মার্কিন ফৌজি।
১২১৮
২০১৩ সাল থেকে ভেনেজ়ুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন মাদুরো। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সাল) নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ আনেন মাচাদো। এর পরই তাঁর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার কেড়ে নেন কারাকাস। ফলে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে গণ আন্দোলন শুরু করেন মাচাদো। সেই কারণেই তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
১৩১৮
এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে অবশ্য প্রবল ভাবে আশাবাদী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর জন্য তিনি নিজে কম প্রচার করেননি। অক্টোবর আসতে আসতে ২০২৫ সালে মোট সাতটি যুদ্ধ থামিয়েছেন বলে বার বার বিবৃতি দিতে শোনা যায় তাঁকে। কিন্তু তার পরেও ট্রাম্পের ভাগ্যে শিঁকে ছেড়েনি। কারও ব্যক্তিগত মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় না বলে জানিয়ে দেয় অসলোর কমিটি।
১৪১৮
তবে তাঁর নাম ঘোষণার পর ট্রাম্পকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার উৎসর্গ করে বসেন মাচাদো। বলেন, ‘‘এই স্বীকৃতি ভেনেজ়ুয়েলার মানুষের সংগ্রামের জন্য এক নতুন অনুপ্রেরণা।’’ গত সেপ্টেম্বর থেকেই ওয়াশিংটন-কারাকাস কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিকে রণতরী দিয়ে একরকম ঘিরে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। ফলে সেখানে বাড়ছে আশঙ্কা।
১৫১৮
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভেনেজ়ুয়েলাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, কারাকাসের হাতে আছে খনিজ তেলের বিপুল ভান্ডার, যার উপর নজর পড়েছে ট্রাম্পের। ছলে-বলে-কৌশলে সেটা কব্জা করতে চাইছেন তিনি। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, অগণতান্ত্রিক ভাবে কুর্সি আটকে রেখেছেন মাদুরো। মাদক ব্যবসায়ীদের মদত দিচ্ছেন তিনি, যা পত্রপাঠ খারিজ করেছে ভেনেজ়ুয়েলা।
১৬১৮
এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে কারাকাসের একাধিক নৌকা ধ্বংস করেছে মার্কিন নৌবাহিনী। সংশ্লিষ্ট নৌকাগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার হচ্ছিল বলে অভিযোগ তোলে ওয়াশিংটন। শুধু তা-ই নয়, ভেনেজ়ুয়েলার একটি তেলবাহী জাহাজও আটক করে তারা। এর পরই বিষয়টি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেয় রাশিয়া। ফলে কারাকাসকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি যে জটিল হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৭১৮
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ট্রাম্পের পক্ষে ভেনেজ়ুয়েলার ব্যাপারে পিছিয়ে আসা কঠিন। কারণ, পর্দার আড়ালে থেকে কারাকাসকে সাহায্য করে যাচ্ছে রাশিয়া, চিন এবং ইরান। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে মস্কোর একটি সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। ক্রেমলিন সেখানে অত্যাধুনিক হাতিয়ার মোতায়েন করলে বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে ওয়াশিংটন। সেই কারণেই দ্রুত মাদুরো সরকারের পতন চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
১৮১৮
ভেনেজ়ুয়েলার ক্ষমতা বদলের জন্য যে মুখের প্রয়োজন, মাচাদোকে সামনে রেখে দিব্যি সেটা করতে পারবে আমেরিকা। সেই কারণেই তাঁকে কারাকাস থেকে বার করে আনার ব্যাপারে এতটা উদ্যোগী হয়েছে ওয়াশিংটন। তবে শেষ পর্যন্ত নোবেলজয়ী মাচাদোর ভাগ্য কোন দিকে যায়, সেটাই এখন দেখার।