Russia takes revenge after three years of losing warship Moskva by sinking Ukraine's largest battleship with naval drone dgtl
Russia Destroy Ukraine Battleship
রুশ প্রতিশোধের আগুনে ছারখার ইউক্রেন! জ়েলেনস্কির ‘সর্ববৃহৎ’ রণতরী ধ্বংস করে ‘পুরনো হিসাব’ মেটালেন পুতিন
সামুদ্রিক ড্রোন হামলায় দানিয়ুব নদীর বদ্বীপে ইউক্রেনের ‘সর্ববৃহৎ’ রণতরীকে ধ্বংস করেছে রাশিয়া। সাড়ে তিন বছর আগে জোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে মস্কোর যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়েছিল কিভ। কড়ায়-গন্ডায় তারই প্রতিশোধ নিল ক্রেমলিন? উঠছে প্রশ্ন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৫ ১৪:৩২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
আর স্যাকরার ঠোকাঠুকি নয়। রুশ হাতুড়ির মোক্ষম বাড়িতে ব়ড় ধাক্কা খেল ইউক্রেন! দু’পক্ষের তুমুল যুদ্ধের মধ্যেই কিভের ‘সর্ববৃহৎ’ রণতরীকে সামুদ্রিক-ড্রোন হামলায় ডুবিয়েছে মস্কোর ফৌজ। এই ঘটনা সাড়ে তিন বছর ধরে চলা পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে বলে মনে করছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। অনেকে আবার একে ক্রেমলিনের চরম প্রতিশোধ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের অনুমান, আগামী দিনে লড়াইয়ের ঝাঁজ আরও বাড়াবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
০২১৮
চলতি বছরের ২৮ অগস্ট ইউক্রেনের ‘সর্ববৃহৎ’ রণতরী ধ্বংস নিয়ে বিবৃতি দেয় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। দানিয়ুব নদীর বদ্বীপে সলিলসমাধি ঘটা কিভের সংশ্লিষ্ট যুদ্ধজাহাজটির নাম ছিল ‘সিম্ফেরোপল’। মস্কোর এ-হেন সামরিক সাফল্যের খবর প্রকাশ্যে আসতেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ড্রোন হামলায় রণতরীতে বিস্ফোরণের হাড়হিম করা ভিডিয়ো। যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম। তবে যুদ্ধজাহাজ হারানোর কথা একরকম স্বীকার করে নিয়েছে কিভ।
০৩১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে প্রথম থেকেই স্থলের যুদ্ধকে জলে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ইউক্রেন। লড়াইয়ের একেবারে গোড়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মস্কোর একটি রণতরী ডুবিয়ে দেয় কিভ। ক্রেমলিনের কাছে সেটা ছিল বড় ধাক্কা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই ঘটনার মোক্ষম প্রতিশোধ নিল রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, পুতিনের এই আঘাত সামলে প্রতি আক্রমণে যাওয়া ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির কাছে কঠিন হতে চলেছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
০৪১৮
ইউক্রেনীয় ফৌজের হামলায় ধ্বংস হওয়া রুশ যুদ্ধজাহাজটির নাম ছিল ‘মস্কোভা’। ক্রুজ়ার শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্র বহণকারী ওই রণতরীটি মস্কোর কৃষ্ণসাগর নৌবহরে থাকাকালীন লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন কিভ আক্রমণের নির্দেশ দিলে সেভাস্তোপোল বন্দর ছেড়ে ধীরে ধীরে ইউক্রেনীয় উপকূলের দিকে এগোতে শুরু করে ‘মস্কোভা’। সর্প দ্বীপ (স্নেক আইল্যান্ড) দখল ছিল এর উদ্দেশ্য। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধজাহাজটির সঙ্গে ‘ভ্যাসিলি বাইকভ’ নামের টহলদারি জলযানকেও পাঠিয়েছিল ক্রেমলিন।
০৫১৮
প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্য ভালই সাফল্য পেয়েছিল ‘মস্কোভা’। প্রায় একার ক্ষমতাতেই সর্প দ্বীপকে ঘিরে ধরে আক্রমণ শানায় ওই রণতরী। সেই চাপ ইউক্রেনীয় সৈন্যবাহিনী সহ্য করতে পারেনি। তাঁদের বেশ কয়েক জনকে বন্দিও করে রুশ ফৌজ। পরবর্তী কালে দক্ষিণ ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের দিকে ‘মস্কোভা’কে নতুন অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান পুতিন। আর সেখানেই মস্ত বড় ভুল করে বসেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
