রাশিয়া ও চিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবল আতঙ্কে আমেরিকা। আর তাই আলাস্কার বরফে ঢাকা দ্বীপের পরিত্যক্ত নৌঘাঁটিকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ওয়াশিংটন। গত শতাব্দীর ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’ এটি যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করত যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ১৬:০০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ৩৪ বছর পার। এখনও রুশ আতঙ্কে ভুগছে আমেরিকা। বরফে ঢাকা আলাস্কায় মস্কোর হামলার আশঙ্কায় তটস্থ যুক্তরাষ্ট্রের তাবড় সেনাকর্তারা। সেই কারণে ওই এলাকার একটি নৌঘাঁটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরা। এতে দুই শক্তিধরের মধ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ স্মৃতি ফেরার আশঙ্কা তীব্র হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
০২১৯
উত্তর আমেরিকার আলাস্কার প্রত্যন্ত অ্যাডাক দ্বীপ। সেখান থেকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব মেরেকেটে কয়েক কিলোমিটার। সুমেরু সাগরের অন্তর্গত ওই এলাকাটি অত্যন্ত ঝড়ঝঞ্ঝা-প্রবণ হওয়ায় একটা সময়ে সেখান থেকে নৌঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় ওয়াশিংটন। কিন্তু, চিনকে সঙ্গে নিয়ে মস্কো ফের ‘আগ্রাসী’ হওয়ায় পরিত্যক্ত ছাউনিটিকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন।
০৩১৯
সুমেরু সাগরের অন্তর্গত অ্যাডাক দ্বীপের নৌঘাঁটির পুনর্জীবনের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনে ‘টাস্ক অ্যান্ড পারপাস’ নামে আমেরিকার অনলাইন সংবাদ সংস্থা। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার আশঙ্কা তীব্র হওয়ায় সেখানে সামনের সারির সামরিক ছাউনি (ফরোয়ার্ড এরিয়া নেভি বেস) হিসাবে নৌবাহিনীর ওই ঘাঁটিকে গড়ে তুলবে পেন্টাগন। এই সংক্রান্ত কাজ অবশ্য এখনও শুরু হয়নি। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে আবেদন করেছে তারা।
০৪১৯
আমেরিকাবাসীর কাছে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ অ্যাডাক দ্বীপের অন্য পরিচয় রয়েছে। তাঁদের কাছে এই প্রত্যন্ত এলাকাটি ‘ভৌতিক শহর’ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বীপটির কিছুটা দক্ষিণে গেলে মিলবে প্রশান্ত মহাসাগর। আর আদাকের চারপাশ ঘিরে রয়েছে সুমেরুর পুরু বরফ। এটি আলাস্কার দক্ষিণতম বিন্দু। স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য সেখানে একটি পুরসভাও রয়েছে।
০৫১৯
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রথম বার মার্কিন সেনা অফিসারদের কাছে অ্যাডাকের সামরিক তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ওই সময়ে এর কাছের আলেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আত্তু এবং কিসকা আক্রমণ করে বসে জাপান। ফলে টোকিয়োর সেনাকে ঠেকাতে বরফে ঢাকা আলাস্কার দ্বীপটিকে রাতারাতি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করতে বাধ্য হয় ওয়াশিংটন।
০৬১৯
বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের যুগে অ্যাডাক কিন্তু গুরুত্ব হারায়নি। কারণ, ওই সময়ে সুমেরু সাগরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ডুবোজাহাজের আনাগোনা দিন দিন বাড়ছিল। সেগুলিকে চিহ্নিত করতে আলাস্কার ওই দ্বীপটিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন মার্কিন নৌকমান্ডারেরা। গত শতাব্দীর ’৬০ এবং ’৭০-এর দশকে সেখানে ছিল প্রায় ছ’হাজার মানুষের বাস। এঁদের মধ্যে অন্যতম ‘উনাঙ্গান’ আদিবাসীরা।
০৭১৯
১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। পরবর্তী দশকগুলিতে রুশ আক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস পাওয়ায় সামরিক দিক থেকে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে অ্যাডাক। ফলে ১৯৯৩ সালে ওই নৌঘাঁটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিরা। যদিও সেটা পুরোপুরি বন্ধ হতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও কয়েকটা বছর। ১৯৯৭ সালে সম্পূর্ণ ভাবে সেখান থেকে পাততাড়ি গোটায় মার্কিন নৌবাহিনী।
০৮১৯
অ্যাডাকের মার্কিন নৌঘাঁটি পরিত্যক্ত হতেই দ্রুত গতিতে সেখানকার জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। আলাস্কার দ্বীপটি থেকে মূল আমেরিকা ভূখণ্ডে ফিরতে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ‘ভূতুড়ে শহরে’ পরিণত হয় সুমেরু সাগর ঘেরা ওই এলাকা। স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, ২০২৩ সালে সেখানে বসবাসকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৫৪। এরা প্রত্যেকেই বাণিজ্যিক ভাবে মাছ শিকারের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গিয়েছে।
০৯১৯
সম্প্রতি এ হেন অ্যাডাকের পুনরুজ্জীবন নিয়ে মুখ খুলেছেন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌসেনা অফিসার অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল পাপারো। তাঁর কথায়, ‘‘রাশিয়া ও চিনের ঘনিষ্ঠতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। ওই দ্বীপ হাতছাড়া হলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ঢোকার রাস্তা বন্ধ হতে পারে। সেই কারণে সুমেরু সাগরের কৌশলগত ঘাঁটিটিকে পুনর্নির্মাণ করার প্রয়োজন রয়েছে।’’
১০১৯
কিছু দিন আগে আমেরিকার সেনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সদস্যদের সভায় বক্তৃতা দেন অ্যাডমিরাল পাপারো। সেখানেই আরও দুই ফৌজি অফিসারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অ্যাডাকের নৌঘাঁটির পুনরুজ্জীবনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন তিনি। এর পরই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চর্চা শুরু হয়ে যায়। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি পেন্টাগন।
