Ukraine failed to neutralized Soviet-Era Bombs of Russia, which may change war dgtl
Soviet Bombs in Ukraine War
সোভিয়েত বোমায় ছিন্নভিন্ন ইউক্রেনীয় শহর থেকে সৈন্যঘাঁটি, ‘পুরনো চালে’ খেলা ঘোরাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন
ভোল বদলে সোভিয়েত যুগের বোমা ইউক্রেন যুদ্ধে বহুল পরিমাণে ব্যবহার করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তা নিষ্ক্রিয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় আরও খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে কিভ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৪৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে এখনও চলছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। যত সময় গড়াচ্ছে ততই চওড়া হচ্ছে কিভের দুর্গে মস্কোর তৈরি করা ফাটল। আমেরিকা-সহ একাধিক পশ্চিমি রাষ্ট্রের থেকে অস্ত্র-সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও ক্রেমলিনের আগ্রাসন ঠেকাতে ব্যর্থ ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’। এ-হেন পরিস্থিতিতে পরাজয়ের কারণ খুঁজতে বসে বার বার একটি ‘ব্রহ্মাস্ত্রের’ কথাই বলছেন ইউক্রেনীয় সেনা অফিসার ও গোয়েন্দারা। নাম গ্লাইড বোমা, যার কোনও ‘অ্যান্টিডোট’ হাতে নেই তাঁদের।
০২১৯
চলতি বছরের ১৪ নভেম্বর সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’কে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ‘এইচইউআর’-এর উপপ্রধান ভাদিম স্কিবিটস্কি। সেখানে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে মুখ খোলেন তিনি। বলেন, ‘‘আমাদের সেনাঘাঁটি এবং শহরগুলিকে ধ্বংস করতে গ্লাইড বোমার বিপুল ব্যবহার করছে মস্কো। কোনও ভাবেই সেটাকে আটকানো যাচ্ছে না। ফলে কৌশলগত এলাকাগুলি হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে।’’
০৩১৯
স্কিবিটস্কির দাবি, বর্তমানে প্রতি দিন ২০০-২৫০ গ্লাইড বোমায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে রুশ ফৌজ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চলতি আর্থিক বছর (পড়ুন ২০২৫-’২৬) শেষ হওয়ার আগেই এই ‘ব্রহ্মাস্ত্রের’ সংখ্যা ১.২০ লক্ষে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে মস্কো। এর মধ্যে বর্ধিত পাল্লার গ্লাইড বোমার সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির জন্মের নেপথ্যে অবশ্য হাত রয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের।
০৪১৯
গত শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময় আইগাইডেড মাধ্যাকর্ষণ বোমা (পড়ুন গ্ল্যাভিটি বম্ব) তৈরি করে দুনিয়াকে চমকে দেয় মস্কো। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ওই মারণাস্ত্রগুলিতে বড় পরিবর্তন আনেন রুশ প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। বোমাটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় গ্লাইড কিট এবং কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থা (নেভিগেশন সিস্টেম)। ফলে রাতারাতি ভোল পাল্টে আরও বিধ্বংসী অস্ত্র হিসাবে রণাঙ্গনে ‘মেগা এন্ট্রি’ নেয় গ্লাইড বোমা।
০৫১৯
রুশ ফৌজে অবশ্য সংশ্লিষ্ট ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টির পোশাকি নাম ইউএমপিকে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, গ্লাইড কিট থাকায় যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি-ভিত্তিক বোমাগুলির তুলনায় এর শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত, ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের বদলি হিসাবে একে ব্যবহার করছে মস্কো। স্বল্পপাল্লার বোমাগুলি নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে সক্ষম। এর ব্যাপক ব্যবহারে লড়াইয়ের খরচ অনেকটা কমিয়ে ফেলতে পেরেছে ক্রেমলিন। পাশাপাশি, আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমণের বেড়েছে তীব্রতা।
০৬১৯