০৬১৮
২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল রণতরী ধ্বংসকারী দু’টি ‘আর-৩৬০ নেপচুন’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ‘মস্কোভা’কে নিশানা করে ইউক্রেনীয় ফৌজ। ওই সময়ে ওডেসা বন্দর থেকে ৮০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১৫০ কিলোমিটার) দূরে ছিল ওই রুশ যুদ্ধজাহাজ। নিঃশব্দে কৃষ্ণসাগরের দিক দিয়ে এগোচ্ছিল সে। তখনই রেডারে তার উপস্থিতি টের পেয়ে জোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বসে জ়েলেনস্কির বাহিনী। বিদ্যুৎগতিতে সেগুলি আছড়ে পড়তেই বিকট বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ‘মস্কোভা’তে আগুন ধরে যায়।
০৭১৮
ইউক্রেনীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ জোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে টলে ওঠে রুশ রণতরী। তার পরেও যুদ্ধজাহাজটিকে বাঁচানোর কম চেষ্টা করেননি মস্কোর নৌযোদ্ধারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে ব্যর্থ হন তাঁরা। ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিল সম্পূর্ণ ভাবে ‘মস্কোভা’র সলিলসমাধি ঘটে। ক্রেমলিন অবশ্য যুদ্ধজাহাজ ডুবে যাওয়ার নেপথ্যে কিভের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা স্বীকার করেনি।
০৮১৮
‘মস্কোভা’ ধ্বংসের প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর জারি করা বিবৃতিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায়, দুর্ঘটনার জেরে গোলা-বারুদে বিস্ফোরণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট রণতরীটিতে আগুন ধরে গিয়েছিল। ওই অবস্থায় অন্য একটি যুদ্ধজাহাজের সাহায্যে একে টেনে বন্দরে ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কৃষ্ণসাগর নৌবহরের অন্তর্গত রণতরীটির সলিলসমাধি ঘটে। ‘মস্কোভা’ ডুবে যাওয়ায় কোনও নৌযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে কি না, তা-ও স্পষ্ট করেনি ক্রেমলিন।
০৯১৮
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে তৈরি ‘মস্কোভা’ রুশ নৌবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করে ১৯৮৩ সালে। ধ্বংস হওয়ার আগে পর্যন্ত মোট চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ওই রণতরী। ২০০৮ সালে জর্জিয়া অভিযানে একে কাজে লাগায় মস্কো। এর পর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ ছিনিয়ে নেয় ক্রেমলিন। পুতিনের সেই সাফল্যের অন্যতম কারিগর ছিল ‘মস্কোভা’। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়ে ভূমধ্যসাগরের দিক থেকে আক্রমণ শানিয়েছিল ক্রুজ়ার শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্র বহণকারী এই রণতরী।
১০১৮
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া ইস্তক আর কখনওই কোনও যুদ্ধজাহাজ হারায়নি রাশিয়া। একের পর এক শত্রুর যুদ্ধজাহাজ এবং লড়াকু জেট উড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল ‘মস্কোভা’র। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট ক্রুজ়ারটিতে স্থলে আক্রমণের কোনও ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না। এককালে সোভিয়েতের অংশ থাকায় এই দুর্বলতার কথা জানত ইউক্রেন। আর তাই ওডেসার উপকূল থেকেই জাহাজ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে কিভের সেনা। এই অপ্রত্যাশিত আঘাতেই সাফল্য পায় তাঁরা।
১১১৮
‘মস্কোভা’ ধ্বংসের পর আত্মবিশ্বাসী ইউক্রেনীয় ফৌজ একেবারেই চুপ করে বসে থাকেনি। অন্তত তিন বার মূল রুশ ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগকারী ক্রাইমিয়ার কের্চ সেতু উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তাঁরা। এ বছরের জুনে শেষ বার আক্রমণ শানাতে আত্মঘাতী ডুবোড্রোন ব্যবহার করে জ়েলেনস্কির বাহিনী। কের্চ সেতুর মূল স্তম্ভের কাছে আঘাত হেনেছিল ওই মানববিহীন ডুবোযান। কিভের সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিতে ছিল ১,১০০ কেজি বিস্ফোরক।