১১১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সুমেরু সাগরের বরফ গলে যাওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে অ্যাডাক দ্বীপের নিরাপত্তা। তবে ওই এলাকায় খুলে গিয়েছে নতুন বাণিজ্যপথ। পাশাপাশি, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিরল খনিজ পদার্থের ভান্ডার অ্যাডাক সংলগ্ন সুমেরু এলাকায় পাওয়ার সম্ভাবনা তীব্র হয়েছে। এই পরিবেশগত পরিবর্তনের জেরে সেখানে নতুন করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে বলে স্পষ্ট করেছেন বিশ্লেষকেরা।
১২১৯
বর্তমানে অ্যাডাকের একেবারে গা ঘেঁষে প্রায় নিত্য দিন চলাচল করে রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর। সূত্রের খবর, সেখানে চিনের অত্যাধুনিক রণতরীগুলির আনাগোনাও বেড়েছে। তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ বাড়াতে বেজিং এই নয়া কৌশল নিয়েছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। ড্রাগনের আগ্রাসন থেকে সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপটিকে রক্ষা করার আশ্বাস দিয়েছে ওয়াশিংটন। সেই কারণ মার্কিন নৌবাহিনীর নজর ঘোরাতে অ্যাডাককে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নিশানা করছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৩১৯
মার্কিন রাজনীতিক তথা আলাস্কার সেনেটর ড্যান সুলিভান অ্যাডাক দ্বীপকে সুমেরু সাগরের ‘প্রবেশদ্বার’ (গেটওয়ে) বলে উল্লেখ করেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার অন্যতম বড় নৌঘাঁটি রয়েছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। আলাস্কার দ্বীপটি থেকে ওই ছাউনিটি প্রায় হাজার মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। অ্যাডাকের ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত হলে ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনার টহল অন্তত ১০ গুণ বাড়বে বলে জানা গিয়েছে।
১৪১৯
সূত্রের খবর, দু’দশকের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও অ্যাডাকের ঘাঁটি অক্ষত অবস্থাতেই রয়েছে। সেখানে আছে আট হাজার ফুটের একটি রানওয়ে, যুদ্ধবিমান রাখার বিশাল বিশাল হ্যাঙার এবং ২ কোটি ২০ লক্ষ গ্যালন জ্বালানি সঞ্চিত রাখার পরিকাঠামো। ছাউনির ভিতরে থাকা কংক্রিটের অন্যান্য পরিকাঠামোরও বিশেষ ক্ষতি হয়েছে এমনটা নয়।
১৫১৯
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঘাঁটিটিতে যে রানওয়ে রয়েছে সেখানে ‘বি-৫২ স্ট্র্যাটোফোর্ট্রেস’-এর মতো দূরপাল্লার কৌশলগত বোমারু বিমান অবতরণ করাতে পারবে মার্কিন বিমানবাহিনী। তবে সংশ্লিষ্ট ছাউনির পুনরুজ্জীবনের কাজ শেষ হলে সেখানে বি-২ স্পিরিটের মতো ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান মোতায়েন করতে পারে পেন্টাগন। এ ছাড়া অ্যাডাক দ্বীপ থেকে ডুবোজাহাজ ও ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরীকে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের।
১৬১৯
সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার পালাউ এবং টিনিয়নের মতো দ্বীপপুঞ্জে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে চিন। অ্যাডাকের নৌঘাঁটি নিয়ে পেন্টাগনের চিন্তাভাবনা করার এটা অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ও বেজিং সম্মুখসমরে গেলে আলাস্কা নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে রাশিয়া। সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় দ্বিমুখী যুদ্ধ লড়তে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এতে আমেরিকার যে বিপদ বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৭১৯
চলতি বছরের জানুয়ারিতে কুর্সি পেয়েই গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধকে বন্ধ করতে তৎপর হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত কয়েক মাসে একাধিক বার বিবদমান দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু, ওয়াশিংটনের এই চাপ অগ্রাহ্য করে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়ে গিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে তাঁকে ‘পাগল’ বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। এতে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্ক নতুন করে জটিল হল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
১৮১৯
অন্য দিকে, এ বছরের এপ্রিল থেকে চিনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ চালাচ্ছিলেন ট্রাম্প। কিছু দিন আগে তাতে সাময়িক দাঁড়ি টানেন তিনি। কিন্তু, সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আমেরিকায় পাঠরত চিনা পড়ুয়াদের ভিসা ‘আগ্রাসী’ ভাবে বাতিল করার ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছে ড্রাগন সরকার। ফলে দু’তরফে সংঘাত আগামী দিনে আরও তীব্র হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
১৯১৯
এই পরিস্থিতি মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের অ্যাডাক পুনর্জীবনের পরিকল্পনাকে মাস্টারস্ট্রোক বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। এর ফলে বরফঘেরা এলাকায় দুর্গ তৈরির সুযোগ পাবে আমেরিকার বাহিনী। যদিও ঘাঁটিটিকে পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে দেড় থেকে দু’বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।