‘রয়টার্স’কে দেওয়া স্কিবিটস্কির সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে প্রথম বার ইউক্রেনীয় শহরগুলিকে গ্লাইড বোমায় নিশানা করে রুশ বিমানবাহিনী। ওই বছরের এপ্রিলে পৌঁছে দিনে ২০টি করে ইউএমপিকের বিস্ফোরণ সহ্য করতে হয়েছে কিভকে। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির কাছে এর কোনও জবাব নেই বুঝতে পেরে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট বোমার ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করে মস্কো। এর পুরোটাই হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশমতো।
০৭১৯
ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধানের আরও দাবি, প্রথম দিকে রুশ গ্লাইড বোমার পাল্লা ছিল ৪০-৫০ কিলোমিটার। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিতে যুদ্ধের গতি ঘুরছে বুঝতে পেরে অচিরেই সেই সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দেন মস্কোর সামরিক গবেষকেরা। ফলে ২০২৩ সালের মে মাসের মধ্যে বর্ধিত পাল্লার ইউএমপিকে হাতে পায় ক্রেমলিনের বায়ুসেনা, যেটা প্রায় ৭০ কিলোমিটার। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সংশ্লিষ্ট ‘ব্রহ্মাস্ত্রে’ যুক্ত হয় আরও একটি ঘাতক ফিচার।
০৮১৯
স্কিবিটস্কি জানিয়েছেন, বর্তমানে গ্লাইড কিট যুক্ত যে ইউএমপিকে রুশ বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে, তা শূন্যে থাকা অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে হাতিয়ারটির বহুমুখিতা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মস্কোর গবেষকেরা প্রথম দিকে ৫০০ কেজির গ্র্যাভিটি বোমার জন্য গ্লাইড কিট তৈরি করছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও বেড়ে ১,৫০০ কেজি এবং তিন হাজার কেজি হয়েছে। এতে কিভের রাতের ঘুম যে উবে গিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
০৯১৯
ইউএমপিকের গ্লাইড কিট নির্মাণকারী রুশ সংস্থার নাম বাজ়াল্ট ডিজ়াইন ব্যুরো। এর কাজ করার সুনির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি রয়েছে। লড়াকু জেট থেকে সংশ্লিষ্ট বোমাটিকে ছুড়ে দিলে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো তীব্র গতিতে তা ছুটে যায় না। উল্টে বাতাসে ভাসিয়ে তাকে বিস্ফোরণস্থলের দিকে নিয়ে যায় গ্লাইড কিট। এ ব্যাপারে রাস্তা দেখানোর কাজটি করছে মস্কোর নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থা (নেভিগেশন সিস্টেম)। ফলে নিখুঁত নিশানায় হামলা করা ক্রেমলিনের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।
১০১৯
ইউক্রেন যুদ্ধে গ্লাইড বোমার ব্যবহার নিয়ে কোনও রাখঢাক রাখেনি মস্কো। রুশ সরকারি গণমাধ্যম ‘আরআইএ নভোস্তি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি ব্যাপক ব্যবহারের জন্য যোদ্ধা পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেয় ক্রেমলিনের ‘মহাকাশ বাহিনী’ (অ্যারোস্পেস ফোর্স)। এর জন্য জনপ্রিয় যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী সংস্থা সুখোইয়ের তৈরি ‘এসইউ-৩৪ ফুলব্যাক’ লড়াকু-বোমারু জেটকে বেছে নেয় তারা।
১১১৯
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, গ্লাইড বোমা ব্যবহারের জন্য ইতিমধ্যেই এসইউ-৩৪-এর সফ্টঅয়্যার আপডেট করেছে রুশ বিমানবাহিনী। এর পাইলটদের গণহারে প্রশিক্ষণ দিয়েছে মস্কো। ২০১৪ সাল থেকে ক্রেমলিনের বায়ুসেনার বহরে রয়েছে দুই ইঞ্জিন এবং দুই আসন বিশিষ্ট সংশ্লিষ্ট মধ্যম পাল্লার সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে গতিশীল) লড়াকু-বোমারু জেট। এক একটি এসইউ-৩৪ অন্তত চারটি করে গ্লাইড বোমা নিয়ে উড়তে পারছে বলে জানা গিয়েছে।
১২১৯
সোভিয়েত যুগের ভোল পাল্টানো বোমাটি প্রথম বার তার জাত চেনায় ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এলাকার অ্যাভদেভকা শহর আক্রমণের সময়। ইউএমপিকের ধ্বংসক্ষমতার জন্যেই সেখানে ভেঙে পড়ে কিভের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর পর গ্রাউন্ড অপারেশনে সংশ্লিষ্ট এলাকাটি কব্জা করতে পুতিন বাহিনীর খুব বেশি সময় লাগেনি। পরবর্তী সময়ে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে পশ্চিমের প্রতিবেশীর অন্যান্য সামরিক ঘাঁটিগুলিতে আছড়ে পড়তে থাকে ওই গ্লাইড বোমা।
১৩১৯