১২১৮
কের্চ হামলার ঘা শুকোতে না শুকোতেই মূল রুশ ভূখণ্ডের ভিতরে পাঁচ সামরিক বিমানঘাঁটিতে নিখুঁত ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। গত ১ জুন হওয়া কিভের ওই সামরিক অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’। এতে কোয়াডকপ্টার শ্রেণির ১১৭টি মানববিহীন আত্মঘাতী উড়ুক্কু যান ব্যবহার করেন জ়েলেনস্কির জেনারেলরা। সংশ্লিষ্ট হামলায় মস্কোর এক তৃতীয়াংশ ‘কৌশলগত’ বোমারু বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম হন তাঁরা।
১৩১৮
‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’-এ রাশিয়ার মুরমানস্ক, ইরকুটস্ক, ইভানোভো, রিয়াজান এবং আমুর এলাকার পাঁচ বিমানঘাঁটিতে ধ্বংসলীলা চালায় ইউক্রেনের কোয়াডকপ্টার ড্রোন। অত্যন্ত গোপনে ট্রাকে করে সেগুলিকে বায়ুসেনা ছাউনিগুলির কাছে পৌঁছে দেয় কিভের গুপ্তচরেরা। পরে প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি জানান, বোমারু ও নজরদারি মিলিয়ে অন্তত ৪০টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে তাঁর বাহিনী। ক্রেমলিনের বোমারু বিমান চিনতে সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলিতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৪১৮
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, এই সমস্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ড্রোন প্রযুক্তিকে উন্নত করার দিকে নজর দেন রুশ প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। অচিরেই মানববিহীন আত্মঘাতী ডুবোযান তৈরি করে ফেলেন তাঁরা। সংশ্লিষ্ট ড্রোনটির পোশাকি নাম অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি। কিভের ‘সর্ববৃহৎ’ রণতরী ডোবাতে কত কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ও গোপন রেখেছে মস্কো।
১৫১৮
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, দানিয়ুব নদীর বদ্বীপে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘সিম্ফেরোপল’কে মোতায়েন করেছিল জ়েলেনস্কির বাহিনী। ওই মোহনা দিয়ে বড় আকারের আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা ছিল ইউক্রেনীয় সেনার। বিষয়টি নজরে আসতেই সংশ্লিষ্ট রণতরীটির উপর সামুদ্রিক ড্রোন হামলা চালান মস্কোর নৌযোদ্ধারা। সেখানে ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা।
১৬১৮
লাগুনা শ্রেণির মাঝারি আকারের যুদ্ধজাহাজ ‘সিস্ফেরোপল’কে ২০১৯ সালে প্রথম বার জলে নামায় ইউক্রেন। কিভের নৌসেনায় এর অন্তর্ভুক্তি হয় আরও দু’বছর পর। অর্থাৎ, কর্মজীবনের চার বছরের মাথায় দানিয়ুবের বুকে চিরতরে হারিয়ে গেল ওই রণতরী। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধজাহাজটি হারানোর ফলে দানিয়ুবের উপরে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ যে কোনও মুহূর্তে কিভ হারাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৭১৮
গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে অবশ্য ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ১৫ অগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে এই নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়নি। মস্কোর যে এখনই সংঘাত থামানোর ব্যাপারে যথেষ্ট অনীহা রয়েছে, তা ইউক্রেন রণতরী ডোবানোর ঘটনাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
১৮১৮
এ বছরের ডিসেম্বরে ভারত সফরে আসছেন পুতিন। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সেখানে দু’তরফে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মধ্যে কি থাকবে যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসকারী সামুদ্রিক ড্রোনও? ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে সেই জল্পনা।