মার্কিন ‘এফ-৩৫’ ও রুশ ‘এসইউ-৫৭’-এর তুলনায় কতটা শক্তিশালী চিনের তৈরি ‘জে-২০’ এবং ‘জে-৩৬’ জেট?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ১৬:১৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
রাশিয়ার তৈরি ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’ না মার্কিন ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’। ভারতীয় বায়ুসেনায় আগামী দিনে শামিল হবে কোন লড়াকু জেট? এই নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এ বার চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার মেজর জেনারেল জিডি বক্সী। চিনের তৈরি পঞ্চম এবং ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে তুলনা টেনে এ ব্যাপারে নিজের মতামত দিয়েছেন তিনি।
০২২০
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি বিতর্কসভায় যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিডি বক্সী। সেখানেই তিন দেশের চারটি যুদ্ধবিমানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করেন তিনি। উপসংহারে ড্রাগনের লড়াকু জেট মোকাবিলায় ‘এসইউ-৫৭’ ও ‘এফ-৩৫’-এর মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর হবে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই সাবেক সেনা অফিসার।
০৩২০
বক্সীর দাবি, স্টেলথ শ্রেণির নিরিখে মার্কিন যুদ্ধবিমান ‘এফ-৩৫’ রাশিয়ার ‘এসইউ-৫৭’-এর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মস্কোর লড়াকু জেটটিকে বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানের বহরে শামিল করা যেতে পারে। কারণ, মাঝ আকাশের লড়াইয়ে অনায়াসেই চিনের পঞ্চম প্রজন্মের ‘জে-২০’ এবং ষষ্ঠ প্রজন্মের ‘জে-৩৬’ যুদ্ধবিমানকে মাত দিতে পারবে রাশিয়ার ‘উড়ন্ত বাজপাখি’।
০৪২০
বিশ্বের সমস্ত পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান স্টেলথ শ্রেণির। অর্থাৎ, রাডারে সেগুলি প্রায় ধরাই পড়ে না বলা চলে। সেই তালিকায় ‘এফ-৩৫’ যে সকলের উপরে রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তাই মার্কিন সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি এই লড়াকু জেটের ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিমানটির হাজারের বেশি ইউনিট নির্মাণ করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
০৫২০
রাডারে কোনও বস্তু কতটা শনাক্তযোগ্য, তা চিহ্নিত করার বিশেষ একটি প্রযুক্তি রয়েছে। তার নাম রাডার ক্রস সেকশন বা আরসিএস। এতে সাধারণত ০.০০১ থেকে ০.০০৫ বর্গমিটার আকারে ধরা পড়ে ‘এফ-৩৫’। ফলে অধিকাংশ সময়ই মার্কিন জেটটির উপস্থিতি বুঝতে পারে না শত্রুসেনা। ফলে সহজেই তাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে পারে লকহিড মার্টিনের যুদ্ধবিমান।
০৬২০
‘এফ-৩৫’কে স্টেলথ করতে এর নকশা অন্য সমস্ত লড়াকু জেটের থেকে আলাদা করেছে মার্কিন সংস্থা। এ ছাড়া এই যুদ্ধবিমানে রয়েছে অত্যাধুনিক ‘এএন/এপিজ়ি-৮১ অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে’ (এইএসএ) রাডার এবং ‘ডিসস্ট্রিবিউটেড অ্যাপারচার সিস্টেম’ (ডিএএস)। এই দু’য়ের সাহায্যে নজরের বাইরে লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে পারেন এর পাইলট।
০৭২০
অন্য দিকে ‘এসইউ ৫৭’-এর স্টেলথ ক্ষমতা অনেকটাই কম। রুশ লড়াকু জেটটির আরসিএস ০.১ থেকে ০.৫ বর্গমিটার বলে জানা গিয়েছে। এর জন্য যুদ্ধবিমানটির ইঞ্জিন, প্যানেল এবং হাতিয়ার বহনের হ্যাঙারকে দায়ী করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। ‘এসইউ ৫৭’-র স্টেলথ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য লাগাতার চেষ্টা করে চলেছে মস্কো, খবর সূত্রের।
০৮২০
২০২২ সালে ‘এসইউ ৫৭’ লড়াকু জেটের ইঞ্জিনে বড় বদল আনেন রুশ প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। যুদ্ধবিমানটিতে বর্তমানে ‘এএল-৫১এফ১’ নামের একটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলির অপর নাম ‘ইজ়দেলিয়ে-৩০’। এতে মস্কোর জেটটির চিহ্নিতকরণ কঠিন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৯২০
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বক্সীর কথায়, ‘‘এসইউ-৫৭ নিয়ে রাশিয়ার মনোভাব যথেষ্ট ইতিবাচক। নিজেদের জেটের স্টেলথ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে মস্কো। আমাদের মূল লড়াইটা চিনের সঙ্গে। ড্রাগনের লালফৌজের হাতে যে জে-২০ এবং জে-৩৬ রয়েছে, তার চেয়ে ক্ষমতার নিরিখে অনেক এগিয়ে রয়েছে রুশ যুদ্ধবিমান।’’