গত বছরের মার্চে অবশ্য এফএবি-৫০০, এফএবি-১৫০০ এবং এফএবি-৩০০০ নামের তিনটি উচ্চ বিস্ফোরক বোমার উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ানো হয়েছে বলে বিবৃতি দেয় রুশ প্রতিরক্ষা দফতর। কিছু কিছু পশ্চিমি গণমাধ্যমের দাবি, এই এফএবি হল গ্লাইড বোমা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একসঙ্গে ১৩০টি উচ্চ বিস্ফোরক বোমায় ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকাকে কাঁপিয়ে দেয় মস্কো। ১-২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১,২০০।
১৪১৯
এ বছরের জুনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পরিসরে গ্লাইড বোমায় হামলা চালায় রাশিয়া। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তার দাবি, দূরপাল্লার বোমাগুলি ৯,০০০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে লড়াকু জেটের মাধ্যমে ছু়ড়ছে মস্কো। ঘণ্টায় ৭০০-৮০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে আসছে সেগুলি। ড্রপ পয়েন্ট থেকে ১২০-১৫০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে ফ্রন্টলাইনের ৬০ কিলোমিটার গভীরে ঢুকে হামলা চালাতে পারছে ক্রেমলিনের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’।
১৫১৯
গ্লাইড বোমার পাশাপাশি ইউক্রেনের ভিতরে যথেচ্ছ ড্রোন হামলাও চালাচ্ছে রাশিয়া। সেটা আটকাতে কিভের ভরসা সোভিয়েত জমানায় তৈরি ইয়াক-৫২ বিমান। এর সাহায্যে কম খরচে মস্কোর মানববিহীন যানগুলিকে তারা শিকার করতে পারছে বলে জানা গিয়েছে। ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর যুগে মূলত যোদ্ধা পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজ তৈরি করেন মস্কোর সামরিক গবেষকেরা। ১৯৭৭ সালে রোমানিয়ায় যার ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়।
১৬১৯
‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট’ জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়াক-৫২ বিমান ব্যবহার করে রাশিয়ার অর্ল্যান ১০, জ়ালা-র মতো অত্যাধুনিক ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করছে ইউক্রেন। এই কাজের দায়িত্বভার রয়েছে কিভের ১১ নম্বর আর্মি অ্যাভিয়েশন ব্রিগেডের কাঁধে। সংশ্লিষ্ট বিমানটির এক পাইলট জানিয়েছেন, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের জমানায় পুরনো উড়োজাহাজে ড্রোন শিকার এক অন্য অভিজ্ঞতা। তবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যাচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
১৭১৯
দুই আসন বিশিষ্ট ইয়াক-৫২ বিমানে নেই কোনও রেডার। শুধু তা-ই নয়, কেবলমাত্র দিনের বেলায় এই উড়োজাহাজ ওড়ানো সম্ভব। ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট’ জার্নাল লিখেছে, রুশ ড্রোন ইউক্রেনের আকাশসীমায় ঢুকলেই সংশ্লিষ্ট বিমান নিয়ে ছুটছেন কিভের যোদ্ধা পাইলটেরা। মাঝ-আকাশে উঠে বিমানের ‘গানার’ মানববিহীন যানগুলিকে লক্ষ্য করে চালাচ্ছেন গুলি। এই কায়দায় দিনের বেলা মস্কোর ড্রোন হামলা অনেকটা ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন তাঁরা।
১৮১৯
অন্য দিকে ইউক্রেনের এই কৌশলের উপর কড়া নজর রেখেছে রাশিয়াও। আর তাই পাল্টা প্রত্যাঘাতের জন্য ইয়াক-৫২বি২ প্রশিক্ষণ বিমানের আধুনিকীকরণ শুরু করেছে মস্কো। ওই উড়োজাহাজের ডানার নীচে লাগানো হয়েছে শটগান। চলন্ত বিমান থেকে গুলি ছুড়ে ড্রোন ধ্বংস করা বেশ কঠিন। এর জন্য দক্ষ ‘গানার’-এর প্রয়োজন। সেই বিষয়টিও ক্রেমলিন মাথায় রেখেছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
১৯১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, যত সময় যাচ্ছে ততই বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ারের পরীক্ষাক্ষেত্র হয়ে উঠছে ইউক্রেন। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, প্রশিক্ষণ বিমানের পর এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হল সোভিয়েত যুগের বোমাও। রূপ বদলে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়া সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি পুতিনকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।