১০২০
উল্লেখ্য, ‘চেংডু জে-২০’কে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনার শিরদাঁড়া বলে ধরা হয়। চলতি বছরের শেষে বেজিংয়ের হাতে থাকা এই স্টেলথ লড়াকু জেটের সংখ্যা ২০০ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যুদ্ধবিমানটির স্টেলথ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ডেল্টা উইং প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
১১২০
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ‘চেংডু জে-২০’-এর আরসিএস ০.০২ থেকে ০.১ বর্গমিটারের মধ্যে। লড়াকু জেটটির নির্মাণে বিশেষ কিছু উপাদান ব্যবহার করেছে চিন। রাডার সেগুলিকে চিহ্নিত করতে অক্ষম। এ ভাবেই যুদ্ধবিমানটির স্টেলথ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে বেজিং। পিএলএ বায়ুসেনা আদর করে এই জেটকে ডাকে ‘শক্তিশালী ড্রাগন’ (মাইটি ড্রাগন) নামে।
১২২০
‘জে ২০’র ইঞ্জিন তৈরিতে প্রাথমিক পর্যায়ে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এতে প্রথম দিকে ‘ডব্লিউএস-১০সি’ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে এতে ‘ডব্লিউএস-১৫’ ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু করেন তাঁরা। এগুলি ১৪২ কিলোনিউটন (কেএন) থ্রাস্ট তৈরি করতে পারে বলে জানা গিয়েছে।
১৩২০
‘জে-২০’কে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রে সাজিয়েছে চিনা বায়ুসেনা। এর সাহায্যে দৃষ্টিশক্তির বাইরে ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারেন পিএলএর ফাইটার পাইলটরা। কিন্তু, তার পরও এই প্রযুক্তির নিরিখে মার্কিন ‘এফ-৩৫’কে এগিয়ে রেখেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
১৪২০
দিল্লির অনুষ্ঠানে সাবেক সেনা অফিসার বক্সী বলেছেন, ‘‘মাঝ আকাশে এসইউ ৫৭-এর সঙ্গে ডগফাইটে নামলে বিপাকে পড়বে জে-২০। কারণ উড়ন্ত অবস্থায় দ্রুত ভল্ট খাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত মুনশিয়ানা রয়েছে রুশ জেটের। এর দু’টি ইঞ্জিনের থ্রাস্ট ১৭৬ কেএন। এ ছাড়া শব্দের চেয়ে ১.৩ গুণ গতিতে ছুটতে পারে মস্কোর যুদ্ধবিমান।’’
১৫২০
‘এসইউ-৫৭’-এ ‘কে-৭৭এম’ নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে রুশ বায়ুসেনা। এর পাল্লা ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়া লড়াকু জেটটি থেকে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলারও সুযোগ রয়েছে। এই সুবিধা নেই চিনের ‘চেংডু জে-২০’তে।
১৬২০
এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে ‘এসইউ-৫৭’র। প্রায় ১০ টন পে লোড বহনের ক্ষমতা রয়েছে রুশ জেটের। সেখানে চিনা যুদ্ধবিমানটি আট টন ওজন নিয়ে উড়তে পারে। অর্থাৎ, যুদ্ধের সময় অতিরিক্ত বিস্ফোরক ব্যবহার করতে পারবেন ‘এসইউ-৫৭’-এর ফাইটার পাইলট।
১৭২০
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরে সিচুয়ান প্রদেশের ‘ঝুহাই এয়ার শো’তে প্রথম বার ‘চেংডু জে-৩৬’ নামের ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট প্রকাশ্যে আনে পিএলএ বায়ুসেনা। এই জেটে স্টেলথ ক্ষমতা বাড়াতে লেজের অংশ রাখেননি চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ফলে যুদ্ধবিমানটিকে দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব।
১৮২০
কিন্তু, এ-হেন ষষ্ঠ প্রজন্মের চিনা জেট ‘জে-৩৬’কে গুরুত্ব দিতে নারাজ সাবেক সেনাকর্তা বক্সী। তাঁর দাবি, এই যুদ্ধবিমান এখনও তৈরি হয়নি। এটা আসলে একটা প্রোটোটাইপ। ফলত, ‘জে-৩৬’কে এখনই যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না বেজিং।
১৯২০
এগুলির পাশাপাশি লড়াকু জেটের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাক্তন সেনাকর্তা। গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে শক্তি দেখিয়েছে রুশ ‘এসইউ-৫৭’। অন্য দিকে, প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ও হিজ়বুল্লার এবং ইরানের সঙ্গে লড়াইয়ে শত্রুর গুপ্তঘাঁটিগুলি মার্কিন ‘এফ-৩৫’-এর সাহায্যেই উড়িয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)।
২০২০
দামের নিরিখে ‘এসইউ-৫৭’ আমেরিকার জেটটির তুলনায় সস্তা। তা ছাড়া রাশিয়া প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্য দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে ‘এফ-৩৫’ সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রস্তাব দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কোন যুদ্ধবিমানকে নয়াদিল্লি বেছে নেয়, তার উত্তর দেবে সময়।